অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0
73

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩০. ( উপসংহার )

চারিদিকে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। একটা ডায়েরি হাতে বিছানায় বসে আছে মোহ। অমনোযোগী দৃষ্টি টেবিলে রাখা পানির বোতলটার দিকে। একটা লম্বা সময় সেই বোতলটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। কলমের সাহায্যে ডায়েরিতে কিছু একটা লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

প্রথমে সে স্বাভাবিক থাকলেও ধীরে ধীরে তার মুখশ্রীতে করুণ বিষণ্ণতা এসে ভর করে। সেই বিষণ্ণতা সময়ের সঙ্গে নীরব কান্নায় রূপ নেয়। মোহর গাল গড়িয়ে নামা অশ্রুজলে ভিজে যায় শুভ্র কাগজের পাতাটা। সাক্ষী হয় সপ্তাদশীর বাঁধ ভাঙা আবেগের।

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠতেই মোহর হাত থেমে যায়। সে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে স্ক্রিনে মননের নামটা। মোহ আবারও ধ্যানে মগ্ন হয়। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই আবারও বেজে উঠে। এবার মোহ ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে সুইচ অফ করে দেয়।

অত:পর? অত:পর সে আবারও কাদলো। ডায়েরিতে মুখ গুজে লম্বা সময় পর্যন্ত কাদলো। এতটা হতভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে কেন এলো সে? কি হতো একটা মোহর অস্তিত্ব পৃথিবীর বুকে না জন্মালে? এই বিশাল পৃথিবীতে মোহর অবদান কি? কোন সুফলটা বয়ে এনেছে সে? কিছুই না। বরংচ আরো সকলের জীবনের একটা কষ্টের অধ্যায় হতে চলেছে সে। মোহ তো এমনটা চায় নি কখনো। তাহলে এরকমটা কেন হলো? আর কতগুলো মানুষকে সে কষ্ট দিবে?

__________

হুট করে মোহর ফোন বন্ধ পেয়ে মননের ভয়টা সত্যিতে রূপান্তর হয়। তার মানে সত্যিই সামহাও সে মোহকে হার্ট করেছে? কিন্তু কিভাবে? মনন ভাবে খুব। কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না।

অনেকটা অসহায়ের মতো যখন মনন বিছানায় বসে নিজের মাথার চুল টানছে ঠিক সেই মুহুর্তে রুমের বাহির থেকে চেঁচামেচির শব্দ পায় সে। আলী আকবর সাহেব চেঁচাচ্ছেন,

“ পানির বোতলটা কোথায়? এই আরিফ! বোতল কোথায় খুঁজে দেখো। “

বোতলটা খুঁজে না পেয়ে চেঁচামেচির পরিমাণ আরো কিছুটা বেড়ে যায়। মননের সবর ফুরিয়ে এতেই সে উঠে রুম থেকে বের হয়। শীতল স্বরে নিজের দাদু এবং আব্বুকে উদ্দেশ্য করে সরাসরি বলে,

“ আমি নিয়েছি বোতলটা। লুকিয়ে নিয়েছি। আর কিছু জানতে চাও তোমরা? “

আরিফ সাহেব ততক্ষণে আন্দাজ করে ফেলে ব্যাপারটা। কিন্তু আলী আকবর সাহেব বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,

“ লুকিয়ে নিয়েছো মানে? লুকিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল কি? আমরা কি তোমাকে পানি খেতে নিষেধ করতাম? “

মনন এবার ক্লান্ত গলায় বলে,

“ আমার জন্য নেই নি দাদু৷ একটা অসুস্থ মেয়ের জন্য নিয়েছি। ওই অসুস্থ মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি। সুস্থ দেখতে চাই ওকে। ওকে সুস্থ দেখার জন্য কোনো সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না আমি। “

আলী আকবর সাহেব অবাক হলেন। অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকলেন। নিজের বিস্ময়তা দমিয়ে কিছুটা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন,

“ অসুস্থ বলতে? কি অসুখ হয়েছে? “

“ ক্যান্সার। থার্ড স্টেজ। সারভাইভাল রেট ফিফটি ফাইভ পার্সেন্ট। “

আলী আকবর সাহেব বাকরুদ্ধ হলেন। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেন। নাতিকে কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারলেন না। অবশ্য উনার কিছু বলতেও হলো না। তার পূর্বেই মনন নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।

__________

আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। দিনটা আজ ২১ ই সেপ্টেম্বর। নিজের কেবিনে বসে পেশেন্ট দেখতে ব্যস্ত মননের টেলিফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। পেশেন্টের অভিভাবকদের এক মিনিটের জন্য এক্সকিউজ মি বলে মনন টেলিফোনটা তুলে কানে ধরে।

“ হ্যালো? “

“ ডক্টর ওয়াসিফ কায়সার মনন? “

“ জি বলুন। “

“ স্যার, আপনি একজন পেশেন্টের এডমিট হওয়ার আপডেট জানতে চেয়েছিলেন। পেশেন্টের নাম মেহনামা ফেরদৌস মোহ। আজকে এডমিট হয়েছে উনি। টেনথ ফ্লোর। রুম নং ওয়ান জিরো জিরো সেভেন। “

“ থ্যাঙ্কিউ ফর ইউর হেল্প। “

“ মাই প্লেজার। “

মনন টেলিফোনটা কান থেকে নামিয়ে আবার পেশেন্ট দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার মুখভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। দেখে মনেই হচ্ছে না যে গত ছয়টা দিন ধরে সে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারছে না। হৃদয় ব্যকুল হয়ে আছে কাউকে এক নজর দেখার জন্য। তার কণ্ঠ শোনার জন্য। গত ছয়টা দিনে মনন কতবার যে হসপিটালের ওয়েবসাইটে লগ ইন করে মোহর ফাইলের আপডেট চেক করেছে সেটারও হিসাব নেই। কিন্তু কোনো আপডেট পায় নি সে। অর্থাৎ এই ক’দিন মোহর ওপিডি, টেস্ট, কেমো কিছুই ছিলো না।

সন্ধ্যা নামার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত মনন বসে সবগুলো পেশেন্টকে দেখা শেষ করে। একেবারে হাতের সব কাজ মিটিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নেয়। পাঁচটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। মনন রওনা হয় একজনের মুখোমুখি হতে। যথেষ্ট হয়েছে! তার জানতে হবে মোহর সমস্যাটা কোথায়।

__________

মোহকে কেবিনে রেখে শিহান গিয়েছে হসপিটালের ডিসপেনসারিতে। মোহর কিছু ওষুধ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেগুলো নেওয়ার উদ্দেশ্যে। মোহ তখন কেবিনে একা। বিছানার এক ধারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকায়। দেখে একজন ওয়ার্ড বয় এসে হাজির হয়েছে। মোহর সামনে এগিয়ে এসে তার দিকে একটা চিরকুট এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ স্যার দিতে বলেছে। “

মোহ চিরকুটটা নিতেই ছেলেটা চলে গেলো। মোহ অনুমান করতে পারে স্যার সম্বোধন করা ব্যক্তিটি কে হতে পারে। সে চিরকুটটা খুলতেই সেখানে চিরপরিচিত ডাক্তারদের মতো বিশ্রী হাতের লেখা দেখতে পায়।

“ চিরকুট দেওয়ার জন্য দুঃখিত নই। আপনিই আর কোনো যোগাযোগের উপায় রাখেন নি। ছাদে আসুন পাঁচ মিনিটের জন্য। আপনার আসতে ইচ্ছে না করলে অসুবিধা নেই, আমি তাহলে কেবিনে চলে আসবো। দেখুন আপনার যা মন চায়। “

মোহ বিস্মিত হয়ে চিরকুটটা কয়েকবার পড়ে। এই লোক মোহকে হুমকি দিলো? এতটা বেপরোয়া হয়ে পরেছে? কখন, কবে? মোহ আগে কেনো টের পায় নি?

শিহানের ফিরতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। তা-ই মোহ অপেক্ষা না করে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। চিরকুটটা হাতে নিয়েই রওনা হয় ছাদের উদ্দেশ্যে।

__________

বৃষ্টি বিরতি নিয়েছে কিছুক্ষণ হলো। সন্ধ্যা নেমে আসা শহরটার কোণায় কোণায় কৃত্রিম আলো জ্বলে উঠছে। মোহ এলো ক্ষিপ্ত গতিতে। এসে মননের হাতে চিরকুটটা ধরিয়ে দিয়ে কিছুটা চেঁচিয়ে উঠলো,

“ এই মনন! ভয় নেই আপনার? হুমকি দেন আমাকে? “

মনন প্রতুত্তর করলো না। নীরবে দেখলো মোহকে। নীরবে শুনলো নিজের নাম। মোহর এই নীরবতা পছন্দ হলো না। জানতে চাইলো,

“ ডাক্তার না আপনি? আপনার কাজ নেই আর? আমার পিছনে কেনো পরলেন? “

“ ফোন বন্ধ করেছেন কেন? কিছু করেছি আমি? কষ্ট পেয়েছেন আপনি? “

মোহ উত্তর দিতে পারে না। কি বলবে সে? কেন মননের সঙ্গে দূরত্ব রাখতে চাইছে সে? মননের ভালোর জন্যই তো! মনন তো বুঝবে না এটা।

মনন আবার প্রশ্ন করে,

“ মোহ সমস্যা কোথায় সেটা বলুন প্লিজ। না বললে আমি বুঝতে পারছি না। আপনি বলুন, আমি সর্ট আউট করার চেষ্টা করছি। “

“ অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুতে জড়ানোর আগে লাগাম টানা উচিত আমাদের। আমি ইতিমধ্যে বাবা আর মায়ার কষ্টের কারণ হয়ে আছি। আমি চাচ্ছি না আপনারও কষ্টের কারণ হই। এই সামান্য… “

মোহ থেমে যায় হঠাৎ। চোখ বন্ধ করে বুকে হাত রাখে। ঠিক ব্যান্ডেজটার উপর। মনন লক্ষ্য করে ব্যাপারটা। চেহারায় উদ্বিগ্নতা এসে ভীড় করলো। প্রশ্ন করলো,

“ কি হয়েছে? মোহ? আর ইউ অলরাইট। “

নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে মোহ বললো,

“ হ্যাঁ। কিছু হয় নি। আমি যাই। আপনি প্লিজ আর দেখা করতে চাইবেন না আমার সাথে। প্লিজ। “

মোহ যেনো তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে পালাতে চাইলো। মনন সুযোগ দিলো না। বাঁধা দিতে মোহর হাতটা ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে সে চমকে উঠলো। বিস্ময় নিয়ে বললো,

“ এই? এই? আপনার জ্বর। কখন থেকে? বলেন নি কেনো? “

মোহকে অস্থির দেখালো। এলোমেলো নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আবারও হাতটা বুকের ডান পাশে ব্যান্ডেজের উপর রাখলো। মনন কণ্ঠে অস্থিরতা নিয়ে জানতে চাইলো,

“ ব্যথা হচ্ছে? বুকে ব্যথা হচ্ছে আপনার? কি হচ্ছে প্লিজ বলুন আমাকে। “

মোহ অস্ফুটে কেবল বলতে পারলো,

“ জ্বলছে। “

বলতেই তার শরীরটা টলে উঠলো। মনন দ্রুত সামলে নিলো। মুহুর্ত অপেক্ষা না করে পাজাকোলে তুলে নিলো মোহকে। মোহ জ্ঞান হারায় নি। তবে হুট করেই অস্বাভাবিক লাগছে তার। ব্যান্ডেজের ভেতরটা জ্বলছে খুব। মনে হচ্ছে একটা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড রাখা ওই ব্যান্ডেজের আড়ালে।

