#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( তৃতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৫>
তবে এই কালী পুজো পার করে নভেম্বরের শেষটা আসতেই একটা ঘটনা ঘটলো সেই রবিবার। তুলি প্রত্যেক সপ্তাহের মতন আজও গেছিল গান শেখাতে রঙ্গন দের বাড়ি। কিন্তু কলিং বেল বাজানোর দু মিনিট বাদে শিখা মাসি দরজা খুললো, এই বাড়ির কাজের লোক। কিন্তু দরজা খোলার পরই ও বলে উঠলো,
—–” আজ মনে হয় বৌদি গান শিখতে পারবে না। খুব জ্বর!”
এই কথায় তুলি বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেছিল,
—–” জ্বর! কোথায় কাকিমা? কেমন আছে?”
এই প্রশ্নে শিখা সাথে সাথেই উত্তর দিয়েছিল,
—–” ঘরেই শুয়ে আছে। যাও না, গিয়ে দেখা করে এসো।”
কথাটা শুনে তুলি আর অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি নিরুপমার ঘরে গিয়েছিল। তবে ঘরে গিয়ে ও থমকে গিয়েছিল কেমন। নিরুপমার মাথা তুলে তাকানোর মতনও অবস্থা নেই, এত জ্বর! তুলি এটা দেখে নিরুপমার কাছে গিয়ে আলতো করে কপালে হাত ঠেকিয়ে ছিল। গা এই সময় জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! কথাটা মনে হতেই শিখা এসে বলেছিল,
—–” আমি সকালবেলা এসে থেকে দেখছি এই অবস্থা! তার মধ্যে দাদাও নেই বাড়িতে।”
কথাটা শুনে তুলি ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিল,
—–” নেই মানে! কোথায় গেছে? আর কাকিমা এতটা জ্বরের মধ্যে বাড়িতে একা!”
এই প্রশ্নে শিখা একটু এলোমেলো হয়েই বললো,
—–” দাদা তো দুদিন ধরে বাইরে। মনে হয় কলকাতার বাইরে কোন কাজ আছে, সেখানে গেছে! আর আমি তো আজ সকালবেলা এসে দেখছি বৌদির এত জ্বর। কাল অব্দি তো ঠিকই ছিল! আমি তারপর অনেকবার দাদার ফোনে চেষ্টা করেছি, কিন্তু রিং হয়েই যাচ্ছে। দাদা আর ফোন ধরেনি।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল শিখা। কিন্তু এইসব শুনে তুলি আর চুপ করে বসে থাকেনি। নিজেই ফোন বার করে কল করেছিল ওদের ফ্যামিলি ডক্টর চন্দন বাবুকে। তারপর এড্রেস দিয়ে দিয়েছিল রঙ্গনদের বাড়ির।
এরপর তুলি সারাদিন ধরে নিরুপমার মাথার কাছে বসেছিল। ওর কপালে জল পট্টি দেয়া থেকে উল্টোদিকের ওষুধের দোকান থেকে সমস্ত ওষুধ কিনে আনা, তারপর বুঝিয়ে শুনিয়ে সেই ওষুধ নিরুপমা কে সময় মতন খাওয়ানো, সব করেছে নিজে। আসলে নিরুপমার ব্যাবহার, নিজের করে নেওয়ার মতন ক্ষমতার জন্য তুলি এই মানুষটাকে ছেড়ে যেতে পারেনি কিছুতেই! শুধু মনে হচ্ছিল কখন আবার এই হাসি খুশি মানুষটা জেগে উঠবে, কখন সেই আগের মতন কথা বলবে, গল্প করবে ওর সাথে!
সেদিন এই মনে হওয়ার ভিরেই সন্ধ্যে নেমে এসেছিল শহরে। তুলি তবে এখনও বাড়ি ফিরতে পারেনি। যদিও নিরুপমার টেম্পারেচার এখন আগের থেকে অনেক কম। তবে সকাল থেকে খেয়াল না রাখলে জ্বরটা নামতো না ওর! এর মাঝখানে নিরুপমা জ্বরের ঘোরে ই অনেকবার বলেছিল তুলিকে,
—–” তুই বাড়ি ফিরে যা; কতক্ষণ আর বসবি এইভাবে আমার সাথে! বাড়িতে চিন্তা করবে।”
কিন্তু তুলি প্রত্যেকবারই এই কথায় একই উত্তর দিয়েছে। ও খুব সহজভাবেই নিরুপমা কে বলেছে,
—–” তুমি এইসব নিয়ে একদম চিন্তা কোরো না। আমি বাড়িতে ফোন করে দিয়েছি। কেউ চিন্তা করছে না। আর মা বাবা আমার মুখে তোমার কথা এত শুনেছে, যে ওরা তোমাকে না দেখেও খুব ভালোভাবে চিনে গেছে, বুঝলে। আর জ্বরটা একটু না নামা অব্দি আমি তোমাকে এইভাবে একা ফেলে কোথাও যাচ্ছি না আজ। শিখা মাসিও তো থাকলো না! দুপুরের আগেই চলে গেল! নইলে শিখা মাসি থাকলে তাও একটা ভরসা ছিল।”
কথাগুলো শুনে নিরুপমা আর বারণ করতে পারেনি তুলিকে এরপর। আসলে কেউ যদি এতটা কাছের ভেবে পাশে থাকতে চায়, তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার সাদ্ধি কারোর নেই।
যাইহোক এইসব ভাবনার ভিড়ে ঘড়ির কাঁটা গড়িয়ে আটটার ঘরে পৌঁছেছিল সেইদিন। তুলি এর মধ্যে তিন চারবার রঙ্গন কে ট্রাই করেছে ফোনে। কিন্তু প্রত্যেকবারই ফোনটা রিং হয়ে কেটে গেছে। তবে এখন নিরুপমা অনেকটা বেটার। তুলি ঠিক করেছে নিরুপমা কে ডিনার খাইয়ে ওষুধগুলো দিয়ে ও বাড়ি যাবে। সেই মতন খাবার বেড়ে নিরুপমার কাছে গেছিল ও, কিন্তু সেই মুহূর্তেই কলিং বেলটা বেজে উঠলো ফ্ল্যাটের। তুলি এবার একটু আনমনেই এসে দরজা খুলেছি ল সেদিন। কিন্তু দরজা খুলতেই দেখলো রঙ্গন দাঁড়িয়ে। পাশে একটা লাগেজ ব্যাগ। রঙ্গনও এই সময়ে তুলিকে বাড়িতে দেখে বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করেছিল,
—-” আপনি এখানে! ”
তুলি এই প্রশ্নে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলেছিল,
——” কাকিমার খুব জ্বর। আজ সকাল থেকেই। আমি গান শেখাতে এসে দেখলাম। আর বাড়িতে কেউ নেই! তাই আমি ছিলাম সকাল থেকে।”
কথাগুলো শুনে রঙ্গন এর যেন ধাক্কা লাগলো একটা! ও কেমন এলোমেলো হয়েই বললো,
—–” কি! মায়ের জ্বর! ”
কথা বলেই ও ব্যাগ ফেলে ছুটলো মায়ের ঘরের দিকে। তবে এই সময়ে নিরুপমা উঠে বসেছিল খাটে। শরীরটা এখন আগের থেকে অনেকটা ই সুস্থ্য লাগছে। এর মধ্যেই রঙ্গন এসে প্রায় হুড়মুড়িয়ে মা কে জড়িয়ে ধরলো। তারপর নিরুপমার কিছু বলার আগেই ও বলে উঠলো,
——” জ্বর হয়েছে তোমার! কিভাবে বাঁধালে? নিশ্চয়ই আমি ছিলাম না বলে ফ্রিজের আইসক্রিম গুলো খেয়েছ। তাই এই অবস্থা!”
কথাটা য় নিরুপমা শান্ত গলায় বললো,
—–” কিছু হয়নি আমার। ঠিক আছি এখন। আর এই সবই তুলির জন্য। তুলি আজ সকাল থেকে এখানে ছিল! ডাক্তার ডাকা থেকে শুরু করে জল পট্টি দেওয়া, মেয়েটা সব করেছে আমার জন্য! আর তোকে তো ফোন করে করেও একবারও পাইনি আজ। তুলি না থাকলে যে কি হতো আমার!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো নিরুপমা। রঙ্গন এর উত্তরে একটু ইতস্তত হয়ে বললো,
—–” আসলে ব্যাঙ্গালোর এ সেমিনার, তারপর দুটো হসপিটালে ভিজিট, এত কাজ ছিল যে আমার নিঃশ্বাস নেওয়ারও সময় ছিল না! তাই বাড়ি থেকে আসা কোন ফোনই রিসিভ করতে পারিনি। আর এয়ারপোর্ট এ এসে ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছিল। তাই ফোনটা অফ ছিল। আই এম রিয়ালি সরি মা! আমি বুঝিনি তোমার এতটা শরীর খারাপ ছিল!”
কথাটায় নিরুপমা আস্তে গলায় বলেছিল,
—–” আচ্ছা, হয়েছে। আমি এখন ঠিক আছি! আর ভাবিস না। যাইহোক, তুই তুলির জন্য একটা ট্যাক্সি বুক করে দে এখনি । মেয়েটা সারা দিন ধরে আমার কাছে পড়ে আছে!”
কথাটা শেষ হতেই তুলি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিল,
——” না না কাকিমা। এত ব্যাস্ত হওয়ার কিছু নেই! আমি চলে যাবো বাসে। ট্যাক্সি বুক করার দরকার নেই।”
তবে এসব শুনে রঙ্গন নিজে থেকে বলেছিল,
——-” প্লিজ! আমি ওলা বুক করে দিচ্ছি। আপনি যা করলেন সকাল থেকে! সিরিয়াসলি থ্যাঙ্ক ইউ..”
এই কথায় তুলি শান্ত গলায়ই উত্তর দিয়েছিল,
——” থ্যাঙ্কস বলার দরকার নেই। যাইহোক, টেবিলে প্রেস্কিপশনে ওষুধগুলোর নাম লেখা আছে। টাইম মতন খাইয়ে দেবেন। আর আপনি তো একজন ডাক্তার, আপনি আমার থেকে আরো ভালো বুঝবেন এইসব।”
কথাটা শেষ করে সেদিন আর তুলি বেশিক্ষণ থাকেনি। তবে বাড়ি যাওয়ার সময় রঙ্গন নিজে থেকেই বলে উঠেছিল,
—- ” আপনি আজকে মায়ের জন্য যেটা করলেন, আমি কোনদিন ভুলবো না! আসলে আমি কাজগুলো নিয়ে এত ব্যাস্ত হয়ে ছিলাম!”
রঙ্গন এর কথাটাকে এবার শেষ হতে না দিয়েই তুলি বললো,
——” আমি এতবার বলার মতন এমন কিছুই করিনি! আসলে কাকিমা এই কদিনে এত নিজের করে নিয়েছে আমাকে; তাই একা ওই অবস্থায় রেখে কখনোই চলে যেতে পারতাম না! তবে আপনাকে একটা কথা বলছি। প্লিজ খারাপ ভাবে নেবেন না! আপনি খুবই ব্যাস্ত জানি, তবে কাকিমারও আপনাকে দরকার হয়। আজ যদি আমি না আসতাম তাহলে ওইভাবেই হয়তো সারাটা দিন পড়ে থাকতো! আর আপনি জানতেও পারতেন না।”
কথাগুলো খুব স্থির গলায় বলেছিল তুলি। তবে রঙ্গন এর কোন উত্তর দিতে পারেনি! আসলে এই প্রথম কেউ একজন বুঝিয়ে দিল ভুলটা। এই ব্যাস্ততায় ভরা জীবন থেকে কিছুটা সময় আলাদা করে নিজের মানুষগুলোর খোঁজ নেওয়া যে কতটা দরকার; এটা আগে কখনো আগে মনে হয়নি। কথাগুলো খুব ভেতর ফিল হলো রঙ্গন এর। তবে তুলি এরপর চলে গেছিল সেদিন। কিন্তু আজ নিজের অজান্তেই ও কেমন রঙ্গন এর মনে একটা স্থায়ী জায়গা করে ফেলেছিল নিজের। আসলে রঙ্গন এর কাছে তুলি ভীষণ আলাদা হয়ে গেছিল এই দিনের পর। হয়তো ও যেই মানুষটার জন্য এতদিন ধরে অপেক্ষা করেছে, তাকেই হঠাৎ খুঁজে পেয়েছিল এই ঘটনার পর। এমন একজন মানুষ, যে ঠিক ভুলের তফাৎটা করতে জানে। যে মন থেকে ভাবে সবার জন্য। যে হিসেব ছাড়াই লোকের পাশে থাকে।
এরপর প্রত্যেকটা রবিবারের জন্য রঙ্গন মনে মনে অপেক্ষা করতো। সেই মেয়েটার মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষা। সেই জন্য যত কাজই থাকুক, রঙ্গন রবিবারের সকাল গুলো ফাঁকা রাখতো। যদিও ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের জন্য তুলির সাথে খুব আলাপ জমিয়ে উঠতে পারত না কোনদিন, কিন্তু তাও নিজে থেকে কিছু কথা শুরু করার চেষ্টা করতো প্রত্যেকবার। এই যেমন ” আপনার বাবার শরীর ঠিক আছে তো?”, ” মা গান ঠিকঠাক করছে তো?”, ” সুর তাল সব ঠিক আছে?” , এই রকম এলোমেলো কথা বলতো হঠাৎ হঠাৎ। তবে এইসব শুনে তুলি অল্প কথায়ই উত্তর দিত। আসলে যে গান জানেই না তাকে কি ই বা বোঝাবে সুর তালের ঠিক ভুলের ব্যাপারে! তবে এইসব দেখে সব থেকে বেশি অবাক হতো নিরুপমা। যেই ছেলে এত গম্ভীর, চুপচাপ, তার হঠাৎ তুলি কে দেখলে কি হয় কে জানে! নিজে থেকে বার বার কথা বলে! আর নিরুপমার গান নিয়েও এখন রঙ্গন কি সিরিয়াস! এই তো সেদিন নিরুপমা নিজে থেকেই বলেছিল সামনের সপ্তাহের গানের ক্লাসটা অফ দেবে। পুরনো কলেজের বন্ধুদের সাথে পিকনিক আছে। কিন্তু তাতে রঙ্গন কেমন প্রতিবাদ করে উঠেছিল যেন! দশ মিনিট ধরে বুঝিয়েছিল গান কত বড় একটা সাধনা! একটা গানের ক্লাসও তাই অফ দেওয়া উচিত না। এইসব শুনে নিরুপমা সত্যি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল। ছেলের ওর গান গাওয়া নিয়ে এত চিন্তা; এটা আসলে আগে কখনো বোঝেনি।
যাইহোক, এইভাবেই দিনগুলো এগোচ্ছিল। তবে সেই ফেব্রুয়ারি মাসের পনেরো তারিখে একটা ঘটনা ঘটলো। সেদিন প্রত্যেক রবিবারের মতন তুলি গান শিখিয়ে বেরোচ্ছিল নিরুপমাদের এপার্টমেন্টটা থেকে, তখনই হঠাৎ পিছন থেকে রঙ্গন এর গলার আওয়াজ। বেশ হন্তদন্ত হয়েই ও তুলির কাছে এসে বলেছিল,
—–” আপনার একটা হেল্প লাগবে। একটু সময় হবে কথা বলার?”
তুলি কথাটা শুনে একটু অবাক হয়ে বলেছিল,
—–” আমার হেল্প! কি ব্যাপারে?”
এই প্রশ্নটায় রঙ্গন সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল,
——” আসলে কাল মায়ের জন্মদিন। আমি মা কে একটা শাড়ি গিফ্ট করতে চাই। কিন্তু আমি আসলে এইসব ব্যাপারে কিছু বুঝি না! তাই আপনি যদি একটু হেল্প করতেন!”
শেষ কথাগুলো বেশ ইতঃস্তত হয়েই বললো রঙ্গন। কিন্তু এইসব শুনে তুলির ভালো লেগেছিল এই মুহূর্তে। তার মানে ছেলেটা নিজের মা কে নিয়ে ভাবে, মা কে স্পেশাল ফিল করাতে চায়! এই কথাগুলো মনে হতেই তুলি বলেছিল,
—-” কাকিমার ফেভারিট কলর কি? জানেন?”
এই প্রশ্ন রঙ্গন একটু হোঁচট খেয়ে বলেছিল,
—–” রামধনুর সাত রঙ! মানে সব কলরই তো পড়তে দেখি, তাই কোনটা ফেভারিট বুঝতে পারি না!”
এই কথায় তুলি অল্প হেসে ফেলেছিল মুখ টিপে। তারপর কিছুটা সময় নিয়ে বলেছিল,
—–” আপনি কখন ফ্রি বলুন, তাহলে কাকিমার জন্য শাড়ি কিনতে যাবো আপনার সাথে।”
কথাটা শুনে রঙ্গন একটুও সময় না নিয়ে বলেছিল,
—–” আজকে সন্ধ্যেবেলা? আমার চেম্বার ও নেই আজ!”
এই কথায় তুলি আর কিছু না বলে নীরবে সম্মতি জানিয়েছিল।
তারপর সেই সন্ধ্যে ওরা দুজন এই দোকান, সেই দোকান ঘুরে ঘুরে অবশেষে একটা আকাশী রঙের শাড়ি পছন্দ করে কিনেছিল নিরুপমার জন্য। শুধু তাই না, একটা বার্থডে কেকেরও অর্ডার দিয়েছিল দোকানে। তবে এরপর রঙ্গন আরেকটা কথা বলে উঠেছিল তুলিকে একটু আস্তে গলায়,
—–” থ্যাঙ্কস আপনি আজ আমাকে এতটা সময় দিলেন। কিন্তু কাল আপনাকে সন্ধ্যেবেলা আসতেই হবে আমাদের বাড়িতে। আমি আসলে মায়ের জন্য একটা সারপ্রাইজ পার্টি রাখছি। মায়ের সব স্কুল কলেজের বন্ধুদের বলেছি। আর আপনি তো মায়ের খুব ক্লোজ! আপনি কাল না এলে সেলিব্রেশনটা কমপ্লিট হবে না।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল রঙ্গন। কিন্তু এইসব শুনে তুলি বেশ স্থির হয়েই বলেছিল,
—–” আপনি যে এত ব্যস্ততার মধ্যেও কাকিমার জন্য এইভাবে টাইম বার করেছেন, এটা দেখে সত্যি খুব ভালো লাগলো। আর আমি নিশ্চয়ই আসবো কাল।”
এই কথায় রঙ্গন এর মুখে একটা মিষ্টি হাসি। আসলে এই সবই যে তুলির জন্যই! তুলি যদি সেদিন ওকে নিজের ভুলটা না বোঝাত, তাহলে আজ হয়তো এইভাবে ভাবতো না রঙ্গন। নিজের ব্যস্ততার ভিরেই ভুলে যেত মায়ের এই জন্মদিনটা!
<৬>
তবে এরপরের দিন তুলি ঠিক সন্ধ্যে সাতটায় এসেছিল রঙ্গনদের বাড়ি। হাতে দুটো সুচিত্রা ভট্টাচার্যের বই নিয়ে। আসলে কাকিকার মুখে অনেকবার শুনেছে সুচিত্রা ভট্টাচার্য এর লেখার কত বড় ফ্যান নিরুপমা! তাই আজ স্কুল এর পর কলেজ স্ট্রিট গিয়ে নিজে খুঁজে এনেছে বই গুলো, আর সেটা দেখে নিরুপমার মুখে একটা চওড়া হাসি। ও তো ভালোবেসে জড়িয়েই ধরলো তুলিকে। কিন্তু এই পুরো দৃশ্যটায় রঙ্গন যেন অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল তুলির দিকে! কি করে বোঝে মেয়েটা এইভাবে মনের কথা! কত কম সময়ে মানুষকে নিজের করে নিতে পারে! এরকম একজনেরই তো অপেক্ষায় ছিল রঙ্গন এতদিন। এই মেয়েটাকেই তো খুঁজছিল ও চেতনে অবচেতনে। কথাগুলো এক মনে ভাবছিল সেদিন। তখনই তুলি পাশে এসে নিজে থেকেই বলে উঠলো,
——” কি ভাবছেন এত? কোন পেশেন্টের কথা?”
প্রশ্নটা য় রঙ্গন আলতো হেসে বললো,
—–” ডাক্তার বলে কি সব সময় পেশেন্টের কথাই ভাববো! আমি মায়ের জন্য আপনার আনা গিফ্টটার কথা ভাবছিলাম আসলে।”
এই কথাটায় তুলি একটু অবাক হয়েই বললো,
—-” আমার গিফ্ট এর কথা! কি ভাবছিলেন?”
এই প্রশ্নে রঙ্গন কোন সময় না নিয়ে বললো,
—–” আমি এত বছরে আমার মায়ের ফেভারিট রাইটার কে তার খোঁজ জানি না! কিন্তু আপনি এই কদিনেই জেনে গেলেন! আর আপনি মা কে বেস্ট গিফ্টটা দিয়েছেন জন্মদিনে। এন্ড আই হ্যাভ টু সে দিজ..”
এই কথায় তুলি অল্প হেসে বললো,
—–” না, আমি না, আপনি কাকিমাকে বেস্ট গিফ্ট দিয়েছেন আজকে; নিজের সময়। কাকিমার জন্য এটাই সব থেকে বেশি দরকার।”
সেদিন এসব এলোমেলো কথার ভিড়ে, সবার সাথে গল্প করতে করতে বেশ রাত নেমে এসেছিল শহরে। তাই তুলিকে কিছুতেই একা ছাড়েনি নিরুপমা, রঙ্গন এর ওপর দ্বায়িত্ব দিয়েছিল তুলিকে বাড়িতে ছেড়ে আসার জন্য। যদিও তুলি বার বার বলেছিল ও চলে যাবে ট্যাক্সিতে, কিন্তু রঙ্গন ই তখন জোর দেখিয়ে বলেছিল,
—–” প্লিজ, এত রাত হয়ে গেছে! ট্যাক্সি পেতে অসুবিধা হবে। আমি ছেড়ে দিয়ে আসছি আপনাকে, কোন প্রব্লেম নেই।”
কথাগুলো রঙ্গন বেশ জোর দিয়েই বলেছিল, তাই তুলি আর না করতে পারেনি ওকে। তবে সেদিন গাড়িতে রঙ্গন খেয়াল করেছিল তুলি যেন একটু আনমনা হয়ে গেছে হঠাৎ। মাঝে মাঝেই নিজের ফোনটা চেক করছে! অকারণে মেসেজ বক্স টা খুলছে বার বার। এইসব দেখে রঙ্গন নিজে থেকেই বলে উঠেছিল,
——” কারোর ফোনের অপেক্ষা করছেন না কি? দরকারি কিছু!”
তুলি এই প্রশ্নটা শুনে চিন্তার ঘোরটা কাটিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায়ই বলেছিল সেদিন,
—- ” না, সেরম কিছু না। কারোর অপেক্ষা করছি না।”
এই কথায় রঙ্গন আজ একটা বেহিসেবী কথা বলে উঠেছিল হঠাৎ কিছুটা আস্তে গলায়,
—–” আচ্ছা, আমরা কি বন্ধু হতে পারি? মানে আমি আসলে না ভেবেই বললাম। আই হোপ আপনি মাইন্ড করলেন না! আসলে আপনাকে দেখে আলাদা লাগে সবার থেকে! স্পেশ্যালি আপনি যখন মায়ের সাথে থাকেন। আমার মা খুব কম সময়ে আপনার সাথে এতটা মিশে গেছে! তাই আর কি!”
কথাগুলো কেমন এক নিঃশ্বাসে বললো রঙ্গন। কিন্তু তুলি এর ঠিক কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না! এরকম একজন নাম করা ডাক্তার, যার সাথে এপয়মেন্ট নিয়ে কথা বলতে হয় ভেবেছিল, যার সাথে মাপা দূরত্ব রাখাটাই নিয়ম মনে হয়েছিল, সে নিজে থেকে বন্ধু হবে বলছে! কথাটা ভেবে বেশ অবাক লাগলো ওর। তবে তুলি এই মুহূর্তে একটু নিজেও সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
—–” আমরা প্রফেশনালি হয়তো দুজন দু প্রান্তের লোক। একজনের হার্ট বিট নিয়ে কাজ, আর একজনের গানের বিট নিয়ে! তবে আমরা মানুষ হিসেবে হয়তো খুব আলাদা নই। ওই দুটো চোখ, একটা নাক, সেম ফিচার! তাই বন্ধুত্ব করাই যায়! আর এতে মাইন্ড করার মতন কিছু নেই।”
কথাটা শুনে রঙ্গন এর মুখে হাসি। যদিও ততক্ষণে অনেকটা রাস্তাই চলে এসেছে দুজন। তবে রঙ্গন এর এই রাস্তাটা হঠাৎ ভীষণ সুন্দর মনে হলো আজ। মনে হলো কলকাতা শহরে এতগুলো বছর থাকলেও এত সুন্দর রাস্তা আগে পেরোনো হয়নি! আজ সবই নতুন। শুধু তুলির জন্যই।
চলবে।