অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব-১০+১১

0
910

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১০ (অলকানন্দা ফুল)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“এভাবেই এক নন্দিনীর রূপের আগুনে ঝলসে যাচ্ছি। আমার এ-রাস্তাটা সহজ হোক!”
কথাটা শুদ্ধ এতটাই আস্তে বলেছিল যে, তনুজার কান অবধি পৌঁছায়নি। তনুজা শোনার আগ্রহও দেখায়নি। এদিকে হেলমেটের আড়ালে শুদ্ধর ওষ্ঠ যে কতটা প্রসারিত হয়েছে, তা-ও তনুজা লক্ষ করল না।

চলো এখনো সময় আছে, বেরিয়ে পড়ি, ফেলে রেখে সব পিছু টান।
ঝাড়া হাত-পা নিয়ে চলো যাই পেরিয়ে, সব বাঁধা সব ব্যবধান…
শুধু চলার জন্য চলা যাক না, ভুলে গিয়ে গন্তব্য।
আমি আমার পথের গান গাইছি, তুমি তোমার গানটা ধরো তো।
এই পথ যদি না শেষ হয়,
তবে কেমন হতো তুমি বলো তো!
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়,
তবে কেমন হতো তুমি বলো তো!

শুদ্ধর মস্তিষ্কে খুব সুন্দর ভাবে এই গানটা বেজে চলেছে। বেজে চলেছে অনেক অসম্ভাব্য ইচ্ছে। তার মধ্যে একটি খুব বেশিই হচ্ছে—এই রাস্তার মাঝে হাঁটু মুড়ে, দু-হাত ছড়িয়ে তনুজাকে বলতে, “ভালোবাসি, মিস. তনুজা। আপনাকে বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসি।”

নিজের ভাবনার উপর হাসল শুদ্ধ। আর কথা না বলে তনুজাকে তার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিলো। তনুজা বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল। শুদ্ধ খেয়াল করল—তনুজা তাকিয়ে আছে। শুদ্ধও তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবল—তনুজা বোধহয় এখন কৃতজ্ঞতা থেকে একবার ‘থ্যাংক ইউ’ বলবে। কেন বলবে না? এটা তো জেনারেল নোলেজ! কেউ উপকার করলে, তাকে ধন্যবাদটা অবশ্যই জানাতে হয়।

কিন্তু শুদ্ধর সে-গুড়ে বালি। তনুজা বলে উঠল, ‘ইয়ে, বাড়ি গিয়ে শার্টটা ধুয়ে দিয়ো।’

শুদ্ধ কপাল কুঁচকে ফেলল। মুখ দিয়ে বেরোল কেবল একটিই শব্দ, “কেন?”

এর উত্তর দিলো না তনুজা। পিছু মুড়ে সোজা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে গেল। শুদ্ধ অবুঝ হয়ে তাকিয়ে রইল। বিরবির করে বলল, “যাহ! একটা থ্যাংক্সও বলল না! তা রেখে শার্ট ধুতে বলল! কেন?”

পরপরই বাইক স্টার্ট দিয়ে নিজের বাড়ির রাস্তা ধরল। আস্তে-ধীরে নিজমনে বলতে লাগল, “নারীজাতি রহস্যময়ী। শাওনের ভাষায় প্যাচাইল্যা।”

______
কলিং বেল চাপছে মিনিট দশেক ধরে। অথচ শাওন দরজা খুলছে না। পকেটে এক্সট্রা কী-ও নেই; সকালে তাড়াহুড়োতে বাসায়ই রেখে গিয়েছিল। ফোন হাতে নিয়ে কল লাগাল শাওনকে। সঙ্গে সঙ্গে সে রিসিভ করল, মুখে হাসি নিয়ে শাওন বলল, “ক, ব্যাটা। কই তুই? আসবি না?”

শুদ্ধ শান্ত থেকে বলল, “তুই কই?”

আড়মোড়া ভাঙল শাওন, “এই তো, ক্যাট্রিনার গান শুনতাছি আর লাফাইতাছি।”

“হেডফোনে?”

“হ। দেখলি কেমনে? ক্যামেরা লাগাইছোসনি?”

শুদ্ধ চাপা শ্বাস ফেলে বলল, “আজাইরা কথা শেষ হলে দরজাটা খুলে দে।”

“ক্যা লো? আইছোসনি? নাকি আমারে এখন আমার কিটিক্যাট থেকে দূর করার ধান্দা, দুষ্টুউউউ?”

শেষ সম্বোধনটা শাওন দুষ্টুভাবে হেসে বলল। শুদ্ধ দুষ্টুমির মুডে নেই। শুধু বলল, “দশ সেকেন্ড দিলাম। দরজা খুলতে যত সেকেন্ড দেরি হবে, পেছনে ঠিক ততগুলাই লাথি খাবি।”

শাওন বুঝল। হেডফোন খুলে, এক দৌড়ে এসে দরজা খুলল। সে জানে, শুদ্ধ এটা এমনিই বলেনি। এর আগেও তো বলেছে। দেরি করায় লাথিও খেয়েছে। গুনে গুনে ঠিক ততটাই, যত সেকেন্ড দেরি করেছে।

দরজা খুলে শুদ্ধকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাওন দাঁত কেলিয়ে হাসল, “বন্ধু, ভালা আছ?”

শুদ্ধ শাওনের দিকে একটা বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। লিভিং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে শুদ্ধ চোখ বন্ধ করে ফেলল। শাওন খুশি মনে বলল, “মামা, আজ তো মনটা এক্কেরে ফুরফুরা হইয়া আছে।”

শুদ্ধ তাকিয়ে বলল, “কেন, কী হইছে?”

“আরে! দিশার বিয়া। মাইয়াডারে দুইদিন ডেট করছিলাম, তারপর এমনভাবে পিছে পড়ছিল, আর ছাড়ার নামই নেয় নাই। কী একটা সমস্যায় পড়ছিলাম, জানিসই তো! আজ কল দিয়া কয়, ‘শাওন, তুমি খুশি তো? আর জ্বালাব না। কার্ড পাঠিয়ে দিচ্ছি। বিয়েতে এসো।’ তারপর থেকে আমি আমার ক্যাটের গানে ঝিঙ্গালালা ঝিঙ্গালালা নাচতাছি, ভাইইইই।”

শুদ্ধ বলল, “মেয়েটা তোকে ভালোবাসত। একটা চান্স দিলেই পারতিস!”

“হুরু, ব্যাটা! তুই জানিস না? আমার ওসব সিরিয়াস রিলেশন-টিলেশনে পোষায় না। দিশা তো জানতই, আর জাইনাই আসছিল। তাইলে?”

“মেয়েটা যে কষ্ট পেল? কাউকে কষ্ট দিয়ে কি ভালো থাকা যায়?”

শাওন হাসল। অধরকোনে হাসির রেশ রেখে কিছু সময় বাদে বলল, “আমি অভিশাপ কুড়াতে ভালোবাসি। ভালো থাকতে ঠিক ভালো লাগে না রে।”

শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে শাওনের কাঁধে চাপর দিয়ে বলল, “সেন্টি খাস না, প্লেট ভরে ভাত খা। রান্না করে গেছে?”

“না, আসেই নাই।”

“হুরু! মা যে কেমন হেল্পিং হ্যান্ড রেখে গেল! একদিন আসে; দেন, এরপরের সাতদিন আসে না।”

শাওন হাসতে হাসতে বলল, “চেতিস না। চেতলে তোরে হেব্বি সুন্দর লাগে৷ আর এখানে ইম্প্রেস করার মতো কোনো গোরু নাই।”

শুদ্ধ আড়চোখে তাকিয়ে বলল, “ক্যান? তুই আছিস না?”

শাওন ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, “ওহ্! আমারে পটাইতে চাস, আগে কইলেই হইতো! আমি তো, ইয়ে মানে, বেইবিইই!”

শুদ্ধ কুশনটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “ছিঃ! অশ্লীল!”

শাওন হেসে দিলো, শুদ্ধও হাসতে লাগল। তারপর বলল, “ফ্রেশ হয়ে আসি, এরপর দুজন মিলে রান্নাটা সেরে ফেলব।”

“আচ্ছা, যা। আমি পেয়াজ কাটতে থাকি ততক্ষণে।”

“হুঁ, সাবধানে। হাত যেন না কাটে।”

শাওন মাথা নাড়ল, বোঝাল—সাবধানেই কাজ করবে। শুদ্ধ হেসে উঠে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগল। শাওন ফোনের স্ক্রিন আনলোক করতে করতে শুদ্ধর দিকে তাকাল। মুহূর্তেই কপাল কুঁচকে এলো। উচ্চস্বরে বলে উঠল, “ওরেএএএএ! পিঠে সিল মারল ক্যারা?”

শুদ্ধ পিছু মুড়ল, না বুঝে শাওনকে জিজ্ঞেস করল, “কী?”

শাওন চোখ ছোটো ছোটো করে বলল, “শার্ট খোল।”

শুদ্ধর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে এলো, “কী বলিস! মাথা ঠিক আছে? শালা, অসভ্য!”

শাওন চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “যার মনে যা, ফাল দিয়া ওঠে তা। বাল, শার্ট খোল। পিছে কোন মাইয়ারে নিয়ে ঘুরছোস? সিল মাইরা দিছে, দ্যাখ।”

তৎক্ষনাৎ শুদ্ধর মনে পড়ল তনুজার সেই কথাটা, ‘বাড়ি গিয়ে শার্টটা ধুয়ে দিয়ো।’
কী হয়েছে—শুদ্ধর আর বুঝতে বাকি রইল না। বোকার মতো সেকেন্ড কয়েক দাঁড়িয়ে থেকে নিজের রুমে চলে গেল। দরজাটা ভালো করে আঁটকে শার্টটা খুলে ফেলল। সাদা শার্ট, তার মাঝে হালকা গোলাপি রঙের ঠোঁটের ছাপ। শুদ্ধ ডান হাতের তর্জনী দিয়ে জায়গাটা ছুঁয়ে দেখল। হাসল সে। এরপর অগুনতি শুষ্ক চুমু শেষে শার্টটা বুকে জড়িয়ে ধরল। বরাবরের মতোই সে তনুজার কথা শুনল না। শার্টটা সে ধুলো না। চরম যত্নে কাবার্ডের এক ড্রয়ারে রেখে দিলো। যেখানে একসময় এক নারীর খোঁপায় শোভা পাওয়া বেলি ফুলের শুকিয়ে যাওয়া মালাটা, ‘T’ অ্যালফাবেট দেওয়া একটা ব্রেসলেট, জোড়া ছাড়া মাঝারি আকারের একটা ঝুমকো, আর কিছু হেয়ার-ক্লিপস স্বযত্নে পড়ে আছে। শুদ্ধ ঠিক সেখানটাতেই নিজের শার্টটি রাখল। সে এই ড্রয়ারের একটা নাম দিয়েছে, ‘শান্তিকুঞ্জ’।

শুদ্ধ শাওয়ার নিয়ে কিচেনে গিয়ে দেখে, শাওন কান্না করছে। চোখ দিয়ে অনবরত জল ঝরছে। দরজায় দাঁড়িয়েই শুধাল, “কী হইছে রে?”

শাওন বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নাক টানতে টানতে বলল, “কিছু না। পানিটা চুলায় দে।”

শুদ্ধ দেখল—শাওন পেয়াজ কাটছে। বুঝতে পেরে মাত্র বেরিয়ে আসা হাসিটা চেপে নিল। মজা করার উদ্দেশ্যে বলল, “আহারে, সোনা গো আমার! ছ্যাকা খাইছো, জান? থাক, কান্না কইরো না। আমি আছি না, বাবু?”

শাওন কান্না করতে করতে হাতের ছুরিটা সামনে তুলে ধরে বলল, “বালডা, খুন হইবি রে তুই।”

শুদ্ধ হেসে ফেলল। তারপর শাওনকে বলল, “কী খাবি?”

শাওন বিরক্তি নিয়ে বলল, “এমন ভাব নিয়া কইতাছোস, যেন সব রান্না পারি। যা মন চায়, তাই খাওয়া যাইব!”

“আজকের জন্য ধরে নে, তাই।”

“কেমনে?”

শুদ্ধ নিজের ফোনটা দেখিয়ে বলল, “এমনে।”

“ওহ্! ইউটিউব কাকু?”

শুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে হাসল। ভেজা চুলগুলো দিয়ে টুপটুপ করে পানি ঝরছে। একহাত দিয়ে ওটা মুছে, অন্য হাত দিয়ে কন্ট্যাক্টে গিয়ে প্রিয় নম্বরটিতে কল লাগাল। শাওন দেখল, স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে একটা নাম, “অলকানন্দা ফুল”।

চলবে?

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১১ (লজ্জা!)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

ক’বার রিং হতেই কল রিসিভ হলো। শুদ্ধ স্পিকারে দিয়ে রাখল। তনুজা ওপাশ থেকে বলল, “কী হয়েছে? কল দিয়েছ কেন?”

শুদ্ধ কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলল, “ম্যাম, একটা হেল্প লাগবে।”

“কী হেল্প?”

“রান্না! আসলে খালা আসেনি আজ। তাই রান্না নেই বাসায়। বাইরের খাবার আমি খেতে পারি না। খুব বিপদে পড়ে আপনাকে কল দিয়েছি।”

“তো, তুমি কী ভেবেছ? আমি তোমাকে আমার বাসায় ডিনার ইনভাইটেশন দেবো?”

“দিলে অবশ্য মন্দ হতো না।”

“তোমার সে গুড়ে বালি। এক জগ পানি খেয়ে ঘুম দাও, রাখছি।”

“এই না না না না, রাখবেন না। আমি কল দিয়েছিলাম একটু রান্নায় হেল্প নেওয়ার জন্য।”

“ইউটিউব নেই?”

“আছে, কিন্তু ব্যাড এক্সপেরিয়েন্স আছে কি না! এককালে ভাত রাঁধতে গিয়ে দুধ ছাড়া চালের পায়েস রেঁধেছিলাম। সময়, খাবার, এনার্জি—সবটাই লস। সেই ভুল আবার রিপিট করতে চাইছি না।”

“তো তোমার মাকে কল দাও!”

“মা তাহলে কান্না শুরু করে দেবে আর সকাল হতেই এখানে চলে আসবে।”

“কেন?”

“বোঝেন না? পানিটা অবধি ভরে খেতে দিত না, মা। সেখানে রান্না!”

“বুঝেছি বুঝেছি! তা তোমার বান্ধবী আছে না? ওকে বলো!”

“কে? প্রাপ্তি?”

“হুম।”

“থাক! লাগবে না। আমি বরং রাতটা উপোস যাই। কী আর করার? ভাগ্য আমার। না খেয়েই থাকতে হবে।”

“হুম, রাখছি।”

শুদ্ধ এক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিল, ও এক পাষণ্ডীর সাথে কথা বলছে। যার কাছে ওর অনুভূতির মূল্য নেই, তাকেই মিছে অভিমান দেখাচ্ছে! গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্রিয়াশীল হলো, “ম্যাম, ম্যাম, ম্যাম! প্লিজ হেল্প মি। সেই যে সক্কালে খেয়েছিলাম। খিদেয় পেটটা চু চু করছে। ও ম্যাম, একটু হেল্প!”

ওপাশ থেকে সেকেন্ড পাঁচেকের নিস্তব্ধতা, তার পর তনুজার দ্বিধান্বিত স্বর, “আচ্ছা, কী হেল্প লাগবে—বলো।”

শুদ্ধ খুশি হলো। হাবভাব অন্তত তাই বোঝাল। সেভাবেই বলল, “ফ্রি আছেন?”

“আছি।”

“আচ্ছা।”
এটুকু বলে শাওনের দিকে তাকাল। শাওন মিটিমিটি হাসছে। শুদ্ধ কলটা মিউট করে শাওনের উদ্দেশ্যে হেসে বলল, “রুমে গিয়ে ঘুম দে, ইচ্ছে হলে নাচ দে। যা; রান্না হলে ডাকব।”

শাওন “ওকে, বস। ইনজয় ইওর কুকিং টাইম। টাট্টা!”

শাওন যেতেই শুদ্ধ আনমিউট করে বলল, “ম্যাম, ভিডিয়ো কলে এলে সুবিধার হতো না? কোনটা কী পরিমাণে নেওয়া লাগত আর কী! ভুল করলে দেখিয়ে দিতেন!”

“শুদ্ধ, আমি কল কাটব?”

“না, না। এভাবেই থাকুন। আমার এতেই হবে।”

শুদ্ধ ফোনটা লাউডে দিয়ে কিচেন কেবিনেটের উপর রেখে দিলো। তনুজা বলল, “কী খাবে?”

শুদ্ধ একটু ভেবে বলল, “খিচুড়ি, ফিশ ফ্রাই আর বিফ।”

“ফ্রোজেন মাছ আর মাংস বের করে রেখেছ?”

“জি, ঘন্টাখানেক আগেই বের করেছি।”

“গুড বয়, এবার ভালো মতো ধুয়ে নাও।”

“ধুয়েছি।”

“টুকরো করে কাটা আছে?”

“ছিল না, কেটেছি।”

“পেয়াজ-লঙ্কা কুচি করেছ?”

“করেছি।”

“ভেরি গুড। এবার..”

“ম্যাম, আপনার মুখের এই ‘গুড, ভেরি গুড’ আমাকে ডিস্ট্র‍্যাক্ট করছে।”

তনুজা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আব্.. একা খাবে, তাই না? চাল..”

“না না, আমি আর শাওন।”

“শাওন! ও?”

“আমরা একসাথেই থাকি।”

“ও আচ্ছা। ও রান্না পারে না?”

“পারে।”

“তো? আমাকে কল করলে কেন? ওকেই তো বলতে পারতে।”
এই পর্যায়ে কথাগুলো তনুজা বেশ জোরেশোরেই বলল। শুদ্ধ মাথার চুলগুলো চুলকে নিয়ে হেসে কেবিনেটের উপর দুই হাত রাখল। ফোনের দিকে হালকা একটু ঝুঁকে বলল, “ম্যাম, ওর গার্লফ্রেন্ডের কদিন পর বিয়ে। ছ্যাকা খেয়ে বেচারা দুঃখ বিলাস করছে। ওকে কীভাবে বলি রান্না করে দিতে, বলুন তো? আমি কি এতটা পাষণ্ড হতে পারি? না, ম্যাম। না। আমি মোটেও এতটা পাষাণ্ড হতে পারি না। তাই তাহাকে পূর্ণ বিশ্রাম করিতে দিয়া, আমি নৈশভোজের আয়োজনে ব্যস্ত হইয়াছি। বুঝিয়াছেন, শ্রদ্ধাস্পদেষু?”

তনুজা ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগল। ভেবে ভেবে বলল, “ঠিকাছে ঠিকাছে, দু-কাপ চাল নিয়ে নাও।”

এভাবেই তনুজা একে একে সবটা বলে গেল আর শুদ্ধ রেঁধে গেল। এমনটা নয় যে, শুদ্ধ রান্না পারে না। পারে; একটু বেশিই ভালো পারে। ছুটিতে বাড়ি গেলে শুদ্ধর হাতের রান্না খাওয়ার জন্য তার দাদিবু তো ভীষণ রকমের উতলা হয়ে যায়; ভালো রাঁধে কি না! এভাবেই একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী ছেলেটা প্রিয়তমার খাতিরে সেই বিষয়েই আনাড়িপনা করে ফেলে। কী অদ্ভুত!

রান্না হতে সময় লাগল, দেড় ঘন্টার বেশি। সবটা রেডি হতেই তনুজা বলল, “হয়েছে, এবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

“আচ্ছা। ম্যাম!”

“হুঁ?”

“কী করছেন?”

তনুজা স্বাভাবিকভাবেই বলল, “এখন তোমার কাজে সহায়তা করলাম।”

“এর আগে কী করছিলেন?”

“বই পড়ছিলাম, তোমার কল কাটার পরও তাই করব।”

“বাপরেহ! কী বই?”

“হুমায়ুন আহমেদ স্যারের—অপেক্ষা।”

“ম্যাম!”

“শুদ্ধ, তুমি এভাবে আমাকে কল দেবে না। এটা ঠিক নয়। আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে যাই। বিষয়টা আগের মতো থাকলেও হতো। কিন্তু তা নয়। তোমার সাথে আমি একটা অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। চাইলেও আর ফ্রীলি কথা বলতে পারব না; জড়তা থেকেই যায়। বোঝার চেষ্টা করো।”

“ম্যাম, স্যরি।”

“ইট’স ওকে, শুদ্ধ।”

“ইট’স নট ওকে, ম্যাম। আগে আপনি আমাকে আপনার দিকে তাকাতে দেখলে, সামান্য হাসতেন। রাস্তায় দেখা হলে নিজ থেকে এগিয়ে আসতেন কথা বলতে। মাঝে মাঝে ক্লাসেও মজা করতেন। আমার চুল নিয়ে মজা করতেন। ভালো লাগত এসব আমার খুব। কিন্তু ভালোলাগাটা থেকে কখন যে কী করে ফেললাম! নিজের পায়ে কুড়াল মারিনি, কুড়ালের উপর উঠে লাফিয়েছি! এখন চোট আমাকেই পেতে হলো।”

“এসব বোলো না। যা হওয়ার হয়েছে। পড়াশোনায় মন দাও। ক্যারিয়ারে ফোকাস করো।”

“ম্যাম, আপনি কি আমার সাথে আগের মতো নরমাল হবেন?”

“সম্ভব নয়। পুরো ক্যাম্পাসে অলরেডি তোমাকে-আমাকে নিয়ে কানাঘুঁষা চলে। এখানে আমি তোমাকে পাত্তা দিচ্ছি না বলেই, ব্যাপারটা সিরিয়াস পর্যায়ে পৌঁছোয়নি। স্টুডেন্টরা আমার কাছ থেকেও এই দিকে রেসপন্স পেলে..”

“রেসপন্স মিনস্ ইয়েস?”

“না। রেসপন্স বলতে বুঝিয়েছি—একে-অপরের সাথে আমার নরমাল হওয়াটাই। আমরা বাঙালি, শুদ্ধ। বাঙালিরা ‘স’ বললেই সমালোচনায় চলে যায়; অথচ ‘স’-তে যে ছোটো থেকে সিংহ শিখে এসেছি—তার খেয়াল থাকে না। বুঝলে?”

“বুঝেছি। তবুও, একটু.. মানে আমাকে দেখলেই এই-যে পালিয়ে যান! আমি বাঘ-ভাল্লুক নই, না?”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। পালাব না। কিন্তু ক্যাম্পাসে আর কোনোরূপ অশালীনতা করবে না।”

“ম্যাম, আমি অশালীনতা করি না।”

“হ্যাঁ, করো না, করবেও না।”

“আচ্ছা, রাতে খেয়েছেন?”

“হ্যাঁ, খেয়েছি। তুমিও খেয়ে নাও। রাখব আমি।”

“এখনই?”

এই পর্যায়ে তনুজা ধমকে উঠল, “তো সারারাত আমি তোমার সাথে প্রেমালাপ করব নাকি, বেয়াদব?”

শুদ্ধ হেসে দিলো। হেসে মাথা নেড়ে কিছু বলতে যাবে, ওমনিই তনুজার অজান্তে ক্যামেরা অন হয়ে গেল, সে তা বুঝল না। তনুজা বারান্দার বেতের সোফায় বসে ছিল। সামনের টি-টেবিলটিতে কিছু বইয়ের সাহায্যে ফোনটা দাঁড় করিয়ে রাখা। সে মাত্রই ফোনটা ওখানে রেখে বসেছে। আর রাখতে গিয়েই তো ভুলটা হলো!
শুদ্ধ খেয়াল করল—তনুজার পরনে জলপাই রঙা কুর্তা, সাদা পালাজো। চোখে মাইনাস পাওয়ারের গোল ফ্রেমের চশমা। চুলগুলো এলোমেলো ভাবে খোঁপা করা। সামনের ছোটো চুলগুলো উড়ছে। বাতাস বেশি না; সামান্য। কিছুক্ষণ আগে গিয়ে বানিয়ে আনা চা-টিতে একটা ছোট্টো চুমুক দিয়ে কাপটি টেবিলে রেখে আবারও কোলে রাখা বইয়ের দিকে তাকাল। হাতে একটা হাইলাইটার পেন। পড়তে পড়তে প্রিয় জায়গাগুলো হাইলাইট করার অভ্যেস আছে তার। এজন্য পেন না নিয়ে বসলে চলেই না।

পেন উঠিয়ে হাইলাইট করল বইয়ের এই লাইনগুলো, “মুক্তির আনন্দে মানুষ অনেক উদ্ভট কান্ডকারখানা করে।”

এটুকু পড়ে কিছু মনে পড়ায় হালকা করে হাসল তনুজা। কতদিন বাদে শুদ্ধ তনুজার হাসি দেখতে পেল; যেন হারিয়েই গেল! অনেকক্ষণ ধরে শুদ্ধর সাড়া না পেয়ে তনুজা ঠোঁটদুটো ভালো করে ভিজিয়ে চোখ দুটো বইয়ে স্থির করেই বলল, “ফোন রেখে দিলো নাকি ছেলেটা! কথা বলছে না যে!”

শুদ্ধ এতক্ষণে সংবিৎশক্তি ফিরে পেল। ডান হাত বুকের বাঁ পাশটা ডলে নিয়ে তনুজার উদ্দেশ্যে কেবল বলল, “মরণ নিশ্চিত!”

তনুজা বুঝল না। ফোনের দিকে চোখ গেল অসতর্কিতভাবে। হুট করেই স্ক্রিনে শুদ্ধকে দেখে তনুজা হতবাক হয়ে পড়ল। বিস্মিত দৃষ্টি স্ক্রিন জুড়ে। শুদ্ধ তা দেখে তার কোঁকড়ানো চুলগুলোয় হাত বোলাল। হাসি যেন মুখে আঁটে না! সেভাবেই অন্য হাত তুলে বলে উঠল, “হা-ই!”

তনুজা যতটা না বিস্মিত হয়েছে, তার চেয়েও বেশি লজ্জা পেয়েছে। খালি গায়ে শুদ্ধকে ওপাশে দাঁড়িয়ে বোকার মতো হাসতে দেখে তৎক্ষনাৎ তনুজার কপোলদ্বয় লাল হয়ে এসেছে। ইশ! এ-কেমন লজ্জা!

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে