#অবশেষে
#Written_by_Sumaiya_Karim
||পর্ব-৭||
আদ্র ফোন টা আয়রার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। অন্য জন ঠায় দাঁড়িয়ে সেটি দেখেই গেলো। কেটে গেলো বিয়ের ১ মাস। এই একমাসে কোনো রকম দূরত্ব ঘুচে নি দুজনার মধ্যে। এই ১ মাসে আদ্র আয়রা কাছে টেনে নিয়েছে আবার দূরে ঠেলে দিয়েছে। এ সকল কিছু তে কোনো রকম ভালোবাসার দেখা পায় নি আয়রা। আদ্র কে অনেক বার জিঙ্গেস করেছে কেন সে এমন করেছে কিন্তু উত্তর সে দেয় নি। আজ ঠিক করলো উত্তর টা জেনেই ছাড়বে। এত্তোগুলো দিবে তাদের কথা গুলো কোনো পরিবার জানে নি। আয়রা জানায় নি কাউকে নিজেই সমাধান জরার চেষ্টা করে গিয়েছিলো। আজ শুক্রবার আদ্র বাড়ি তেই আছে তবে এই মুহূর্তে রুমে নেই। এটি চূড়ান্ত সুযোগ ভেবে একে একে সব গুলো রুম আদ্র কে খুঁজতে থাকে আয়রা। তক্ষুনি হুট করে তন্নি সামনে পড়ে যায়।
–‘ভাবী কাউকে খুঁজছো?’
–‘হ্যাঁ মানে না!’
–‘এতো মানে মানে না করে বললেই তো হতো যে ভাইয়া কে খুঁজছো। তোমার উনি ছাঁদেই আছে!’
–‘তুমি দেখেছো?’
–‘হুম যাওয়ার সময় দেখেছি!’
–‘আচ্ছা ঠিক আছে!’
আয়রা ছাঁদে গিয়ে দেখলো আদ্র ছাঁদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে ও গিয়ে তার পাশেই দাঁড়ায় এটা দেখে আদ্র তার দিকে ঘুরে তাকায়। ভ্রুঁ কুঁচকে আয়রা ও তাকালো চোখাচোখি হতেই চোখ ফিরিয়ে নেয় আদ্র। আর চলে যেতে নিলেই আয়রা গিয়ে সামনে দাঁড়ায়।
–‘আরে রে রে যাচ্ছেন কোথায়? আপনার জন্যই তো এখানে এলাম!’
–‘মানে?’
–‘মানে জানতে চান?’
–‘বুঝলাম না কিছু?’
–‘বুঝাচ্ছি এক মিনিট…
বলেই হুট করে আদ্র কে জাপটে ধরলো। আদ্র রোবটের মতো সেই এক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো। কিছু সময় পর আয়রা কে নিজের থেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো কিন্তু সে কিছুতেই ছাড়ছে না। দেখে রেগেমেগে বললো,
–‘ছাড়ো বলছি এসব কি করছো?’
–‘সব সময় তো আমাকে কাছে টেনে নিয়ে আবার দূরে সরিয়ে দেন। আমি জানতে চাই কেন এমন করেন? বিয়ের দিন থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক দিন নিয়ম করে জানতে চেয়েছি বার বার ইগনোর করেছেন আজ আপনাকে বলতেই হবে!’
আদ্র দাঁতে দাঁত চেপে সব রকম চেষ্টা করলো আয়রা কে সরানোর কিন্তু ব্যর্থ হলো।
–‘আপনি যদি কারণ টা বলেন তাহলে আমি আপনাকে ছেড়ে দিবো! আর না বললে ছাড়বো না!’
আদ্র ই জোড় করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। রক্ত চক্ষু নিয়ে আয়রার দিকে তাকায়। আর প্রতিদিনের ন্যায় আজ ও ইগনোর করে চলে যেতে নেয়। এটা দেখে আয়রা পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে,
–‘আমি আজকে সবাই কে বলে দিবো এই সব! কোনো কারণ ছাড়াই আপনি আমার সাথে এসব করেই যাবেন তা তো হবে না ব্যাস এনাফ আর না অনেক হয়েছে।’
আয়রার কথা শুনে এবার থামলো আদ্র। আর আয়রার দিকে এগিয়ে এসে তার দু হাত চেপে ধরে চোখে অগ্নিরাশি ছুড়ে মারতে মারতে প্রচন্ড রেগে বললো,
–‘এতো তাড়াতাড়ি অসহ্য হয়ে গেলে? তুমি যেভাবে একটা ছেলের জীবন নরক বানিয়ে তাকে মেরে ফেলেছো আমি ও তোমাকে তাই করবো। এতো সহজে পার পাবে না তুমি!’
–‘আমার হাতে লাগছে!’
–‘লাগুক ব্যথা লাগার জন্য ই তো ধরেছি! কারণ জানার খুব শখ না তোমার? তাহলে এই টুকু ব্যথা তেই কেন হাঁপিয়ে উঠলে?’
–‘ওকে ফাইন। বলেন কারণ কি আমি কোন ছেলের সাথে কি করেছি?’
হাতের ব্যথায় আয়রার চোখে পানি চলে আসে এটা দেখে আদ্র তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
–‘জিসানের কথা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?’
জিসান নাম টা শুনে অবাক নয়নে আদ্রর দিকে তাকায় আয়রা। প্রশ্ন একটাই এসবের সাথে জিসানের কি সম্পর্ক?
–‘এটা সেই জিসান যাকে আমি ভাইয়ের মতো দেখতাম। আরে ও তো আমার ভাই ই ছিলো। কলিজার টুকরা ছিলাম আমরা একে অপরের।’
আয়রা আদ্রর কথা শুনে ভাবতে থাকে এসব কথা এখানে কেন আসলো?
–‘৩ বছর আগের ঘটনা মনে পড়ে? আমরা চারজন বন্ধু ছিলাম। জিসান আমি রাতুল সায়ন। আমি দেশের বাহিরে চলে যাই। কথা ছিলো ১ বছর পর জিসান ও যাবে। আমি চলে যাওয়ার কয়েক মাস পর ই জিসান ভার্সিটির একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে। খুব ভালোবেসে ও ফেলে। আমাকে বলতো দোস্ত আমার ঐ মেয়ে কেই লাগবে! ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না মনে হয়! জানো ঐ মেয়ে কে ছিলো? তুমি ছিলা তুমি!’
আয়রা কিছু বলতে যাবে আদ্র তাকে থামিয়ে দেয়,
–‘জিসান তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো আর তুমি কি করলে ওকে মেরে দিলে?’
–‘আমি মেরেছি মানে? কি বলতে চান আপনি?’
–‘তুমি জিসানের প্রপোজ এক্সেপ্ট করো নি। বার বার অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলে! মারা যাওয়ার আগের দিন ও আমাকে বলেছিলো আজ শেষ চেষ্টা করবে তোমাকে নিজের করে পাওয়ার! সেদিন তুমি কি করেছিলে জানিনা পরের দিন আমি জানতে পারি জিসান মারা গেছে! ও সুইসাইড করেছে তার কারণ শুধুই তুমি! তুমি ই মেরে ফেলেছো ওকে!’
আদ্রর চোখে প্রচন্ড রেগে কথা বলা সত্ত্বেও জিসানের মারা যাওয়ার কথা বলার সময় চোখে পানি চলে এসেছে দেখে ও আরেক দিকে ফিরে হাতের তালু দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেলে। জিসান কে ভাইয়ের মতো দেখতো। এক আত্নার সম্পর্ক যেনো দুজনার মধ্যে বিদ্যমান। আদ্রর সব কথা বুঝতে একটু সময় লাগলো আয়রার। ও তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
–‘তার মানে বন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছিলেন আমার থেকে? আপনার বন্ধু কে আমি মারিনি। আপনি শুধু সেদিনের সূচনা টা শুনেছেন পুরো ঘটনা টা না জেনেই আমার থেকে প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করলেন? বাহ মিস্টার আদ্র বাহ! সত্যি ই আপনি বাহবা পাওয়ার যোগ্য!’
–‘একদম মিথ্যা কথা বলবে না! তোমাকে আমি কিছু তেই সুখে থাকতে দিবো না! সব টা শুধু দেখে যাও। প্রথম দিন ও আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরের দিন কাহিনী উল্টো হয়ে যায়। তোমার পরিবার থেকে আলাদা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। এবার এমন কিছু করবো যাতে তুমি ও তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে ধুকে ধুকে মরতে বাধ্য হও! তোমার পরিবার কেও সুখে থাকতে দিবো না। ছারখার করে দিবো সব!’
আদ্র রেগে চলে যায়। আয়রা নিচে বসে পড়ে। কান্না করতে থাকে। ৩ বছর আগের ঘটনা টা মনে পড়লে এখনো তার ভয় কাজ করে।
তাদের দুজনার কথা আড়াল থেকে ঘাপটি মেরে শুনছিলো তন্নি। কেননা প্রথমেই তার গড়বড় লাগছিলো তাই সে এটা করতে বাধ্য হয়েছে। আদ্র চলে যাওয়ার পর ধীর পায়ে আয়রার দিকে এগিয়ে আসে সে। আয়রা কে শান্তনা দিতে যাবে ওমনি হুট করে উঠে আয়রা তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে,
–‘তন্নি বিশ্বাস করো আমি উনার বন্ধু কে মারিনি। আমি সত্যি বলছি। উনার বন্ধু নিজেই আমার অসম্মানি করতে চেয়েছিলো।’
পরিবারের ক্ষতির কথা শুনে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে আয়রা। কারণ তার পরিবার আর পরিবারের মানুষ গুলো কে খুব ভালোবাসে সে।
–‘শান্ত হও নিচে চলো!’
–‘তোমার ভাই আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি করে দিবে তন্নি!’
–‘আমার সাথে আসো তো তুমি প্লিজ!’
আয়রা কে নিচে নিয়ে যায় আর এক গ্লাস পানি তার দিকে এগিয়ে দেয়। এক নিশ্বাসে সব টুকু পানি গিলে ফেলে আয়রা।
–‘এবার বলো কি হয়েছিলো সেদিন?’
–‘আমি বাড়ি যাবো।’
–‘আগে কি হয়েছে তা বলো!’
-‘তোমার ভাই যেখানে বিশ্বাস করে না তুমি কিভাবে করবে?’
–‘সত্যি করে বলো সব কোনো মিথ্যা কথা বলবে বা। আমি সত্যি তে বিশ্বাসী। নিজেকে শক্ত করো তুমি যদি সত্য হয়ে থাকো তাহলে এভাবে ভেঙ্গে পড়ছো কেন?’
–‘আমি মিথ্যা বলছি না তন্নি সেদিনের ঘটনার সাক্ষী আছেন রাতুল আর সায়ন ভাই উনারা দুজন ও ছিলেন সেখানে উপস্থিত!’
–‘তাহলে আগে তুমি আমাকে বলো তো সেদিন হয়েছিলো টা কি?’
–‘ঘটনা ৩ বছর আগের। তোমার ভাই যেমন টা বললো আমাকে পছন্দ করতো জিসান। আমার উনাকে একদমি ভালো লাগতো না। গুন্ডামি করতো ভার্সিটি তে। একদিন তো একটা ছেলে কে মেরে আধমরা পর্যন্ত করে ফেললো। এই রকম অমানুষিক কার্যকলাপ দেখে উনার প্রতি আমার আরো ঘৃণা জন্ম নেয়। আমি প্রপোজ এক্সেপ্ট করিনা দেখে আমাকে তিন দিন সময় দিয়েছিলো ভেবে দেখতে। আর হুমকি ও দিয়েছিলো যেনো আমি আমার পরিবার কে এ ব্যাপারে না জানাই।
তিন দিন আমি আর ভার্সিটিতে যাই নি। চতুর্থ দিন আমার ভার্সিটির এক ফ্রেন্ড জারিফার জন্মদিন এর পার্টি এরেঞ্জ করা হয়। ও নিজে এসে আমাকে তার বাড়ি তে নিয়ে যায়। আর আশ্বাস দেয় জিসান এখানে এসে কোনো রকম খারাপি করতে পারবে না!
এতটুকু বলে থামলো সে। তন্নি সব টা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকলো!
–‘তারপর?’
–‘আমি বাধ্য হয়ে সেখানে যাই। জারিফার বার্থডে টা ঠিক ভাবে পালন করা হয়। এক সময় হুট করে কারেন্ট চলে যায় আর কে জেনো আমাকে কোথাও জোড় করে নিয়ে যাচ্ছিলো। এটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম তবে চিৎকার করতে চেয়ে ও পারিনি। আমার মুখ কেউ চেপে ধরে রেখেছিলো। অন্ধকার একটা রুমে আমাকে একা ছেড়ে দেওয়া হয়। আমি যখন কে?… কে? বলে চিৎকার করতে থাকি হঠাৎ করে লাইট জ্বলে উঠলো। আর সামনে রক্ত চক্ষু দ্বয়ের মানুষ অর্থাৎ জিসান কে দেখি। আমার স্বপ্নে ও ছিলো না যে উনি এখানে চলে আসবে। উনি আমাকে ভালো ভালোয় জিঙ্গেস করে আমি এক্সেপ্ট করবো কিনা। কিন্তু আমার ঐ ঘটনায় ঘৃণায় গা রিরি করতে থাকায়। বারবার বিরক্ত করায় এক সময় আমি রেগে গিয়ে উনার গালে চড় বসিয়ে দেই।
–‘তারপর!’
–‘এই চড় টা আমার কাল হয়ে দাঁড়ায় উনি আমার সাথে অসভ্যতামি করার চেষ্টা করে। আমি প্রাণপণে ছুটে বাঁচার চেষ্টা করি কিন্তু উনি আমার সাথে খুব জোড়াজুড়ি করতে থাকে। খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম আমি মনে হয়েছিলো ওইটাই আমার জীবনের শেষ দিন। হুট করে দরজা কেউ খুলে দেয় আর আমাকে অসহায় ভাবে দেখে সবাই জিসান কে নানান কটুক্তি করতে থাকে। ভয়ে আমি এক পাশে জড়সড় হয়ে বসে গলা ছেড়ে কাঁদছিলাম। জারিফা এসে আমার গায়ে ওড়না জড়িয়ে দেয়। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদি। জিসান কে উনারা যেতে দেয় না। আমার বাবা মা কে ফোন করে জারিফার বাবা, উনারা সব টা শুনে ছুটে চলে আসেন। আর জিসানের বাবা মা কে ডেকে সেদিন খুব অপমান করেন। জিসানের বাবা জিসান কে সকলের সামনে মারে। জারিফা ভার্সিটির সব ঘটনা সবাই কে খুলে বলে। কেননা ও আমার সাথে ছিলো বলে সব কিছু জানতো। শেষে জিসান আর তার বাবা মা খুব অপমানিত হয়ে বাড়ি চলে যায়। আর তার পরের দিন আমি জানতে পারি জিসান সুইসাইড করেছে!’
চলবে?