অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব-১৬+১৭

0
880

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৬ (লুকোচুরি)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“ম্যাম, জীবনটা সুন্দর! আরেকটা সুযোগ দিন!”

তনুজা হাসি মুখটা হুডতোলা রিকশা থেকে বের করে পিছে তাকাল। মিষ্টি কণ্ঠে বলে উঠল, “সুযোগ দিয়েছি বলেই, বেঁচে আছি, শুদ্ধ। লাইফের প্রতিটি মোমেন্ট ইনজয় করছি। নিজেকে ইনজয় করছি। আই লাভ মাই লাইফ, আই লাভ মাইসেলফ্!”

“ম্যাম, জীবনের শেষ বয়সে এসে একা লাগবে আপনার! একজন সঙ্গী থাকুক না, যে সবেতে পাশে থাকবে।”

তনুজা মাথা ফেরাল। নিচু স্বরে বলল, “সঙ্গ প্রয়োজন নেই, শুদ্ধ। প্রয়োজন নেই। আমি একাই বাঁচতে পারব পুরুষ ছাড়া।”

শুদ্ধ তা শুনতে পেল না। আরও একবার চিৎকার করে উঠল, “আপনাকে আমার চোখ-ভাঙা ঘুমে সকালের চা হিসেবে চাই, রোজ চাই।”

_______
ক্যাম্পাসের পুকুরপাড়ে প্রাপ্তিকে বসে থাকতে দেখে শুদ্ধ এগিয়ে গেল। মুচকি হেসে বসল প্রাপ্তির পাশেই। প্রাপ্তির উলটো দিক থেকে রোদ এসে লাগল শুদ্ধর গায়ে। চোখ-মুখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “কীরে! এখানে কী করছিস? ক্লাস হচ্ছে তো!”

প্রাপ্তি শুদ্ধর চোখের অর্ধাংশ রোদে ঝলমল করতে দেখে একটু ডানে ঝুঁকে বসল। খেয়াল করল এখন আর শুদ্ধর মুখে রোদ লাগছে না, কোঁচকানো চেহারা সোজা হয়েছে। তা দেখে আনমনে হেসে বলল, “তুই দেরি করলি কেন এত? একা ক্লাস করতে ভালো লাগছিল না, তাই এখানে বসে ছিলাম।”

“কেন? তুহিন কই?”

“আসেনি আজ। আঙ্কেল ধরে নিয়ে অফিসে বসিয়ে দিয়েছে। বেচারা কাজে ব্যস্ত।”

“তুই আজ এত সুন্দর করে কথা বলছিস কেন? কয়টা ভর করল?”

প্রাপ্তি পুকুরের দিকে দৃষ্টিপাত করে ভ্রু কুঁচকে অধর কোনে হাসি রেখে বলল, “একটা ধরেছে; সেই কলেজ লাইফ থেকেই।”

“বলিস কী! নাম?”

“শুদ্ধ জিন সাহেব!”—বলেই প্রাপ্তি সোজা ঘাসের উপর সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে হাসতে লাগল। যেই সেই হাসি নয়, সেই হাসি থামারও নয়। শুদ্ধ প্রাপ্তির কথাটা কৌতুক হিসেবেই নিল। ঘাসের উপর হাতের কনুইয়ের ভর দিয়ে, সেই হাতে মাথা ঠেকিয়ে হেলে শুয়ে পড়ল ঘাসের উপর। প্রাপ্তির থেকে অনেকটা দূরেই আছে। প্রাপ্তির হাসি থামছে না। চোখের কোনে পানি জমা হয়েছে। সেই জমাটবাঁধা অশ্রু নিয়ে আড়চোখে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর অপ্রেমের খবর কী?”

“ধুর শালি! তোর গোড়াতেই গলদ! একে তো অপ্রেম বললি, তার উপর আবার খবর চাইলি! অপ্রেমের খবর কেমন হয়, জানা নয় তোর?”

প্রাপ্তি কিছু না বলে উঠে বসল। আসন করে বসল শুদ্ধর দিকে ঘুরে। শুধাল, “ম্যাম ঢাকা থেকে এই শহরে ট্রান্সফার করল কেন? বলতে গেলে এই শহরে তো তার কেউই নেই!”

শুদ্ধ ঠোঁট উলটিয়ে বলল, “আমি কী জানি!”

প্রাপ্তি হাতের তর্জনী উঁচিয়ে শাসালো, “এই একদম মিথ্যা বলবি না। আমি জানি, তুই সব জানিস। না জেনে-বুঝে প্রেমে পড়লেও, প্রিয় নারীর ব্যাপারে কোনো বিষয় তুই অজানা রাখবি না। বিশেষ করে ম্যাম ডিভোর্সি জানার পর!”

শুদ্ধ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “ওহ্, জানিসই তাহলে!”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। এমনি এমনি তোর ফ্রেন্ড হইনি আমি।”

“বুঝেছি!”

“এবার বল।”

“কী?”

“ম্যামের ব্যাপারে!”

“এত আগ্রহ কেন?”

“আরে তুই কীভাবে এত কথা খুঁজে বের করলি, বলিসনি আমাদের। এখন বল। কিউরিওসিটি বলেও তো কিছু আছে, রাইট?”

“হ্যাঁ, আছে।”

“বল।”

“আচ্ছা, শোন।”

“হুঁ।”

“ম্যামের ম্যারিড জানার পর ওই যে অসুস্থ ছিলাম না কিছুদিন?”

“হুঁ।”

“৮ দিন পর হসপিটাল থেকে বাসায় এসেই দাদাইকে কল দিয়েছিলাম। দাদাইয়ের সাথে আমাদের ভার্সিটির প্রিন্সিপালের সম্পর্ক ভালো, ভীষণ ভালো। দাদাইকে ভঙচঙ বুঝিয়ে ম্যামের ইনফো কালেক্ট করি। কিন্তু তা পুরোটাই আকাম ছিল। তেমন আহামরি কিচ্ছু ছিল না ওতে। তাই ম্যামের কলেজে চলে যাই; যেটা ঢাকায়। কলেজে ম্যামের ব্যাচের ছবি-টবি খুঁজতে থাকি। ম্যামকে চিনতে অবশ্য অনেক বেগ পোহাতে হয়েছিল। চিনতেই, গ্রুপ ফোটোগুলোতে ম্যামের আশে-পাশে যারা যারা ছিল, তাদেরকে খোঁজার চেষ্টা করেছি। সৌভাগ্যবশত তন্মধ্যে একজন ছিল সেই কলেজেরই লেকচারার। উনি আমাকে তনুজা ম্যামের বেস্ট ফ্রেন্ডের এড্রেস জোগার করে দেন। দুইদিনে এসব করি। ৩য় দিনে মিসেস শিখা.. আই মিন ম্যামের বেস্ট ফ্রেন্ডের বাসায় যাই। উনি প্রথমে কিচ্ছু বলতে চাননি। তারপর চলে এসেছি। শেষমেষ দাদাইয়ের পাওয়ারের ইউজ করেছি; যেটা এই অবধি কোনোদিন করিনি! ফাইনালি উনি বলেছেন।”

“কী করেছিস?”
প্রাপ্তি চোখ ছোটো ছোটো করে শুধাল। শুদ্ধ মিহি হেসে চোখের পাতা ঝাপটিয়ে বলল, “সিক্রেট!”

“আচ্ছা! কী জানলি সেটা তো বল!”

“ওটাও সিক্রেট! ম্যামের সিক্রেটগুলো এখন থেকে আমারও সিক্রেট! খুব যত্নে বুকের গভীরে পুষব; রহস্যময়ী পাষণ্ডীর রহস্য কেউ ভেদ যাতে করতে না পারে।”

প্রাপ্তি মুঝ ভেঙচি কেটে ব্যাগ নিয়ে উঠে পড়ল। তারপর সোজা হেঁটে ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিংয়ের দিকে এগোল।
শুদ্ধ সোজা হয়ে সেখানটাতেই ঘাসের উপর শুয়ে রইল। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল। ভাবতে লাগল প্রিয় নারীকে। কী স্নিগ্ধ সে! কী স্নিগ্ধ সে নারীর চক্ষু-দৃষ্টি, ওষ্ঠ-হাসি! এত মায়া তাতে না থাকলেও তো হতো!
বন্ধরত চোখ খুলল সময় নিয়ে। দেখতে পেল শরতের আকাশে ভাসমান টুকরো টুকরো মেঘ কুচি। সেখানটাতেই শুদ্ধর অর্ধ-অচেতন মস্তিষ্ক আঁকতে লাগল তাকে। একটা ফুল হাতে নিয়ে তনুজা শীতলপাটি বিছিয়ে বসে আছে। শুদ্ধ তনুজার বিনুনি গাঁথা চুলের ভাঁজে ভাঁজে একটা করে ফুল গেঁথে দিচ্ছে।

_______
ওই গুনগুন সুরে মন হাসে না!
জানি ফাগুন আমার ভালোবাসে না!
তারে বলে দিয়ো—সে যেন, আসে না!
আমার দ্বারে!
তারে বলে দিয়ো..

তনুজা আজ ক্লাসে পুরো দশ মিনিট লেট। এই নিয়ে শুদ্ধর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। ক্লাসরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল ক্রমাগত। দেখতে পাচ্ছে না কাউকেই। ঠিক আর কিছুক্ষণ বাদে সিঁড়ির ধারে তনুজার দেখা পেল। শুদ্ধ লুকিয়ে গেল। হাতে পুকুরপাড়ের কৃষ্ণচূড়া গাছের কিছু ভীষণ ছোটো ডাল রয়েছে। শিখা বলেছে, তনুজার প্রিয় ফুল কৃষ্ণচূড়া। মনে পড়তেই সেখান থেকে একটা পাপড়ি ছিঁড়ে সিঁড়িতে ফেলল। এভাবেই করিডোরে ফেলতে ফেলতে ক্লাসের দিকে এগোল। কারো নজরে এলো না বিষয়টা। ধরতে গেলে, সবাই ভাববে—শুদ্ধ আনমনেই এটা ফেলেছে।

এভাবেই ক্লাসরুমের ধারে গেল। সাথের দেয়ালে একটা ফুল স্কচটেপ দিয়ে লাগাল। সেই স্কচটেপের উপর রেড মার্কার দিয়ে লিখল, “তি আমো!”

তারপর হেসে ক্লাসে চলে গেল। সামনে থেকে ব্যাগটা নিয়ে একদম লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসল। তনুজা এসে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে লেকচার দিতে শুরু করল। শুদ্ধ জানালা দিয়ে বাইরে খেয়াল করে দেখল, ফুলসহ স্কচটেপটা ওখানে লাগানো নেই। বিক্ষিপ্ত নজরে সেটা খুঁজতে লাগল। দৃষ্টি স্থির হলো করিডোরের ফ্লোরে। ছেঁড়া স্কচটেপের সাথে মোচড়ানো ফুল দেখে হেসে ফেলল মোহময় হাসির শুদ্ধপুরুষ।

এরপর কী যেন মনে করে, হাতের কৃষ্ণচূড়ার একটা পাপড়ি নিজের কানে গুঁজল। গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইল তনুজার দিকে। একদম নিষ্পলক। কোঁকড়ানো চুল, ঘোর লাগানো দৃষ্টি, গালে হাত, অধর কোনে লেপটানো অনিমন্ত্রিত হাসি—তনুজা চেয়েও এড়াতে পারল না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোর্ডের এক কোণায় ব্লু মার্কার দিয়ে লিখল, “Mppl bxbz!”

তারপর আবার পড়ানো শুরু করল। ক্লাসের কেউই এই সংকেতের মানে বুঝল না, যেটা শুদ্ধ বুঝতে সময় নিল না। তৎক্ষনাৎ ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করল। একটা পেইজে বেশ বড়ো বড়ো করে লিখল, “J dbo opu!!”

এরপর ওটা নিজের মুখের সামনে এনে ধরল। তনুজা দেখেই চোখ সরিয়ে ফেলল। সে হতাশ! ভীষণ হতাশ! এই ছেলেটা এত ধুরন্ধর না! সে একটি ইংরেজি বাক্যের সব অ্যালফাবেটের স্থান পরিবর্তন করে পরবর্তী অ্যালফাবেটের জায়গা দিলো। এভাবে এক সাংকেতিক বাক্য তৈরি করল। শুদ্ধ সেই ধরন অনুসরণ করেই পরবর্তী বাক্য বোঝাল, অর্থাৎ, “I can not!!”

পরপরই শুদ্ধ আবার আরেকটা কাগজ মাথার উপর রাখল। তাতে লেখা, “আই লাভ ইউ মোর, মোর অ্যান্ড মোর দ্যান মাই গিটার, অলকানন্দা।”

তাৎক্ষণিক ভাবে কাগজটি নিচে রেখে দিলো। তনুজা এক ঝলক দেখেই চোখ সরিয়ে নিল। পুরো ভরা ক্লাসের মধ্যে একজন বাদে তাদের এই লুকোচুরি কেউ দেখল না, কারো নজরে পড়ল না। সেই একজনটা প্রাপ্তি! প্রাপ্তির ঠোঁটের কোনেও হাসি।

চলবে..

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৭ (পত্র-পরিণতি)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“মামা, মাস কয়েক আগেই জানতে পারি—আমি আর কখনও মা হতে পারব না। চেকআপের পর দেখা যায়—সব কম্পলিকেশন আমার মধ্যে। জরায়ুর সমস্যার জন্য আমি কনসিভ করতে পারছি না; ডাক্তার বলেছে পারবও না। সে-রাতে আমি প্রচুর কেঁদেছি। সাহারা হিসেবে কারো কাঁধ পাইনি। বুকটা ফেঁটে যাচ্ছিল আমার। বন্ধ্যাত্ব একটা নারীর জীবনে সত্যিই অভিশাপস্বরূপ। আমি ভেঙে পড়েছিলাম খুব।
সিদ্দিক নিজেও এসব জেনে হতাশ, আমাকে কী স্বান্তনা দেবে? সে ইদানিং বাসায় খুব দেরিতে আসে। এসেও আমার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। ও আমার কম্পলিকেশনের ব্যাপারটা মা-বাবাকে জানাতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু, এত বড়ো কথা আমি না-জানিয়ে পারিনি। পরদিন বিকেলে মা-কে বলে দিই। এরপর যা হবার হলো। এখন তারাও আমার সাথে কথা বলে না। প্রথমে খুব হা-হুতাশ করলেও, এখন কিচ্ছু বলে না। তবে বিরক্ত হয় প্রচণ্ড। আমাকে দেখলেই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। আকারে-ইঙ্গিতে কত কিছুই বোঝায়!

সেদিন বিকেলে বাসায় ঘটক এলো। ভেবেছিলাম সিঁথি আপুর জন্য। পরে খেয়াল করি, ঘটক পাত্রীর ডিটেইলস বলছে। বুঝতে পারি, আমার উপস্থিতিতেই আমার বরের জন্য মেয়ের সন্ধান করা হচ্ছে। আমি কিচ্ছু বলতে পারিনি। মাথা নিচু করে প্রস্থান ঘটিয়েছে। মা দিনকে দিন আমার প্রতি রূঢ় হতে লাগলেন। আগে এই বাড়িতে যা-ও থাকতে পারতাম। এখন একদমই পারি না।

ঘটনাটা গত পরশু সিদ্দিককে অফিস থেকে ফেরার পর জানাই। ও তেতে ওঠে। আমাকে বলে, ‘জানাতে নিষেধ করেছিলাম না? আমার কথা তো শুনলে না। এবার তাদের কথাই শোনো!’

আমার থুতনি গিয়ে বুকে ঠেকে। ও-বাড়িতে ধীরে ধীরে আমার মাথা নিচু হতে লাগে। আমি যেন একটা বোঝা বই কিছুই না। বিষয়টা নিয়ে সিদ্দিককে কী বলব? ও কী বলবে? আমার আর বলার কিছুই নেই। সিদ্দিকও তো এখন আর আমার হয়ে নেই। সে ঝুঁকেছে অন্যত্র।”

“এক মিনিট! সিদ্দিকের ব্যাপারটা ক্লিয়ার করো।”
শফিক সাহেব এতক্ষণ শান্ত হয়ে ভাগ্নির কথা শুনছিলেন। তার মনের কোথাও একটা সিদ্দিকের প্রতি আস্থা ছিল, যেটা মাত্র বলা তনুজার কথাটিতে নড়বড়ে হয়ে গেল। তাই পুনরায় নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করল।

তনুজা শাড়ির প্রান্তদেশ দিয়ে চোখের পানি মুছে নিয়ে আবার বলা শুরু করল, “আশামণি! সিদ্দিকের কলেজ ফ্রেন্ড ছিল। এক সময় ওদের মধ্যে সম্পর্কও শুরু হয়। তারপর আশা আপুর বিয়ে হয়ে যায়। সিদ্দিক কিছুদিন আপসেট থাকলেও, এরপর নিজেকে গুছিয়ে নেয়। আমাদের বিয়ের পরের বছর, সিদ্দিকের সাথে ওর অফিসেই আশা আপুর দেখা হয়; নিউ এমপ্লয়ী হিসেবে। সিদ্দিকের আন্ডারেই কাজ করে প্রথম তিন মাস। এরপর প্রোমশন পেয়ে যায়। ধীরে ধীরে পুরোনো প্রেম আবার জাগতে থাকে!”

ঘৃণায় মুখ লুকোয় তনুজা। শফিক শাহেব শুধালেন, “সিদ্দিকের যে আগে একটা সম্পর্ক ছিল, এটা কার কাছ থেকে জানতে পেরেছ? মানে, কে বলেছে?”

“সিদ্দিক বলেছে।”

“ও নিজেই?”

“হুম।”

“আচ্ছা। আর এই-যে, সিদ্দিকের সাথে আশার আবার দেখা হওয়াটা, এটা কীভাবে জানলে?”

“এটাও সিদ্দিক বলেছে।”

“প্রেমের বিষয়টাও?”

“না না, এটা না।”

“তবে এটা কী করে জানলে?”

“যেদিন চেকআপে গিয়েছিলাম, সেদিন আমাকে হসপিটালে নিয়ে যেতেই ওর ফোনে একটা কল আসে। ৫ মিনিট পর কথা বলে এসে আমাকে বলে, ওর যেতে হবে। খুব দরকার নাকি!
আমি আটকাইনি। তবে আমার চেয়েও জরুরি ওর জন্য কিছু আছে যে, এটাই ভাবতে পারছিলাম না। সিদ্দিক বেরোতে বেরোতে আমাকে বলল, ফেরার সময় ও নিয়ে যাবে। আর আসতে না পারলে সিঁথি আপুকে পাঠিয়ে দেবে।
আম শুধু মাথা নাড়লাম। সিদ্দিক বেরিয়ে গেল। যাবার আগে ভুলে ভালে নিজের ফোনটা রেখে গেল। কৌতুহলবশত ফোনটা ধরতেই দেখতে পাই, নোটিফিকেশন প্যানেলে একটা ম্যাসেজ। লেখা, ‘জলদি এসো, আবরার।’
ম্যাসেজটা পাঠিয়েছে, ‘আশা।’
আমি মন খারাপ করে ফেলি। অত কিছু বুঝিনি তখনও। কেবল বুঝেছিলাম, সিদ্দিকের লাইফে আমার চেয়েও ইম্পর্ট্যান্ট কিছু আছে।”

“ওয়েট! আশার না বিয়ে হয়ে গিয়েছিল?”

“হুম, তবে টেকেনি। বছর ছয়েক আগেই ডিভোর্স হয়েছে।”

“এটাও সিদ্দিক বলেছে?”

“হ্যাঁ।”

“সব কথাই তো বলে। তবে পরকীয়ার বিষয়টা লুকোল কেন?”

“মামা, এই ওয়ার্ডটা স্কিপ করুন। খুব বিশ্রী শোনায়।”

“আচ্ছা। তো এই গোপন বিষয়টা জানলে কবে?”

“জানলাম, কদিন পরেই। আমি একদিন লুকিয়ে সিদ্দিকের ফোনের লক দেখে নিই। এরপর আরেকদিন ফোন চেক করি।”

“বিষয়টা একদমই ঠিক না। যাকে বিশ্বাস করো, তাকে সবটা দিয়েই বিশ্বাস করা উচিত। সেই বিশ্বাসে এইটুকু পরিমাণ খুঁত থাকলে, সম্পর্কের চরম অধঃপতন হয়। এক্সাম্পল তুমি নিজেই!”

তনুজা মিনমিনে স্বরে বলল, “কী করব বলুন? আমার মাথা ঠিক ছিল না। নিজের অস্তিত্বের উপর থেকেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিলাম আমি। কিন্তু সন্দেহটা বৃথা ছিল না।”

“কী দেখেছিলে ফোনে?”

“দেখেছিলাম, আশার সাথে আমার বিষয় নিয়ে সিদ্দিকের ক্ষোভগুলো। দেখেছিলাম, কীভাবে ওই আশা আমার বরকে স্বান্তনা দেয়, হুটহাট নিজের ফ্ল্যাটে ডাকে, আমার খুঁতগুলো চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেয়। তারপর দেখলাম, সে কীভাবে আমার বরকে ধীরে ধীরে আমার থেকে দূর করতে লাগে!”

“তুমি শিওর? এমনও তো হতে পারে, যা দেখেছ তা ভুল ছিল!”

“না। ভুল না, ভুল না। আমি ঠিক দেখেছি, ঠিক বুঝেছি। আমার সিদ্দিককে তো আমি চিনি। এই সিদ্দিক আমার সিদ্দিক নয়। ও অনেক পালটে গেছে। আপনাকে আমি বোঝাতে পারব না খুলে।”

কথাটা বলতে বলতে দুহাতে নিজের চুলগুলো মুচড়ে ধরল। শফিক সাহেব প্রিয় বোনের একমাত্র মেয়ের এই দশা মেনে নিতে পারছেন না। বহুবছর পর সে তনুজার খোঁজ পেয়েছে। বোন তো সেই দুই যুগ আগেই একজনের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। প্রথমে বাড়ির কেউ মেনে নেয়নি। এরপর যখন পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়, তখন আর তনুজার মায়ের খোঁজ পায়নি। পাবে কী করে? ততদিনে সে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে গিয়েছে। এরপর, এত বছর পর, শফিক সাহেব বোনের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন। জানতে পারেন বোনের স্বামীর অকাল মৃত্যু, বোনঝির অবস্থা। তারপরই তনুজার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। অতীতের বিষয়গুলো খুলে জানান। তনুজা আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে দেয়। এরপর একে একে নিজের জীবনের সব ঘটনা তুলে ধরে।

এই পর্যায়ে এসে শফিক সাহেব ক্রন্দনরত তনুজার মাথায় হাত রেখে বলল, “তুমি যা চাইবে, তাই হবে।”

তনুজা মাথা তুলে অশ্রুসজল নয়নে তাকাল। কান্না গিলে নিয়ে শক্ত হয়ে বসল, কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে দৃঢ় মনোবল নিয়ে বলে উঠল, “ডিভোর্স চাই!”

_______
পৃথিবীতে কিছু ধরনের মানুষ থাকে, যারা খুবই নির্লিপ্ত, খুবই ধৈর্যশীল; তাদের সহজে রাগ লাগে না, রাগ ঝারে না, কান্না তো মোটেই করে না, তবে ভালোবাসে অফুরন্ত। কিন্তু, সেই ভালোবাসাটাও তার প্রাপ্ত মানুষটির একটি মাত্র ভুলের জন্য নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। প্রচণ্ড ভালোবাসা হুট করেই শূন্যের কোঠায় নেমে যেতে পারে। ধীরে ধীরে সেই মানুষটি হয়ে যেতে পারে ইস্পাতের ন্যায় কঠিন। আবেগ-অনুভূতি থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে বের করে ফেলতে পারে। তারা মৃত নয়, তারা কেবল বেঁচে থাকে। বাঁচার জন্য বেঁচে থাকে, ভালো থাকার জন্য নয়।

তেমনই একজন শক্ত-পোক্ত পুরুষ হচ্ছে আজওয়াদ আবরার সিদ্দিক। গায়ের গরন বেশ আকর্ষনীয়। তার চেয়েও বেশি টান আছে তার দৃঢ়-কঠিন ঘোলাটে দৃষ্টি, অকম্পিত আওয়াজ, ইস্পাত-কঠিন নার্ভস আর রূঢ়ভাষী স্বভাবটায়!
হাত বাড়িয়ে অতিপ্রিয় তেতো কফির কাপটা তুলে চুমুক দিলো, দৃষ্টি সামনের ফাইলেই; সবটায় নজর বুলিয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময় কেবিনে নক করল একজন স্টাফ।

কাঁপা কণ্ঠে কান্তা শুধাল, “মে আই কাম ইন, স্যার?”

সিদ্দিক দৃষ্টি সরাল খানিকটা। কান্তার দিকে তাকিয়ে, ঠোঁটের ভাঁজ হালকা নেড়ে বলল, “ইয়েস্!”

সে কথার শব্দ হলো না। তবে কান্তা বুঝতে পারল, সিদ্দিকের ইতিবাচকতা। সিদ্দিক আর কিছু না বলে আবারও দৃষ্টি ফাইলের মাঝে আঁটকে ফেলল। অনুমতি পেয়ে কান্তা জলদি ভেতরে এসে গেল। সিদ্দিককে সে অকারণেই ভয় পায়। যেভাবে তাকায় না, যেন একেবারে জানে মেরে দেবে! সেই ভয় থেকেই হাতের এনভেলপটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “স্যার! আপনার লেটার এসছে!”

সিদ্দিক না তাকিয়ে আস্তে-ধীরে বলল, “জাস্ট লিভ ইট হেয়ার।”

কান্তা সিদ্দিকের সামনে এনভেলপটা রেখে ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। সিদ্দিক সময় নিল। হাতের কাজ শেষ দিয়ে, এনভেলপটা হাতে নিল। এনভেলপের গাঁ থেকে ভেসে আসছে এক চিরপরিচিত শুকনো বকুলের সুবাস। সিদ্দিক প্রাণ ভরে সুবাসটা টেনে নিল।
এরপর গিয়ে দাঁড়াল জানালার সামনে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করল। একটা সিগারেট ঠোঁটের ভাঁজে গুঁজে নিল। দুইবার টান দিয়ে সিগারেটটি হাতের দুই আঙ্গুলের ভাঁজে রেখে বাইরে তাকিয়ে রইল। এরপর ফিরে তাকাল এনভেলপের দিকে।

বেশ কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল, দেখা যেন শেষ হয় না। এরপরই লাইটার দিয়ে এনভেলপের এক মাথায় আগুন জ্বালিয়ে সেটা শেষ অবধি জ্বলার আগ পর্যন্ত হাতে ধরে রাখল। তাপ শরীরে মাত্রাতিরিক্ত স্পর্শ করলে সে অর্ধ-ভস্ম হওয়া এনভেলপটি বিনে ফেলে দিলো। পুড়ে সম্পূর্ণটা ছাঁই হওয়া নাগাদ তাকিয়ে রইল, একদৃষ্টে। ছাঁই হওয়ার পরও দেখে গেল। তারপর শেষ করল আরও তিনটে সিগারেট।

এই ছাঁই দেখলে সিদ্দিকের শরীরের রক্ত গরম হতে থাকে, মস্তিষ্ক অশান্ত হয়ে যেতে লাগে। বিগত ৭ বছরের প্রথমটি বাদে বাকি ৬টি চিঠি সিদ্দিক এভাবেই পুড়িয়েছে। তবুও যেন আশ মেটে না। প্রতিবারের মতো আজও বলে উঠল, “ভাগ্যিস! তুই এখানে নেই, তনু! নয়তো এই ৬টা চিঠি দেওয়ার সাধ্য তোর হতো না। প্রথম বারেই আমার উপকারার্থে বাপের কাছে চলে যেতিস! এই চিঠির জায়গায় তুই হতিস!”

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে