অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০৫

0
2

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৫

শ্বশুরবাড়িতে অহনার থাকার পাঁচ সাতদিন হয়ে গেলো। এই কয়েকদিনে বদলায়নি কিছুই। বরং সাদিক চলে যাওয়াতে ফরিদা আরো ঝাড়াহাতপা হয়ে গেছে। বাড়ির সব কাজের ভার অহনার কাঁধে তুলে নিশ্চিন্তে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। অহনা কাজের ফাঁকে যখন খেতে বসে তখন ভাগে পড়ে বাসি রুটি কিংবা বাসি ভাতের সাথে মাছ ছাড়া মাছের সামান্য তরকারি অথবা দুইদিনের পুরোনো ভাজি। সেটাই খেয়ে ফেলে ক্ষিদের তাড়নায়। ওর আনন্দ তো হয় নিজের ঘরে ফিরে, যখন তার ঘর প্রাকৃতিক আলোতে সেজে ওঠে। দুপুরে ঘর আলো করে বসে বসে আকাশ দেখে সে৷ আর নয়তো সন্ধ্যার পর অন্ধকার আকাশে তারা ওঠা দেখে। দেখে আর চমৎকৃত হয়। তারাগুলো কি সুন্দর জ্বলজ্বল করে। দেখতে কি যে ভাল লাগে!
কিন্তু মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখতে গেলে অন্য কিছু দেখায়। তার ঘরে লাইটের ব্যবস্থা হয়নি। হয়নি ফ্যানের ব্যবস্থাও। সন্ধ্যা হলেই অন্ধকারে পুরো ঘর ডুবে যায়। আবার সূর্য মাথার উপর উঠলে অসহ্য গরমে টেকা দুষ্কর হয়ে উঠে। আবার জানালা খুললেই মশা এসে ভীড় করে। এতেও অহনা সুখ খুঁজে নিয়েছে৷ ভাগ্য তাকে এটা দিলে এটাই সই।
সেদিন দুপুরের রান্নায় ব্যস্ত ছিলো অহনা। ফরিদা বোধহয় ঘরে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। ওই মূহুর্তে কলিংবেল বেজে উঠলো। অহনা কি করবে ভেবে না পেয়ে গুটিগুটি হেঁটে দরজা খুলে দিলো। দরজার ওপাশে মাঝবয়েসী একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। অহনাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে কপাল কুঁচকে বলল,
–তুমি সাদিকের বউ?

অহনা ভয়ে ভয়ে মাথা উপর নিচ করে সায় জানাতেই সামনের মহিলাটি ওকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। দরজা খোলার শব্দে ফরিদা প্রায় দৌঁড়ে এসেছে। মেয়েটার উপর চোটপাট করার সমূহ ইচ্ছা সামনে ননদকে দেখে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেলো। মুখে প্রসন্ন মুখে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল,
–তুমি কখন আসলে সিদ্দিকা?

সিদ্দিকা ভেতরে সোফায় বসতেই অহনা রান্নাঘরে ফিরে গেলো। রান্নাঘর থেকে তাদের কথোপকথন স্পষ্ট কানে আসতে লাগলো তার। না চাইতেও সব কথা শুনতে লাগলো। সিদ্দিকা বেশ গম্ভীর গলায় বলল,
–এসব কি ভাবী? ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে বলে মেয়েটার এই অবস্থায় রাখবেন? বড় ভাই কল দিয়ে না বললে তো কিছুই জানতে পারতাম না। সাদিকও তো শুনলাম ভার্সিটি চলে গেছে।

ফরিদা মন মরা হয়ে বলল,
–সাদিকের পছন্দে বিয়ে হয়নি। মেয়ের পরিবার জোর করে বিয়ে দিয়েছে। সাদিক তো ওকে পছন্দই করে না। ও তো মৌলিকে..

বলেই থামলো ফরিদা। অর্ধসমাপ্ত কথাটা সিদ্দিকা বুঝতে পারলো। ফরিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–তালাকের কথা চিন্তা করছি। তালাক হয়ে গেলেই সাদিক আর মৌলির বিয়েটা দিয়ে দেবো। এতো ঝামেলা আর ভালো লাগে না। এখন এই মেয়ে এসেছে, দুইদিন পর আরেকটা আসবে।

সিদ্দিকা গম্ভীরমুখে বলল,
–সাদিক এখন বিবাহিত ভাবী৷ মৌলি আমার মেয়ে হলেও সাদিক আমার পর না। নিজের মেয়ের জন্য অন্য কারো সংসার ভাঙার কল্পনা করাও মহা পাপ ভাবী। বিয়ে হয়েছে, পরিস্থিতি মেনে নেন।

ফরিদা চুপচাপ শুনে উদাস হলো। তার পরপরই চমকে উঠে বলল,
–এই ব্যাপারে আর কে কে জানে?

–শুধু আমি আর মা জানে। মা সাদিকের বউ নিয়ে বাড়ি যেতে বলেছে।

ফরিদা হায় হায় করে উঠে বলল,
–বাড়ি! অসম্ভব! মেয়েটাকে তো সাদিক সহ্যই করতে পারে না। ওকে বাড়িতে নিয়ে গেলে তুলকালাম হয়ে যাবে। ওই দেখো, রান্নাঘরে কাজের বাহানায় আমাদের সব কথা শুনছে। কি শেয়ানা মেয়ে দেখেছো! যাও ঘরে যাও। বাবা মা ভদ্রতা শেখায়নি?

অহনা কোন একটা কাজে দরজার দিকে আসতেই ফরিদার নজরে পড়ে যায়। তক্ষুনি নিজের কথা রেখে গর্জে উঠলো ওর উপর। অহনা ভয়ে চমকে উঠে রান্না ফেলে চুপচাপ নিজের ঘরে ফিরে গেলো। ওকে স্টোররুমে যেতে দেখে সিদ্দিকা কপাল কুঁচকে বলল,
–ওটা তো স্টোররুম। মেয়েটাকে ওখানে থাকতে দিয়েছেন?

ফরিদা মুখ বেঁকিয়ে বলল,
–তো আর কোথায় থাকতে দেবো? সাদিক তো ওর ছায়াও সহ্য করে না। আমার ঘরে তো ঢুকতেই দেবো না আমি। আর গেস্টরুমে কত দামী দামী জিনিস আছে। যদি চুরি করে বিক্রি করে দেয়? এসব মেয়েদের তো হাত ভালো না। কোন পরিবার থেকে এসেছে কে জানে!

–আমি তো শুনলাম, ও সাদিকের বন্ধুর কাজিন। ওর বন্ধু যদি ভালো ফ্যামিলি থেকে আসে তাহলে ওরও ভালো ফ্যামিলি থেকেই আসার কথা।

–ওসব ভুয়া কথা! কার মনে কি আছে তা আমরা জানবো কীভাবে?

সিদ্দিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সামনের মানুষটার মনে কোন কথাই ঢুকছে না। তাই আর বুঝাতে চাইলো না। উঠে দাঁড়ালো সরাসরি অহনাকে থাকতে দেওয়া ঘরে গেলো। মেয়েটা উল্টাপাল্টা কিছু বলে দেয় নাকি সেই ভয়ে ফরিদাও পিছু নিলো। ঘরের জানালা খোলা থাকলেই মশা আসে জন্য দরজা বন্ধ না করে জানালা খোলে না অহনা। তবে আজকে দরজা বন্ধ করলেও জানালা খোলেনি। অন্ধকারে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো। সিদ্দিকা ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ভ্রু কুঁচকে বলল,
–ঘর এতো অন্ধকার করে রেখেছো কেন? লাইট জ্বালাও।

অহনা চমকে উঠলেও নিজেকে সামলালো। মিনমিন করে বলল,
–ঘরে লাইট নেই।

সিদ্দিকা ঠান্ডা চোখে ভাবীর দিকে তাকাতেই ফরিদা আমতা-আমতা করে বলল,
–লা-লাইটের লাইন নেই তো। কোথায় লাগাবো?

সিদ্দিকা তপ্ত শ্বাস ফেলে এগিয়ে অহনার হাত ধরে টেনে বলল,
–আমার সাথে এসো।

অহনা মাথা নিচু করে চুপচাপ গেলো। সিদ্দিকা ওকে সাদিকের ঘরে নিয়ে আসলো। এর আগে এই ঘরে সে আসেনি। সিদ্দিকা অহনাকে খাটে বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো। এরপর নরম স্বরে বলল,
–তোমার নাম কি?

–মারিয়াম জান্নাত অহনা।

অহনা ছোট করে উত্তর দিলো। সিদ্দিকা মৃদু হেসে বলল,
–সুন্দর নাম। আমি সাদিকের ফুপু। সাদিক আমার কথা খুব মানে। তুমি কোন চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। সময় সব ঠিক করে দেবে। বুঝেছো?

অহনা মাথা হেলিয়ে সায় জানাতেই সিদ্দিকা আবার বলল,
–তোমার সব জিনিসপত্র এখানে নিয়ে এসো। এখন থেকে তুমি সাদিকের ঘরেই থাকবে।

অহনা চমকে উঠলো। ও এখন সাদিকের ঘরে আছে! ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। এই মূহুর্তে পালিয়ে যেতে মন চাইলেও পারলো না। দুরুদুরু বুকে অল্প মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাতেই সামনে চেয়ার টেবিল দেখতে পেলো। চেয়ারে একটা তোয়ালে ছড়িয়ে রাখা। বোধহয় সাদিকেরই। মূহুর্তেই মন ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো। সিদ্দিকা ফরিদার অসন্তোষ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
–কাল ওকে সাথে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে জামাকাপড় কিনে দেবো। তোমার ছেড়া শাড়ি ওর গায়ে মানাচ্ছে না ভাবী।

ফরিদা কিছুই বললো না। সিদ্দিকা চলে যাওয়ার সময় ভেজা চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
–এতো ভালো মানুষি দেখিও না সিদ্দিকা। মেয়ের কথাটা চিন্তা করো একবার।

সিদ্দিকা মৃদু হেসে বলল,
–সবার উপর যে মায়া দেখাও তার এক অংশ মেয়েটার উপর দেখাও। বাকি আমার মেয়েকে আমি বুঝে নেবো।

*****
দুই তিনদিন পার হলেও সাদিক আর মাহাদীর সম্পর্কের কোন উন্নতি নেই। কিছুক্ষণ পরপর এটা ওটা নিয়ে সাদিক মাহাদীকে খোচাতেই থাকে। যেমন গতকালই অহনা রান্নাঘরে কাজ করছিলো আর মাহাদী বারান্দায় রাখা টেবিলে বসে ড্রয়িং করে বাইরে সাইকেল চালাচ্ছিলো। হুট করে সাদিক রান্নাঘরের দরজায় এসে বলল,
–তুমি জানো অহনা, আকাশ নীল হয় কেনো?

অহনা বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
–কেনো?

সাদিক কাঁধ নাচিয়ে বলল,
-ওর ইচ্ছা।

বলেই অহনাকে হতভম্ব করে হেলতে দুলতে চলে গেলো। ওকে টেবিলের কাছে দেখেই মাহাদী সাইকেল ফেলে ছুটে এসে দেখে, সাদিক ওর আর্টের দফারফা করে ফেলেছে। সানসেটের সুন্দর ছবি আঁকাচ্ছিলো সে। সেখানকার পুরো আকাশে সবুজ রঙ দিয়ে দিয়েছে। মাহাদী ঠোঁট ফুলিয়ে ভেজা চোখে মায়ের কাছে অভিযোগ জানালো। অহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলো শুধু। ছেলের চোখ স্পষ্ট করে বলছিলো, এ তুমি কেমন বাবা এনেছো আম্মু? বদলে আনো তাড়াতাড়ি!

অহনা নিজের সিদ্ধান্তে বিভ্রান্ত। সাদিককে এনে ঠিক করেছে নাকি বুঝতে পারছে না। ওর এমন ব্যবহার তো কোনদিনও দেখেনি। এ কি নতুন রুপ!
কাজ আছে অহনার। বিকালের দিকে বড় ব্যাগ হাতে বেরোচ্ছিলো। সাদিক বাঁধ সাধলো। পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
–কোথায় যাচ্ছো?

অহনা ছোট করে বলল,
–আমার বাইরে একটু কাজ আছে।

–কখন আসবে?

–দুই এক ঘন্টা লাগতে পারে।

সময় শুনে তৎক্ষনাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়ে বলল,
–ততক্ষণ কি আমি একা থাকবো?

অহনা আমতা-আমতা করে বলল,
–মাহাদী আছে তো।

সাদিক মুখ ঘুরিয়ে রাগ দেখিয়ে বলল,
–তোমার ছেলে আমার সাথে কথা বলে না।

এবারে ছেলে সম্পর্কে বাবার অভিযোগ। অহনা হতাশ হয়ে ছেলের দিকে তাকালো। বাড়ির সামনের ছোট উঠানে নিজের খেলনা গাড়ি দিয়ে খেলছিলো মাহাদী। অহনা ছেলের পাশে বসে বলল,
–আব্বু, এমন করছো কেন? তুমি তো সারাক্ষণ বাবা বাবা করতে। এখন বাবার সাথে কথা বলো না কেনো? আমার মাহাদীর তো গুড আর তার বাবাও গুড।

মাহাদী সজোরে মাথা নেড়ে বলল,
–নাহ। গুড মাহাদীর গুড আম্মু। বাবা গুড না।

সাদিক চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই অহনা ছেলেকে আড়াল করে বলল,
–ঠিক আছে৷ গুড মাহাদী বাবার সাথে গুড বাচ্চা হয়ে থাকুক। আম্মু কাজ শেষে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।

মাহাদী অনিচ্ছায় ঘাড় নাড়তেই অহনা সন্তোষজনক হেসে সাদিকের দিকে তাকালো। সাদিক কপাল কুঁচকে বিরক্তিকর স্বরে বলল,
–আমি তোমার ছেলের সাথে এতোক্ষণ বোর হবো নাকি? বাইরে যাবো আমি। তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করো, আমার সাথে যাবে নাকি?

অহনা মাহাদীর দিকে ফিরতেই সে সজোরে মাথা নেড়ে বলল,
–না আম্মু, মাহাদী যাবে না।

সাদিক গরম গলায় বলল,
–কে যাবে না?

বলেই অহনাকে উপেক্ষা করে মাহাদীকে পাজাকোলা করে তুলে এদিক ওদিক ঘুরাতে ঘুরাতে হাঁটতে লাগলো। মাহাদী প্রথমে ভয়ে চিৎকার দিলেও পরক্ষণেই মজা পেয়ে হাসতে লাগলো। অহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তালা দিয়ে পাশের বাড়িতে গেলো। দরজা নক করতেই সেদিনের সেই মহিলা এসে দরজা খুলল। অহনা তাকে দেখেই তাড়াহুড়ো করে বাড়ির চাবি দিয়ে বলল,
–মৌসুমি ভাবী, উনি মাহাদীকে নিয়ে একটু বাইরে গেছেন। ফিরলে একটু চাবি দিও।

মৌসুমি চাবি হাতে নিয়ে চিন্তিত গলায় বলল,
–তোর বর এখন কেমন রে? আগের মতোই আছে নাকি বদলেছে?

অহনা মলিন হেসে বলল,
–ওনাকে তো আমার জন্য আনিনি। বদলালেও বা কি!

–বেশি করে সময় কাটা। পুরুষ মানুষ তো। সুখ পেলেই কাছে থাকবে।

–ওনার সুখ ফেলে এখানে এসেছে ভাবী। বিয়ের আসর থেকে টেনে তুলে এনেছি৷ এখন শুধু যাওয়ার দিন গুণছে।

মৌসুমি বিরক্ত হয়ে বলল,
–তুই এতো শক্ত কেন! বাচ্চা হওয়ার পর দাদী কতবার বরের কাছে যেতে বলল। গেলিই না। এখন ফিরেছে আর তুই গুরুত্বই দিচ্ছিস না। দাদী বেঁচে থাকলে এক ঘরে বন্ধ করে রাখতো তোদের।

অহনা কথা ঘুরিয়ে বলল,
–হোটেলের লোকেরা আসতে পারে৷ ওদের থেকে জিনিসগুলো নিয়ে তোমার কাছে রেখো। আমি এসে নেবো।

মৌসুমি বুঝে আরো বিরক্ত হয়ে বলল,
–আচ্ছা ঠিক আছে। আমার কথা তো শুনবি না। সবসময় নিজের মনমনানিই করবি।

বলেই বাড়ির ভেতর চলে গেলো। অহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ জীবন ওর সাথে বাড়ে বাড়ে খেলে। এবারেও খেলছে। দেখা যাক, এই খেলা ওকে কতদূর নিয়ে যায়!

সাদিক মাহাদীর হাত ধরে আশেপাশে হাঁটতে লাগলো। কিছুদূর হাঁটার পর ডাবওয়ালাকে দেখা গেলো। ডাবওয়ালা বোধহয় মাহাদীর অতি পরিচিত। তাকে দেখেই আদুরে গলায় বলল,
–মাহাদী দাদু, ডাব খাবা?

মাহাদীও এক গাল হেসে ঘাড় কাত করে বলল,
–খাবো দাদু।

সাদিক মাহাদীর দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
–দাদু বলছো কেন? তোমার দাদু অন্য কেউ। নানু বলো এনাকে।

ডাবওয়ালা ডাব কাটা রেখে সন্দেহী গলায় বলল,
–আপনি কেডা?

সাদিক থতমত খেয়ে গেল। আসলে কি উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে আস্তে করে বলল,
–আমি ওর মায়ের হাজবেন্ড।

ডাবওয়ালা কপাল যথাসম্ভব কুঁচকে বিরক্তি গলায় বলল,
–মানে ওর আব্বা?

সাদিক হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,
–হ্যাঁ, সেটাই।

এবারে বিরক্তির সাথে সাথে তার গলা দিয়ে রাগ ঝড়ে পরলো। তেঁতে উঠে বলল,
–ওহ! তো এতো বছর যাওয়ার পর বউ ছাওয়ালের কথা মনে পড়ছে? আমি মাসে দুইবার করে বাড়িত যাই। নাতিপুতিরা দাদু দাদু কইয়া কোলে ঝাপায়া আসে। আর এতো সুন্দর বাচ্চাডার কথা একবারও মনে পড়লো না। ছ্যাহ! এই নাও দাদু। টাকা লাগবে না। ফিরি দিলাম। তোমার বাপের টাকা আমি নিমু না।

মাহাদী ডাবের পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পানি খেতে শুরু করলো। সাদিক রেগে বলল,
–নানু বলে ডাকুন। ওর দাদু আছে।

ডাবওয়ালা ওকে পাত্তাই দিলো না। মাহাদী বাবার হাত ধরে তাদের কথা শুনছিলো আর ডাবের পানি খাচ্ছিলো। কথা শেষ হতেই একটা ডাবের দিকে আঙুল তুলে বলল,
–দাদু, এটা আমি নেই? আর্ট করবো।

ডাবওয়ালা পান খাওয়া দাঁত বের করে হেসে বলল,
–তুমি নিতে পারবা না দাদু। অনেক ভারী। আমি তোমার বাড়িতে দিয়ে আসবোনে। একটা না, অনেকগুলা দেবোনে।

মাহাদী খুশি হলেও সাদিকের রাগ হলো। কেউ তার কথা পাত্তাই দিচ্ছে না! পকেট থেকে একশো টাকার নোট বের করে ভ্যানের উপর শব্দ করে রেখে বলল,
–ওর বাবার ডাব খাওয়ানোর ক্ষমতা আছে। ফ্রীতে খাওয়াতে হবে না।

তারপর আর সেখানে দাঁড়ালো না। মাহাদীর হাত এক প্রকার টেনে অন্যদিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
–তোমাকে আর এখানে আনবো না। কিসব মানুষের মধ্যে যে বড় হচ্ছো!

সাদিক বড় বড় পা ফেলে হাঁটছিলো। ওর হাঁটার সাথে তাল মেলাতে মাহাদীকে দৌঁড়াতে হচ্ছিলো। খানিকটা পথ যাওয়ার পর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
–আমি হাঁটতে পারছি না। ব্যাথা করছে।

সাদিক দাঁড়িয়ে পরলো। কপাল কুঁচকে মাহাদীর অবস্থা দেখে কোলে তুলে নিয়ে বিরক্তিকর স্বরে বলল,
–কোলে কোলে মানুষ হয়েছো। পা তো ব্যাথা করবেই।

সাদিক কোলে তুলতেই মাহাদী ওর গলা জড়িয়ে ধরলো। প্রশান্তি বয়ে গেলো সাদিকের হৃদয়জুরে। তারপর খেয়াল করলো মাহাদীর জোরে জোরে শ্বাস ফেলা কমছে না। সাদিক বিচলিত হয়ে মাহাদীর পিঠ ঘষে মৃদু গলায় বলল,
–কি হয়েছে? পানি খাবে?

মাহাদী মাথা নেড়ে না বুঝিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে। সাদিকও শক্ত হাতে আগলে রাখলো। মাহাদী মিনিট খানেকের মধ্যে ঠিক হয়ে যেতেই সাদিক আবার হাঁটা শুরু করে বলল,
–এতো পাতলা কেন তুমি? বাতাসের থেকেও হালকা।

মাহাদী কিছু বলল না। ওভাবেই বাবার সাথে লেপ্টে থাকলো। সাদিক হাঁটতে হাঁটতে মাঠে কাছে চলে আসলো। অসমাপ্ত এক বিল্ডিং এর সামনে অনেকটা জায়গা ফাঁকা। বাচ্চারা সেটাকেই খেলার মাঠ বানিয়ে ফেলেছে। সেখানেই অনেকগুলো বাচ্চা ফুটবল খেলছে। সাদিক দেখেছিলো, মাহাদী প্রায় সময়ই ফুটবল পায়ে নিয়ে হাঁটে। তাই দাঁড়িয়ে পরে বলল,
–চলো ফুটবল খেলি।

মাহাদী মাথা নেড়ে বলল
–আমি দৌড়াতে পারি না। কষ্ট হয়।

–দৌড়াতে হবে না। তুমি আমার কাছেই থাকো।

বলেই ওকে কাঁধে তুলে নিলো। কাঁধের দুই পাশে পা দিয়ে বসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো মাহাদী। নিজেকে পাখির মতো লাগতে লাগলো তার। মনে হলো এখন উড়তে পারবে। কিছুক্ষণের মধ্যে উড়তেও লাগলো। সাদিক ওকে কাঁধে তুলে ওর হাত নিজের হাতে নিয়ে শক্ত করে ধরে বাচ্চাদের সাথে দৌড়ে দৌড়ে ফুটবল খেলতে লাগলো। মাহাদী মহা আনন্দে খিলখিল করে হাসতে লাগলো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে