অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-০৭

0
54

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭.

হসপিটালে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে লিফটে করে ছাদে পৌঁছাতে মননের সর্বোচ্চ পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মতো লেগেছে। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠা কদম গুলো ছাদের দরজার কাছাকাছি এসে ধীর হয়ে যায়। দরজাটা খোলা। অর্থাৎ মোহ হয়তো ছাদে আছে। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই মনন বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে ছাদে পা রাখে। যেনো এতক্ষণ সে প্রবল তাড়া নিয়ে ছাদে পৌঁছানোর জন্য মাঝপথ থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে আসে নি।

ছাদে পা রাখতেই মাতাল করা বাতাস এসে মননের শরীরে ধাক্কা খায়। মনন সেকেন্ড কয়েকের জন্য থামে। সামনের দিকে চোখ বুলায়। উঁহু, কেউ নেই। মোহ কি তবে আসে নি? নাকি এসে চলে গিয়েছে? প্রশ্নগুলো মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই ছাদের পিছনে বাম পাশ হতে একটা স্বর বলে উঠে,

“ হ্যালো ডক্টর, আমাকে খুঁজছেন? “

মনন সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায় না। বুঝতে পারে ওই মেয়ে ছাদেই আছে। তা-ই সে পিছনে না ফিরেই রেলিঙের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জবাব দেয়,

“ আপনাকে খোঁজার কথা ছিলো না-কি? “

মোহ কোনো প্রতুত্তর করে না। মনন রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মোহর উত্তরের অপেক্ষা করে। তবে কোনো উত্তর না এলেও কয়েক সেকেন্ডের মাঝে মোহ নিজেই এসে তার পাশে দাঁড়ায়। দু’জনের মাঝে প্রায় তিন হাত সমান দূরত্ব। মনন এবার ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে তাকায়। অবলোকন করে কালো রঙের সুতি কাপড়ের একটা কুর্তি এবং প্লাজো পরিহিত মোহকে। মননের দৃষ্টি স্থির মোহর মাথায় প্যাঁচানো স্কার্ফটার দিকে। স্কার্ফের নিচে শক্ত মাথার আকৃতিটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। চুল কেটে ফেলেছে তার মানে। মনন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।

মোহ এবার পাশ ফিরে তাকায়। সবসময় হসপিটালের পোশাক পড়ে থাকা লোকটা আজকে হালকা আকাশী রঙের শার্ট এবং কালো প্যান্ট পড়ে আছে। চোখ জোড়া স্বচ্ছ চশমার ফ্রেমের আড়ালে ঢাকা। মোহ অস্ফুটে বলে,

“ ভেবেছিলাম চলে গিয়েছেন। “

মনন শুনে তা। তবে পাত্তা না দিয়ে বলে উঠে,

“ কানে কি অযথাই ইয়ারফোন গুজে রেখেছেন, নাকি গান শুনছেন? “

মোহকে উৎসাহী দেখা যায়। এক কানের ইয়ারফোন খুলে সে মননের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ গান শুনছিলাম। শুনবেন? “

মনন অনাগ্রহ দেখিয়ে বলে,

“ উহু, শুনবো না। আপনারও শোনা উচিত না। ওয়্যারড ইয়ারফোন রেডিয়েশন প্রডিউস করে। আপনার হেলথের জন্য সেটা ভালো না। উল্টো ক্ষতিকর। “

মোহ মুখ কালো করে ফেলে। কান থেকে ইয়ারফোন খুলে বেরস মুখে বলে উঠে,

“ এতো রেস্ট্রিকশন? এক কাজ করি, নিঃশ্বাস নেওয়াও বন্ধ করে দেই। ঢাকার মতো পলিউশনে ভরপুর একটা শহরে নিঃশ্বাস নেওয়াটাও তো উচিত না। প্রতি নিঃশ্বাসে কত ক্ষতিকর জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে, তাই না? “

মনন ভ্রু কুচকে মোহর দিকে তাকায়। সব কথার জবাব এই মেয়ের ঠোঁটের আগায় প্রস্তুত থাকে। মননকে এভাবে কপাল কুচকে তাকাতে দেখে মোহ বলে উঠে,

“ আইডিয়াটা পছন্দ হয় নি? আমি তো আপনাদের ভাষাতেই কথা বললাম। ডক্টররা পারলে পেশেন্টদের নিঃশ্বাস নেওয়ার উপরেও রেস্ট্রিকশন বসিয়ে দেয়। “

“ ডক্টররা কোনো কিছু বারণ করলে সেটা পেশেন্টদের ভালোর জন্যই করে। নিয়মে বাঁধা জীবন কিছুটা কষ্টের হলেও তো বিনিময়ে সুস্থতা পাওয়া যাচ্ছে। সেটাই বড়ো ব্যাপার বলে আমি মনে করি। “

মননের সিরিয়াস কথাটাকে মোহ গায়ে মাখে না। উল্টো হেসে দিয়ে বলে,

“ প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের টিচারের মতো মোটিভেশনাল শোনাচ্ছে আপনার কথা। “

মনন বিরক্ত হয়। তার এতো দামী একটা কথাকে এই মেয়ে আমলে নিলো না টের পেতেই মুখটা করলার মতো রূপ ধারণ করে। প্রশ্ন করে,

“ আপনি কি কাউকে জানিয়ে ছাদে এসেছেন? “

“ হ্যাঁ। নার্সকে বলে এসেছি। তাছাড়াও ডিনার করে চুপচাপ বসে থাকতে অস্বস্তি লাগছিলো। উনারা তা-ই আর মানা করে নি। “

“ আপনার ফ্যামিলি? উনাদের জানিয়ে আসেন নি? “

মোহ আনমনে বলে বসে,

“ ফ্যামিলির কেউ থাকলে তো বলবো! “

মনন কিছুটা অবাক হয়ে তাকায়। মোহও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নিজের কথার অর্থ বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি করে বলে উঠে,

“ আই মিন মায়া বাসায় গিয়েছে। ওর কালকে এক্সাম আছে। এক্সাম শেষে আসবে। “

“ আপনার আম্মু আব্বু? “

“ বাবা আপাতত দেশে নেই। আর মা তো পৃথিবীতেই নেই। “

মোহর অবলীলায় বলা কথাটা শুনে মনন নিশ্চুপ হয়ে যায়। বুঝে উঠতে পারে না তার কি বলা উচিত। কিছুক্ষণ নীরবতা বজায় থাকে দুইজনের মাঝেই। মনন সেই নীরবতা ভেঙে বলে,

“ এভাবে গার্ডিয়ান ছাড়া একা থাকাটা তো আপনার অথবা আপনার বোনের জন্য সেফ না। বাচ্চা মানুষ দু’জনই। কোনো রিলেটিভ নেই? “

“ আছে তো। আমার মামা মামী আছে। উনারা কানাডায় স্থায়ী। তাছাড়া বাসায় দাদু আর আন্টি আছেন। আন্টি মূলত দাদুর খেয়াল রাখার দায়িত্বেই আছেন। দাদু একচুয়্যালি প্যারালাইজড তো। উনার পাশে সর্বক্ষণ একজনের থাকাটা জরুরী। আর আমি বাচ্চা নই। আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেল্ফ। কেউ আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা বেবি সিটিং করুক সেটা আমার পছন্দ না। “

মনন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“ আচ্ছা, মানলাম। আপনি বাচ্চা নন। খুশি? “

মোহ মননের কথা শুনে চোখ ছোট করে তাকায়। এই লোক কি এইমাত্র তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করলো? মোহ কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই মনন প্রশ্ন করে,

“ বাই দ্যা ওয়ে, আপনার তো কেমোর প্রথম সাইকেল শেষ। তাহলে হসপিটালে কি করছেন? আপনাকে কি আপনার ডক্টর হসপিটালে এডমিট থাকতে সাজেস্ট করেছেন? “

প্রশ্নের উত্তরটা মোহর কাছে আছে। তবে তা বলতে ইচ্ছে হলো না তার। সে তাড়া দেখিয়ে বলে,

“ অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছে। আমি এখন যাই। টাটাহ। “

বলেই মোহ উল্টো পথ ধরে সেখান থেকে প্রস্থান করে। মনন নির্বিকার ভঙ্গিতে তা দেখে। বাঁধা দেয় না। পকেটে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই কিছু একটা মনে পড়ে তার। পকেট থেকে বের করে বেলী ফুলের সেই মালাটা। মুহুর্তেই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সেই ফুলের ঘ্রাণ। মনন কিছুক্ষণ সেই মালাটা দেখে আবার পকেটে ভরে নেয়।

__________

নির্মল সকালটায় ফোলা ফোলা চোখ মেলে হসপিটালের বেডে বসে আছে মোহ। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে সে। কিন্তু ঘুমটা ভালো হয় নি তার। কেমোর প্রভাবে যদিও তার ঘোড়া বেঁচে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করে, কিন্তু হসপিটালের এই বেডটায় সে প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাতে পারে না। ছোটবেলা থেকে বিশাল বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে অভ্যস্ত মানুষের কি এই এক হাত সমান বিছানায় পোষায়? তার উপর ন্যাড়া মাথাটা বালিশে রাখলেই বারবার খোঁচা লাগছিলো তার। সব মিলিয়ে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।

কেবিনের দরজা খোলার শব্দ পেতেই মোহ দ্রুত ভঙ্গিতে হাতের কাছের স্কার্ফটা টেনে মাথা ঢেকে নেয়। একজন ওয়ার্ড বয় এসেছে একটা ট্রে হাতে। ট্রে তে থাকা সকালের নাস্তাটা মোহকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি চলে যায়। মোহ গিয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে আসে। তারপর তীব্র অনিহা নিয়েই শুরু করে হসপিটালের সাদামাটা পুষ্টিসম্পন্ন নাস্তা খাওয়া।

নাস্তা শেষে ওষুধ খেয়ে মোহ বসে টিভি দেখছিলো। এই হসপিটালে সময় কাটাতে টিভি দেখা, ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলা, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা এবং নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরির সঙ্গে সময় ব্যয় করা ছাড়া সে করার মতো আর কিছু খুঁজে পায় না।

মোহ যখন টিভি দেখতে ব্যস্ত ঠিক সেই মুহুর্তে একজন নার্স ব্লাড টেস্টের সরঞ্জামাদি পূর্ণ ট্রে হাতে কেবিনে প্রবেশ করে। মোহ দ্রুত স্কার্ফ নিতে চাইলে নার্সটি হেসে বলে,

“ রিলেক্স। লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। হসপিটালের প্রতিটা পেশেন্টই ন্যাড়া মাথায় ঘুরে বেড়ায়। একবার জানো কি হয়েছিল? ক্লাস সেভেনে থাকতে আমার ভয়ংকর টাইফয়েড হয়েছিলো। মাথা ভর্তি সব চুল হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। কিন্তু এখন দেখো, কি সুন্দর লম্বা চুল হয়েছে না আমার? তোমারও হয়ে যাবে দেখে নিও। “

কথা বলতে বলতে ভদ্রমহিলা সুই প্রস্তুত করে মোহর হাতে তরতাজা রগ খুঁজতে থাকে। ডান হাতটা বেশ কিছুক্ষণ এপাড় ওপার করে খুঁজেও যখন কোনো রগ পায় না তখন তিনি বাম হাতটা ধরেন। লম্বা সময় ধরে খোঁজার পরে একটা আবছা রগ খুঁজে পান তিনি। মুষ্টিবদ্ধ হাতের উপর পিঠটা স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণু মুক্ত করে নিয়ে তিনি সুঁই ব্যবহার করেন।

কিঞ্চিৎ ব্যথায় মোহ চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। নার্সটা বেশ কিছুক্ষণ টিউব হাতে অপেক্ষা করেন। কিন্তু খুব সামান্য পরিমাণ রক্তই আসছে। এই সামান্য পরিমাণ রক্ত টেস্টের জন্য যথেষ্ট নয়। মোহ পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। দেখে নার্সের কপালের ভাজ। অত:পর দেখে সুঁইয়ের নিম্নভাগে লাগোয়া সরু স্বচ্ছ পাইপের মতো অংশটা। যার একভাগ সুঁইয়ের সঙ্গে জোড়া লাগানো এবং অপর অংশ দ্বারা টিউবে রক্ত নেওয়া হয়। খুবই সামান্য পরিমাণ রক্ত দেখে মোহ হতাশ হয়। ওই ডক্টর আবার গ্রাফিল টাফিল দিবে না তো?

নার্স কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে,

“ এরকম হলে তো চলবে না। ব্লাড টেস্টের জন্য তো সতেজ রগ দরকার। এভাবে তো টেস্ট করা সম্ভব নয়। “

মোহ চটপটে গলায় উত্তর দেয়,

“ আপনি আরেকটু খুঁজে দেখুন। আমি তো কথামতো সারাদিন পানি, আনারের শরবত, খেজুর এসব খেয়েছি। একটুও গাফলতি করি নি। “

নার্সটা মোহর কথায় কিছুটা নরম হয়ে বলে,

“ অসুবিধা নেই। আমি আবার সন্ধ্যায় ব্লাড নিতে আসবো। তুমি রেস্ট করো। “

বলেই নার্সটা ট্রে হাতে বেরিয়ে যায়। মোহ বসে বসে নিজের দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বারবার রগ খুঁজতে থাকে। শুভ্র পাতলা ত্বকের নিচে তো রগ খুঁজে পাওয়া খুব সহজ হওয়ার কথা। তাহলে মোহর বেলায় এমন হচ্ছে কেন? ভাবনাটা মাথায় উঁকি দিতেই মোহ দরজা খোলার শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকায়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে বিস্মিত হয়। ভুলে বসে সব কিছু। অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

“ বাবা। “

শিহান ফেরদৌস কিছুক্ষণ থম মেরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মেয়ের মুখটা দেখে। পরপর ধীর পায়ে কেবিনে প্রবেশ করে। মোহ তৎক্ষণাৎ সম্বিত ফিরে পায়। স্কার্ফটা মাথায় নিয়ে চুপচাপ বসে রয়। শিহান ফেরদৌস অসচেতনের মতো আচরণ করেন না। সোজা তিনি আগে ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসেন। কেবিনের টেবিলের উপর থাকা স্যানিটাইজার নিয়ে অত:পর দু-হাত পরিষ্কার করে নেন। মোহর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে একটা সোফায় বসে।

মোহ বাকা চোখে একবার বাবার থমথমে মুখটা দেখে নেয়। বাবা কখন দেশে ফিরলো? এইমাত্র নাকি গত রাতে? গত রাতে ফিরলে মায়া তাকে জানায় নি কেন? রাতেও তো সে দিব্যি মায়া এবং আন্টির সাথে কথা বলেছে। মোহর বিস্ময়তা চিরে শিহান প্রশ্ন করে,

“ শরীর কেমন তোমার? “

মোহ অপ্রস্তুত বোধ করে। অজানা কারণে তার মনে হচ্ছিলো এই বুঝি বাবা কিছু একটার জের ধরে তাকে বকবে। কিন্তু বাবা উল্টো জানতে চাইছে সে কেমন আছে। এই পরিবর্তনটা কি মোহ অসুস্থ বলেই? যদি তা-ই হয় তাহলে এই অসুস্থতা দীর্ঘস্থায়ী হলেও মোহ তা চুপচাপ সয়ে নিতে রাজি।

মোহর তরফ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে শিহান কিছুটা গলা ঝেড়ে বলে,

“ এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? “

মোহর বিস্ময়তা কাটে। তড়িঘড়ি করে জবাব দেয়,

“ জি? ঠিক আছি। “

আবারও অস্বস্তি পূর্ণ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায় কেবিনটা। কেউই বুঝে উঠতে পারে না কি বলা উচিত তাদের। মোহর নিজের বাবার সাথে সম্পর্কটা খুব একটা সহজ নয়। কিছুটা সংকোচ, কিছুটা দ্বিধা এবং অসীম দূরত্ব দ্বারা সৃষ্ট এক জটিলতা তাদের সম্পর্কে বিরাজমান।

মোহর ধারণা এই জটিলতার মূল কারণ তাদের মায়ের মৃত্যু। মোহ এবং মায়ার জন্মের এগারো দিনের মাথায় তাদের মা মারা যান। মামা মামীর মুখে মোহ শুনেছে সেই দিনগুলোর কথা। তার বাবা খুব ভালোবাসতো তার মা’কে। স্ত্রী’র অকাল মৃত্যু শিহানের মাঝে পরিবর্তন নিয়ে আসে। লোক সমাগম এড়িয়ে গিয়ে একা থাকতে শুরু করে। কাজের সাগরে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে শুরু করে। বাসায় যতক্ষণ থাকতো ততক্ষণ নিজের রুমেই থাকতো। স্ত্রী’র শোকে ডুবে থাকা শিহানের অজান্তেই তার সন্তানদের সাথে একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়। মায়া এবং মোহ কিছুটা বড়ো হওয়ার পর টের পায় তাদের বাবা নামক মানুষটার চারিদিকে একটা অদৃশ্য পর্দা রয়েছে। মায়া যদিও ধীরে ধীরে সেই পর্দার আড়ালে থাকা নরম মনের বাবার কাছে পৌঁছাতে পেরেছে, কিন্তু মোহ ব্যর্থ হয়েছে। সে নিজের জড়তা কাটিয়ে কখনোই আগ বাড়িয়ে বাবার সাথে মেশার আগ্রহ দেখায় নি। আর না শিহান নিজ থেকে কাঠিন্যতা ভুলে মোহকে স্নেহের ছায়ায় আগলে নিতে পেরেছে।

মোহ ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে শিহানের কথায়,

“ থাকো তবে। আমি গিয়ে তোমার ডাক্তারের সাথে দেখা করে আসি। কিছুর প্রয়োজন হলে কল দিও। “

মোহ কিছু বলতে পারে না। শিহান যেভাবে এসেছিলো, সেভাবেই উঠে চলে যায়। মোহ ভাবতে বসে বাস্তবিক অর্থে তার আসলে কি প্রয়োজন?

__________

ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে মননের ডিউটি আওয়ার শেষ এখন। হসপিটালের পোশাক বদলে নিয়ে সে শার্ট প্যান্ট পড়ে নেয়। কাধে ব্যাগটা চাপিয়ে নিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে পা বাড়ায় লিফটের দিকে। পথিমধ্যে দেখা হয় এক সহকর্মীর সঙ্গে। তার সঙ্গে টুকটাক আলাপের ইতি ঘটে লিফট পঞ্চম ফ্লোরে থামার মধ্য দিয়ে। মননের সাথের সহকর্মী পঞ্চম তলায় নেমে গেলেও মনন নামে তা। তার উদ্দেশ্য চৌদ্দতম ফ্লোরে। ছাদে যেতে হবে যে তার!

আজ ছাদের দরজার কাছে এসে অবাক হলো মনন। দরজা খোলা নেই। তারমানে মোহ এখনো আসে নি। মনন তেমন একটা না ভেবে নিজেই দরজা খুলে ছাদে পা রাখে। একা একা মুক্ত বাতাসে পায়চারি করতে থাকে।

সময় গড়ায় আপন গতিতে। দশ মিনিট… বিশ মিনিট… ত্রিশ মিনিট। পায়চারি করতে করতে ক্লান্ত মনন রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। হাত ঘড়িটায় একদফা চোখ বুলায়। ঘড়ির কাটা নয়টা ছুঁই ছুঁই। মোহর আসার কোনো নাম গন্ধ নেই।

মননের শূন্য মস্তিষ্ক আচমকা একটা ধাক্কা খায়। সে মোহর জন্য অপেক্ষা কেন করছে? কিসের ভিত্তিতে সে ছাদে এসে অচেনা, অজানা ওই মেয়েটার জন্য সময় ব্যয় করছে? মোহ তো কখনো বলে নি যে সে প্রতিদিন এই সময়টাতে ছাদে আসবে। তাদের মধ্যে এরকম কোনো চুক্তি হয় নি। নাকি হয়েছে? নীরব চুক্তি বলে তাকে।

মনন আর অপেক্ষা করে না। ঠিক করে এই নীরব চুক্তির ইতি ঘটা দরকার। ভিন্ন দুটো জীবন, যার কোনো যোগসূত্র নেই, সেরকম দুটো মানুষের অহেতুক এই দেখাশোনাটা নেহাৎই অপ্রয়োজনীয়। অপ্রয়োজনীয় কিছু করাটা মননের উচিত নয়। ওইটুকু বাচ্চা মেয়ের সাথে প্রতিদিন ঘড়ি ধরে দেখা করার মতো দায়বদ্ধ সে নয়। কিংবা মোহও প্রতিদিন এই সময় ছাদে আসতে বাধ্য নয়।

মনন আরও কিছু ভাবার পূর্বেই তার মুঠোফোনটা বেজে উঠে। প্যান্টের পকেট হতে ফোনটা বের করে সে রিসিভ করে। কানে ধরতেই আরিফ কায়সার বলেন,

“ কোথায় তুমি? দাদু সে-ই কখন বাসায় এসে খবর আছে? দ্রুত বাসায় আসো। তোমার উপর রেগে আছে খুব। বোঝাপড়া করবেন আজ তিনি। “

মনন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলটা কেটে দেয়। ছাদ থেকে প্রস্থান করে। লিফটে উঠে সোজা গ্রাউন্ড ফ্লোরের বাটন চেপে দেয়। কিন্তু লিফটটা মধ্য পথে দশম তলায় এসে থামে। দরজা খুলে যায় দু’দিকে। দু’জন লোক লিফটে উঠে। মনন নীরবে দেখে তা। এই ফ্লোরটাতেই মোহ আছে। মনন মোহর খোঁজ করার আগ্রহ বোধ করে না। কিংবা বোধ করলেও তা মানতে আগ্রহ দেখায় না। সব আগ্রহকে পাত্তা দিতে নেই। সে আপন জায়গায় স্থির রয়। লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। দেখা হয় না আর দু’জনের।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে