#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( পঞ্চম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৯>
সেদিন তুলি যখন বাড়ি ফিরেছিল, তখন ঘড়িতে রাত দশটা। আসলে ও কেমন নিজের মধ্যে ছিল না ঠিক। এতগুলো বছরের স্মৃতি এসে ভিড় করছিল চোখে। মনে পড়ছিল সুপ্রিয়র সেই স্ট্রাগল এর দিনগুলো! যখন একটার পর একটা অডিশনে ছেলেটা রিজেক্ট হতো, আর মন খারাপ করে তুলির কাছেই আসতো, তুলি সেই দিনগুলোতে সুপ্রিয়কে আগলে রাখতো যেন। সব সময় না বলে ওর পকেটে হাত খরচের টাকা রেখে দিত নিঃশব্দে। এটাই বোঝাতো সারাক্ষণ যে সুপ্রিয় খুব ভালো গান গায়। আর একদিন ঠিক সাকসেস খুঁজে পাবে ও। সেই সময় সুপ্রিয় ওকে বাচ্চাদের মতন আঁকড়ে ধরতো। বার বার বলতো ‘ ভালোবাসি ‘। আর আজ এই সবই মিথ্যে হয়ে গেল! ভালো সময় আসতেই সুপ্রিয় জাস্ট ওকে একটা ইউজলেস প্রোডাক্ট এর মতন ছুঁড়ে ফেলে দিল! এত সস্তা করে দিল ভালোবাসাটাকে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই গঙ্গার ঘাটে বসেছিল অনেকক্ষণ। তারপর কোন রকমে নিজেকে সামলে বাড়ি ফিরেছিল তুলি।
তবে সেদিন দরজা খুলে ওর বিদ্ধস্ত চেহারা দেখে মা বাবা যেন থমকে গেছিল! আর তুলি এতটা ঝড় পাড় করে বাড়ি এসে নিজের সব থেকে কাছের মানুষগুলোকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল হঠাৎ। কারোর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ও যেন বাবাকে আগলে কেঁদে উঠেছিল চিৎকার করে। আসলে এতটা মিথ্যে লাগছিল সব কিছু; এতটা কষ্ট হচ্ছিল বুকের মধ্যে, যে তুলি আর নিজেকে আটকাতে পারেনি।
সেদিন অশোকবাবু মেয়ের এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়েই জিজ্ঞেস করেছিল তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে,
——” কি হলো! কি হলো মা? এইভাবে কাঁদছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে না কি! কি হয়েছে?”
তুলির মা ও এই সময় পাশে এসে খুব চিন্তা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
——” কি হলো তোর? আর এত রাত অব্দি কোথায় ছিলিস! তুই কাঁদছিস কেন এইভাবে মা?”
এই প্রশ্নে তুলি আর চুপ না থেকে ভাঙা গলায় বলেছিল,
——” ঠকে গেলাম আমি। খুব বেশি করে ঠকে গেলাম! সুপ্রিয় বলেছে ও আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। ও আর ভালোবাসে না আমাকে। সবটা মিথ্যে ছিল! সব কিছু।”
কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা ধরে এলো ওর, কান্নায়। কিন্তু তুলির বাবা মা এইসব শুনে কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না! মেয়েটাকে এইভাবে কষ্ট পেতে দেখে ভীষণ খারাপ লাগছিল আসলে। তাই অশোকবাবু তুলিকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরলো। তারপর ধীরে ধীরে ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল কোন রকমে।
সেদিনের পর তুলি যেন কেমন চুপ করে গেছিল হঠাৎ করে। দুদিন তো ঘর থেকেই বেরোয়নি নিজের। সারাক্ষণ কেমন পাথরের মতন স্থির হয়ে বসে ছিল এক জায়গায়। ঠিকভাবে খাচ্ছিল না, স্কুলে যাচ্ছিল না, কথা বলছিল না কারোর সাথে! কিরকম যেন হারিয়ে ছিল ও এই কষ্টটার মধ্যে। সেই জন্য সেই রবিবার নিরুপমাকে গান শেখাতেও যায়নি আর ফ্ল্যাটে। তবে আজ রাতে তুলির ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠেছিল আননোন একটা নাম্বার থেকে। তুলি একটু আনমনেই ফোনটা ধরেছিল সেদিন, আর ওপার থেকে ভেসে এসেছিল একটা ভরাট কণ্ঠ।
—–” হ্যালো, আমি রঙ্গন বলছি। ”
কথাটা শুনে তুলি বেশ অবাক হয়ে ছিল সেই মুহূর্তে। ও একটু সময় নিয়ে বলেছিল,
——” আপনি! হ্যাঁ বলুন, কোন দরকার ছিল?”
এই প্রশ্নে রঙ্গন কিছুটা এলোমেলো হয়ে বলেছিল,
——” আপনি ঠিক আছেন তো? আসলে আজ আপনি এলেন না! মা তাই চিন্তা করছিল।”
এই কথাগুলো শুনে তুলির কেমন আশ্চর্য লাগলো যেন! এই কদিনের আলাপ নিরুপমা কাকিমার সাথে! তাতেই এতটা ভাবে ওকে নিয়ে! আর যাকে তুলি মন থেকে দিনের পর দিন ভালোবাসলো! যাকে নিজের সব থেকে কাছের মানুষটা মনে করলো! সে ই ওকে নিয়ে নিজের সমস্ত ভাবনা থামিয়ে দিল হঠাৎ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তুলি বললো,
—–” না, আসলে শরীরটা একটু ভালো নেই। তাই যাইনি। নিরুপমা কাকিমা কে চিন্তা করতে বারণ করবেন।”
কথাটা শুনে রঙ্গন এবার বেশ চিন্তা নিয়ে বললো,
—–” শরীর ভালো নেই! কি হয়েছে আপনার? জ্বর? এই সিজন চেঞ্জে অনেকের জ্বর হচ্ছে। ডাক্তার দেখিয়েছেন তো?”
প্রশ্ন গুলো এক নিঃশ্বাসে করলো রঙ্গন। কিন্তু তুলি এইসব শুনে ওকে শান্ত করে বললো,
—–” না না, সিরিয়াস কিছু না। ঠিক আছি আমি এখন। কাকিমা কে বলবেন নেক্স উইক এসে ক্লাস করিয়ে দেব। যাইহোক, আমি রাখছি। আসলে আমার ফোনে চার্জ একদম শেষ।”
এই শেষ কথাগুলো তুলি বানিয়েই বললো নিজের মনে। আসলে সত্যি আজকাল দরকারের বেশি কথা বলার মতন ইচ্ছে নেই ওর কারোর সাথেই। তাই ফোনটা রাখারই চেষ্টাই করছিল ও। তবে রঙ্গন যদিও এতকিছু বোঝেনি এই মুহূর্তে। তাই কথাগুলোকে সত্যি ভেবে ফোনটা রেখে দিয়েছিল এরপর। কিন্তু ফোন কাটলেও তুলির চিন্তা থেকে নিজের মনকে আটকে রাখতে পারেনি কিছুতেই! আসলে প্রত্যেক রবিবারের মতন আজও তো ও অপেক্ষা করছিল তুলির! তারপর যখন সারা দিন পার করেও মেয়েটা এলো না, তখন একটা মন খারাপের দেওয়াল ঘিরে ধরলো ওকে। জীবনে কাউকে প্রথম খুব মিস করলো রঙ্গন।
<১০>
তবে এই মন খারাপের ভিড়ে দুদিন বাদে মা এসে হাজির। আজ একটা হেস্ত নেস্ত করেই ছাড়বে নিরুপমা! অনেকদিন ঝুলিয়েছে রঙ্গন। আর না। কথাগুলো ভেবেই সেদিন কয়েকটা মেয়ের ছবি নিয়ে হাজির হয়েছিল ছেলের ঘরে। রঙ্গন ল্যাপটপ খুলে বসেছিল সেই মুহূর্তে। নিরুপমা এরপর কিছু না বলেই ওর টেবিলের সামনে মেয়েগুলোর ফটো রেখেছিল একটু আওয়াজ করে। রঙ্গন সেসব দেখে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
——” এসব কি! এগুলো কাদের ফটো!”
নিরুপমা এই প্রশ্নে বেশ রাগি গলায় বলেছিল,
——” এগুলো সব মেয়েদের ফটো। দেখতেই পাচ্ছিস নিশ্চই। আমি পেপার ঘেঁটে ঘেঁটে, ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট থেকে খুঁজে খুঁজে এদের বার করেছি। দয়া করে তুই এদের দ্যাখ। কথা বল। বিয়ের ব্যাপারে একটা ডিসিশন নে এবার। নইলে আমার টিকিট কাট আজই হরিদ্বারের। আমি আশ্রমে চলে যাবো। অনেক হয়েছে। আর আমি তোর জন্য চিন্তা করতে করতে জীবনটা কাটাতে পারবো না।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল নিরুপমা। এসব শুনে রঙ্গন মা কে শান্ত করার জন্য বলেছিল,
—–” একটু রিল্যাক্স করো তুমি প্লিজ। আর কে বলেছে আমার জন্য চিন্তা করতে! আমি তো দিব্যি আছি। আর এইভাবে এরেঞ্জ ম্যারেজ আমার দ্বারা হবে না। সত্যি বলছি।”
কথাগুলো শুনে নিরুপমা এবার হাল ছেড়ে দিয়ে বলেছিল,
—–” বুঝে গেছি। তুই বিয়ে করবি না। যাইহোক, আমি তোর মামাকে বলবো আমার জন্য হরিদ্বারের একটা টিকিট কেটে দিতে। তুই তো এটুকুও করবি না আমার জন্য!”
কথাটা বলেই নিরুপমা এবার বেশ অন্ধকার মুখেই বেরিয়ে যাচ্ছিল ঘর থেকে। তখন রঙ্গন কিরকম নিরুপায় হয়েই মা কে আটকে বলে উঠলো,
——” মা, প্লিজ কোথাও যেও না! একচুয়ালি আই লাইক সময়ান! তাই আমি অন্য কারোর সাথেই এনগেজ হতে পারবো না।”
কথাটা শুনে নিরুপমা থমকে গেল যেন! তারপর রঙ্গন এর কাছে এসে ওর হাতটা ধরে বললো আস্তে গলায়,
——” কাকে পছন্দ করিস তুই? এটা তো আগে বলবি আমাকে! আর মেয়েটার সাথে কেন আলাপ করাসনি আমাকে!”
এই প্রশ্নে রঙ্গন ইতঃস্তত হয়েই বলে উঠলো,
—–” মা, আমি শুধু তাকে পছন্দ করি। সে হয়তো ওইভাবে কিছু ফিল করে না আমার ব্যাপারে! আর তাই এই নিয়ে কথা বলার মতনও কিছু নেই।”
এই কথায় নিরুপমা একটু জোর দেখিয়েই বললো,
—–” তুই বলবি আমাকে নামটা? নইলে আমি টিকিট কাটতে বলছি মামাকে হরিদ্বারের।”
এই কথায় রঙ্গন আর কি বলবে ভেবে না পেয়ে আস্তে গলায় বলে উঠলো,
—–” তুলি। হয়েছে শান্তি!”
এটা শুনে নিরুপমা চোখ গুলো বড় বড় করে বললো সঙ্গে সঙ্গে,
—–” তুলি! মানে আমাদের তুলি? মানে তুই আর রবীন্দ্রসঙ্গীত!”
এই কথায় রঙ্গন একটু রেগেই বললো,
—–” এই জন্য আমি বলতে চাইনি কিছু! যাইহোক, এই নিয়ে আর কোন কথা আমি শুনতে চাই না। তুমি যাও এবার। আমার অনেক কাজ আছে!”
কথাটা শেষ হতেই নিরুপমা বেশ উজ্জ্বল মুখে বললো, ——” গুড চয়েজ রে। সত্যি তুলির মতন মেয়ে আমি হাজার খুঁজেও পেতাম না! যাইহোক, আর হরিদ্বার যাওয়ার দরকার হবে না বলে মনে হচ্ছে! আমি আসছি।”
কথাটা বলেই নিরুপমা আর কোন প্রত্যুত্তরের সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কিন্তু রঙ্গন এর বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে শুরু করলো হঠাৎ। মা কে বলে কথাটা ঠিক করলো তো! কোন কেস করে দেবে না তো মা এবার! চিন্তা যেন চেপে বসলো খুব জোর রঙ্গন এর মনে।
কিন্তু অবশেষে রঙ্গন এর চিন্তাটাই সত্যি হলো। মা কেসটা ঘটিয়েই ফেললো। সেই সপ্তাহেই তুলি দের বাড়িতে ফোন করে নিজে সম্বন্ধের কথা বলেছিল নিরুপমা। তুলির মা বাবা তো শুনে পুরো অবাক হয়ে গেছিল! তবে রঙ্গন এর কথা এর আগেও তুলির মুখে শুনেছিল কিছু কিছু সময়। তাই ছেলেটাকে নিয়ে বেশ ভালোই একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল মনে। তবে তুলির বাবা একটা কথাই ভাবছিল, মেয়ের যা এখন মনের অবস্থা, তাতে এই বিয়ের কথা কিভাবে বলবেন উনি! কিভাবে পুরনো সব কিছু ভুলে এত তাড়াতাড়ি নতুন জীবন শুরু করার জন্য জোর করবে তুলিকে! সেদিন সারা দিন এই চিন্তার ভিড়েই অশোকবাবু মুখটা অন্ধকার করে ঘুরছিল বাড়িতে। আর এটা তুলির মা খেয়াল করেছিল। তবে আজ তুলি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর মা নিজে গেছিল ওর কাছে। তারপর একটু শান্ত গলায় বলেছিল,
——-” তোর জন্য একটা সম্বন্ধ এসেছে। ডক্টর রঙ্গন এর মা ফোন করেছিল। রঙ্গন এর জন্য ওনার তোকে খুব পছন্দ।”
কথাটা শুনে তুলি কেমন আকাশ থেকে পড়েছিল! ও অবাক হয়েই বলেছিল,
——” কি! নিরুপমা কাকিমা নিজে বলেছে এইসব!”
এই কথায় তুলির মা আস্তেভাবেই বলেছিল,
——” হ্যাঁ, উনিই বলেছে ফোন করে।”
এটা শুনে তুলি কেমন নিশ্চুপ হয়েছিল যেন। আসলে উত্তর দেয়ার মতন কিছু নেই ওর। সুপ্রিয় এতটা ধাক্কা দিয়েছে তুলিকে যে এই ভালোবাসা, বিয়ে, পুরো ব্যাপারটা থেকেই বিশ্বাস উঠে গেছে তুলির। সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই হারিয়ে ছিল ও, তখনই মা বলে উঠলো,
——-” রঙ্গন খুব ভালো ছেলে তুলি। আর তোর বাবার ওকে খুব পছন্দ। আর কদিন ধরেই তোর বিয়ের ব্যাপারে চিন্তাও করছে খুব মানুষটা! যদিও আর এই চিন্তার কথা নিজের মুখে তোকে বলবে না কখনো! কিন্তু, আমি তো মা! আমি তোর ভালোটাই চাই। তাই বলছি। আমি জানি, তুই একবার ভালোবেসে খুব কষ্ট পেয়েছিস। কিন্তু একটা ঘটনায়ই তো জীবন শেষ হয়ে যায় না! আরেকটা সুযোগ দিতেই হয় জীবনকে। আর রঙ্গনই হয়ত সেই আরেকটা সুযোগ তোর কাছে! তাই আরেকবার সব কিছু ভুলে নতুন করে শুরু করার চেষ্টা কর তুলি। নিজের জন্য, আমাদের জন্য। প্লিজ…”
কথাগুলো খুব অসহায় গলায় বলেছিল মা ওকে। তারপর আস্তে আস্তে ঘরটা ফাঁকা করে চলে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে। কিন্তু তুলি কেমন পাথরের মতন বসে ছিল এক জায়গায়। চোখ দুটো ভিজে এসেছিল ওর জলে। আসলে আজও যে মনের কোণে সেই ছেলেটাই আছে! যাকে কালবৈশাখীর ঝড়ে উস্কো খুস্কো চুলে প্রথম দেখেছিল তুলি! যার গানকে ভালোবেসেছিল ভীষণভাবে। কিন্তু সেই ছেলেটার তো সব কিছুই মিথ্যে! এতদিনের এত ভালোবাসার পর শুধু অপমানই ফেরৎ দিয়েছে সুপ্রিয়। তবে ভুলটা তুলিরই। তুলিই মানুষ চেনেনি। কিন্তু ওর ভুলের মাসুল মা বাবা কেন দেবে! ওরা কি দোষ করেছে! আর এমনিও বাবা হাইপার টেনশন এর পেশেন্ট। আর বাবার এখন একটাই চিন্তা, তুলির বিয়ে। যদিও বাবা কোনদিন ওকে জোর করবে না! কিন্তু মনে মনে সারাক্ষণ মানুষটা চিন্তা করে যাবে। কথাগুলো কেমন মনে এসে ভিড় করলো এই মুহূর্তে। আর চারিদিকটা আরো বেশি আবছা, অসচ্ছ হয়ে ধরা দিল চোখের সামনে।