অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-০৩

0
61

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩.

রাত তখন প্রায় দশটা বাজে। চার শয়নকক্ষ বিশিষ্ট বিশাল এপার্টমেন্টে কেবল দুজন মানুষ এই মুহুর্তে অবস্থান করছে। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক আরিফ কায়সার ওভেনে খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে ছেলেকে ডাকার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। করিডরের দ্বিতীয় রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রুমের দরজায় নক করে। ভেতর থেকে মনযোগ ভঙ্গ হওয়া পুরুষালি স্বরটা বলে উঠে,

“ এসো আব্বু। “

আরিফ কায়সার দরজার নব ঘুরিয়ে রুমে পা রাখতেই দেখতে পায় সাধারণ টি শার্ট এবং ট্রাউজার পরিহিত ছেলেকে। টেবিলে বসে চোখে পাওয়ারের চশমা এঁটে বইয়ে মুখ গুজে রেখেছে। কপালের মাঝে সূক্ষ্ণ চিন্তার ভাজ। আরিফ কায়সার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

“ বেশি ব্যস্ত তুমি? খাবার বেড়ে রুমে দিয়ে যাবো? “

মনন শুধায়,

“ তুমি খেয়ে নাও আব্বু। আমি পরে খেয়ে নিবো উঠে। “

ছেলের মলিন কণ্ঠ স্বর শুনে আরিফ কায়সার জানতে চায়,

“ মন খারাপ কোনো বিষয় নিয়ে? “

মনন এবার বই ছেড়ে মুখ তুলে নিজের আব্বুর দিকে তাকায়। অত:পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ আজ একটা নতুন পেশেন্টের কেস এসেছে। চার মাসের একটা বাচ্চা মেয়ে। তার বাবা এবং দাদী তাকে নিয়ে এসেছে। বাচ্চাটার জন্মের এক সপ্তাহের মাথায় তার মা মারা যায়। ওর প্রাথমিক লক্ষ্মণ গুলো হলো জ্বর, শ্বাসকষ্ট, রাতে ঘেমে যাওয়া, শরীরে ছোট লাল লাল দাগ আরো ইত্যাদি। আমি বোন ম্যারো বায়োপসি সহ আরো জরুরী টেস্ট গুলো করতে দিয়েছি। যত দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্ভবত রিপোর্ট দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু… “

“ কিন্তু কি? “

“ রিপোর্টে বাচ্চাটার লিউকেমিয়া ধরা পড়বে বলে আমি প্রায় নিশ্চিত। মনে মনে দোয়া করছি যেনো আমার ধারণা ভুল হয়। কিন্তু কিছুটা হলেও আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই মনে হচ্ছে বাচ্চাটার শরীরে ভয়ংকর অসুখটা বাসা বেঁধেছে। আব্বু তুমি দেখলে বুঝতে পারতে… বাচ্চাটা অনেক ছোট। ওর আব্বু ওকে কোলে নিয়ে রেখেছিলো। মনে হচ্ছিলো হাতের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে এক্ষুণি পড়ে যাবে। অনেক নিষ্পাপ দেখতে। আমার… “

আরিফ কায়সার ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

“ তোমার কথার অর্থ বুঝতে পেরেছি। আমিও দোয়া করবো যেনো রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। বাকিটা আল্লাহর মর্জি। ধরো যদি রিপোর্টে মেয়েটার লিউকেমিয়া ধরাও পড়ে, তাহলে তোমার হাতে করার মতো একটাই জিনিস আছে। নিজের জ্ঞান থেকে বাচ্চাটাকে একটা প্রোপার ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন দিয়ে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করা। আল্লাহ হায়াত রাখলে বাচ্চাটা কোনো না কোনো উছিলায় ঠিকই সুস্থ হয়ে যাবে। দেখে নিও। “

মনন আর কিছু বলে না। তার বারবার ওই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটার মুখ মনে পড়ছে। হয়তো ওই নিষ্পাপ বাচ্চার এতো ভয়ংকর একটা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা তাকে ভীত এবং আবেগী করে তুলেছে। কিন্তু ব্যাপারটা মননের সাথে সাজে না। সে তো জেনে বুঝেই এই প্রফেশন বেছে নিয়েছে। সে তো সবসময়ই জানতো, সে যে-ই রোগীদের চিকিৎসা করবে তারা প্রত্যেকেই পৃথিবীর বুকে নিষ্পাপ ফুল। মনন আর কিছু বলতে পারে না। নিজের মন খারাপটা ভেতরে চেপে গিয়ে বলে,

“ আমি কিছুক্ষণ পরে আসছি। তুমি খেয়ে নাও। “

আরিফ কায়সার আর ছেলেকে বিরক্ত করে না। যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই প্রস্থান করে।

__________

এসি চালিত মিটিং রুমটায় গোল টেবিলে অফিশিয়াল বৈঠকে ব্যস্ত নয়-দশ জন বাংলাদেশি এবং চায়নিজ পুরুষ। গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস মিটিং এর ফাঁকে জ্বলজ্বল করা ফোনের স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টিপাত করেন সাতচল্লিশ বছরের শিহান ফেরদৌস। টেবিলের উপর সাইলেন্ট মুডে থাকা ফোনটায় আদরের মেয়ের হোয়াটসঅ্যাপে ইনকামিং কলটা উনার দৃষ্টি এড়ায় না। তবে এই মুহুর্তে কল রিসিভ করাটা সম্ভব নয় উনার পক্ষে। তাই ফের মিটিংয়ে মনযোগ দেয় তিনি।

চায়নিজ ক্লাইন্টদের সঙ্গে লম্বা মিটিংটার সমাপ্তি ঘটে আরো প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট পর। একে একে সকলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের বিদায় জানান শিহান ফেরদৌস। এইমাত্র শেষ হওয়া মিটিংয়ে একটা জ্যাকপটের ন্যায় ডিল ফাইনাল হওয়ার খুশিটা উনার মুখে স্পষ্ট। আচমকা শিহানের খেয়াল হয় মেয়ের কথা। সম্পূর্ণ রুমটা খালি হতেই উনি আরাম করে গিয়ে চেয়ারে বসেন। ফোনটা নিয়ে মেয়ের নাম্বার ডায়াল করেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কলটা রিসিভ হয়। ফোনের অপর পাশে থাকা মেয়েলি স্বরটা সোজা বলে উঠে,

“ মোট বিশ বারের উপর কল করেছি। ইমারজেন্সি সিচুয়েশন ভেবে অন্তত একবার কলটা রিসিভ করলেও পারতে তুমি। তোমার কি এতটুকুও চিন্তা হয় নি, যে তোমার মেয়ে ঠিক আছে তো? “

শিহান ফেরদৌসের হাসি-হাসি মুখটা কাঠিন্য রূপ ধারণ করে। তিনি ভরাট গলায় বলে,

“ তুমি জানতে আমি মিটিংয়ে ছিলাম। মিটিংয়ের মাঝে বারবার কল করাটা কোন ধরনের অভদ্রতা? “

অপর পাশের মেয়েটা এবার কিছুটা রেগে গিয়ে বলে,

“ তুমি দেশের বাহিরে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আছো সেটা আমার অজানা নয় বাবা। কিন্তু তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো যে তোমার মেয়ে হসপিটালে। দিন-রাত আমাকে এখানে তোমার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। একবার অন্তত দেশে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে গেলেও তো পারো। এইটুকু করার মতো সময়ও তোমার হবে না? আমি তোমার হয়ে তোমার দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছি না। তোমার পরিস্থিতিটা আমি জানি। কিন্তু তুমি একবার অন্তত হসপিটালে আসবে এটা এক্সপেক্ট করাটাও কি দোষের? “

“ তোমার কি মনে হয় আমি ইচ্ছে করে তোমাদের অবহেলা করছি? “

“ প্রশ্নটা নিজেকে করো। আমি শুধু তোমাকে এইটুকু জানাতে কল দিয়েছিলাম আমার আগামীকাল সকালে এক্সাম আছে। আজ রাতে হসপিটালে থাকা সম্ভব হবে না আমার। এখানের নার্সদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তবুও তুমি কথা বলে একটু স্পেশাল টেক কেয়ারের ব্যবস্থা করো। সারারাত যেনো অন্তত একজন পেশেন্ট এসিস্টের দায়িত্বে থাকে। আমি আগামীকাল কলেজ থেকে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার হসপিটাল আসবো। “

কথাটুকু বলেই সোজা কল কেটে দেয় মেয়েটা। শিহান ফেরদৌস নীরবে পিঠ এলিয়ে দেয় পিছনে। তার আদরের মেয়েটা ইদানিং আর বাবা খেয়েছে কি-না অথবা কেমন আছে এরকম কিছু জানতে চায় না। কণ্ঠে কেমন অভিমান মিশিয়ে কথা বলে।

শিহান বুঝতে পারে মেয়ের তার প্রতি অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু উনার কাছে কি-ই বা করার আছে? নিজের তরফ থেকে যা সম্ভব হচ্ছে তা-ই করছে উনি। দেশের সেরা ক্যান্সার স্পেশাল হসপিটালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। বেস্ট চিকিৎসাটাই তিনি নিশ্চিত করেছেন। আর কি-ই বা করবেন তিনি? চাইলেই কি এখন তার দেশে ফেরা সম্ভব নাকি? সদ্যই তিনি নিজের কোম্পানির একটা নতুন ব্র্যাঞ্চ চায়নায় খুলেছেন। তা নিয়ে ব্যস্ততার শেষ নেই। সকল কাজ ফেলে দেশে ফেরাটা কোনো ভাবেই সম্ভব নয় এই মুহুর্তে।

__________

মননের প্রতিদিন হসপিটালে এসে সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে নিজ তালিকাভুক্ত পেশেন্টদের কেবিনে গিয়ে একবার রাউন্ড দিয়ে আসা এবং সারাদিন শেষে বাসায় ফেরার পূর্বেও তার ডিউটি হচ্ছে আরেকবার পেশেন্টদের শারীরিক অবস্থা পরখ করতে রাউন্ডে যাওয়া। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। নিজ কেবিন থেকে বেরিয়ে সে সোজা চলে যায় লিফটের কাছে।

এক হাজার এগারো নম্বর রুমে আট বছরের ছেলে বাচ্চাটার সদ্য বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট সম্পন্ন হয়েছে। মনন চশমার ফ্রেম গলে মনযোগ দিয়ে তার ফাইল দেখতে ব্যস্ত। বাচ্চাটার পাঁচ বছরের ছোট বোন নিজের মায়ের কোলে বসে ছিলো। সে চোখ পিটপিট করে মননকে দেখে প্রশ্ন করে,

“ ভাইয়া কবে বাসায় যাবে? “

মনন চোখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকায়। কিছুটা হেসে জবাব দেয়,

“ এইতো আর কয়েকটা সপ্তাহ। তোমার ভাইয়া সুস্থ হোক। তারপর বাসায় যাওয়ার পারমিশন দিয়ে দিবো আমরা। “

মেয়েটা এবার ঠোঁট উল্টে বলে,

“ ভাইয়া এখনো সুস্থ হয় নি? কিন্তু আম্মু তো বলেছিলো আমি ভাইয়াকে আমার থেকে একটু গ্লুকোজ গিফট করলে ভাইয়া সুস্থ হয়ে যাবে। বাসায় গিয়ে আমার সাথে খেলতেও পারবে। “

মনন প্রশ্নসূচক দৃষ্টি মেলে তাকাতেই বাচ্চাটার মা বলে উঠে,

“ বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট শব্দটা ওর জন্য কঠিন ছিলো। তা-ই সহজ করে বুঝাতে গ্লুকোজ বলেছি। “

মনন একবার হসপিটাল বেডে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চা ছেলেটাকে দেখে নেয়। অত:পর ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ ভাইয়ার জন্য প্রে করো আল্লাহর কাছে। যেনো আল্লাহ তোমার ভাইয়াকেও তোমার মতো স্ট্রং করে দেয়। আল্লাহ ছোট বাচ্চাদের দোয়া দ্রুত কবুল করেন। “

বাচ্চাটা মনযোগ দিয়ে তা শুনে। মনন পেশেন্টের মা বাবার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত করে সব ঠিক আছে। চিন্তার কোনো বিষয় নেই। আগামীকাল সকালে সে আবার আসবে।

আজকের দিনের শেষ পেশেন্টটাকে দেখা শেষে মনন লিফটের দিকে যাওয়ার জন্য করিডর ধরে হাঁটছিলো। আচমকা এক হাজার চার নম্বর কেবিনের সামনে এসে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে কেবিনের ভেতর দিকে তাকায় সে। বেশ কিছু নার্সকে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ভেতর থেকে ভেসে আসছে কারো চেঁচামেচির শব্দ।

মনন সিচুয়েশন বুঝার জন্য কেবিনের ভেতর পা রাখে। ছয় সাতজন নার্সের ভীড় কেটে সে ভিতরে যেতে যেতে প্রশ্ন করে,

“ কি হচ্ছে এখানে? “

মূল দৃশ্যটা নিজ চোখে দেখতেই মনন আশ্চর্যে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। হালকা নীল রঙা হসপিটাল বেডে হাত পা গুটিসুটি মেরে চিৎকার করে কাঁদছে সপ্তদশী মেয়েটা। তার দু হাত পা চেপে ধরে রেখেছে তিনজন নার্স। সামান্যতম শরীর নড়াচড়া করার সুযোগটা দিতে রাজি নয় তারা। আরেকজন নার্স একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ হাতে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সপ্তদশী তখন যন্ত্রণায় পুরো শরীরটা কুঁকড়ে রেখেছে। দু চোখ খিচে বন্ধ করে রেখে কান্না করতে করতে আওড়াচ্ছে,

“ ইনজেকশন দিবো না আমি। দিবো না। প্লিজ। “

মনন প্রথম দর্শনেই চিনতে পারে মোহকে। আশেপাশে তাকিয়ে একটা নার্সকে প্রশ্ন করে,

“ কাঁদছে কেন? কিসের ইঞ্জেকশন? “

একজন নার্স বিরক্তি নিয়ে জবাব দেয়,

“ স্যার, ডাব্লিউ বি সি কাউন্ট দেখে ডক্টর বলে গিয়েছে গ্রাফিল ইঞ্জেকশনের একটা ডোজ দিতে। কিন্তু পেশেন্ট দিতে চাইছে না। কান্নাকাটি করছে। জোর করে দিতে চাইলে হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে। এভাবে ইঞ্জেকশন কিভাবে দেই বলুন? “

মনন স্থির দৃষ্টি মেলে একবার মোহকে দেখে। পরপর এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর থাকা ফাইলটা হাতে নিয়ে ভেতরের পাতা গুলোয় চোখ বুলায়। মেহনামা ফেরদৌস মোহ। ফাইল নং সি আর সিক্স জিরো নাইন সেভেন। বোন এন্ড সফট টিস্যু ডিপার্টমেন্টের পেশেন্ট। ফিমার নামক অস্থিতে টিউমার রয়েছে। ফাইলে থাকা বায়োপসি রিপোর্ট অনুযায়ী টিউমারে স্টেজ থ্রি ক্যান্সারের জীবাণু শনাক্ত করা হয়েছে।

মনন ফাইলটা রেখে নার্সদের উদ্দেশ্য করে বলে,

“ ছেড়ে দিন। জোর করে ধরেবেধে ইঞ্জেকশন দিতে চাওয়াটা রিস্কি। “

একজন নার্স দ্বিধা নিয়ে বলে,

“ কিন্তু স্যার, ইঞ্জেকশন…? “

মনন এগিয়ে গিয়ে মোহর পাশে দাঁড়িয়ে স্বভাবসলুভ নরম গলায় ডাকে,

“ মোহ? চোখ খুলুন। ইঞ্জেকশন দেওয়া হচ্ছে না। কান্নাকাটি, চেঁচামেচি থামান। টক টু মি। “

কিছুটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে মোহ পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। কান্না থামিয়ে কিছুক্ষণ ফোলা ফোলা চোখ মেলে মননকে দেখে। হুট করে যেনো সে খুব পরিচিত কাউকে পেয়ে গিয়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এক লাফে উঠে বসে চটপটে গলায় বলে,

“ আপনি? কি নাম যেনো আপনার? ডক্টর মদন… নাকি মরণ? যা-ই হোক, প্লিজ এদের আমাকে ছাড়তে বলুন। আমি কোনো গ্রাফিল টাফিল নিবো না। এদের যেতে বলুন বাচ্চাদের ডক্টর। “

নিজের অনাকাঙ্ক্ষিত নাম বিকৃতিতে মননের স্বাভাবিক মেজাজটা বিগড়ে যায়। মুহুর্তেই মুখটা কালো হয়ে যায়। এই তো, এইমাত্রও তার এই মেয়েটার জন্য এজ এ হিউম্যান খারাপ লাগছিলো। কিন্তু এখন তার সেই খারাপ লাগাটা বিরক্তিতে পরিণত হয়েছে। সে চোখ তুলে দেখে দু একজন নার্স ঠোঁট টিপে হাসছে। থমথমে গলায় মনন শুধায়,

“ মনন। এম ও এন ও এন। ঠিকঠাক উচ্চারণ করুন। “

মননের বলা কথাটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মোহ মরিয়া গলায় বলে,

“ আমি এতো কিছু জানি না। আমি শুধু জানি যে এই ইঞ্জেকশন অনেক পেইনফুল। এটা আমি নিবো না। জোর করলে ডিরেক্ট কেস করে দিবো বলে দিলাম। তখন টের পাবে আমি কে। “

শেষ বাক্যটা মোহ খুব আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে। যেনো সে আসলেই খুব বড়ো কেউ। কিন্তু সেই সম্পর্কে জানার প্রয়োজন বোধ করে না মনন। একজন নার্সকে জিজ্ঞেস করে,

“ পেশেন্টের অভিভাবক কোথায়? “

নার্স কিছু বলার পূর্বেই মোহ বলে উঠে,

“ অভিভাবক দিয়ে কি কাজ? আমি বলেছি না আমি ইঞ্জেকশন নিবো না? আমার ডিসিশনই ফাইনাল। “

মনন এবার বিরক্তি নিয়ে বলে,

“ আপনি এখনো আঠারো বছরের হোন নি মিস। সুতরাং আপনার ব্যাপারে যেকোনো ডিসিশন নেওয়ার ক্ষেত্রে হসপিটাল অথরিটি আপনার ফ্যামিলির সঙ্গেই তা ডিসকাস করবে। আর বারবার ইঞ্জেকশন নিবেন না বলে চেঁচাচ্ছেন কেনো? আপনার ভালোর জন্যই গ্রাফিলের একটা ডোজ সাজেস্ট করেছে ডক্টর। চুপচাপ ইঞ্জেকশন নিয়ে নিন। “

“ না। ফাহিম আমাকে বলেছে এই ইঞ্জেকশন ভুলেও না নিতে। খুব ব্যথা হয়। এমনকি ব্যথায় জ্বর চলে আসে। আমি কখনোই এটা নিবো না। “

মনন আশ্চর্য গলায় প্রশ্ন করে,

“ ফাহিম কে? “

“ পাশের কেবিনের এগারো বছরের বাচ্চাটা। ও আমাকে বলেছে যে ডাব্লিউ বি সি কাউন্ট একটু উপর নিচ হলেই ডক্টররা এক ডোজ গ্রাফিল দিয়ে দেয়। এইটা কেমোর থেকেও বেশি পেইনফুল। ডক্টররা মিষ্টি করে হেসে বলবে এইটা কিছুই না। কিন্তু এইটা দিলে শরীরের প্রতিটা মাংসপেশিতে ভয়ংকর ব্যথা হয়। তাই পেশেন্টদের উচিত ডক্টরদের বিশ্বাস না করা। “

মনন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মাঝেমধ্যে তার মনে হয় তার বাচ্চা পেশেন্ট গুলোই বুঝি বেশি ভালো। এরকম হাতে পায়ে লম্বা তবে বাচ্চাদের মতো জেদ ধরা পেশেন্টের থেকে মননের বাচ্চা পেশেন্টদের সঙ্গে ডিল করাটাই অধিক সহজ। মনন নীরবে টেবিলের উপর থেকে একটা গ্লাভসের প্যাকেট খুলে দু’হাতে সফেদ রঙা মেডিক্যাল গ্লাভস পড়ে নেয়। অত:পর নার্সের হাত থেকে সিরিঞ্জটা নিয়ে নেয়। মোহর কাছে এগিয়ে যেতে নিলেই মোহ গুটিসুটি মেরে বেডের এক কোণে চলে যায়। মনন পেশেন্ট বশে আনতে জানে। সে সরাসরি মোহর চোখে দৃষ্টি স্থির করে। পানপাতা সরূপ মুখটায় ভয়ের ছাপ লেপ্টে আছে। মনন অত্যন্ত মোলায়েম স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কেমো নিয়েছেন আপনি? “

মোহ মাথা নেড়ে বলে,

“ প্রথম সাইকেল চলছে। “

“ কেমো কেনো দেওয়া হচ্ছে জানেন? “

“ ট্রিটমেন্টের অংশ তাই। “

“ আপনার ফিমারে একটা টিউমার আছে মোহ। কেমো দেওয়া হচ্ছে সেই টিউমারটাকে যথাসম্ভব অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য। কারণ টিউমারকে অনুকূলে নিয়ে আসতে না পারলে সার্জারি পারফর্ম করা অসম্ভব। কিন্তু টিউমারকে অনুকূলে আনার জন্য শুধুমাত্র কেমো যথেষ্ট নয়। আরো অনেককিছু স্ট্যাবল থাকা জরুরী। আপনার মনে হতে পারে ডক্টররা অযথা হিমোগ্লোবিন, প্লাটিলেট, ডাব্লিউ বি সি, আর বি সি নিয়ে এতো সিরিয়াস থাকে। কিন্তু ট্রিটমেন্ট চলাকালীন সময়ে কম্পলিট ব্লাড কাউন্ট স্থিতিশীল পর্যায়ে না থাকলে আপনার ফিজিক্যালি অনেকটা ক্ষতি হবে। সেই ক্ষতিটাকে এড়াতে আপনার ডক্টরের সাথে কো অপারেট করতে হবে। আমি বলছি না এই পুরো প্রসিডিওরে আপনার একটুও কষ্ট হবে না। অনেক কষ্ট হবে, সাইড ইফেক্ট হবে, অসুবিধা হবে। কিন্তু সুস্থ হওয়ার জন্য এতটুকু সহ্য করে নিতে পারবেন না? “

মোহ মনযোগ দিয়ে মননের কথা গুলো শুনে। অত:পর মুখ কালো করে প্রশ্ন করে,

“ আর কোনো অপশন নেই? “

মনন মাথা নেড়ে বলে,

“ অন্য কোনো অপশন থাকলে আমি এই মুহুর্তে আপনাকে তা-ই সাজেস্ট করতাম, ট্রাস্ট মি। “

মোহ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের ডান হাতটা এগিয়ে দেয়। মনন একজন নার্সকে ইশারা করে মোহর টি-শার্টের হাতাটা বাহুর দিকে উঁচু করে তুলতে। নার্স দ্রুত টি-শার্টের স্লিভটা উপরের দিকে তুলতেই মনন আগে কিছুটা তুলায় স্যানিটাইজার লাগিয়ে বাহুর চারিপাশটা জীবাণুমুক্ত করে পরিষ্কার করে নেয়। পরপর সিরিঞ্জটা নিয়ে দক্ষ হাতে পাতলা চামড়া ভেদ করে সূক্ষ্ণ সুঁচালো অংশটা ভেতরে প্রবেশ করিয়ে ইঞ্জেকশন পুশ করে। এতক্ষণ চোখ খিচে চুপ করে থাকলেও এই পর্যায়ে মোহ চিৎকার করে কান্না করে উঠে। সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে শীতল একটা মেডিসিন হাত থেকে ধীরে ধীরে যেনো তার শরীরের ভেতরে সর্বাংশে ছড়িয়ে পড়ছে। ভয়ংকর যন্ত্রণা হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে প্রত্যেকটা মাংসপেশিকে এক বিষাক্ত কিছু কাঁমড়ে ধরেছে। ব্যথাটা সহ্য সীমার মধ্যে নেই মোটেও। মোহ কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে উঠে,

“ আম্মু! আম্মু… আল্লাহ… না। “

মনন ততক্ষণে জরুরী কার্যসিদ্ধি করে সিরিঞ্জটা ফেলে দিয়ে কিছুটা তুলা হাতের ওই জায়গাটায় চেপে ধরে রাখে। নার্সকে ইশারা করে টি-শার্টের স্লিভটা নামিয়ে দিতে। নার্সরা যে যার ডিউটিতে ফিরে যায়। মোহ তখনো পুরো শরীর কুঁকড়ে কাঁদছে। মনন না চাইতেও আড়চোখে দৃষ্টিপাত করে সপ্তদশীর মুখপানে। চোখ বুজে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আর্তনাদ করে কখনো আল্লাহকে স্মরণ করছে তো কখনো নিজের মা কে। বদ্ধ চোখের কার্নিশ ঘেঁষে উত্তপ্ত জল গড়িয়ে পরছে গাল বেয়ে। কান্নার ফলস্বরূপ মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যটা বিষণ্ণ। তবুও আশ্চর্য এক মুগ্ধতায় স্থবির হয়ে যায় মনন।

মুহুর্তেই নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সে। তুলাটা সরিয়ে হাতের ইঞ্জেকশন দেওয়া অংশটা একবার দেখে নেয়। হাত থেকে গ্লাভস খুলে মনন বলে,

“ হাতের এই জায়গাটায় ব্যথা থাকবে কয়েক ঘন্টা। রাতে সাবধানে ঘুমাবেন। ঘুমের মাঝে ডান পাশে ফিরবেন না। হাতে চাপ লাগলে কিন্তু ব্যথা বেড়ে যাবে। আর যদি দেখেন জায়গাটা ব্যথায় ফুলে শক্ত হয়ে গিয়েছে তাহলে নার্সকে বলবেন। আইস প্যাক ইউজ করলেই হবে। জ্বর আসছে মনে হলেও নার্সকে জানাবেন। গ্রাফিল দিলে টুকটাক জ্বর আসেই। ঘাবড়াবেন না, তেমন সিরিয়াস কিছু না এইটা। “

কথাগুলো বলে মনন বেরিয়ে যেতে নিলেই মোহ কান্না মিশ্রিত স্বরে পিছু ডাকে,

“ ডক্টর মরণ। “

মনন চোখ কুচকে পিছনে ফিরে তাকায়। মোহ হয়তো বুঝতে পারে। সে দ্রুত গলায় বলে,

“ সরি, আপনার নাম খেয়াল থাকে না। মরণ বা মদন শব্দটা ইজি বেশি। “

“ ডেকেছেন কেনো? “

“ আমি কান্নাকাটি করেছি এইটা যেনো কেউ না জানে। নার্সদের কাইন্ডলি মানা করে দিবেন আমার ফ্যামিলিকে বিষয়টা জানাতে? ওরা যদি জেনে যায় আমি বাচ্চাদের মতো ভয় পেয়ে কান্না করেছি তাহলে আমার প্রেস্টিজ আর ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে। “

মনন বিস্মিত হয়। ব্যথা করলে তো কান্নাকাটি করাটাই স্বাভাবিক। সেটার জন্যও ইমেজ নষ্ট হয় না-কি? কি অদ্ভুৎ!

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে