অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২৯

0
48

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৯.

মোহ এবং মননের জীবনের দিন গুলো কেটে যেতে থাকলো হসপিটাল, ফোনালাপ আর বিভিন্ন জল্পনা কল্পনায় ডুবে। ক্যালেন্ডারের তারিখ আজ ১৪ ই সেপ্টেম্বর। সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে আজ। থামাথামির কোনো নাম গন্ধ নেই। তার উপর সকাল সকাল খুব কাছেই কোথাও জোরে বজ্রপাত হয়ে বাসার কারেন্ট নাই হয়ে গিয়েছে।

শীতল আবহাওয়ায় মোহর গায়ে কাটা দিচ্ছে। সেই ঠান্ডা ভাব দূর করতে এখন পর্যন্ত দু গ্লাস গরম দুধ খেয়ে ফেলেছে সে। এখন বসে বসে খেজুর খাচ্ছে। আজকে তার ব্লাড টেস্ট আছে। ব্লাড কাউন্ট নরমাল আসাটা জরুরী। না-হয় আবার তার কেমোর ডেট পিছানো হবে।

মেয়েকে নিজ গরজে এটা সেটা খেতে দেখে শিহান কিছুটা স্বস্তি পায়। এটাই তো চায় সে। মেয়ে দুটো ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করুক, সুস্থ থাকুক, ভালো থাকুক।

__________

আজকে মননের সকাল সকাল হসপিটালে যাওয়া হয় নি আর। হাফ ডে এর ছুটি নিয়েছে। এর পিছনে অবশ্য কারণও আছে। তার এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয় আজ তাদের বাসায় আসবে বলে জানিয়েছেন। ভদ্রলোক সদ্য হজ্জ করে দেশে ফিরেছেন। দেশে ফিরে উনি একে একে সকল আত্মীয়র বাসাতেই যাচ্ছেন দেখা করতে।

কায়সার পরিবারের সকল পুরুষরাই তাই আজ বাসায় উপস্থিত। টুনির মা-ও সকাল থেকে অতিথির জন্য বিভিন্ন পদের রান্না সেড়ে রেখে গিয়েছেন। এখন কেবল অতিথির অপেক্ষা।

মেহমান এলেন দুপুর বারোটা নাগাদ। লিভিং রুমটা পুরুষদের আলাপে জমে উঠলো। মনন অবশ্য বড়োদের মাঝে নীরব শ্রোতা কেবল। তাকে শুধু যতটুকু প্রশ্ন করা হচ্ছে তার বিপরীতে জবাব দিচ্ছে সে। তবে এই চুপচাপ বসে থাকা মননের কান খাড়া হয় ভদ্রলোকের কথায়।

ভদ্রলোক একটা ব্যাগ মননের দাদুর হাতে তুলে দিয়ে বলে,

“ আংকেল, হজ্জ থেকে ফেরার সময় সবার জন্যই খুব সামান্য কিছু হাদিয়া নিয়ে এসেছি আমি। এখানে আপনাদের জন্য জায়নামাজ, খেজুর এবং জমজম কূপের পানি রয়েছে। আপনি কবুল করলে খুশি হবো। “

মননের দাদু আলী আকবর সাহেব উপহার পেয়ে আপ্লুত হলেন। দোয়া করে দিলেন,

“ আল্লাহ তোমার হজ্জ কবুল করুক। “

মননের মনোযোগ আটকে রইলো কেবল ব্যাগের ভেতর থাকা জমজম কূপের পানির বোতলের প্রতি। এই খাস পানিতে বিশেষ রহমত আছে বলে জানে মনন। সুস্থতার নিয়ত করে এই পানি পান করলে আল্লাহ পাক বান্দার নিয়ত কবুলও করে নেন অনেকসময়। সুতরাং এই পানির তাদের থেকেও বেশি আরেকজনের প্রয়োজন। মনন সুযোগের অপেক্ষায় রইলো। সবাই যখন খাওয়া-দাওয়ায় ব্যস্ত মনন সে-ই সুযোগে ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা সকলের আড়ালে লুকিয়ে ফেললো।

__________

আজকে মোহ শায়লা আন্টির সঙ্গে হসপিটালে এসেছে। যদিও শিহানের আসার কথা ছিলো, কিন্তু একটা জরুরী মিটিং পড়ে যাওয়ায় তার আসা সম্ভব হয় নি। অপরদিকে মায়ারও পরীক্ষা সামনে, তা-ই তার পড়া আছে বলে বাসায় দাদুর কাছে রয়ে গিয়েছে।

সকল টেস্ট করিয়ে মোহ রিপোর্টের অপেক্ষায় আছে। রিপোর্ট এলে ডক্টরের কাছে যাবে সে। ততক্ষণ সে শায়লাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হসপিটালের বিভিন্ন জায়গা চেনাচ্ছে। এই প্রথম ক্যান্সার হসপিটালে এলো শায়লা। অবাক চোখে সে চারিদিকে তাকাচ্ছে। হসপিটাল নয় বরং এখানকার পেশেন্টদের দেখছে সে। প্রত্যেককে দেখতে তাদের মোহর মতো লাগছে। কি করুণ জীবনযুদ্ধের সাক্ষী এই হসপিটালটা ভাবতেই শায়লার মন খারাপ হয়। মনে মনে প্রার্থনা করে, রাব্বুল আল আমিন যেনো প্রত্যেককে এই যুদ্ধে জয়ী করে দেয়।

ঘুরতে ঘুরতে ক্যাফেটেরিয়াতে এসে বসে দু’জন। মোহ শায়লার জন্য কফি অর্ডার দিয়ে নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মননকে ম্যাসেজ দেয়,

“ কি করছেন? “

বেশ কিছুক্ষণ পরে রিপ্লাই আসে,

“ ওপিডিতে আছি। আপনি কি করছেন? রিপোর্ট দেখানো হয়েছে? “

“ উঁহু। কেবল টেস্ট করিয়ে আসলাম। রিপোর্ট পেতে আরো ঘন্টা খানেক লাগবে। আন্টি সাথে এসেছেন আজ। উনার সাথে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে আছি। “

মিনিট পাঁচেক পরে রিপ্লাই আসে,

“ মোহ? ছাদে আসতে পারবেন কিছুক্ষণের জন্য? আমি কিছুক্ষণের জন্য সময় বের করে নিচ্ছি। “

মোহকে ভাবুক দেখা গেলো। সে একবার আড়চোখে শায়লার দিকে তাকায়। শায়লা তখন কফি খেতে খেতে চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছে। মোহ মননকে রিপ্লাই দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। শায়লাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আন্টি আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি। তুমি এখানেই বসো। কোথাও যেও না। “

শায়লাও উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ আমিও তোমার সাথে যাবো। “

“ ওয়াশরুমে আমার সাথে গিয়ে কি করবে তুমি? আমি বড়ো হয়েছি তো! একা ওয়াশরুমে যেতে অসুবিধা নেই কোনো। তুমি এখানেই বসো। কফি খাও। “

বলে মোহ শায়লাকে বুঝ দিয়ে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে আসে। কোনো মতে লুকিয়ে লিফটের কাছে চলে যায়। মনে তার প্রশ্ন জাগে ডক্টর হঠাৎ দেখা করতে চাইলো কেনো?

__________

পরিবেশটা থমথমে, নিশ্চুপ। বৃষ্টি থেমেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। ছাদের মেঝেতে বৃষ্টির পানি জমে আছে। সেই পানির উপর ধীরে সুস্থে পা ফেলে হাঁটছে মনন। হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো মোহকে। হাসলো মনন। এগিয়ে গিয়ে বলে,

“ মা শা আল্লাহ। খুব খুশি মনে হচ্ছে আপনাকে। সামথিং হ্যাপেন্ড? “

মোহ বলতে আগ্রহী ছিলো। মনন প্রশ্ন করতেই সে সঙ্গে সঙ্গে বলা শুরু করে,

“ জানেন? লিফটে আছে না? আমার সামনে একটা ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে ছিল। উনার কোলে একটা এত্তো কিউট ছেলে বাচ্চা ছিলো। হয়তো এক দু বছর বয়স হবে। আমার দিকে তাকিয়ে গাল ভেঙে হাসছিলো। পুরাই কুচিপুচিপু একটা! রসগোল্লার মতো খেয়ে ফেলতে মন চাচ্ছিলো আমার। “

মনন লক্ষ্য করলো কথা বলতে বলতে মোহও গাল ভেঙে হাসছে। মননের জানা নেই ওই বাচ্চাটার হাসি কেমন ছিলো দেখতে, তবে মোহর হাসির ধরণ দেখে সে ধারণা করে নিলো একটা। মনের কোণে একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলেকে কল্পনা করলো। যার হাসিটা হুবুহু একদম মোহর মতো। মোহ আর তার বিয়ে হলে তাদের ছেলেও কি দেখতে এরকম হবে? নিজের অবান্তর ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে মনন মৃদু হেসে প্রশ্ন করে,

“ বাচ্চা পছন্দ আপনার? “

“ না। খুব পছন্দও না আবার অপছন্দও না। কিন্তু সাধারণত বাচ্চারা আমার দিকে তাকিয়ে এভাবে হাসে না কখনো। তাই ব্যাপারটা খুব মজার লেগেছে। আমি ফেরত হাসার পরে ছেলেটা লজ্জা পেয়ে মায়ের কাধে মুখ গুজে আবার হাসতে থাকে। “

মোহর কণ্ঠে আনন্দে ঠিকরে পড়ছে। মনন না চাইতেও হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। আজকে অলরেডি সে দুপুরের পর থেকে শিফট শুরু করেছে। তার উপর এখন আবার কিছুক্ষণের জন্য ব্রেক নিয়ে এলো। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে এসব ব্যাপার সিনিয়রদের কানে পৌঁছাবে। সেটা হবে আরেক উটকো ঝামেলা। তাই মনন বেশি কথা না বাড়িয়ে সরাসরি নিজের হাতের পানির বোতলটা মোহর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ রাখুন। “

মোহ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায়,

“ পানি দিয়ে কি করবো? “

“ জমজম কূপের পানি এটা। সুস্থতার নিয়ত করে বিসমিল্লাহ বলে খেয়ে নিবেন। আমরা ডাক্তাররা তো শুধুমাত্র উছিলা, সুস্থতার নিশ্চয়তা সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। “

মোহ অবাক হলো। মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে এরকম কিছু সে আশা করে নি। অপ্রস্তুত গলায় প্রশ্ন করে,

“ আমার জন্য? “

“ হ্যাঁ, আপনার জন্যই। “

মোহ কিছুক্ষণ থম মেরে মননের দিকে তাকিয়ে রইলো। বুঝে উঠতে পারলো না তার আর মননের মাঝে না থাকা সম্পর্কটা এতো গভীর কবে হলো? নিজের সতেরো বছরের এই জীবনে এতো চমৎকার কোনো উপহার কি মোহ কখনো পেয়েছিল? উঁহু। কেউ দেয় নি এরকম উপহার।

অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি এসে যেমন শহরটাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়, ঠিক সেরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই মোহ উপলব্ধি করলো এই লোকটার তার প্রতি শুধু মায়া নেই। আরও কিছু আছে এই লোকের মনে। গভীর কিছু, অদৃশ্য কিছু।

মনন মৃদুস্বরে ডাকে,

“ মোহ? “

মোহ হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিলো। অত:পর কিছু না বলে নীরবেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো। মনন অবাক হয়। পিছু ডাকে। মোহ ফিরে তাকায় না। মনন দ্বিধায় পড়ে যায়। সে কি ভুল কিছু করেছে? মোহ কি তার কোনো আচরণে কষ্ট পেলো? মনন বুঝতে পারে না সে কি করেছে। তবে মনে মনে দোয়া করে যেনো তার দ্বারা এই মেয়েটা কখনো কষ্ট না পাক।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে