#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১ (অপ্রেমের সূচনা)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
“তোমার লজ্জা করে না, নিজের চেয়ে বছর আটেকের বড়ো একটা মহিলাকে প্রপোজ করতে?”
শুদ্ধ হাঁটু গেড়ে দু’হাত ভর্তি সাদা চন্দ্রমল্লিকা ফুল এগিয়ে ধরে ছিল। তনুজার প্রশ্নে অধর প্রসারিত করে হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে বাঁ হাত দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো সামান্য চুলকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইল। তনুজার রাগ ততক্ষণে তুঙ্গে চড়ল। ফুলগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে আবার শুদ্ধের শুদ্ধতম মুখটিতে তাকাল। তবে, সেই মুখশ্রীর নিষ্পাপ মায়া তাকে স্পর্শ করতে পারল না। উঁচু স্বরে রাগ প্রকাশ করল, “কী হলো? কথা বলো!”
শুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল, “বয়স কেবল সংখ্যামাত্র..”
“তুমি কি এসব দার্শনিক কথা-বার্তায় আমাকে পটানোর চেষ্টা করছ!”
“ইয়েস, ম্যাম।”
শুদ্ধর মুচকি হেসে দেওয়া অকপটে জবাব যেন কাটার মতো তনুজার শরীরে বিঁধল। পরপর কতগুলো শ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, “দেখো, শুদ্ধ! তোমার সামনে পুরো লাইফটাই বাকি আ..”
“ম্যাম, আই লাভ ইউ।”
“শুদ্ধ! এসব কোন ধরনের পাগলামি?”
“সারাদিন প্রেম প্রেম পড়িয়ে এখন প্রেমে পড়ে যাওয়াটা আপনার কাছে দোষের মনে হচ্ছে?”
“বাংলা সাহিত্যে প্রেম থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আর আমার জায়গায় যদি পুরুষ লেকচারার থাকতেন, তার প্রেমেও কি পড়তে তুমি?”
“ছি! ছি! আস্তাগফিরুল্লাহ! নাউজুবিল্লাহ! কী বলেন এসব? আপনি মেয়ে বলেই তো প্রেমে পড়েছি।”
“শুদ্ধ!”
“জি, ম্যাম?”
“আর কেউ তো প্রেমে পড়ল না, তোমারই কেন এত প্রেম এলো?”
“জানি না—সবার কেন ইচ্ছা করে না। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা করেছে। আর, আপনি ওমন করেন কেন, ম্যাম? একটু প্রেমে পড়ে যান না! প্লিজ প্লিজ প্লিজ!”
“উফ! তুমি কি জানো, তুমি বেশ অসভ্য একটা ছেলে?”
শুদ্ধ বরাবরের মতোই মাথা চুলকে হাসিমুখে বলল, “ম্যাম, আপনার জন্য পৃথিবীর চরম অসভ্য ছেলেও হতে পারি।”
“শুদ্ধ! আমার এসব ভালো লাগে না। প্লিজ!”
“একবার প্রেমে পড়ে তো দেখুন, ম্যাম! সব ভালো লেগে যাবে।”
“এ্যাই! তোমার মাথায় প্রেমটা কে ঢুকিয়েছে, হ্যাঁ?”
“ম্যাম, আপনি।”
শুদ্ধর জবাব শুনে তনুজা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমি ইন্টারেস্টেড নই—আর কীভাবে বোঝাব?”
শুদ্ধ হেসে দিয়ে বলল, “এটা আপনি বোঝাতে পারবেন না। তবে, গ্যারান্টি দিচ্ছি, ম্যাম—রাজি হয়ে গেলে, বছর কয়েকের মাঝেই বিয়ে করে নেব। আর, সারাটাজীবন পাশে থাকব। ট্রাস্ট মি, একদম ছেড়ে যাব না আপনাকে।”
“শুদ্ধ, এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু!”
“ম্যাম, আপনি রাজি হন বা না-হন, আমি আপনার পিছু কোনোদিনই ছাড়ছি না। আই প্রমিস, সারা জীবনের জন্য থেকে যাব, আপনি না চাইলেও।”
তনুজা অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে কপালে হাত চাপড়াল। রাগ লাগছে তার। প্রচুর রাগ লাগছে। সে জীবনে এমন পাগল দেখেনি। ছেলেটা কি বুঝতে পারছে না—তনুজা তার সাথে কোনোরূপ সম্পর্কে জড়াতে আগ্রহী নয়! দোষ আছে। ঘোরতর দোষ! শুদ্ধ একে তো তার স্টুডেন্ট, তার উপর বয়সে ৮ বছরের ছোটো। তাছাড়া..
মনের ভেতরটা বিষিয়ে উঠল। ছেড়ে যাওয়া বিষয়টি উঠতেই, তনুজার হুট করে মনে পড়ে গেল—সেই ছোট্টো সময়ের কথা। তখন সে সবে ১২। তখন থেকেই তো সবাই হাড়িয়ে যাচ্ছে, ছেড়ে যাচ্ছে। পোড়া কপাল তো তার আগে ছিল না!
গত হওয়ার আগের বছরটাতেই, তার বাবা তাকে জন্মদিনটায় প্রথম বারের মতো বিয়ে প্রাসঙ্গিক কথাতে বলে বসেন, “আমার তনু মা তো বেশ বড়ো হয়ে যাচ্ছে! এখন তো বিয়ে দিতে হবে..”
তনুজা তখন সে কী হাসা! যেন বাবা তাকে কৌতুক শুনিয়েছেন। রয়ে-সয়ে হাসি থামিয়ে জবাব দেয়, “বিয়ে হলে কি বরের বাড়ি যেতেই হয়?”
“হ্যাঁ, যেতে তো হয়ই!”
“না গেলে হয় না, বাবা?”
“না, সোনা মা। না গেলে হয় না।”
“কেন?”
“এটা তো নিয়ম। মেয়েরা বাবা-মায়ের কাছে আমানত হয়ে থাকে। সময় হলেই দিয়ে দিতে হয়।”
“আমি গেলে তো তুমি একা হয়ে পড়বে।”
“সে কি! তবে, যাবে না বলছ?”
“আমার বাবাকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না।”
তোফাজ্জল সাহেব হাসতে হাসতে বলেন, “আচ্ছা, যাওয়া লাগবে না। বাবার কাছেই থেকো।”
তনুজা তখন গাল ফুলিয়ে বলে, “প্রমিস করো, তুমিও যাবে না।”
“আচ্ছা, যাব না।”
“না না। এভাবে না। পাক্কা প্রমিস করতে হবে।”
“মুখের কথা বিশ্বাস করছ না? হায়! আমার মা-টা দেখছি অবিশ্বাস করতে শিখে গেছে।”
“মা শিখিয়ে দিয়েছে। মা-ও তো বলেছিল, যাবে না। গেল কেন? অবশ্যই প্রমিস করেনি, তাই।”
তোফাজ্জল সাহেব তখন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে বলেছিলেন, “আমি আমার মাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। প্রমিস।”
অথচ, ছোট্টো তনুজা বুঝলই না—ওয়াদা করাই হয় ভাঙার জন্য। বছর ঘুরতে না ঘুরতে সে এতিম হয়ে গেল। মেট্রিক অবধি চাচা-চাচির কাছে বোঝা হয়ে থাকল। তারপর..
“ম্যাম! আপনি কাঁদছেন কি?”
শুদ্ধের প্রশ্নে তনুজা ভাবনা থেকে বেরোল। চোখে মুক্তোর ন্যায় জলকণা চিকচিক করছে। ঘুরে দাঁড়াল সে। ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে অশ্রু শুষে নিল। এরপর শুদ্ধের উদ্দেশ্যে বলল, “তুমি আমাকে ডিস্টার্ব করছ, শুদ্ধ। নেক্সট টাইম এরকম কিছু করলে, আমি ভিসিকে জানাব। সেটা নিশ্চয়ই তোমার জন্য মঙ্গলকর হবে না!”
বিনিময়ে শুদ্ধকে কিছু বলতে না দিয়েই তনুজা ক্লাসরুম থেকে প্রস্থান ঘটাল। ফাঁকা ক্লাসরুমে শুদ্ধ এক গুচ্ছ চন্দমল্লিকা ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল তনুজার যাওয়ার পানে চেয়ে। তারপর আবারও মাথার পেছনের চুলগুলো আলতো হাতে চুলকে হাসল। একবার মনে কিছু এসে গেলে, তা এভাবেই বের করার মতো ছেলে শুদ্ধ নয়। যে করেই হোক, তার যেটা পছন্দ হয়, সেটা চাই; চাই-ই চাই। আর সে যদি নিষিদ্ধ বস্তু! কথায় আছে না—নিষিদ্ধ কিছুর প্রতিই মানুষের ঝোঁক বেশি থাকে..
______
ক্লাসের একদম শেষের দুটো বেঞ্চে শুদ্ধ-শাওন এবং প্রাপ্তি-তুহিন বসে আছে। তিনজনেই হতভম্ব হয়ে শুদ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে। আর শুদ্ধ! সে বেচারা দাঁত দিয়ে নখ কাটতে ব্যস্ত। আশ্চর্যের রেশটা কাটিয়েই শাওন শুদ্ধের বাহুতে ঠাস করে বাড়ি মেরে বলে উঠল, “কী কামডা করছস, ব্যাডা!”
শুদ্ধ হালকা করে আঘাত-স্থলে হাত বুলিয়ে নির্বিকার রইল। প্রাপ্তি আরেক দফায় চেঁচিয়ে উঠল, “শাওন্যা রে! এই ব্যাডারে থাপ্রা। এক্কেবারে থাপ্পড়ের উপ্রে রাখবি। নো থামাথামি। কথার একটুও নড়চড় হইলে আমি লাত্থানো শুরু করব। পরে ডিপার্টমেন্ট হেডের কাছে আমাদের নামে কপ্লেইন গেলে দোষ দিবার পারবি না।”
তুহিন এদের দুজনকে হাতের ইশারায় থামাল। প্রাপ্তি পেছনের বেঞ্চের উপর কনুইয়ের ভর রেখে আঁধ-ঘুরো হয়ে বসে ছিল, একই ভঙ্গিতে তুহিনও। শাওন আর প্রাপ্তি থামতেই তুহিন নিশ্চিতকরণ প্রশ্ন করল, “সিরিয়াসলি প্রপোজ করছিস?”
শুদ্ধ মেকি ভদ্র ছেলে বনে উপর নিচ মাথা ঝাঁকাল। তৎক্ষনাৎ প্রাপ্তি বলে উঠল, “এই! তুহাইন্যা! ওরে জিগা—কয়টা থাপ্রা খাইছে!”
তুহিন জিজ্ঞেস করার আগেই শুদ্ধ বিরক্তিকর চাহনিতে প্রাপ্তির দিকে তাকাল। রাশভারি কণ্ঠে বলল, “আমারে কি ম্যাম বলদ পাইছে, যে—থাপ্রাইয়া থাপ্রাইয়া রিজেক্ট করবে?”
শাওন শুধাল, “কাহিনি কিন্তু ক্লিয়ার না, মাম্মা। ক্লিয়ার কর, ফাস্ট।”
শুদ্ধ শ্বাস ফেলে বলল, “আর কী ক্লিয়ার করব? ম্যামকে প্রপোজ করেছি। এই টুকুই।”
তুহিন বলল, “মানল ম্যাম?”
শুদ্ধ নেতিবাচক জবাবে ডানে বামে মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু। বাট আ’ল ট্রাই টু মাই বেস্ট।”
শাওনও ডানে-বামে মাথা নাড়ল, তবে তা অতিষ্ঠ হয়ে। তারপর কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে উঠল, “তোর কপালে থাপ্রা আছেই।”
কিছুক্ষণের মাঝেই তনুজা ম্যামের ক্লাস শুরু হলো। আজ ক্লাসে চর্যাপদ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সবাই পড়া নিয়ে ব্যস্ত, এদিকে শুদ্ধ গালে হাত দিয়ে ম্যামকে দেখে যাচ্ছে। তনুজা ভুলেও শুদ্ধের দিকে চাইছে না আর শুদ্ধ দৃষ্টি ফেরানোর অবসরই পাচ্ছে না। কী দারুণ এক মুহুর্ত! গালে হাত দিয়ে তনুজাকে ভাবতে ভাবতে শুদ্ধ গভীর খেয়ালে তলিয়ে গিয়েছে। তনুজা বরাবরের মতোই এক অনুজ্জ্বল আকাশি রঙের সুতির শাড়ি পরে আছে, আঁচল ওঠানো। হাই কর্লারের সাদা ব্লাউজটির স্লিভস কবজি অবধি। বাঁ হাতে কালো চিকন ফিতের ঘড়ি। কানে ছোটো একটা টপস্। আর চুলগুলো পেছনে আঁট করে খোপা গাঁথা। দেখতে ভারি সুশ্রী দেখাচ্ছে। শুদ্ধ সেদিকে তাকিয়ে কল্পনা করছে—এখন যদি তনুজা হাঁটতে হাঁটতে কাছে আসত, তবে তাকে দেখতে কেমন লাগত? ধীরে ধীরে ম্যামের আকৃতি বড়ো হবে আর দেখতে স্পষ্ট দেখতে পারবে। এক গাল হেসে শুদ্ধর কোঁকড়ানো চুলগুলো এলোমেলো করে বলবে, ‘কী? এত কী দেখছ? কোনো সমস্যা?’
শুদ্ধ ভাবনায় এতটায় তলিয়ে গিয়েছে, যে সত্যি সত্যি সামনে তনুজাকে দেখতে পাচ্ছে। সে ধীরপায়ে এগিয়ে কাছে এসে দাঁড়াল। তবে হাসল না। কল্পনায় নাকি যা মনে আসে, তাই করা যায়। তবে শুদ্ধ কেন মন মতো ম্যামকে দেখতে পাচ্ছে না? তবে কি মনও ম্যামকে এমন রাগি, গম্ভীর দেখতে চায়? হয়তো বা তা-ই। তনুজা এখন বলে উঠল, “সমস্যা কী?”
ইশ! কল্পনায় শব্দরাও বুঝি এলোমেলো হয়ে যায়? নয়তো ‘কোনো সমস্যা’ টাইপের বিনয়ী প্রশ্নের বদলে ‘সমস্যা কী’-এর মতো বিরক্তিকর অভিব্যক্তি পেল কেন? সে জানে না। তাই শুদ্ধ এখানে ‘কোনো সমস্যা’ ধরে নিয়ে উত্তর দিলো, “ইশ! এভাবে কেউ পড়ায়, ম্যাম? এখানে লাগে তো!”
শেষ বাক্যটি বলার সময় ডান হাতের তর্জনী দিয়ে বুকের বাঁ পাশটায় ইশারা করে দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে পুরো ক্লাস হেসে উঠল। তনুজা দ্রুত এদিক-ওদিক দেখল। সবাই তাকিয়ে আছে। তবে মুহূর্তেই তনুজার বড়ো বড়ো চোখের শাসানো দৃষ্টি দেখে চুপ মেরে গেল। এদিকে সে বুঝতেই পারেনি, ছেলেটা এভাবে অকপটে স্বীকার করে নেবে। তনুজাকে দ্বিতীয় দফায় অবাক করে শুদ্ধ বলে উঠল, “ম্যাম, এরপর থেকে হালকা রঙের শাড়ি পরে ক্লাস নেবেন না। শুধু হালকা নয়, কোনো রঙেরই শাড়ি পরবেন না; অন্য পোশাক আছে। চুলগুলোকে ওভাবে মাঝ সিঁথি করে খোঁপায় বাঁধবেন না। চোখের নিচেটায়, কাজল দেবেন না। এভাবে হাত নেড়েচেড়ে পড়াবেন না। ম্যাম! আমার বুকের এখানটায় ব্যথা হয়। তিন সত্যি।”
চলবে…
খুব সুন্দর লাগলো।।এরকম আলাদা কিছুই খুঁজছিলাম।সব এক রকমএর গল্প পড়ে ভালো লাগছিলো না।ধন্যবাদ আপনাকে এরম গল্প উপহার দেবার জন্য।আরো এরম ভিন্ন প্রেমের গল্প পেলে খুশি হব।