মোহকে নিয়ে কেবিনে পৌঁছাতে মননের সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট লাগলো। পথে সকলে অবাক হয়ে দেখছিলো একজন ডক্টর একটা রমণীকে কোলে তুলে হন্য হয়ে ছুটছে। মননকে দৌড়ে কেবিনের দিকে যেতে দেখে তার পিছে পিছে নার্সরাও ছুটে এলো। মনন চেঁচিয়ে বললো,

“ পোর্ট সার্জনকে খবর দাও। “

একজন নার্স ছুটে গেলো কাউন্টারে মোহর সার্জনকে ইনফর্ম করতে। মনন মোহকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েই দ্রুত চিৎকার করে বলতে লাগলো,

“ গ্লাভস আর ক্লিনিং এইড কিট নিয়ে এসো। “

নার্সরা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। মনন কি করতে চাইছে বুঝতে পারছে না তারা। মননের আদেশ পালন করাও কতটুকু ঠিক হবে তা নিয়েও তারা সন্দিহান। কারণ হাজার হোক মনন এই পেশেন্টের ডক্টর নয়। তবে মননের ধমকের তোপে তারা বেশি কিছু ভাবার সময় পেলো না। একজন কিট আনতে ছুটে গেলো। আরেকজন দ্রুত গ্লাভস এনে মননের হাতে পড়িয়ে দিতে থাকলো। মনন মোহর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,

“ এই মোহ! কিছু হবে না। আপনি রিল্যাক্স থাকুন। “

মোহ রিল্যাক্স হতে পারলো না। জ্বর তো তার আগেও এসেছে। এরকম তো অনুভূতি হয় নি। ব্যান্ডেজের ভেতরে অনুভব করা উত্তাপটা মোহ মুখ ফুট বলতে পারলো না। ভয়ে তার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে।

মনন দ্রুত একজন নার্সকে বললো মোহর স্কার্ফটা সরাতে মাথা থেকে। ততক্ষণে আরো একজন নার্স নিজের হাত স্যানিটাইজ করে গ্লাভস পড়ে তৈরী। নার্সকে মোহর জামার গলাটা কিছুটা নিচে নামিয়ে ধরে রাখতে বলে মনন অতি সাবধানে দ্রুত ব্যান্ডেজটা খুললো। ব্যান্ডেজ উন্মুক্ত করতেই সে ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো। নার্সরাও ভীত হলো। মনন আবারও চেঁচিয়ে উঠে,

“ ডক্টর কোথায়? “

নার্স ইতিমধ্যে পোর্ট সার্জনকে কল করেছে। ডক্টর এক্ষুণি আসছে জানিয়েছে। তবে অশান্ত, ক্ষিপ্র মননকে সেটুকু বলারও সাহস পেলো না সে। মোহ চোখ মেলে নিজেও লক্ষ্য করলো তার বুকের ডান পাশের সেলাইয়ের জায়গাটা। দেখলো জায়গাটা লাল হয়ে কেমন ভয়ংকর দেখাচ্ছে। সেলাইয়ের জায়গাটায় পানি জমে ফুলে আছে। মোহ আর ঠিক থাকতে পারলো না। ভয়ে চিৎকার করে কান্না করে উঠলো।

মনন আরো অশান্ত হয়ে পড়ে। মোহর গাল ধরে বলে,

“ কিচ্ছু হয় নি। ইনফেকশন সম্ভবত। ঠিক হয়ে যাবে। প্লিজ শান্ত হন আপনি। শান্ত হন মোহ। “

ডক্টর আসার পূর্বে শিহান এসে উপস্থিত হলো। কেবিনের ভেতর অশান্ত নার্স এবং ডক্টরকে দেখে ভড়কালো। এগিয়ে এসে মোহর অবাক দেখতেই উনি নিথর হয়ে চেয়ে রইলেন। মোহ কান্নার মাঝে লক্ষ্য করলো শিহানকে। এই প্রথম যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে সে মা’য়ের নাম ছেড়ে বাবাকে ডাকলো।

“ বাবা! বাবা! বাবা কি হচ্ছে আমার? বাবা প্লিজ কিছু করো। বাবা! “

শিহান পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। এগিয়ে যেতে পারলো না। মেয়ের ডাকে সাড়া দিতে পারলো না। মোহ চোখ খিচে বন্ধ করে আবার চিৎকার করতে থাকে। শিহান সম্বিত ফিরে পায়। দৌড়ে এগিয়ে যায় মেয়ের মাথার কাছটায়। হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

“ কি হয়েছে মা? কি হচ্ছে তোমার? কোথায় ব্যথা হচ্ছে? বুকে ব্যথা হচ্ছে? “

প্রশ্নগুলো করতে করতে শিহান অনুভব করলো মোহর তীব্র জ্বর। এতটাই তীব্র যে মনে হচ্ছে শিহানের হাতের তালু সেই জ্বরের উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে। শিহান চেঁচালো। সবার উপর চেঁচালো।

“ কি হয়েছে আমার মেয়ের? ঠিক ছিলো ও। হঠাৎ কি হলো ওর?… “

শিহানের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় পেলো না কেউ। তন্মধ্যে ডক্টর এসে হাজির হলো। মোহর সার্বিক পরিস্থিতি দেখে উনি চিন্তিত হলেন। নার্সদের নির্দেশ দিলেন দ্রুত মোহকে নিয়ে প্রয়োজনীয় দু একটা টেস্ট করাতে। রিপোর্টটাও যেনো আর্জেন্ট পাঠানো হয় সেজন্য কল করে জানালেন নির্দিষ্ট অথরিটিকে।

মোহকে ধরে বেড থেকে নামিয়ে একটা হুইলচেয়ারে বসানো হলো। নার্স দু’জন ফাইল হাতে হুইলচেয়ার নিয়ে ছুটলো। তাদের সঙ্গে ছুটলো শিহানও। মনন পিছু যায় নি। বরং ডক্টরের সঙ্গে রইলো। একান্তে প্রশ্ন করলো,

“ ইনফেকশন হয়েছে বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক হয়ে যাবে তো? তাই না? “

ডক্টর জানালো,

“ বাহির থেকে দেখে তো অবস্থা ভয়ংকর মনে হচ্ছে। রিপোর্ট পেলে বিস্তারিত বুঝা যাবে। কিন্তু ইমিডিয়েট সার্জারি করতে হবে এটা নিশ্চিত। পানি জমে গিয়েছে। পোর্টে ইনফেকশন হওয়াটা কতটা রিস্কি আপনি তো জানেনই। “

বলেই ডক্টর সেখান থেকে প্রস্থান করলো। উনার হাতে ফুরসত নেই। এখনই নিজের টিম নিয়ে প্রস্তুত হতে হবে উনার। মোহর কেসটা নিয়ে আলোচনাও করতে হবে। মনন দেয়ালের সঙ্গে ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের গ্লাভস খুললো। পকেট থেকে ফোন বের করে কল করলো আলী আকবর সাহেবকে। সরাসরি আবদার করে বলে,

“ আমি একটা সার্জারি এটেন্ড করতে চাই দাদু। ওটিতে দূরে দাঁড়িয়ে থাকবো। কাউকে বিরক্ত করবো না। তুমি প্লিজ ব্যবস্থা করে দাও। আমি না শুনতে চাই না। “

__________

মোহর খবর পেয়ে মায়া ছুটে হসপিটালে এলো। রাত তখন আটটা বাজে প্রায়। মোহকে ওটিতে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। পড়নের জামা বদলে দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। মায়া ওটি এরিয়ার কাছে আসতেই শিহানকে দেখতে পেলো। ছুটে গিয়ে বাবাকে ধরে কাদতে কাদতে প্রশ্ন করে,

“ আমার বোন কোথায়? কি হয়েছে ওর? ওর সার্জারি কেন করবে? “

শিহান উত্তর দিতে পারলো না। তার আগেই দেখা গেলো মোহকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পেশেন্ট বেডটা ওটির ভেতর প্রবেশ করার পূর্বেই মায়া দৌড়ে গেলো। মোহর হাত ধরে বলে,

“ প্যারা নিবি না তুই। একদম ঠিক হয়ে যাবি। আমরা সবাই দোয়া করবো। “

কাদতে কাদতে মোহর গলা বসে গিয়েছে। সে ক্ষীণ স্বরে কিছু একটা বলে। মায়া স্পষ্ট কথাটা বুঝতে না পেরে মাথা নুইয়ে আনে। এবার মোহর কথাটা বুঝতে পারে সে। প্রতুত্তরে কিছু বলার সুযোগ পায় না। এর পূর্বেই মোহকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়।

মায়া একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসে কাদতে থাকে। শিহান দূরে দাঁড়িয়ে দেখে তা। নিজেকে অসহায় মনে হয় তার। দুই মেয়ের এক মেয়েরও কষ্ট দূর করার ক্ষমতা নেই তার কাছে। এতটা জঘন্য কেন সে বাবা হিসেবে?

__________

ওটিতে ঢোকার আগ পর্যন্ত মোহর চোখ অজান্তেই বারবার একজনকে খুঁজে বেরাচ্ছিলো। কিন্তু না, মানুষটাকে কোথাও দেখতে পায় নি সে। লোকটাকে কি দেখার সুযোগও হবে না তার?

ওটি রুমের মধ্যিখানে সার্জারির জন্য নির্ধারিত বেডটায় মোহকে বসানো হয়। দুইজন নার্স তাকে একটা পর্দার মতো কাপড় দিয়ে আড়াল করে দেয়। আরেকজন নার্স তার হসপিটাল গাউনটা খুলতে সাহায্য করে। এতো যন্ত্রণার মাঝেও মোহর অস্বস্তি কাজ করছিলো। সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে নার্সদের সামনে বসে থাকতে তার জড়তা কাজ করছিলো। তার উপর ওটি ভর্তি ছয় সাতজন পুরুষ ডাক্তার। কিন্তু নার্সদের মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। এইটা তাদের নিত্যদিনের কাজ।

মোহ বেডে সোজা হয়ে শুতেই তার পুরো শরীর একটা সবুজ পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো। এইবার নার্সরা পর্দা সরিয়ে নিলো। মোহ দেখলো না কিছু। সে ইতিমধ্যে চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলেছে। জাগতিক সকল চিন্তা তার মস্তিষ্কে এসে ভীড় করেছে। একবার মায়ার কথা মনে পড়ছে। একবার বাবার। একবার…

“ ভয় পাবেন না। “

কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলা কথাটুকু শুনে মোহর ভাবনা উধাও হয়ে গেলো। সে চমকে চোখ মেলে তাকায়। তার পাশে দাঁড়ানো সার্জিক্যাল এপ্রোন, মাস্ক পড়া লোকটাকে চিনতে ভুল হলো না তার। চিনতে পেরে মোহ বুক পর্যন্ত টানা কাপড়টাকে টেনে গলা পর্যন্ত তুলতে চাইলো। মনন তাকে বাধা দিয়ে বলে,

“ ডক্টর হিসেবে আছি আমি। আমার দৃষ্টিতে আপনি শুধুমাত্র পেশেন্ট এখন। প্লিজ বি কম্ফোর্টেবল। “

মননের কথায় মোহ ভুললো না। সে জানে মনন ডাক্তার হিসেবে ওটিতে উপস্থিত নয়। সে মোহর জন্য এসেছে। মোহ তার কাছে শুধুমাত্র পেশেন্ট নয়। মোহ কোনোকালেই এই লোকটার পেশেন্ট ছিলো না।

মনন আরেকবার তাকে আশ্বস্ত করে বলে,

“ ভয় নেই। এখনো আমি আছি। চোখ খুলেও আইসিইউতে সবার আগে আমাকেই দেখবেন। সুস্থ হোন আগে। বোঝাপড়া বাকি আছে আমাদের। “

মোহ উত্তর দিতে পারে না। না চাইতেও আরো একবার তার চোখ গড়িয়ে জল পড়তে থাকে। মনন নীরবে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। একটুও নড়ে না। দু’জনেই তাকিয়ে থাকে একে অপরের দিকে। সেই ফাকে একজন ডক্টর এসে বহু খুঁজে শিরা বের করে মোহর হাতে ক্যানেলা পড়ায়। অত:পর সেটার সাহায্যে চেতনানাশক ওষুধ ইঞ্জেক্ট করে দেয়। ধীরে ধীরে মোহর মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। তবুও সে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা চালায়। যখন আর তাকিয়ে থাকতে পারে না তখন অস্ফুটে বলে,

“ আমি আর চোখ খুলবো না। আপনাকেও দেখবো না। আপনি অপেক্ষা করবেন না। “

মনন শুনলো সবটা। কিছু বললো না। মোহ ঘুমিয়ে পড়তেই ডক্টররা সার্জারি শুরু করতে এগিয়ে এলো। মনন তাদের বিরক্ত করে না। ধীরে ধীরে পিছিয়ে গিয়ে ওটির একটা কোণায় দাঁড়িয়ে থাকে। দূর হতে দেখতে থাকে মোহর বুকে চলমান কাটাছেঁড়া। মনন হঠাৎ অনুভব করলো তারও বুক জ্বলছে। কাটাছেঁড়া তারও বুকে চলছে। কেউ দেখছে না সেটা। মনন কাউকে দেখাতে পারবে না। তার বুকের এই কাটাছেঁড়া মোহ বাদে কেউ সাড়াতে পারবে না।

__________

মৃত্যুর সময় রাত নয়টা বেজে তিন মিনিট। ফাইলে ডেথ টাইমটা নোট করে নিয়ে ওটি থেকে বেরিয়ে গেলো একজন নার্স। তার পিছু পিছু ডাক্তাররাও বেরিয়ে যেতে নিলো। কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো ওটির এককোণে মেঝেতে বসে থাকা বিধ্বস্ত মননকে। এক দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বেডের উপর থাকা ডেডবডিটার দিকে। সবার মাঝে ফিসফিস শোনা যাচ্ছে। কানাঘুঁষা করছে পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্টের ডক্টর ওয়াসিফকে নিয়ে। সেই ডক্টর যে কি-না এক পেশেন্টের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখে কেমন দিশেহারার মতো সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লো।

ডক্টররা সবাই বেরিয়ে যায় একে একে। মনন আপন জায়গায় সটান ভঙ্গিতে বসে রয়। অনেকটা পাথরের মতো। অনুভূতিশূন্য। একজন নার্স এগিয়ে এসে ডাকে,

“ ডক্টর? “

ওয়াসিফ শুনে না তা। জগতের কারো ডাকই তার কানে পৌঁছাচ্ছে না। ব্যর্থ নার্স সরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মনন নিজেই উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে যায় বেডটার কাছে। দেখে মোহর ফ্যাকাশে মুখটা। চোখের কার্নিশে এখনো পানি জমে আছে। মনন হাত বাড়ায় মুছে দিতে। কিন্তু হুট করেই হাত থেমে যায় তার। ছোঁয় না আর মোহকে। কেন ছুঁইবে? ওই মেয়েটা অপেক্ষা করেছে? করে নি। মননের সঙ্গে বৈধ সম্পর্কে জড়ানোর অপেক্ষাটুকু অবধি করে নি। তাহলে কোন অধিকারবোধ থেকে মনন ওই মেয়ের চোখের পানি মুছবে?

মন ব্যথায় ক্লান্ত মনন বেরিয়ে এলো ওটি থেকে। বাহিরে বেরিয়ে আসতেই দেখলো মোহকে। বেঞ্চিতে বসে বুক ভাসিয়ে কাদছে। মনন বেশ কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। উপলব্ধি করলো এইটা মোহ না। মোহর বোন মায়া। বোন হারানোর ব্যথায় কাদছে। মনন আবার মাথা নুইয়ে হেঁটে সেখান থেকে প্রস্থান করে।

শিহান মায়ার মাথায় হাত রাখে। মায়া তখনও হাউমাউ করে কাদছে। হঠাৎ মাথায় বাবার হাতের ছোঁয়া পেতেই সে আহাজারি করে বলে,

“ আমাকে তোমার খেয়াল রাখতে বলে গিয়েছে ও। ও তোমাকে অনেক ভালোবাসতো বাবা। অনেক… “

শিহানের মনের অবস্থা কেউ ব্যাখ্যা করতে পারলো না। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কখনো শব্দে ব্যাখ্যা করাও যায় না। কেবল যে হারায় সে অনুভব করতে পারে তা। শিহানের কেবল মনে হলো তার অর্ধেকটা কলিজা বোধহয় কেউ কেটে নিয়ে গেলো। বাকিটা জীবন তার এই অর্ধেক কলিজা নিয়েই চলতে হবে।

__________

কেবিন নং ওয়ান জিরো জিরো সেভেনটা পেশেন্টশূন্য পড়ে আছে। অথচ আজ দুপুরেও এই কেবিনে একজন পেশেন্ট ভর্তি হয়েছিলো। সন্ধ্যা থেকে তার কেমো শুরু হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তা আর হলো কই? তার আগেই পেশেন্টটা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলো।

হাহাকার করা বুক নিয়ে মনন বসে রইলো কেবিনের বেডটায়। যেই বেডটায় শুয়ে মোহ তড়পাচ্ছিল, সেই বেডটায়। চশমার আড়ালে ভেজা চোখ জোড়া জ্বলছে মননের। মোহ যে সম্পূর্ণ মননকে অসম্পূর্ণ রেখে গেলো, সেই দায় মোহ কিভাবে এড়াবে? এই-যে মননের সঙ্গে মোহর বোঝাপড়া অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো এই দায় কি শুধু এবং শুধুমাত্র মোহর না? মোহ যে মননের কত বড়ো সর্বনাশ করলো এই খবর কি পৃথিবী জানে? মননের যে একটা অপ্রেমের গল্প আছে সেটা কি পৃথিবী জানে?

বুক ব্যথা করার মতো একটা গল্পের কি এখানেই শেষ হলো? হয়তো না। কেবিন ক্লিন করতে আসা একজন স্টাফ হঠাৎ টেবিলের ড্রয়ারে একটা ডায়েরি খুঁজে পেলো। ডায়েরিটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল সে। কেবিনে উপস্থিত মননের দৃষ্টি এড়ায় না তা। ক্লান্ত স্বরে বলে,

“ কি ওটা? “

“ জানি না স্যার। পেশেন্টের জিনিস হয়তো। উনার পরিবারের মানুষরা হয়তো এটা নিতে ভুলে গিয়েছে। “

“ এখানে নিয়ে এসো। “

স্টাফ এসে ডায়েরিটা মননের হাতে দিয়ে চলে যায়। মনন বেশ কিছুক্ষণ ডায়েরিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। অত:পর ধীর গতিতে ডায়েরিটা খুলতেই প্রথম পাতায় নীল কলমের কালি দ্বারা লেখা একটা নাম চোখে পড়ে তার।

“ মোহ। “

সমাপ্ত…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে