অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-১২

0
3

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ১২

মাহাদীর ডক্টর সাদিকের বন্ধু। অনেকদিন পর দুইজনই দুজনকে অবাক, বিষ্মিত। ডক্টরের নাম অনিন্দ। সাদীকের কলেজ জীবনের বন্ধু৷ তবে বন্ধুর ছেলে জেনে কিছুটা চিন্তিত দেখালো তাকে। মাহাদীর চেকাপ করিয়ে কিছু টেস্ট লিখে দিলো। সব কিছু নিজ হাতে সামলালো সাদিক৷ ওর স্বাভাবিক ভাব দেখে ড. অনিন্দ একটু অবাক হলো। অহনার আড়ালে বলল,
–ভাবী তোকে কিছু বলেছে?

বন্ধুর বউ বলে আগের সম্মোধন তক্ষুনি বাতিল করে এখন ভাবী বসিয়েছে। সাদিক ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কি ব্যাপারে?

অনিন্দ খানিক ইতস্তত করে বলল,
–মাহাদীর অসুস্থতা নিয়ে?

কপালে চিন্তার ভাজ আরো গভীর হলো। উদ্বিগ্ন হলো বেশ। দুর্বল গলায় বলল,
–না বলেনি। আমার ছেলের কি হয়েছে?

অনিন্দ উত্তর দিলো না৷ সাদিকের উতলা ভাব দেখে কাধে হাত রেখে বলল,
–টেস্টের রিপোর্ট কাল দেবে। তুই কাল আসিস, এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করবো। এখন মনে হয় না সিচুয়েশন সুইটেবল।

সাদিকের চোখে ভয় দেখা দিলো। অনিন্দ আশ্বাস দিয়ে বলল,
–চিন্তা করিস না, এমন অসুস্থ হয়নি যে চিকিৎসা সম্ভব না।

সাদিক দুর্বল গলায় বলতে চেষ্টা করল,
–তবুও..

অনিন্দ হালকা হেসে বলল,
–ডোন্ট ওয়ারি ডিয়ার। মোমেন্ট এঞ্জয় কর। ছেলের চিন্তা কাল করিস। আর ভাবীকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করিস না।

সাদিক মাথা হেলিয়ে সায় জানালো। অনিন্দ শুধুমাত্র অহনার সাথে কিছু কথা বলল। সাদিক তখন ছেলেকে নিয়ে বাইরে বসেছিলো। অহনা বের হলো ফ্যাকাসে মুখে৷ সাদিক দেখে আরো চিন্তিত হলো। এরপরের পুরোটা সময় দুইজনই চুপ ছিলো। একজনের বলার ইচ্ছা ছিলো না আর একজনের শোনার সাহস ছিলো না। মাহাদীর জ্বর যায় আসে করছে। সাথে ঠান্ডায় গলা বসে গেছে। সন্ধ্যার পর যখন সাদিক ছেলেকে কোলে বসিয়ে গল্পের বই পড়ে শোনাচ্ছিলো তখন হঠাৎই মাহাদী নিজের হাত সামনে ধরে ভয়ার্ত গলায় বলল,
–বাবা, র’ক্ত!

সাদিক থমকালো। ছেলের মুখ ভালো করে চেক করে বুঝলো, নাক দিয়ে র’ক্ত পড়ছে। আর্ত গলায় ছেলেকে সাহস দিয়ে বলল,
–সমস্যা নাই আব্বু। আমারও এমন হয়।

মাহাদী যাতে ভয় না পায় তাই এই মিথ্যেটা বলেছিলো সে। এতে মাহাদী বেশ মজা পেলো সাথে তার ভয়ও দূর হলো। আগ্রহ নিয়ে বলল,
–তোমার কান দিয়ে র’ক্ত পরে?

সাদিক চিন্তিত থাকলেও ছেলেকে বুঝতে দিলো না। হালকা হাসার চেষ্টা আরো উৎসাহ দিয়ে বলল,
–হ্যাঁ বাবা। অনেকের তো চোখ দিয়েও পরে।

–চোখ দিয়ে পরে?

দারুন বিষ্মিত হলো মাহাদী। সাদিক মাথা নেড়ে বলল,
–হ্যাঁ, ভ্যাম্পায়ারদের চোখ দিয়ে পড়ে।

মাহাদী বাবার দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে বলল,
–ভেমপায়ের কি?

সাদিক এবারে হেসেই ফেললো। তার ছেলের জন্য ভ্যাম্পায়ার উচ্চারণটা বেশ কঠিন হয়ে গেছে। উচ্চারণের সময় চোখ কুঁচকে অনেক কষ্ট করে উচ্চারণ করেছে। আদুরে ভঙ্গিতে ছেলের গালে চুমু দিয়ে বলল,
–ভ্যাম্পায়ার হলো যারা মানুষের র’ক্ত খায় তারা।

বাবার কথা বুঝে মাথা নাড়লো সে৷ বিজ্ঞ ভঙ্গিতে চিন্তাভাবনা করে বলল,
–তাহলে কি মশা ভেমপায়ের?

–না। ভ্যাম্পায়ার মানুষের মতো দেখতে হয়।

–তাহলে কি ডাক্তাররা ভেমপায়ের হয়? ওই ডাক্তার আংকেলটার ওখানে একটা ডাক্তার আন্টি ইজেকশন দিয়ে আমার র’ক্ত নিয়েছিলো। আমার র’ক্ত নিয়ে কি ওরা ভেমপায়েরকে দিয়েছিলো?

ইঞ্জেকশন উচ্চারণও একই ভাবে করলো মাহাদী। সাদিক বুঝলো, এমন কঠিন কঠিন উচ্চারণ তার ছেলের জন্য আসলেই কতটা কঠিন। মুখে আসতে চায় না তাও গাল ভরে উচ্চারণ করে। সাদিক মাহাদীর মাথায় চুমু দিয়ে বলল,
–না বাবা। ওটা টেস্টের জন্য নিয়েছিলো। তুমি অসুস্থ নাকি সেই টেস্ট করতে র’ক্ত নিয়েছে।

মাহাদী মাথা নেড়ে আফসোসের সুরে বলল,
–কি বোকা! আম্মুকে জিজ্ঞাসা করলেই তো হয়। আমার আম্মু সব জানে।

সাদিক মৃদু হাসলো। ছেলের মাথায় চুমু দিয়ে উদাস গলায় বলল,
–হ্যাঁ বাবা, তোমার আম্মু অলরাউন্ডার।

মাহাদী মাথা নেড়ে স্বীকার করলো, বাবা সব বোঝে। বই ছেড়ে টিভিতে কার্টুন চালালো মাহাদী। বাবার বুকে লেপ্টে কার্টুন দেখতে লাগলো। সাদিক চোখ মুদে ছেলের স্পর্শ অনুভব করতে লাগলো। এটাতে যে এতো শান্তি লুকিয়ে আছে! বাবাকে অমনোযোগী দেখে মাহাদী গাল ফুলিয়ে ছোট দুই হাত দিয়ে সাদিকের গাল ধরে বলল,
–বাবা, আমরা হলুদ বাড়িতে ঘুরতে যাবো। আজকে যেমন লাল বাড়িতে ঘুরতে গেছিলাম তেমন।

সাদিক হেসে উঠলো। তার কাছে থাকা প্রিয় মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে থাকলে তারও রাগ ওঠে। ছেলে এই বৈশিষ্ট্যও নিয়ে নিয়েছে৷ হেসে উঠে মাহদীর ছোট হাত নিজের বলিষ্ঠ হাতে নিয়ে তাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
–ঠিক আছে।

–আমার আর্টের বাড়ির মতো বাড়িতে।

বাবাকে হলুদ বাড়ির আসল দৃশ্য বুঝাতে চাইলো মাহাদী। যদিও আঁকানো এখনও সম্পূর্ণ হয়নি তার। খুব চেষ্টায় আছে শেষ করার কিন্তু আর পারেই না করতে। সাদিক হাসি চেপে ছেলেকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
–আচ্ছা, ওইরকম ভাঙাচোরা হলুদ বাড়িতেই আমরা থাকবো।

মাহাদী গাল ফুলিয়ে বলল,
–না, ভালো বাড়ি। ওখানে আমরা অনেকদিন থাকবো।

সাদিক মাহাদীর ফুলা গালে টোকা দিয়ে বলল,
–ঠিক আছে। আমরা অনেকদিন থাকবো।

–আমি থাকবো, আম্মু থাকবে, তুমি থাকবে আর আপু থাকবে।

আপু বলতে মাহাদীর সেই নিশু আপুকে বুঝলো সাদিক। বেয়াদপ মেয়েটাকে কিছুতেই তাদের ফ্যামিলিতে আনবে না। তাই একটু রাগী গলায় বলল,
–তোমার নিশু আপুকে আমি নেবো না।

মাহাদী বাবার বোকামিতে কপাল চাপড়ে বলল,
–উফফ! নিশু আপু না তো, অন্য আপু। একদম বেবি আপু। সারাক্ষণ আমার সাথেই থাকবে, এমন আপু।

মাহাদীর স্মৃতিতে বেবি আপুর স্মৃতি অনেক গভীর। তাদের এক প্রতিবেশির ছোট বাচ্চাকে দেখতে গেছিলো মাহাদী। মিষ্টি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দারুন খুশি হয়েছিলো। কিন্তু আফসোস, কিছুক্ষণ থেকেই চলে আসতে হয়েছিলো। সেদিন খুব মন খারাপ হয়েছিলো তার। মাকে কতবার বলেছিলো, অমন বেবি আপু তাদের নাই কেন? মা কোনো উত্তর দেয়নি। কিছুদিন পর নিজে থেকে চুপ হয়ে গেলেও মনে আশা রেখে দিয়েছে। অনেক ভাবার পর মাহাদীর বেবি আপুর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে ফেলেছে সাদিক। হাসতে হাসতে বলল,
–মাহাদীর তাহলে বোন চাই?

মাহাদী কি বুঝলো কে জানে, জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে বলল,
–হ্যাঁ, একদম বেবি আপুর মতো বেবি আপু চাই।

খানিকক্ষণের এই কথাবার্তায় মাহাদীর র’ক্তের ব্যাপারটা কখন ধামাচাপা পরে গেলো, কেউ বুঝতেই পারলো না। রাতে মাহাদীকে ঘুম পারানোর সময় অহনার নজরে র’ক্ত পরেছিলো। মাহাদীর নাক দিয়ে আবার র’ক্ত পড়ছিল। ভেজা চোখে আলগোছে আচল দিয়ে র’ক্ত মুছে দিয়েছিলো অহনা।

সাদিক অনেক রাত পর্যন্ত অফিসের কাজ করবে জন্য নিজের পুরোনো ঘরে গিয়েছিলো। কাজ শেষে ঘরে ফিরতেই অহনাকে না দেখে বাইরে এসে দেখে, অহনা বারান্দায় বসে আছে। সাদিক তেজি পা ফেলে অহনার ঠিক পাশ ঘেঁষে বসে। নীরবে কিছুটা সময় কাটা পর সাদিক হুট করে বলল,
–তোমার সমস্যাটা কি জানো অহনা?

বারান্দার টিমটিমে আলোতে সাদিকের দিকে তাকালো অহনা। চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। হঠাৎ তার আবার কি সমস্যা হতে যাবে! সাদিক সামনে দৃষ্টি রেখে বলল,
–তুমি নিজেকে এক্সপ্রেস করতে পারো না। না কখনও অভিযোগ করো আর না কখনো প্রতিবাদই করো। এসব কেনো করো না জানো?

অহনা জানতে কোনো প্রশ্ন করলো না। এই কথা এখন কোন দিকে যাবে তা ভালোই বুঝতে পারছে সে। সাদিক নিজ থেকেই বলল,
–কারন তুমি ভিক্টিম কার্ড প্লে করতে পছন্দ করো। নিজেই নিজের মতো কথা বানিয়ে নাও৷ সামনের মানুষটাকে ভাবার সুযোগই দাও না। সবসময় ভাবো, আমার সাথে এটা হবারই ছিলো। অথবা, আমি যদি কিছু বলি তাহলে কি হবে! বলে তো দেখো কি হয়?

অহনা চোখ সরিয়ে আস্তে করে বলল,
–আমি পারি না।

সাদিক রেগে ধমকে উঠলো,
–তুমি পারোনা না, তুমি চেষ্টাই করো না। নিজেই নিজের মতো কথা বানিয়ে নাও। ইউ আর আ সাইকো। সাইকোলজিক্যাল ডিসওর্ডার আছে তোমার। ডক্টর দেখানো উচিৎ। ট্রিটমেন্টের খুব জরুরি।

সাদিক বেশ উত্তেজিত হয়ে পরলো। অহনা কি বলবে ভেবে পেলো না। বলার মতো ভরসা তো কোনোদিন পায়ই-নি। তাহলে বলবে কিভাবে! যাদের এতোদিন হলো জানে, চেনে, বিশ্বাস করে তাদেরকে বিশ্বাস না করে, তাদের দেওয়া প্রমাণে বিশ্বাস না করে কি তাকে বিশ্বাস করতো!
প্রসঙ্গ পাল্টালো সে। মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করা প্রশ্নটা করতে বলল,
–সেদিন আপনার বিয়ে ছিলো না সেটা বলেননি কেন?

–বলে কি লাভ হতো?

অহনা ব্যথিত স্বরে বলল,
–সাদিক লেখা দেখে ভেবেছিলাম আপনার বিয়ে।

সাদিক মৃদু হেসে বলল,
–পৃথিবীতে কি আমার একার নামই সাদিক? মৌলি জেদ ধরেছিলো, সাদিক ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। ও মানুষ চায়নি, নাম চেয়েছে। তাই ওকে সাদিক নামটা এনে দিয়েছি।

দুপুরেও একই কথা বলেছিলো সাদিক। অহনা নীরব রইলো। সাদিক তর্জনি দিয়ে অহনার থুতনি ধরে মুখ তুলে বলল,
–মনের কথা মুখে না আনলে এমন কষ্টই পেতে হয়, সাইকো ওম্যান। মা হয়েছো, এখন ওম্যানই হতে হবে।

অহনার মনে পরলো, এর আগে অনেকবার এটা নিয়ে কথা শুনিয়েছিল সাদিক৷ কেনো নিজের মতো কথা ভেবে নেয়? কেনো কিছু প্রকাশ করে না? সরাসরি তো সাইকো গার্ল উপাধি দিয়ে দিয়েছিলো।
সাদিক অহনাকে ছেড়ে সামনে তাকিয়ে নিস্প্রভ স্বরে বলল,
–অহনা, আর সময় ছিলো মাত্র দুইমাস। তোমার ভিসার প্রসেসিং চলছিলো৷ এই দুইমাস কি অপেক্ষা করতে পারতে না?

অহনা মাথা নিচু করে ফেললো। কিভাবে বলবে, পরিস্থিতি ওকে সময় দেয়নি। সাদিক ওর নিরবতায় রেগে গেলো। ধমকে উঠে বলল,
–কিছু বলছো না কেন? কথা বলতে পারো না?

সাদিকের গর্জনে অহনা কেপে উঠলো। ঠোঁট নাড়িয়ে আস্তে করে বলল,
–কি বলবো?

–তুমি তো কিছুই বলো না। কেনো বলো না? কোথায় খুঁজিনি তোমাকে? পাহাড়, সমুদ্র, বস্তি, গ্রাম, কোথায় না খুঁজেছি! আর তুমি এসে পরে আছো এই মোহাম্মদপুরে! রিডিকিউলাস মোহাম্মাদপুরে! আমার কি জানার কথা ছিল তুমি এখানে এসে বসে আছো? আমি কিভাবে এক মাস ছুটি নিয়েছিলাম তা কেবল আমিই জানি। প্রতিবার তুমি কেনো ভেবে নাও আমি মৌলিকে বিয়ে করবো? ও আমার পাস্ট। যেদিন থেকে তোমাকে মেনে নিয়েছি সেদিক থেকে মৌলির চিন্তা বাদ দিয়েছি। কোন জাহান্নামের মধ্যে ছিলাম আমি, একবারও জানতে চেয়েছো? নাহ! নিজের মতো ভেবে নিয়েছো সবকিছু। চুপ করে আছো কেনো?

সব কথার পর এমন ধমকে না উঠলেই কি হয় না! অহনা ভয় পেয়ে চুপ রইলো। সাদিক অহনার হাত শক্ত হাতে চেপে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–তোমার নামে কি কি এসেছিলো আমার কাছে তা কল্পনাও করতে পারবে না। সব কিছুর পরেও আমি তোমার সাথে সরাসরি কথা বলতে চেয়েছি। কিন্তু হঠাৎ একদিন শুনি, অহনা পালিয়েছে। হিউজ টাকা চুরি করে পালিয়েছে। অসাম!

সাদিকের স্বরে রাগ ছিলো, ব্যাথা ছিলো, আফসোস ছিলো। অহনা নিজেও ব্যথিত হলো। আমি পালাইনি! আমাকে পরিকল্পিত ভাবে বের করে দিয়েছিলো। আপনার জীবনে থাকতে দেয়নি। এগুলো তো অহনা বলতে পারতো৷ কিন্তু বরাবরের মতোই মুখে তালা লাগিয়ে রাখল।

–ছয় বছর কতটা লম্বা সময় জানো তুমি? কতটা ব্যস্ত দিনের আড়ালে চিন্তিত, ঘুম না হওয়া রাত আছে, জানো সেসব? দিনের কত ঘন্টা তোমাকে খুঁজতে ব্যয় করেছি, জানো? তোমাকে খুঁজতে কত টাকা নষ্ট করেছি, ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া! সব টাকা ফেরত দেবে। আমার অতো টাকাও হয়নি যে, এতোগুলো টাকা পানিতে ভাসিয়ে দেবো।

অহনার অনেক কিছু বলার ছিলো। সেসব না বলে ফট করে বলে বসলো,
–কত টাকা?

সাদিক আগুনের স্ফূলিঙ্গের মতো ধপ করে উঠলো। অহনার ঘাড় ধরে নিজের মুখোমুখি এনে বলল,
–টাকার গরম দেখাচ্ছো? ছয় বছরের সব সময় ফেরত দিতে পারবে? অশান্তি, অপমান, ডিপ্রেশন সব ফেরত নিতে পারবে?

চোখে চোখ রাখার মতো সাহস অহনার কোনকালেই ছিলো না। চট করে চোখ সরিয়ে ফেললো। সাদিক তাচ্ছিল্যের হেসে দূরে সরে বলল,
–ছয় বছর পর ফিরে এসে কি বললে, স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া নাকি দ্বিতীয় বিয়ে করা যায় না। স্বামী থাকতে পরকিয়া করা যায়, না? প্রমান দিতে পারবে, যেগুলো আমার কাছে এসেছে তার সব মিথ্যা?

কোনো প্রমান তার কাছে নেই। মুখের কথা কে কবে বিশ্বাস করেছে। এই বিষয়ে কিছুই বলতে চাইলো না সে। উঠে যেতে চাইলে সাদিক শক্ত হাতে হাত চেপে মুখোমুখি বসিয়ে রাগী গলায় বলল,
–তুমি আসলে দিতে চাওই না। যার যা ভাবার ভাবুক। তুমি নিজের মতো ভাবলেই হলো! কথায় যে অনেক কিছুর সমাধান হয় তা আর কবে শিখবে?

অহনা ঢোক গিলল। ওর কিছুই বলার নেই। সত্যিই কিছু বলার নেই। যেখানে বলে কোন লাভ নেই সেখানে বলবেই বা কেন! জীবনে শুধু নিজের বাবাকে মনের কথা বলেছে। বাবা শুনে সমাধান দিয়েছে না হলে মনোযোগ দিয়ে শুনে বিশ্বাস করেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর মামা বাড়ির বাজে ব্যবহার মায়ের কাছে বলতে নিয়ে অনেক মার খেয়েছিলো সে। এরপর যে মুখে তালা লেগেছে, আজ অব্দি সেই তালা খোলেনি। অন্তত এইটুকু তো বুঝেছে, যেখানে তার মূল্য নেই সেখানে কথা বলা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। সেই ঘটনার পর যদি ও প্রতিবাদ করতো তাহলে জল আরো ঘোলা হতো। না জানি আর কি কি অভিযোগ আনতো। সেগুলো ভুল প্রমান করার কোন পদ্ধতি তো ওর জানা ছিলো না। মোবাইল তার ছিলো, নাম্বারটাও তারই ছিলো। এখন সেখানে কে কি করছে তা তো কেউ জানতে চাইবে না। অহনার নীরবতা দেখে প্রচন্ড রাগলো সাদিক৷ হাত ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,
–আমার ছেলেকে নিয়ে আমি চলে যাবো। তারপর তুমি তোমার ভাবনা চিন্তা নিয়ে থেকো।

অহনা পিলারের গায়ে স্বশব্দে বাড়ি খেলো। বারান্দার সিঁড়ির ওখানেই বসে ছিলো তারা। ওর আর্তনাদের শব্দে সাদিক বিচলিত হতে জড়িয়ে ধরলো অহনাকে। কাঁধে হাত বুলিয়ে ধীর গলায় বলল,
–সত্যিটা বলো অহনা?

আবার সেই একই কথা! অহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে ছাড়িয়ে চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো। সাদিক রেগে গেলো আবার,
–বলবে না তাইলে?

অহনা মাথা নিচু করে ফেললো। সত্যিই বলতে চায় না। সাদিক নিজের এক হাত দিয়ে অহনার এক হাত চেপে আরেক হাত দিয়ে ওর থুতনি চেপে হিসহিসিয়ে বলল,
–মাথা নিচু করছো কেন? কি বোঝাতে চাচ্ছো? তুমি অন্যায় করেছো? আমার কাছে সে ছবি ভিডিও স্ক্রিনশট এসেছে তার সবটাই সত্যি?

অহনা তবুও চুপ রইলো। ওর জেদ দেখে যা বোঝার বুঝলো সাদিক। চোয়াল ছেড়ে দিয়ে বলল,
–এভাবে বলবে না। সাইকো গার্ল তো তুমি। ভুলেই গেছিলাম।

বলেই হাত ধরে টানতে টানতে ঘুমন্ত মাহাদীর কাছে নিয়ে গেলো। ওর গায়ের উপর অহনার হাত রেখে বলল,
–ওর গায়ে হাত রেখে সত্যিটা বলো?

আঁতকে উঠলো অহনা। সাদিক ভীষণ সিরিয়াস। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও যখন কাজ হলো না তখন মোক্ষম চাল দিয়েছে। অহনা অসহায় চোখে অসুস্থ ছেলের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিলো সবটাই বলবে। এর ফল যাই হোক, ও বলবেই। কাঁপা গলায় বলল,
–তাহলে কথা দেন, আমার কথা অবিশ্বাস করলেও বাকি এই আড়াইমাস আপনি আমার ছেলেকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না?

অহনার ভয় এই এক জায়গাতেই। সব জানার পর যদি বিশ্বাস না করে ওকে সাহায্য করতে না চায় তাহলে ওর ছেলের কি হবে! তিন মাসের মধ্যে তো দুই সপ্তাহও হয়নি। এখনও বাকি অনেকদিন! সাদিক অহনার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ভরসা দিয়ে বলল,
–কথা দিলাম, কোনোদিন ছেড়ে যাবো না।

অহনা ভরসা পেলো নাকি জানা গেলো না। শুধু বলে গেলো নির্লিপ্তভাবে। এমন অনূভুতিহীন ছিলো যে মনে হলো, এটা নিয়ে ওর কোনো চিন্তাই নেই। আসলেই নেই। মাহাদীর জন্মের পর ওর অতীত নিয়ে আর কোনো মাথা ব্যাথা নেই। কে ওকে কি ভাবলো সেটা ওর কাছে ফিঁকে হয়ে এসেছে। এগুলো ওর সাথে ঘটা নিছক কোন ঘটনা ছাড়া আর এর আর কোনো মূল্য নেই। সাদিক সব শুনে অহনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। মনে হলো, হয়তো এক্ষুনি আবার কোনো ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে অহনাকে হাড়িয়ে ফেলবে। যাদের নিজের ভাইবোন ছাড়া কোনোদিন কিছু ভাবেনি তারা ওর এতো বড় সর্বনাশ করে ফেলবে তা কল্পনাতেও আসেনি। ওদের হয়তো শাস্তি দেওয়া উচিত তার। কিন্তু সাদিক সিদ্ধান্ত নিলো সে কিছুই করবে না। সৃষ্টিকর্তার ন্যায় বিচারের উপর ওর সম্পূর্ণ আস্থা আছে। তাই তার হাতেই সব ছেড়ে দিলো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে