অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব-১৮+১৯

0
937

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৮ (দীর্ঘশ্বাস)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“মা, আমি বাবার বিজনেসে আসতে চাই।”

“তুই সিরিয়াস, শুদ্ধ?”

সুভা বেগমের কথায় শুদ্ধ ফোনের এপাশে হালকা হেসে বলল, “খুব সিরিয়াস। মেয়ে পটানোর আগে অবশ্যই নিজের খুঁটি শক্ত করে গেড়ে নিতে হবে। নয়তো সে এক্সকিউজ পেয়ে যাবে, ‘শুদ্ধ, তুমি তো নিজেই বাপের টাকায় খাও। আমায় কী খাওয়াবে?’ আমি তখন কিছু বলতেই পারব না!”

“ভালো কথা! গুড ডিসিশন। বাট এটা তো তোর বাবাকে বলা দরকার, তাই-না?”

“তুমি বলে দিয়ো।”

“এহ! নিজেরটা নিজে করে নে, আমি পারব না।”

“এটা অবিচার!”

“একদম না। দরকারের সময় এত ম্যা ম্যা করবি না। নিজের কাজ নিজে করতে শেখ। আর শোন, তোর বাবাকে বলিস—মাকে শপিংয়ে নিয়ে যেতে। এ-মাসে আমাকে নিয়ে যায়নি তোর বাপ।”

“নিজের কাজটাও আমাকে দিয়ে করাবে?”

“অবশ্যই। মায়ের কথা শোনা তো তোর সন্তানধর্ম রে, পাগলা।”

“বুঝলাম। কিন্তু, বাবার সাথে এই বিষয় নিয়ে কীভাবে কথা বলব?”

“সে আমি কী জানি?”

“কেন? তুমি জানো না—আমি বাবার সাথে খানিকটাও ফ্রী নই। কথা বলতে গেলে হাঁটু কাঁপে; সে-ভয়ে সামনেই যাই না।”

“সামনে আসার প্রয়োজন কী? কল দিয়ে কথা বলে নে।”

“ও-মা, একটু ম্যানেজ করো না! জানো তো বাবার ভয়েস শুনলেই কলিজা শুকিয়ে যায় আমার।”

“আচ্ছা, তোর বাবা তো রাগী না। এত ভয় পাবার কী আছে?”

“ও-তুমি বুঝবে না। কিছু কিছু মানুষ কিছু না করেও অনেক কিছু করে ফেলে। তোমার বর সেরকম একজন। উফ! চাহনিতেই স্পষ্ট, ‘শুদ্ধ, একদম বেহুদা কথা বলবে না; চিবিয়ে খেয়ে ফেলব’। তার ভয়ে কথা তো দূর, আওয়াজই আসে না।”

“তুই বেহুদা কথা না বললেই হয়।”

“পারব না, পারব না।”

“কেন?”

“কী কেন? এতক্ষণ কি আমি আমার বাচ্চাদের নাম-ধাম ডিসকাস করছিলাম তোমার সাথে?”

সুভা বেগম মিনমিনে স্বরে বললেন, “লাজ-লজ্জা সব খেয়ে নিয়েছে, সুভার বাচ্চাটা!”

“কিছু বললে?”

“না, বলিনি কিচ্ছুটি। তোকে একটা পেইজ লিংক দিচ্ছি। ওই পেইজ থেকে দুইটা ভালো দেখে সেম ডিজাইনের বেনারসি কাতান কিনে আমার এড্রেসে পাঠিয়ে দিস। আমি এদিকটা সামলে নেব।”

“ঘুস খাচ্ছ, বাবা জানে?”

“তুই যে তলে তলে এতদূর গেছিস, বাবা জানে?”

“উঁহু উঁহু, না। জানে না।”

“আমারটাও যেন না জানে।”

“আচ্ছা, কিন্তু দুইটা সেম শাড়ি?”

“একটা আমার, একটা তোর বউয়ের। মা-মেয়ে একদম সেম সেম সাজব। তোকে আর তোর বাপকে পাত্তা দেবো না। তোর বউয়ের সাথে আমি লং ড্রাইভে যাব, মুভি দেখব, চিল করব। মাস খানেকের নামে ল-ম্বা একখান ট্রিপ দেবো। তুই আর তোর বাপ ফক্কা।”

এই বলা সুভা বেগম হাসতে লাগলেন। মায়ের এমন সোজাসাপটা মনোভাব দেখে শুদ্ধরও অন্তরটা জুড়িয়ে গেল। হেসে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে দিলো। ঝটপট একটা শাওয়ার নিয়ে বেরোতেই কলিং বেলের আওয়াজে জলদি গিয়ে দরজা খুলল। ওপাশে দিশা ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে। শুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে আসতে আসতে বলল, “জানো, শুদ্ধ ভাইয়া? আজকে তোমার পছন্দের সব রান্না করেছি। খেয়ে দেখো তো—কেমন হয়েছে!”

শুদ্ধ দিশার পিছে পিছে ডাইনিংয়ে গিয়ে বসল। দিশা খাবার বাড়তে লাগল। শুদ্ধ বলল, “এসবের কি কোনো দরকার ছিল? এটুকু সময় পড়ালেখা করলেই কিন্তু ভালো হতো! সামনে তোমার টার্ম ফাইনাল আছে।”

দিশা খাবার বাড়া থামিয়ে সরু দৃষ্টিতে শুদ্ধের দিকে তাকাল। ওভাবে তাকাতে দেখে শুদ্ধ থতমত খেয়ে বলল, “কী? কী হয়েছে?”

দিশা বলল, “এত পড়াশোনা নিয়ে এডভাইস দেবে না। তুমি নিজেও আমার মতোই; পড়া দরকার তাই পড়ছি টাইপের পাবলিক। আমাদের এই পড়াশোনা দিয়ে কিচ্ছু হবে না। কিছু করার জন্যও পড়ছি না। আমি হব পাক্কা গৃহিণী; বাচ্চার শিক্ষিত মা হবার জন্য যতটুকু দরকার পড়ছি। আর তুমি আর্নিং মেথোড হিসেবে সিঙ্গিংটাকে নিতে পারো।”

“বুঝলাম! বাট শখ আর প্রফেশন—দুটোকে এক করলে যদি ব্যর্থতায় নাম ফেলতে হয়! ভয় তো এটারই!”

“ভয় পেয়ো না। ইট উইল বি স্ট্রংগার।”

শুদ্ধ জবাবে মুচকি হেসে খাওয়া শুরু করল। খেতে খেতে দিশার প্রশ্ন শুনতে পেল, “আচ্ছা, সেদিন তনু আপুর সাথে তোমার কাহিনিটা বললে না?”

“হুঁ।”

“আমার না খুব ইন্ট্রেস্টিং লেগেছে। কী সুন্দর! কিন্তু..”

শুদ্ধ খাওয়া থামিয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি রেখেই বলল, “নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেশি সেই আদিমতার শুরু থেকেই। আমিও মানুষ, আকর্ষণ আমারও হয়েছে।”

“তোমাদের পরিণতি নিয়ে আমি সত্যিই চিন্তিত।”

“চিন্তা কোরো না। তাকে নিয়ে সব চিন্তা আমার একান্ত থাকুক; যেমনটা তাকে ঘিরে আমার প্রেম রয়েছে!”

“তাকে পাবে তো তুমি?”

“সে-আশা রাখছি না আর। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাব নিজের সবটুকু দিয়ে। বাকিটা ভাগ্য। সে আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে ইচ্ছে ছাড়াই। এদিকে আমি তাকে নিজের ভাগ্যে জায়গা করানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগে গেছি। সে আমার হলে আমি ব্যর্থতাকেও আপন করে নিতে রাজি।”

_______
রাত জাগার বাজে একটা অভ্যেস আছে তনুজার। এক যুগ আগে, এই মেয়েটা ঘুমপ্রিয়া ছিল। তারপর একজন এসে তাকে রাত জাগতে শিখিয়ে দিলো। সে তো চলে গেল, কিন্তু অভ্যেসগুলো পিছু ছাড়ল না; মনের কোনে সুপ্ত প্রেম ভেতরে ভেতরে একটা মানুষকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভস্ম করে দিয়ে গেল।

রাতের আড়াইটা বাজে। পুরো বাসার লাইট অন করে রাখা, তনুজা অন্ধকারে ভয় পায় তো—তাই। সারারাত এই আলো জ্বলবে, নিভবে ভোরে। এর মাঝে ঘুম এলে ভালো, নয়তো ওভাবেই তনুজা পড়ে থাকবে৷ একাকিত্বের এই দমবন্ধকর অনুভূতি চার দেয়ালের বাইরে যায় না। তনুজা একাই অনুভব করে। সে কাঁদে না, হাসেও না। কেমন যেন গম্ভীর হয়ে থাকে। অথচ, এক সময় কতটা চঞ্চল ছিল!

বিছানায় হেলান দিয়ে বই পড়ছিল তনুজা। এমন সময় হোয়াটসঅ্যাপের এক অনাকাঙ্ক্ষিত ম্যাসেজে সে চকিতে চাইল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখতে পেল, একটা আননৌন নম্বর। সে চোখ বুজে ধরে নিল, এটা শুদ্ধ। কৌতুহল নিয়ে নয়, সামান্য বিরক্তি নিয়েই ম্যাসেজটা দেখল।

স্ক্রিনে লেখা আছে, “প্রিয়তমার কথা স্মরণ হতেই এক প্রেমিক পুরুষের ঘুম রাত্রির তৃতীয় প্রহরে ভেঙে গেল। ঘুম-ভাঙা চোখে সে প্রেমিক দেখতে পেল—তার প্রিয়া হাসছে, খিলখিলিয়ে হাসছে; তখন তার বুকটা প্রশান্তির শীতল হাওয়ায় জুড়িয়ে গেল। আর সেই মুহূর্তে সে অনুভব করল—এর চেয়ে শান্তির কিছু দ্বিতীয়টা নেই। প্রেমিকের চোখে দেখা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সর্বসুন্দর দৃশ্যের একটি হচ্ছে প্রিয়নারীর স্নিগ্ধ হাসি। অথচ অলকানন্দা, আমি আপনাকে মন থেকে হাসতেই দেখিনি।”

তনুজা দেখল, পড়ল বেশ কয়েকবার। এর মাঝে আবার দেখতে পেল—টাইপিং হচ্ছে। তনুজা ওদিকে তাকিয়ে রইল। সময় নিয়ে শুদ্ধ পরের ম্যাসেজটি সেন্ড করল।

“আমার কল্পনায় আপনি ভীষণ চঞ্চল একজন মানুষ, আপনার মাঝে গাম্ভীর্যের ছিটেফোঁটাও নেই, আপনি সবসময় হাসতে জানেন, কারণে-অকারণে হাসেন। আবার আমার একটু অযত্নেই ঠোঁট উলটে কাঁদেন, অভিমানে গাল ফোলান, অভিযোগের ঝুলি খুলে বসেন। তখন আপনাকে দেখতে অসহনীয় সুন্দর লাগে.. অসহনীয়। আর কেবল-মাত্র এই লোভেই তো আপনার যত্নে আমি খুঁত রাখি। নয়তো কি রাখতাম? কল্পনায় আমি আমার অলকানন্দাকে নিয়ে খুব বেশিই অধিকারসূচক। এই-যে, ম্যাডাম! আপনাকে না আমার কল্পনায় ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগে। কারণ, আমার কল্পনায় আপনি একজন সপ্তদশী কিশোরী, বয়সে আমার ছোটো, সম্পর্কে আমার প্রেমিকা; মাঝে কোনো ধরণের বাঁধা নেই। আর এইখানটায় গিয়েই রইল আকাশসম দীর্ঘশ্বাস।”

এটুকু পড়তে পড়তে আবারও ম্যাসেজ এলো, “জীবনে সবাই সব পায় না, না?”

তনুজা উত্তর দিলো না। শুদ্ধ নিজের মতো ম্যাসেজ করতে লাগল, “আপনাকে পাবার আশা আমার জীবদ্দশায় আমি ছাড়ব না। নিরাশ হব, হতাশ হব, তবুও আশা ছাড়ব না। আপনি চাইলে আপনি আমার, না চাইলেও আমি আপনার।”

“আমার ভালোবাসা কৃষ্ণগহ্বরের মতন গভীর, আলোর ন্যায় তেজী আপনিও সেখানটায় পথ হারাবেন; ঘুরে ফিরে কেবল আমাকেই পাবেন।”

তনুজা এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল। চোখ জ্বলছে খুব তার। টাইপিং হচ্ছে, কিছুক্ষণ বাদে সেন্ডও হলো। সেখানে লেখা, “কল্পকন্যা, আপনি কি কখনও বুঝবেনই না—গোটা বিশ্ব বিপরীতে রেখে আমি কেবল আপনাকেই চেয়ে গেছি।”

এই ম্যাসেজটা তনুজা দেখতে পেল না। টাইপিং শো করতেই সে ফোনটা সুইচ অফ করে রেখে দিয়েছে। মাথা গিয়ে ঠেকেছে দেয়ালে। চোখ দুটো বন্ধ। গুমোট পরিবেশটিতে হুট করেই তনুজা শুনতে পেল একটি আওয়াজ। কেউ যেন কানের কাছে এসে বড্ড ফিসফিসিয়ে বলছে,

“তনুশ্রী, সোনাবউ আমার! তোমার মুখের এই হাসিটা আমাকে জানান দেয়—আমি কতটা সার্থক পুরুষ। ঘুম-ভাঙা চোখে আমি আমৃত্যু তোমার মুখের হাসিটা দেখে যেতে চাই। জানো কি—এই হাসির শব্দ আমাকে হাজার বছর বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দেয়! যেদিন তোমার এই হাসিটা গায়েব হয়ে যাবে, সাথে সাথে আমার জানটাও হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। বুকে আসো। তোমাকে ছাড়া বুকটা খালি খালি লাগে।”

অথচ, আজ আট বছর হলো তনুজা সিদ্দিকের বুকে যায়নি। তাই বলে কি সে বুক খালি রয়েছে? উঁহু! সে-বুকে আজ অন্য নারীর বসত। সিদ্দিক বেঁচেই আছে, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দিব্যি সুখে আছে…
আর সহ্য হচ্ছে না তনুজার। ত্বরিতে চোখ দুটো খুলে ফেলল। লালচে চোখ দিয়ে জল গড়ায় না। অস্বাভাবিকভাবে তনুজা গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল। সারারাত আর দুচোখের পাতা এক করল না। মনের কোনায় বড্ড গভীর ভাবে গেঁথে গেল, “কেউ কাউকে ছাড়া মরে না।”

চলবে?

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৯ (রাগ না কি অভিমান!)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“তনুশ্রী! লাঞ্চের পর মেডিসিনগুলো নিয়ো ঠিকঠাক, আজ খুব ব্যস্ত থাকব। কল দেওয়ার সময় হবে না হয়তো। তাই বলে এসে যেন না শুনি—মেডিসিন মিস গেছে, তবে মাইর খাবে। বুঝেছ? সিদ্দিক লাভস ইউ, সোনাবউ!”

নিজের ফোনে আসা ম্যাসেজটা তনুজার মনের বিষাদ দূর করতে পারল না। পালটা ম্যাসেজে লিখল, “হুম।”

দুপুরের রান্না সেরে এসে ঘুমিয়ে পড়েল। ইদানিং শরীরে ক্লান্তিটা খুব বেশিই এসেছে। মনের সাথে সাথে শরীরটাও ঝিমিয়ে পড়েছে। বিছানায় শুতেই কখন যে চোখ লেগে গেল—টেরই পেল না। অর্ধ-অচেতন অবস্থায় সে শুনতে পেল ফোনের কলিং টিউনের তীব্র আওয়াজ। সিদ্দিক এই সময়ে কল করবে না। সিদ্দিক ছাড়া আর কল করার মতো কেউ নেই-ও। এই ভেবে সে ওভাবেই পড়ে রইল। কল কেটে গেল, আবার কিছু সময় পর রিং হলো। এবার আর না উঠে তনুজা পারল না। চোখ বন্ধ করেই ফোনটা রিসিভ করে কানে তুলল। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে একটা ভারি আওয়াজ শুনতে পেল, “তনুজা বলছ?”

তনুজা চোখ খুলল। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল—আননৌন নম্বর। ওপাশের নারীটিকে তনুজা চিনতে পারল না। ইতস্তত করে বলল, “জি, আপনি কে?”

“আমাকে চিনতে পারবে কি? নাম বললে বোধহয় চিনতে পারবে!”

“নাম বলুন।”

“আমি আশামণি বলছি।”

আশামণি! তনুজার নিকট পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত নাম বোধহয় এটাই। চাপা রাগ ভেতরে চেপে রেখে বাইরে থেকে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল, “চিনতে পারছি না। কোনো প্রয়োজন?”

আশা বুঝতে পারল—তনুজা তাকে চিনেছে। কেন অস্বীকার করল—তা-ও আন্দাজ করতে পেরেছে। সে মিহি হেসে বলল, “কেমন আছ?”

“ভালো আছি।”

“আমিও ভালো আছি। বাড়ির সবাই ভালো?”

“ভালো।”

“তোমার শরীর কেমন আছে এখন?”

“ভালো।”

“মেডিসিন নিচ্ছ তো ঠিকঠাক?”

“নিচ্ছি।”

“কাল আবরার বলল—তুমি নাকি ইদানিং খুব রাগচটা হয়ে গেছ?”

“আবরার? এসব কেন বলেছে?”

“আরে? রেগে যাচ্ছ আবার? রাগবে না, কেমন? শোনো। কাল আমাকে ইনসিস্ট করল—রাতের ডিনারটা একসাথে করার জন্য। আমি রাজি হলাম। তারপর ডিনার করতে করতে তোমার বিষয়ে বলছিল। তুমি নাকি ওর সাথে উইয়ার্ড বিহেভ করছ, ঠিকমতো কথাই বলছ না।”

“এসব আপনাকে বলার কারণ?”

“শোনো, তনু।”

“তনুজা!”

“আচ্ছা, তনুজা। শোনো, তোমার সাথে যা হয়েছে তাতে তোমার কোনো হাত নেই। তবে তুমি ভুক্তভোগী। আবরার তা বুঝতে পারছে। এজন্য তোমাকে দেখলেই ওর ভেতরটা কেঁদে ওঠে। ও চায়নি তোমাকে এতটা ভেঙে পড়তে দেখতে। ওর কষ্ট হয়। সেজন্য এখন ও তোমার সামনেই যেতে চাইছে না। বুঝতে পারছ? তোমার স্বামী তোমার সামনে যেতে চাইছে না জাস্ট বিকজ অব্ ইওর বিহেভিয়ার। নিজেকে একটু সামলাও! আল্লাহ চাইলে সব হবে। এত কষ্ট নিয়ো না।”

তনুজা রাগে-দুঃখে কল কেটে দিলো। তার ব্যর্থতার গুনগান সিদ্দিক বাইরেও করছে! বিষয়টা কতটা অপমানের—তা তনুজা সিদ্দিককে বোঝাতে পারল না। এদিকে কাল সে সিদ্দিকের অপেক্ষা করতে করতে রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওদিকে সিদ্দিকের অশান্ত মস্তিষ্ক আশার কাছে মানসিক ভোগান্তির কথা বলতে বলতে ভুলেই বসেছিল তনুজার অপেক্ষা।

এভাবেই কাটছিল দিন। তনুজা ডিভোর্সের কথা বললেও, তা মন থেকে চাইছে না। সে সুযোগ খুঁজছে থেকে যাওয়ার। একটা মানুষ কতটা অসহায় হলে—নিজ থেকে মুক্তির পথ বের করে, আবার পিছে তাকিয়ে থেকে যাওয়ার কারণও খোঁজে, তা বোঝার সাধ্য খুব কমেরই আছে!

এভাবে ছোটো ছোটো কিছু ঘটনা, মন থেকে মনের আস্তে-ধীরে স্থির দূরত্ব, মানসিক বিপর্যয়, সময়ের খেলা, অনুভূতির মিশ্র প্রতিক্রিয়া—সব মিলিয়ে তনুজা আর টিকতে পারল না। এক সন্ধ্যায় সিদ্দিকের সাথে তুমুল ঝগড়া শেষে বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে গেল। এরপর আর সে-বাড়িতে ফিরল না। তনুজার মনে পড়ল, সেই দেখাটাই সিদ্দিকের সাথে তার শেষ দেখা।

____
ভাবনা থেকে বের হলো তনুজা। সেই শেষেরদিনগুলো আজও তার ভারি মনে পড়ে। সে তো ফিরে যেতে চেয়েছিলই! কিন্তু..

জীবন হচ্ছে চোরাবালির ন্যায়। জীবনের কোনো নির্দিষ্ট দিকে এগোতে গেলে, সে রাস্তাটা আস্তে আস্তে তোমাকে নিজের মাঝে গিলে নেবে। তুমি আর বেরোতে পারবে না। তনুজাও পারেনি। তলিয়ে গিয়েছে ভেতরটায়। বার বার হাতড়ে ওঠার চেষ্ঠা চালিয়েছে, আজও পারেনি; ওঠার সুযোগও অবশ্য আর নেই তার।

দীর্ঘস্বাস ফেলে কিচেনে গিয়ে রান্না সেরে নিল তনুজা। আজ ভার্সিটি অফ। তাই বাসাতেই থাকবে। রান্না করতে করতেই কলিং বেলের আওয়াজ এলো। তনুজা হালকা পায়ে এগিয়ে গেল। দরজা খুলতেই ডেলিভারি ম্যানকে দেখে সে খানিকটা চমকে গেল। সে তো কিছু অর্ডার দেয়নি! তনুজা সাইন করে তার হাত থেকে একটা বক্স নিল। সেটা দেখার লোভ একটুও নেই তনুজার। তবে জানার একটা কৌতুহল আছে।

রান্না সেরে নিয়ে বক্সটা খুলল এবং সবিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল এবার। বেশ বড়ো একটা বক্স। আর পুরোটা ভরা চিরকুট। অসংখ্য চিরকুটের মাঝ থেকে একটি তনুজা বের করল। তাতে লেখা, “মিস তনুজা, জেনে রাখুন—কোনো এক শুদ্ধপুরুষ তার অলকানন্দাকে বেশ ভালোবাসে।”

আরেকটা চিরকুট বের করল। তাতেও একই লেখা। তনুজা একাধারে একটা-দুইটা-তিনটা এরপর অসংখ্য চিরকুট বের করল, সবেতে একই লেখা। বুক ফেটে কান্না এলো তার।

কেন যেন সে শুদ্ধর অনুভূতি অনুভব করে, শুদ্ধকে অনুভব করে। ভালো তো সে-ও বেসেছিল অন্য একজনকে। একই রকম ভালোবাসাই সে পাচ্ছে, অন্য পুরুষের থেকে। এই প্রেম, এই পাগলামি! এগুলো সবই তার মাঝে ছিল। সে-ও একটা পাগলাটে প্রেয়সী ছিল তার স্বামীর। এরকম কাজ কত্ত করল!
একবার সিদ্দিক রেগে গিয়েছিল প্রচণ্ডভাবে। সে রাতে তনুজাকে বুকে না নিয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। সকালে উঠে নিজের মাথার ধারে সিদ্দিক একটা ডায়েরি পায়। সে-ডায়েরির প্রতিটা পেইজের আগা-গোড়া একটা শব্দ দিয়েই পরিণত ছিল—‘ভালোবাসি’।

তনুজা এমন ভালোবাসা ভয় পায় এখন। ভয়টা প্রকাণ্ডরূপে বেড়ে চলেছে। তাই আর দেরি করল না। অনেকদিন ধরে যা ভেবে চলেছিল, তা এবার বাস্তবিক অর্থেই করতে নিল। ফোন বের করে শফিক সাহেবকে কল লাগাল।

রিসিভ করতেই তনুজা কোনোরূপ কুশলাদি ছাড়া বলে উঠল, “মামা, সাহায্য লাগবে।”

_______
অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে সিদ্দিকের আজ রাত হলো। সে আগের মতো কোনো কিছুতে বাধ্য নয়, রাত হয়-ই! সব জায়গা থেকে সে মুক্ত হলেও, এক জায়গায় গিয়ে আটকে আছে, একজনের কাছে থমকে রয়েছে। তার জন্য এই রাতের বারোটায় কিছু লাল ফুল আর চকোলেট নিল।
তার ফিরতে যতদেরিই হোক না কেন, একজন অপেক্ষা করে। দেরি হলে গাল ফোলায়। মাঝে মাঝে ছল ছল চোখে তাকিয়ে বলে, “পাষাণ!”

সিদ্দিক সেই দৃষ্টিকে ভয় পায় কেবল। আনমনে হেসে বাসায় চলে এলো। কলিং বেল বাজাল না। এক্সট্রা কী দিয়ে দরজা খুলে নিল। ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখ গেল লিভিং স্পেসে। লাইট জ্বালানো। এত রাতে এই একজন তার অপেক্ষায় এখানে বসে আছে। সোফায় বসে টেবিলের উপর কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে টিভি দেখছে। টিভিতে কার্টুন চলছে।

সিদ্দিকের আসাটা সে খেয়াল করেনি। সিদ্দিক তাকিয়ে রইল, কেমন গুটিশুটি মেরে বড়োদের মতো বসে আছে। এভাবেও যেন কত রাগ ঝাড়ছে!
আর অপেক্ষা না করে ডাকল সে, “প্রিন্সেস!”

অর্ষা আড়চোখে বাঁয়ে তাকিয়ে বাবাকে দেখল। আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। সিদ্দিক এগিয়ে গিয়ে ছোট্টো অর্ষাকে কোলে তুলে নিল। বুকে জড়িয়ে বলল, “বাবাই লাভস ইউ, প্রিন্সেস!”

অর্ষা কিচ্ছু বলল না। ফুলো গালগুলো কেবল বেলুনের মতো আরও খানিকটা ফুলতে লাগল। সিদ্দিক রাগ ভাঙানোর উদ্দেশ্যে তাকে কোলে করে সোফাতে বসল। এরপর চকোলেটস আর ফ্লাওয়ার্সগুলো দিলো। তাকিয়ে দেখল—অর্ষার রাগ গলল বলে!

অর্ষা কথা বলল এবার, “কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি, জানো? তুমি সবসময় এমন লেইট করো, বাবাই!”

সিদ্দিক অর্ষার গাল দুটো টিপে দিয়ে বলল, “আর হবে না, মা।”

“প্রমিস?”

“পাক্কা!”

অর্ষা খিলখিল করে হেসে উঠল। সিদ্দিককে দুহাতে জড়িয়ে বুকে মুখ ঘষে বলল, “লাভ ইউ মোওওওওওওর, বাবাই।”

সিদ্দিক ভেবে পায় না! পাঁচ বছরের বাচ্চাটা এত পাকনামি কীভাবে করে! বাচ্চাটা এত কথা জানে! বায়নাগুলোতে সবসময় সে তনুজার ছোপ পায়, বায়না না মেটানোর কান্নাগুলোতেও যেন তনুজার বাচ্চাকালের রূপ প্রকাশ পায়। হয়তো এই জন্যই এখনও বেঁচে আছে। তনুজার জুনিয়র ভার্সন বলে কথা!

অর্ষা আবার বলল, “বাবাই, তোমাকে একটা জিনিস দেখাব! দাঁড়াও।”

এই বলে সিদ্দিকের কোল থেকে নেমে সোজা রুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ বাদে একটা ফোটোফ্রেম নিয়ে এসে বলল, “আজ মাম্মা আমাকে সব্বার আগেকার ছবি দেখাচ্ছিল। সবাইকে চিনলেও, এনাকে চিনতে পারিনি। মাম্মাকে জিজ্ঞেস করায় বলল—এটা নাকি আমার আরেক মাম্মা। আচ্ছা, সবার তো একটা করে মাম্মা হয়। আমার দুইটা কীভাবে? মাম্মাকে কুয়েশ্চনটা করায়, আমাকে আর কিচ্ছু বলেনি। তাই আমি ছবিটা লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। তোমার কাছে জিজ্ঞেস করব বলে। ভালো করেছি না—বলো, বাবাই?”

রাগে সিদ্দিকের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছে সে। তার সামনে যে একটা বাচ্চা রয়েছে—সে জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছি। অর্ষার হাত থেকে এক ঝটকা মেরে ফ্রেমটা নিয়ে বাইরে চলে গেল। অর্ষা ওখানটাতেই কেঁপে উঠল, এগোনোর সাহস পেল না। সিদ্দিক ফ্রেম নিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। ছবিটি বের করল। এরপর টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল। কিছু মানুষকে ছবিতেও দেখতে ইচ্ছে করে না। সিদ্দিকের নিকট তনুজা তেমনই একজন মানুষ।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে