#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( চতুর্থ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৭>
কিন্তু তুলির সেদিন বাড়ি ফিরে মনটা কেমন থমকে ছিল যেন। আজ প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল, সুপ্রিয়র সাথে কোন কথা নেই। তিন বছরের রিলেশনটার কি আর কোন দাম নেই ছেলেটার কাছে! মানছে অনেক ব্যাস্ত এখন, ওই টিভির রিয়্যালিটি শো টা জিতে সুপ্রিয় খুব নাম করেছে সিঙ্গার হিসেবে ইন্ডিয়ায়। কিন্তু তুলি তো এই নাম ডাকের অনেক আগে থেকে সঙ্গে ছিল ওর। ভালোবেসেছিল মন থেকে। আর আজ এই রিলেশনটার জন্য পাঁচটা মিনিটও কল করার সময় নেই সুপ্রিয়র! কথাগুলো ভেবেই চোখের কোণ টা চিকচিক করে উঠলো জলে তুলির। আর মনে পরে গেল আজ সকালে বাবার কথাগুলো। মা যদিও কদিন ধরেই পেপারে খুঁজে খুঁজে এই ওই ছেলের সম্বন্ধ দেখাচ্ছে ওকে। কিন্তু তুলি এইসবের হ্যাঁ না কোন উত্তর দিয়ে চুপচাপ এড়িয়ে যাচ্ছিল। তবে আজ বাবা যখন বললো, তখন আর না শুনে থাকতে পারলো না। আসলে ওই এক্সিডেন্টটার পর বাবার শরীর খুব দূর্বল। তাই তুলির বিয়ে নিয়ে আজকাল খুব চিন্তা করে। সেই জন্যই হয়তো খুব স্পষ্টভাবে আজ তুলির কাছে এসে বলেছিল,
—–” মা, আমার তো সামনের বছরই রিটায়ারমেন্ট। আর শরীরটাও আজকাল বেশ ক্লান্ত লাগে কেমন! তাই আমি আর দেরি করতে চাই না। আমি এই বছরের মধ্যেই তোর বিয়েটা দিয়ে দিতে চাই। আসলে আমাদের মধ্যবিত্ত বাড়িতে কত টাকাই আর জমানো থাকে বল! তার মধ্যে চাকরিটা থাকতে থাকতে তোর বিয়েটা হয়ে গেলে আমি নিশ্চিন্ত। সেই জন্য মা আর আমি মিলে তোর সম্বন্ধ খুঁজছি। ইন ফ্যাক্ট একটা ছেলেকে তো আমাদের খুব পছন্দ! ব্যাঙ্কে চাকরি করে। তুই রাজি থাকলে ছেলেটাকে ফ্যামিলি নিয়ে আমরা বাড়িতে ডাকতে পারি!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল বাবা। কিন্তু তুলি এইসব শুনে কেমন নিঃস্তব্ধ হয়ে গেছিল যেন! আসলে বাবাকে কোনদিন কোন ব্যাপারে ও মুখের ওপর না বলেনি। তাই আজ খুব অসহায় লাগছিল নিজেকে যেন! কিন্তু ‘ না ‘ তো বলতেই হবে তুলিকে; সুপ্রিয়র জন্য। নিজের ভালোবাসার জন্য। কথাটা ভেবেই তুলি খুব ধীর গলায় বলে উঠলো,
——-” বাবা, আমি আসলে একজনকে ভালোবাসি। আমার একটা রিলেশন আছে তিন বছরের।”
কথাটা শুনে অশোকবাবু একটু অবাক হয়েই বললো, ——” রিলেশন! কখনো তো বলিসনি কিছু! কে ছেলেটা?”
এই কথায় তুলি একটু ইতঃস্তত হয়ে বললো,
——” তুমি চেন ওকে বাবা। ইন ফ্যাক্ট, তুমি ওর গানের ফ্যানও! আসলে ছেলেটা সুপ্রিয় বোস।”
কথাটা শুনে অশোকবাবু আকাশ থেকে পড়ে যাওয়ার মতন মুখ করে বললো,
—–” সুপ্রিয়! ফেমাস সিঙ্গার সুপ্রিয়! কিন্তু তুই ওকে চিনলি কি করে?”
কথাগুলো একসঙ্গে বললো অশোকবাবু। কিন্তু এর উত্তরে তুলি সেই আস্তে স্বরেই বললো,
——” আমরা একসাথেই রবীন্দ্রভারতী থেকে পড়েছি গান নিয়ে। ও যখন কোন কিছু ছিল না, এমনি আমার মতন একজন সাধারণ এম.মিউজের স্টুডেন্ট ছিল, তখন থেকে আমরা বন্ধু।”
কথাগুলো শুনে অশোকবাবু কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন সেদিন। তারপর নিজেকে একটু সামলে বলে উঠেছিল,
——” বিয়ে করবে ও তোকে? তাহলে আমার সাথে দেখা করতে নিয়ে আসিস এই সপ্তাহে।”
কথাটা শুনে তুলি শুধু ঘাড় নেড়েছিল আলতো করে। হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারেনি বাবাকে। আসলে সুপ্রিয়র সাথে কখনো ওর বিয়ে নিয়ে কথা হয়ইনি আজ অব্দি! আর তার ওপরে এখন তো এমনি কথা টুকু বলতেও যেন এপয়েন্টমেন্ট লাগে ছেলেটার সাথে! এতই ব্যাস্ত সিঙ্গার বম্বের! তাই তুলি জোর দিয়ে বাবাকে কোন উত্তর দিতে পারেনি আজ সকালে। আর তারপর থেকে অনেকবার তুলি ছেলেটাকে ট্রাই করে যাচ্ছে ফোনে। কিন্তু প্রত্যেকবারই রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে কলটা। কেউ ফোন ধরা তো দূরে থাক, একবার দেখে কলব্যাক ও করছে না তুলিকে! কথাগুলো ভেবেই ভীষণ কান্না পেয়ে গেল এই মুহূর্তে। আর রাতের অন্ধকারটা আরো গভীর হয়ে ধরা দিল চোখে।
তবে এর দুটো দিন বাদে অবশেষে তুলি দেখা করেছিল সুপ্রিয়র সাথে। সুপ্রিয় কলকাতায় একটা কনসার্টের জন্য এসেছিল এক সপ্তাহের জন্য। আর এসে তুলিকে ফোন করেছিল নিজে থেকেই। তারপর সেই একই এক্সকিউজ দিয়েছিল প্রত্যেকবারের মতন, যে রেকর্ডিং আর কনসার্ট নিয়ে এতই ব্যাস্ত ছিল যে তুলির ফোনটা ধরতে পারেনি কিছুতেই। তবে তুলি আজ একটু গম্ভীর গলায় বলেছিল, ——” আমি দেখা করতে চাই তোমার সাথে। কথা আছে কিছু আমার।”
এই কথায় সুপ্রিয় সাথে সাথেই বলেছিল,
—–” হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আজ রাত আটটার সময় চলে এসো ক্যাফে একান্তে তে। আমি রেকর্ডিং শেষ করে চলে যাবো।”
তুলি কথাটা শুনে সেই মুহূর্তে আর কোন কথা না বাড়িয়ে রেখে দিয়েছিল ফোনটা। তবে আজ একটা অদ্ভুত সংশয় হচ্ছিল মনে। সুপ্রিয়র সাথে রিলেশন টা যেই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে বিয়ে কি সম্ভব! না কি ভাঙ্গনটাই শেষ অব্দি সত্যি! কথাগুলো যেন নিজের অজান্তেই মনে এসে ভিড় করলো আজ।
<৮>
সেদিন এরপর সন্ধ্যের দিকে তুলি এসেছিল ক্যাফেতে, সময়ের একটু আগেই। তারপর আধ ঘন্টা অপেক্ষার পর সুপ্রিয় এসেছিল ওর সামনে। তুলি যদিও আজ বেশ চুপচাপ ছিল প্রথম থেকে। নিজের মনের চিন্তাগুলোর সাথে যেন জড়িয়ে ছিল ভিতরে ভিতরে। তবে সুপ্রিয় এসবের খোঁজ না নিয়েই খুব স্বাভাবিক গলায় বলেছিল,
—–” বলো, কি খাবে? এখানকার কাবাব খুব ফেমাস শুনেছি। ওটাই অর্ডার করি?”
প্রশ্নটা শুনে তুলি একটা অন্য কথা বলে উঠেছিল নিজের মনে। ও থমকে থাকা স্বরে বলেছিল,
——” আমি খেতে আসিনি এখানে আজ। বাবা আমার বিয়ে দিতে চায় এই বছরই। আমার জন্য সম্বন্ধ খুঁজছে। আমি এসব শুনে তোমার কথা বলে দিয়েছি বাবাকে। আর সব শুনে বাবা তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে, এই সপ্তাহে।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল তুলি। কিন্তু এইসব শুনে সুপ্রিয় কেমন শক খাওয়ার মতন মুখ করে বলেছিল,
——-” হোয়াট! বিয়ে! তুমি বিয়ের কথা বলবে বলে এসেছো এখানে?”
এই প্রশ্নে তুলির যেন ধাক্কা লেগেছিল একটা। ও ভীষণ স্থির গলায় বলেছিল,
——” বিয়ের কথা শুনে তুমি এতটা চমকে উঠলে কেন! আর তিন বছর হয়ে গেছে আমাদের রিলেশনশিপ এর! তারও কত বছর আগে থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। আর এখন তো তুমিও ওয়েল সেটলড, আর আমিও চাকরি করি। তাহলে বিয়ে করতে প্রব্লেম কোথায়?”
কথাগুলো বলতে বলতে তুলির গলাটা ধরে আসছিল যেন! নিজেকে হঠাৎ খুব ছোট লাগছিল এই ছেলেটার সামনে। মনে হচ্ছিল ভিক্ষা চাইতে এসেছে ভালোবাসার! কথাটা ভাবতেই সুপ্রিয় খুব কঠিন গলায় বলে উঠেছিল,
——” দ্যাখো, কেরিয়ারের এই স্টেজে আমি বিয়ের কথা চিন্তাও করছি না। আর এখন একটা রিলেশন কে দেওয়ার মতন টাইমও নেই আমার কাছে। আর তোমার কাছে বিয়ে করাটাই লাইফের এইম হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে সেটা না। তবে আমি তোমাকে আমার জন্য ওয়েট করতেও বলছি না। বিকজ অনেস্টলি, আমি আর তোমার জন্য সেইভাবে ফিল করি না। আমি ইন্ডিরেক্টলি কথাটা তোমাকে অনেকবার বোঝাতে চেয়েছি, কিন্তু কখনো মুখের ওপর বলতে পারিনি!”
কথাগুলো খুব নির্বিকার গলায় বলেছিল সুপ্রিয়। কিন্তু তুলির যেন কাঁচ বিঁধছিল মনে এইসব শুনে। এতটা অপমান যে ছেলেটা কোনদিন ওকে করবে, ভাবেনি আসলে। এতটা সস্তা দামহিন লাগছে নিজেকে সুপ্রিয়র সামনে! কথাটা ভেবেই তুলি উঠে দাঁড়ালো সেই মুহূর্তে। আসলে মনে হচ্ছে উল্টো দিকে যেই ছেলেটা বসে আছে, সে একটা কঠিন পাথরের মতন! যে খুব সহজে কাউকে কষ্ট দিতে পারে, চোখের পলকে যে পুরনো দিনগুলো, পুরনো সময়, পুরনো মানুষকে ভুলে যেতে পারে। কথাটা ভেবেই তুলি নিজের হাত দুটোকে মুঠো করে ভীষণ কঠিন হয়ে বললো,
—–” আসলাম। এন্ড থ্যাঙ্কস, ফর এভরিথিং. তুমি আজ আমাকে খুব ভালো একটা শিক্ষা দিলে আসলে। কোনদিন কাউকে বিশ্বাস না করার শিক্ষা! আর আজকের দিনটা আমি সারা জীবন মনে রাখবো। ভালো থেকো।”
চলবে।