#অবেলায়_তোমার_আকাশে
#পর্ব_১
#লেখিকা_N_K_Orni
— তুমি ভাবলে কিভাবে তোমার মতো একটা অক্ষম মেয়ের সাথে আমি আমার ছেলের বিয়ে দিব?
বিয়ের দুই দিন আগে নিজের হবু শাশুড়ির মুখে এই কথা শুনে চমকে ওঠে বৃষ্টি। তার মাথা ঘুরতে থাকে। বৃষ্টির বাবা রাদিব সাহেব ওখানেই বসে ছিলেন। বৃষ্টির হবু শাশুড়ি মিসেস আয়েশার কথা শুনে তিনি সামনে এগিয়ে আসেন। বৃষ্টির বাবা রাদিব সাহেব বলে ওঠেন,
— দেখুন আমার মেয়ের সম্পর্কে না জেনে শুনে আপনি এমন মন্তব্য করতে পারেন না।
মিসেস আয়েশা মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
— আমি কখনো না জেনে কথা শুনে কথা বলি না। এই দেখুন প্রমাণ।
বলেই তিনি রাদিব সাহেবের হাতে একটা রিপোর্ট দেন। রাদিব সাহেব কাঁপাকাঁপা হাতে সেটা খুলে পড়ে দেখেন। সেখানে স্পষ্ট লেখা রয়েছে যে বৃষ্টি কখনো মা হতে পারবে না। মিসেস আয়েশা এবার পাশ থেকে বলে উঠলেন,
— কি? এবার প্রমাণ হয়ে গেল তো যে আপনার মেয়ে একটা বাঁজা?
মিসেস আয়েশার কথা শুনে রাদিব সাহেব রেগে বলে উঠলেন,
— দেখুন আপনি আমার মেয়েকে এই ধরনের বাজে মন্তব্য করতে পারেন না।
বৃষ্টির সৎ মা মিসেস সানিয়া পাশের রুমেই ছিলেন। তাদের এসব কথোপকথন শুনে তিনি এই রুমে ছুটে আসেন। তিনি রাদিব সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলেন,
— ওনাকে ধমকে কি হবে? তোমার মেয়েরই তো দোষ। আর উনি বললেই ভুল।
মিসেস সানিয়ার কথা শুনে মিসেস আয়েশা বলে উঠলেন,
— আপনি ঠিকই বলছেন। আর এই কারণে এই বিয়ে হবে না।
— এসব আপনি কি বলছেন? পরশু বিয়ে আর আপনি বলছেন যে এই বিয়ে হবে না।
— তো কি করব? আপনার মেয়ের সাথে বিয়ে দিব। কখনোই না। ওর মতো অক্ষম মেয়েকে আমি আমার বাড়ির বউ কোনোদিন করব না।
ওনার কথা শুনে রাদিব সাহেব রেগে বলে উঠলেন,
— বারবার আমার মেয়েকে অক্ষম বলে অপমান করবেন না। বাচ্চা দেওয়া না দেওয়ার মালিক আল্লাহ। তাই এসব বলবেন না।
তখনই পাশ থেকে মিসেস সানিয়া বলে উঠলেন,
— তুমি চুপ করো।
তারপর তিনি মিসেস আয়েশার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— দেখুন আমি বলছিলাম কি যে বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে? আত্মীয়স্বজনদেরও বলা হয়ে গেছে। তারা খুব তাড়াতাড়ি এসেও পড়বে। এখন এসব কিছু বাতিল করা ঝামেলার না? তাই বলছি কি? আমার তো আরও একটা মেয়ে আছে। আপনারা তো দেখেছেনই সায়েরাকে। তাই বলছি সবকিছু ঠিকই থাক। শুধু বৃষ্টির জায়গায় আমার সায়েরার সাথে আসিফের বিয়েটা দিন। তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই হয় না।
মিসেস সানিয়ার কথা শুনে রাদিব সাহেব বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে উঠলেন,
— এসব তুমি কি বলছো? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আমার বৃষ্টির কথা একবারও ভাবছ না।
মিসেস সানিয়া এবার রাদিব সাহেবের দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে উঠলেন,
— তুমি চুপ করো। আমি যা করছি ভালোই করছি।
মিসেস আয়েশা কিছুক্ষণ ভেবে বলে উঠলেন,
— প্রস্তাবটা খুব একটা খারাপ নয়। সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। আমার বাসায় তো অনেকে চলেও এসেছে। এখন মানা করাটা ঝামেলার। তাই যদি বৃষ্টির বদলে সায়েরার বিয়ে হয় তাহলে ভালোই হয়।
মিসেস আয়েশার কথা শুনে মিসেস সানিয়া বলে উঠলেন,
— দেখলেন আমি সবসময় ঠিকই বলি।
— সানিয়া তোমার মাথা ঠিক আছে। তুমি কিভাবে এটা বলতে পারলে যে বৃষ্টির বদলে সায়েরার সাথে আসিফের বিয়ে হবে? তুমি একবারও আমার মেয়েটার কথা ভাবছ না। মেয়েটার মনের ওপর দিয়ে কি ঝড় যাচ্ছে?
— দেখ এখন এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তোমার মেয়েরই তো সমস্যা। নাহলে কি ওরা বিয়ে ভাঙত? আর না আমি সায়েরার সাথে বিয়ের কথা বলতাম?
— আর সবাই যখন জিজ্ঞাসা করবে সায়েরার সাথে আসিফের বিয়ে হচ্ছে কেন? তখন?
— তখন বলে দেব যে আসিফের বৃষ্টিকে নয় সায়েরাকে পছন্দ। তাই ওর সাথে বিয়ে হচ্ছে।
— বাহ! খুব ভালো। সব কথা তো আগে থেকেই মনে মনে সাজিয়ে রেখেছ। আরে বিয়েটা ভেঙে গেলে যেত। কিন্তু যে ছেলের সাথে আমার বড় মেয়ের বিয়ে ছিল সেই ছেলের সাথেই তুমি আমার ছোট মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা বলছ।
— দেখ আমি যা করছি আমাদের মানসম্মানের কথা ভেবেই করছি। তাই যা হচ্ছে হতে দাও।
তখনই পাশ থেকে মিসেস আয়েশা বলে ওঠেন,
— আমি আজ আসি। তাহলে ওই কথাই রইল। আসিফের সাথে সায়েরার বিয়ে হচ্ছে। আবার বেইমানি করে সায়েরার বদলে আমার ছেলের সাথে এই বন্ধ্যা মেয়েটার দিয়ে দিয়েন না। তাহলে কিন্তু আপনাদের আমি ছাড়ব। আসি।
বলেই মিসেস আয়েশা বেরিয়ে গেলেন। রাদিব সাহেব একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এই দীর্ঘশ্বাসে রয়েছে একরাশ বিষণ্ণতা। আর মিসেস সানিয়ার মুখে লেগে আছে বিজয়ের হাসি।
বৃষ্টি আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। সে ধীরে ধীরে পা ফেলে তার রুমে চলে এলো। রুমে এসে দরজা দিয়ে সে দেওয়াল ঘেসে নিয়ে বসে পড়ল। একটু আগে বৃষ্টির সাথে যা ঘটল তা সে এখনো মানতে পারছে। সবকিছু তার কাছে একটা দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে। তার মনে হচ্ছে সে এখনি ঘুম থেকে জেগে উঠবে আর দেখবে এসব স্বপ্ন। আর সবকিছু ঠিকই আছে। কিন্তু না। তা যে হওয়ার নয়। বৃষ্টি এবার এইচএসসি দিয়েছে। দেড় বছর রিলেশনের পর পরশু তার আসিফের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটা ধাক্কায় সব এলো মেলো হয়ে গেল। সে এখনো মানতে পারছে না যে সে কখনো মা হতে পারবে না। একটা মেয়ে তখনই নারী হিসেবে পূর্ণতা পায় যখন সে মা হয়। আর সে যখন জানতে পারে যে সে মা হতে পারবে না এর থেকে দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে?
বৃষ্টির অবস্থাও এখন অনেকটা সেরকম। হয়তো বা তার থেকে বেশি। আর আজ সে মা হতে পারবে না বলে তার বিয়েটা ভেঙে গেল। সে তার ভালোবাসার মানুষকে চিরদিনের জন্য হারালো। সে পেয়েও তার ভালোবাসার মানুষকে পেল না। আর সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে তারই ছোট বোনের বিয়ে হবে। পরশু তার বিয়ের জায়গায় তার ছোটবোনের সাথে তার ভালোবাসার মানুষের বিয়ে। কারণ সে কখনো মা হতে পারবে না। যাকে বলে বন্ধ্যা। মিসেস আয়েশা যখন তাকে বারবার বন্ধ্যা, অক্ষম বলছিল তখন তার ওতোটাও খারাপ লাগেনি। যতটা খারাপ লেগেছে এটা জানতে পেরে যে সে মা হতে পারবে না।
বৃষ্টি ভেবেছিল বিয়ের পর একটু সুখ পাবে। কিন্তু সুখ জিনিসটা যে তার শত্রু সে সেটা কোনো দিন পাবে না তা তার জানা ছিল না। বৃষ্টির যখন পাঁচ বছর বয়স তখন একটা দূর্ঘটনায় সে তার মাকে হারায়। কিন্তু দূর্ঘটনা সম্পর্কে তার একটুও মনে নেই। তারপর থেকে সে তার বাবার কাছেই থাকত। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার বাবা আরেকজনকে বিয়ে করে আনেন। আর একটা মেয়ে তার সৎ মায়ের সংসারে যে খুব একটা ভালো থাকে তা নয়। সায়েরা তার সৎ মায়ের আগের ঘরের মেয়ে। ও বৃষ্টির চেয়ে এক বছরের ছোট। বৃষ্টি তাকে সবসময় নিজের বোন মনে করলেও সায়েরা কখনো তাকে নিজের বোন বলে ভাবে না।
বৃষ্টি এসব ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার জীবনটাই এমন, স্রোতে ভাসা শেওলার মতো। বৃষ্টির হঠাৎ আসিফের কথা মনে পড়ল। সে চোখ মুছে সাথে সাথে আসিফকে ফোন দিল। এখন যদি কেউ কিছু করতে পারে সেটা হলো আসিফ।
চলবে,,,
( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। )