অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৮.
বাড়ির তিন পুরুষ আজ বসার ঘরে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেছেন। এই বৈঠকের ডাকটা মূলত আলী আকবর কায়সারই দিয়েছেন। দেশের মাটিতে পা রেখেই বুড়ো খুব চটেছেন। জরুরী তলবে নিজ পুত্রকে কল করে আদেশ করেন,
“ হতচ্ছাড়া কোথাকার! এই মুহুর্তে বাসায় ফিরো। তোমার ছেলেকেও কল করে বাসায় ফিরতে বলো। “
আলী আকবরের এহেন কড়া তলবের কারণেই আরিফ কায়সার এবং ওয়াসিফ কায়সার এই মুহুর্তে উনার সামনে উপস্থিত। মনন চশমা ভেদ করে বিচক্ষণ দৃষ্টি মেলে দাদুর মেজাজ মাপতে ব্যস্ত। আলী আকবর সাহেব নিজের স্মার্টফোনে একটা যুবকের ছবি বের করে আরিফ এবং মননের দিকে ধরে শুধায়,
“ চিনতে পারছো এই ছেলেকে? “
মনন এবং আরিফ সাহেব সূক্ষ্ণ চোখে ছবির মানুষটাকে দেখে। পরপর একই সঙ্গে বলে উঠে,
“ এটা তো সাকিব। “
মনন মাথা নেড়ে বলে,
“ চিনবো না কেন? বাপ্পি আংকেলের ছেলে, করিম দাদুর নাতি ও। “
আলী আকবর সাহেব থমথমে গলায় বলেন,
“ দেশে ফিরতেই আমাকে করিম কল করেছে। নিজের নাতির বিয়ের দাওয়াত দিলো। আগামীকাল কার্ড দিতে বাসায় আসবে। “
আরিফ সাহেব হাসিমুখে বলে,
“ তা-ই নাকি? যাক আলহামদুলিল্লাহ। সাকিবের বিয়ে হচ্ছে এটা তো খুশির খবর। “
আলী আকবর সাহেব রেগে গরম গলায় বলে,
“ আহাম্মক কোথাকার! দাঁত বের করে কেলাচ্ছো কেন তুমি? এখানে খুশির কি পেলে তুমি? আমার তো লজ্জায় নাক কাটা যাচ্ছে। যে-ই করিম কি-না স্কুল, কলেজ লাইফে কখনো আমাকে টপকে প্রথম হতে পারে নি, আজ সেই করিম কি-না আমার আগে নিজের নাত বউয়ের মুখ দেখবে। আর আমি বসে বসে ঘাস কাটবো? “
আরিফ সাহেব এবং মনন এতক্ষণে বুঝতে পারে আসল সমস্যাটা কোথায়। মনন ভালো করেই জানে এই মুহুর্তে দাদুর এই প্যাঁচাল শুরু হলে থামার নাম নিবে না। তাই এর আগেই কেটে পড়ার জন্য সে ক্লান্ত গলায় বলে,
“ আমি খুব টায়ার্ড। গোসল করে একটু ঘুমাতে হবে। আমি যাচ্ছি। “
আলী আকবর চোখ রাঙিয়ে বলে,
“ কোথায় পালাচ্ছো? আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। লজ্জা করে না? তোমার থেকে দুই বছরের ছোট ছেলেটা বিয়ে করে ফেলছে। বলি এই বাসায় কি কোনো মেয়ে বউ হয়ে আসবে না সংসারটা সামলানোর জন্য? “
মনন ক্লান্ত দেহ নিয়ে রুমের দিকে যেতে যেতে বিনয়ী গলায়ই বলে,
“ ঘরে বউ আনার জন্য আমার বিয়ে করাটা বাধ্যতামূলক নয় দাদু। আব্বুকেও চাইলে বিয়ে করিয়ে দিতে পারো একটা। কিংবা তুমিও কিন্তু এখনো ব্যাচেলর আছো। দেখতেও আমার এবং আব্বুর থেকে বেশি হ্যান্ডসাম। সুযোগ হাতছাড়া করো না। “
আলী আকবর সাহেব পিছন থেকে রেগে খেকিয়ে উঠেন,
“ হতচ্ছাড়া কোথাকার! একদম বাপের মতো হয়েছে। নালায়েক। “
__________
সকাল তখন এগারোটা বাজে। থমথমে মুখে নিজ কেবিনে বসে আছে মোহ। তার সামনেই একটা সোফায় বসে আছে মায়া। মুখটা কাচুমাচু করে রেখেছে সে। শিহান ফেরদৌস কেবিনে প্রবেশ করে তাড়া দিলো মোহকে,
“ এখনো হসপিটালের পোশাক পড়ো নি কেন তুমি? একটু পরেই নার্স আসবে তোমাকে নিতে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। এই মায়া, তোমার বোনকে সাহায্য করো। আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি। “
মোহ প্রতিবাদ করে,
“ আমি রেডি হবো না। আমি কোথাও যাবো না ওই নার্সের সাথে। যা ইচ্ছে হয়ে যাক। “
শিহান ফেরদৌসের কপালে ভাজ দেখা যায়। কিছুটা শাসনের সুরে বলে,
“ একদম বাচ্চাদের মতো আচরণ করবে না। তোমার ভালোর জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তুমিও জানো এই মুহুর্তে আর কোনো অপশন নেই আমাদের কাছে। “
“ অপশন আছে কি না আই ডোন্ট কেয়ার। আর কোনো অপশন না থাকলে দরকারে আমি চিকিৎসা করাবো না। তবুও কখনো এই পি আই সি সির জন্য রাজি হবো না। আমি সারারাত এটা নিয়ে রিসার্চ করেছি। এর ভিডিও দেখেছি। খুব পেইনফুল একটা প্রসিডিওর। আমি এসবের মাঝে নেই। “
মায়া বসে অসহায় চোখে নিজের বাবা এবং বোনকে দেখছে। সে ভালো করেই জানে যে এই মুহুর্তে এখানে বাবা মেয়ের মাঝে কথা কাটাকাটি হবে। সেই ব্যাপারটাকে মায়ারই সামলাতে হবে। মোহর কথার পিঠে শিহান শাসায়,
“ চিকিৎসা করাবে না মানে কি? ছোটবেলার অভ্যাস বদলায় নি এখনো তোমার। সমস্যা দেখলেই সেটাকে ফেস না করে কেটে পড়তে চাও সবসময়। তোমাকে সুস্থ করার জন্য এতো চেষ্টা করছি আমরা, আর তুমি ভয়ে পালাতে চাচ্ছো। “
মায়া এবার উঠে দাঁড়ায়। বাবাকে গিয়ে থামিয়ে বলে,
“ তুমি রাগারাগি করো না এখন প্লিজ। বাহিরে গিয়ে ওয়েট করো। আমি কথা বলছি ওর সাথে। “
মায়ার কথায় আশ্বস্ত হয়ে শিহান বেরিয়ে যায়। তার এই মেয়েটা অত্যন্ত বুঝদার। মোহর মতো বেখেয়ালি নয়। যেকোনো সমস্যা সুন্দর করে সমাধান করার অসাধারণ প্রতিভা আছে তার মাঝে।
শিহান বেরিয়ে যেতেই মায়া এসে মোহর পাশে বসে। মোহ চোখ রাঙিয়ে আগেভাগে সতর্ক করে,
“ একদম বাবার হয়ে চামচামি করতে আসবি না। কোনো মোটিভেশনাল জ্ঞান তো ভুলেও দিবি না। কষ্টটা পুরোটা আমার সহ্য করতে হবে। শরীরটা যেহেতু আমার, সেহেতু আমার শরীর কোন ব্যথাটুকু সহ্য করতে প্রস্তুত সেটা আমি ভালো জানি। আমার ট্রিটমেন্ট জনিত যেকোনো ডিসিশন নেওয়ার অধিকার আমার আছে। “
মায়া মুখটা কালো করে তাকায় মোহর দিকে। কণ্ঠে অসহায়ত্ব ঢেলে দিয়ে বলে,
“ আই নো তোর অধিকার আছে। কিন্তু আমিও চাই আমার বোন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাক। আমার চাওয়াটা কি ভুল বল? ব্লাড টেস্টের জন্য কিংবা কেমো, ইঞ্জেকশন দেওয়ার জন্য ভেইন পাওয়া কতটা জরুরী তুইও জানিস। এখন তোর ভেইন পাওয়া যাচ্ছে না বলেই তো ডক্টররা ট্রিটমেন্ট চলমান রাখার জন্য বিকল্প হিসেবে এই পি আই সি সি অথবা পোর্ট সার্জারির উপায়টা সাজেস্ট করেছে। একবার রাজি হয়ে যা প্লিজ। ট্রিটমেন্ট শেষ হয়ে গেলে তো এসব থেকেও তখন মুক্তি পেয়ে যাবি। “
মোহ নরম হলো কি-না বুঝা গেলো না। উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করে,
“ বিকল্প সাজেস্ট করেছে সেটা শুনতে পেরেছিস, কিন্তু সেই বিকল্প ওয়েটা কতটা পেইনফুল আর রিস্কি সেটা শুনিস নি? না শুনে থাকলে আমি আবার তোকে মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমার সজ্ঞানে আমার বাম হাতের কনুইয়ের উপরের বাকের এখানে কিছুটা কেটে তারা একটা শিরা খুঁজবে আগে। সেই শিরার মাধ্যমে ওই ২৪ ইঞ্চির টিউবটা ধীরে ধীরে আমার হার্টে পৌঁছাবে। ক্যাথেটারের মাধ্যমে যখন পুরোটা সেটাপ করে ফেলবে তখন জাস্ট তারা সেই পি আই সি সি লাইনকে সেফ রাখতে আমার হাতে ড্রেসিং করে দিবে। এই পুরো প্রসিডিওরটা আমাকে সজ্ঞানে দেখতে হবে, অনুভব করতে হবে, তড়পাতে হবে। কি চমৎকার না? খুব ইজি! যতদিন এই চিকিৎসা শেষ না হবে ততদিন আমাকে নিজের শরীরের ভেতর একটা পাইপ নিয়ে ঘোরাফেরা করতে হবে। “
মায়ার অসহায় মনে হয় নিজেকে। সে তো জানে ব্যাপারটা মোহর জন্য অত্যন্ত কষ্টকর হবে। কিন্তু এছাড়া আর কি-ই বা করার আছে তাদের কাছে? মায়া মোহকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে বলে,
“ একটু কষ্ট সহ্য করে নে প্লিজ? একবার কাজটা কমপ্লিট হয়ে গেলে দেখবি তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর ট্রিটমেন্টে আর কোনো অসুবিধা হবে না। “
“ কে বলেছে হবে না? পি আই সি সির রিস্ক ভুলে গেলি? ইনফেকশনের হাই চান্স থাকবে তখন। সামান্যতম বিষয়ে ইনফেকশনের ভয় থাকবে আমার। তাছাড়া আমি ড্রেসিং করা হাত নিয়ে রাতে ঘুমাবো কি করে? “
মায়া আর কিছু বলতে নিবে তার আগেই মোহ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“ তুই প্লিজ যা এখান থেকে। আমার অসহ্যকর লাগছে তোকে। রাগের মাথায় কিছু বলতে চাচ্ছি না। “
মায়া নীরবে উঠে যায়। দরজার কাছাকাছি গিয়ে সে ফিরে তাকায় মোহর দিকে। শেষ চেষ্টা চালাতে মলিন স্বরে বলে,
“ যা ভালো মনে হয় কর। ট্রিটমেন্ট মাঝ পথে থামিয়ে গিভ আপ করতে চাইলে কর। আমাকে নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না। মা, বাবা ছাড়া চলতে পারলে তোকে ছাড়াও চলতে পারবো আমি। আফটার অল আমাকে তো একাই চলতে হবে। “
বলেই মায়া কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। মোহ নিশ্চুপ বসে রয়। সে জানে মায়া কি বুঝিয়ে গিয়েছে এইমাত্র। সে না থাকলে মায়া পুরো একা হয়ে যাবে। ওই এতো বড়ো বাড়িটাতে কথা বলার মতো মানুষের খুব অভাব হবে মায়ার।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মোহ বেডের একপাশে রাখা হসপিটালের পোশাকের দিকে তাকায়। হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে যায় গত রাতের ঘটনা। সে যখন ছাদে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ঠিক সেই মুহুর্তে নার্স এসেছিলো তার কেবিনে ব্লাড টেস্টের জন্য। কিন্তু এবারও পরিস্থিতি একই দেখে নার্স বাধ্য হয়ে কল করে ডক্টরকে ব্যাপারটা জানায়। তারপর আর মোহ সুযোগই পেলো না। শিহান এবং মায়ার নজর এড়িয়ে ছাদে যাওয়াটা অসম্ভব ছিলো তার কাছে। তার উপর সে-ই মুহুর্তেই ডক্টর এসে নিজেও মোহর চেকাপ করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। যখন দেখে স্পষ্ট শিরার অভাবে মোহর ব্লাড টেস্ট, ইঞ্জেকশন কিংবা কেমো দেওয়াটা অসম্ভব হয়ে পরেছে তখন তিনি বিকল্প হিসেবে পি আই সি সি সম্পর্কে জানান শিহানকে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিহানও রাজি হয়। তারপর… তারপর সারাটা রাত মোহর কিভাবে কেটেছে তা শুধু সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।
গত রাতের কথা ভাবতে গিয়ে মোহর মনে প্রশ্ন জাগে, ওই ডক্টর কি গত রাতে ছাদে গিয়েছিল? আর গেলে কি মোহর অপেক্ষা করেছিলো? আনমনে মস্তিষ্কে হানা দেওয়া প্রশ্নে মোহ নিজেই বিরক্ত হলো। ওই মরণ তার জন্য কেন অপেক্ষা করবে? হয়তো এসেছে, তারপর ঘুরে ফিরে চলে গিয়েছে। সেটাই তো হওয়ার কথা।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]