অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২৮

0
6

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৮.

বাসার কলিংবেলটা অবিরতভাবে বেজে চলেছে। আলী আকবর কায়সারের চোখে মুখে বিরক্তি ভাব স্পষ্ট। এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। গাধার বাচ্চার ঘরে একমাত্র বাচ্চাটা দরজা না খুলে কোথায় উধাও হয়ে গেলো হুট করে? আলী আকবর কায়সার দরজায় করাঘাত করতে নিবে ঠিক সে-সময় হাট করে দরজাটা খুলে যায়। মুখে চওড়া হাসি ঝুলিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মনন। দাদুকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আরে দাদু! তুমি? হসপিটাল থেকে আজকে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলে? কিছু ভুলে গিয়েছো? তোমার কষ্ট করে ভেতরে আসতে হবে না, আমাকে বলো আমি খুঁজে এনে দিচ্ছি। “

আলী আকবর কায়সার নিজের অভিজ্ঞ দৃষ্টি দিয়ে নাতিকে পরখ করেন। মনন নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে যায়। আলী আকবর সাহেবের সন্দেহজনক লাগে ব্যাপারটা। উনি মননকে পাশ কাটিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে করতে বলে,

“ অযথা ছাগলের মতো হাসছো কেন? “

মনন নিজের চুরি লুকাতে অতিশয় ব্যস্ত। সে না চাইতেও আরো একদফা হেসে বলে,

“ হাসছি? আমি কি হাসছি? ওহ! আমার মুখটাই আসলে হাসি-হাসি টাইপ। তাই তোমার মনে হচ্ছে আমি হাসছি। “

আলী আকবর কায়সার আবারও সূক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে নাতিকে পরখ করেন। তিনি এবার ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়িটা একবার দেখতে থাকেন। উনার মন বলছে মনন কিছু একটা লুকাচ্ছে উনার থেকে। দাদুকে এভাবে গোয়েন্দাদের মতো অনুসন্ধান করতে দেখে মননের কপাল থেকে ঘাম ছুটে যায়। শরীর অসাড় লাগে। ভয়ে মনে হচ্ছে আরো এক দফা জ্বর এসে পরবে।

মননের আতংক তীব্র হয় যখন আলী আকবর কায়সার তার রুমের দিকে পা বাড়ায়। মনন দৌড়ে গিয়ে নিজের রুমের বদ্ধ দরজার সামনে দু-হাত মেলে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আতংকিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ আমার রুমে তোমার কি কাজ? “

আলী আকবর সাহেবের মনে হয় উনি সঠিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছেন। মননের এই অস্বাভাবিক আচরণই প্রমাণ দেয় যে সে কিছু একটা লুকাচ্ছে। আলী আকবর সাহেবের ধারণা তিনি মননের রুমে প্রবেশ করলেই হাতেনাতে কিছু একটা ধরতে পারবেন। কি হতে পারে সেটা? বৃত্তের মাঝে ওই নাম না জানা মেয়েটার চুল আর কালো জাদুর আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র?

আলী আকবর সাহেব এবার গম্ভীর স্বরে সরাসরি প্রশ্ন করে,

“ কি লুকাচ্ছো তুমি? “

মনন বুঝে যায় আর দুই মিনিট সে সত্যিটা লুকানোর চেষ্টা করলে যেকোনো ভাবে ধরা পড়েই যাবে। তাই সেই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে সে কথা ঘুরিয়ে এক অকল্পনীয় কাজ করে ফেলে। নিজের দাদুকে জড়িয়ে ধরে উনার রুমের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ দাদু তোমার এখন আগে গোসল করা উচিত। তোমার শরীর থেকে হসপিটালের গন্ধ আসছে। মেডিসিনের গন্ধে আমার মাথা ব্যথা করছে। তাড়াতাড়ি যাও তুমি। আগে গোসল করো, পরে সব কথা হবে। “

বলতে বলতে মনন আলী আকবর সাহেবেকে ঠেলে উনার রুমে পাঠিয়ে দ্রুত দরজা বাহির থেকে আটকে দেয়। সাথে সাথে ভেতর থেকে দরজা ধাক্কাতে শুরু করে আলী আকবর সাহেব। চিল্লিয়ে বলতে থাকে,

“ মনন! অসভ্যের বাচ্চা কি লুকাচ্ছো তুমি? কোন মিথ্যা পর্দা দিয়ে ঢাকতে চাচ্ছো তুমি… “

আলী আকবর সাহেবের চেঁচামেচিকে খুব একটা পাত্তা দেয় না মনন। পরে না-হয় সে কিছু একটা বলে দাদুকে সামলে নিবে। আপাতত মোহকে নিয়ে বের হওয়াটা বেশি জরুরী।

মনন দ্রুত গিয়ে নিজের রুমের দরজা খুলতেই দেখতে পায় বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মোহকে। রুমের ভেতর থেকে এতক্ষণ সে মননের সব মদন মার্কা কথাবার্তা শুনেছে। মননকে দেখতেই সে ফুঁসে উঠে বলে,

“ এতো থার্ড ক্লাস আর বাকওয়াস এক্টিং করেন আপনি! জীবনে কখনো মিথ্যা টিথ্যা বলেন নি? আপনার কথা শুনে তো একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও বুঝে যাবে যে ডাল মে কুছ কালা নেহি বরং পুরো ডালই কালা। “

মনন তাড়া দেখিয়ে বলে,

“ এখন তাড়াতাড়ি চলুন। আপনাকে আগে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। বাসায় ফিরে আমার আরেক তুফান সামলাতে হবে। “

বলে মনন দ্রুত মোহর হাত ধরে টেনে রুম থেকে বের হয়। চোরের মতো তাড়াতাড়ি জুতো পড়ে দরজা লক করে লিফটের সামনে গিয়ে হাজির হতেই লিফটের দরজা খুলে যায়। মনন পা বাড়াতে নিয়েও হঠাৎ থেমে যায়। লিফটের ভেতর থেকে এক জোড়া বিস্ফোরিত দৃষ্টি তাকে দেখছে অবাক হয়ে। মনন অপ্রস্তুত বোধ করে। মনে মনে ভাবে আজ সকালে উঠে সর্বপ্রথম কার মুখ দেখেছিল সে? মননের মনে পড়ে সে রুম থেকে বেরিয়ে সর্বপ্রথম টুনির মা’কে দেখেছিল। টুনির মা! ওই মহিলাটাই তাহলে কুফা! উনার কারণে আজ মননের দিনটা খারাপ যাচ্ছে এতো।

মননকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে মোহ তাড়া দেয়,

“ কি ব্যাপার? সমস্যা কি? খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে পড়েছেন কেনো? তাড়াতাড়ি চলুন। আপনার দাদু এনিটাইম দরজা ভেঙে বেরিয়ে যাবে। “

লিফটের ভেতর হতভম্ব মুখে দাঁড়িয়ে থাকা আরিফ সাহেব এবার ছেলের থেকে চোখ ফিরিয়ে মোহকে লক্ষ্য করে। লক্ষ্য করে মননের মোহর হাত ধরে রাখার ব্যাপারটাও। মনন কিছুটা অপরাধীর ন্যায় বলে,

“ আব্বু তুমি যা ভাবছো সেরকম কিছু না। উনি আমার পেশেন্ট। আমাদের মধ্যে কিছু নেই। “

আরিফ সাহেব লিফট থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে কেবল থমথমে গলায় বলে,

“ ওহ আচ্ছা। তুমি যে আজকাল বড়ো বাচ্চাদের উপরও ডাক্তারি করছো তা আমার জানা ছিলো না। হয়তো আমাকে বলতে ভুলে গিয়েছো। “

পুরো ব্যাপারটা বুঝতেই মোহ নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বিশ্লেষণ দেওয়ার মতো করে বলে উঠে,

“ আংকেল আসলেই আমাদের মাঝে কিছু নেই। আপনার ছেলের চেহারা দেখুন। আপনার মনে হয় এই কনফিডেন্স, আই-কিউ আর হিউমার নিয়ে উনার জীবনে প্রেম হবে? “

মনন নিজের ইজ্জত নিলামে উঠার আগেই মোহকে টেনে নিয়ে লিফটে উঠে পড়ে। দ্রুত গ্রাউন্ড ফ্লোরের বাটন চেপে দিয়ে নিজের আব্বুকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আব্বু, আমি এসে তোমাকে সব বুঝাচ্ছি। আরেকটা কথা, প্লিজ দাদুকে এই ব্যাপারে কিছু বলো না। দাদুকে ক বললে দাদু চন্দ্র বিন্দু বুঝবে। “

লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আরিফ সাহেব আপন জায়গায় কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। অনুভব করলো উনি ঘামছেন। ছেলের এই নতুন রূপ উনার বোধহয় জ্বর এনে তবেই ক্ষান্ত হবে।

__________

মোহকে নিজ বাসায় পৌঁছে দিয়ে ঘন্টা খানিক পরে বাসায় ফিরলো মনন। তবে বাসার দরজার কাছে এসেই থেমে গেলো সে। ভেতরে প্রবেশ করার সাহস খুঁজে পাচ্ছে না সে। কি বলবে সে? ধ্যাৎ! মনন মনে মনে বিপদের যাবতীয় সকল দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে নিলো। নিজেকে শাসালো,

“ তুই একটা এডাল্ট মনন। এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ভয় পাওয়া তোকে মানায় না। বি এ ম্যান। ইউ ক্যান হ্যান্ডেল ইট। কাম ওন! “

মনে মনে নিজেকে সাহস জুগিয়ে মনন দরজার নব ঘুরালো। দরজা লক করা ছিলো না। তাই সে সহজেই প্রবেশ করতে পারলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে বাসাটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই।

মননের মনে হলো এটাকেই বোধহয় ঝড়ের আগের নীরবতা বলে। সে পা টিপে টিপে একবার নিজের আব্বুর রুমে উঁকি দিলো। আব্বু রুমে নেই। বাথরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। সম্ভবত গোসল করছেন। মনন এবার উঁকি দিলো নিজের দাদুর রুমের দিকে। দাদু থম মেরে বিছানায় বসে আছে।

মনন আরেক দফা বুকে ফুঁ দিয়ে রুমে পা রাখলো। আলী আকবর সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে নমনীয় স্বরে ডাকে,

“ দাদু। “

আলী আকবর সাহেব চোখ তুলে তাকায় না। মনন বুঝে উঠতে পারে না তার কি বলা উচিত। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে সে বলে,

“ দাদু আমি আসলে একজনের জন্য গিফট রেডি করছিলাম। রুমে ঢুকে পড়লে তুমি ওটা দেখে ফেলতে তাই ওরকম করেছি। আমি কোনো খারাপ কাজ করছিলাম না বিশ্বাস করো। “

আলী আকবর কায়সার এবার সরাসরি মননের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ আমি কখন বললাম তুমি খারাপ কাজ করছিলে? “

মনন নিজের প্রতি বিরক্ত হয়। ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাস বাংক না করে মস্ত বড়ো ভুল করেছে সে। অন্তত মিথ্যেটা তাহলে আজ ঠিকঠাক বলতে পারতো। আলী আকবর সাহেব আর জবাবের অপেক্ষা করেও না। বরং ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ আমি আর এই ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করবো না। তবে এটা স্পষ্ট যে তুমি কিছু লুকাচ্ছো। আমি আশা করবো সেটা যা-ই হোক, তোমার জন্য যেনো মঙ্গলকর হয়। “

মনন এবার কিছুটা আনমনে বলে বসে,

“ ট্রাস্ট মি দাদু, যা লুকাচ্ছি তা নিজেই একদিন তোমাদের জানিয়ে দিবো। আর সেটা খুব চমৎকার কিছু। এর থেকে ভালো কিছু নেভার হ্যাপেন্ড টু মি। “

__________

দাদুর সঙ্গে ব্যাপারটা মিটমাট করে নিয়ে এবার আরিফ কায়সারের কাছে হাজির হয় মনন। ভদ্রলোক কেবল গোসল সেড়ে বেরিয়েছেন। ছেলেকে রুমে দেখেও না দেখার ভান করলেন তিনি। মনন সেধে কথা শুরু করে,

“ বাবা। সত্যিই ওর সাথে আমার কিছু নেই। ট্রাস্ট মি ও জাস্ট আমাকে একটা গিফট দিতে এসেছিলো। “

আরিফ সাহেব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে হেয়ার ব্রাশ চালাতে চালাতে জবাব দেয়,

“ তোমাদের মাঝে কিছু নেই এটা মেয়েটার কথা শুনেই আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি। ও বেশ কনফিডেন্টলি এটা স্বীকার করেছে। কিন্তু ওর প্রতি তোমার মনে কিছু নেই এই ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। আমি নিজেও তোমার আম্মুকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। তুমি ওর হাত ঠিক সেভাবে ধরেছিলে যেভাবে এককালে আমি তোমার আম্মুর হাত ধরতাম। “

মনন জানে এই সব ব্যাপার সে তার ঘরের পুরুষদের থেকে বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারবে না। তার বাপ, দাদা এসব ব্যাপারে বেশ অভিজ্ঞ। তাই সে নিজের দিকটা না লুকিয়ে স্বীকার করে,

“ অস্বীকার করবো না, আই রিয়েলি ডু হ্যাভ ফিলিংস ফর হার। “

আরিফ সাহেবের বুক হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে এই ভয়টাই কাজ করছিলো তার। ছেলের দিকে তাকিয়ে উনি প্রশ্ন করে,

“ ও কি অসুস্থ? “

“ হ্যাঁ। কিন্তু ও সুস্থ হয়ে যাবে। তোমার ধারণা নেই ও কতটা ব্রেভ। “

আরিফ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনের উপর কারো জোর নেই। মননেরও নেই। তবে উনি চায় না উনার ছেলে কষ্ট পাক। তাই এগিয়ে গিয়ে ছেলের কাধে হাত রেখে বলে,

“ ইউ হ্যাভ টু মেক শিওর ও যেনো সুস্থ হয়। ডু এভ্রিথিং টু কিপ হার এলাইভ। আমি আমার ছেলেকে কষ্ট পেতে দেখতে চাই না। “

মনন কিছুটা ভরসা খুঁজে পায়। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে,

“ ও সুস্থ হবে। অবশ্যই হবে। তোমাকে আর দাদুকে ওর বাসায়ও যেতে হবে। এই সংসারে কেউ আসুক তোমরা চাও না? মোহই আসবে। “

আরিফ সাহেব জবাব না দিয়ে কেবল হাসে। মননের মতো এতো আত্মবিশ্বাস উনার মাঝে নেই। ছেলে তার খুব সিরিয়াস মেয়েটার ব্যাপারে। কিন্তু মেয়েটার অসুস্থতাটা কোন পর্যায়ে আছে কে জানে! মনের ভয়টা ছেলের সামনে আর প্রকাশ করেন না তিনি।

__________

বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে বয়ে আসা বাতাসে রুমের সফেদ পর্দা গুলো উড়ছে। মনন রুমে প্রবেশ করতেই সেই শীতল বাতাস এসে তার গায়ে ধাক্কা খেলো। মনন এগিয়ে যায় বারান্দার দিকে। তবে দরজা লাগাতে নয়, বরং বারান্দায় রাখা ছোট চারাগাছটা দেখতে।

বারান্দায় গিয়ে চারাগাছটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মনন। হাত বাড়িয়ে আলতো ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দেয় ছোট ছোট পাতা গুলোকে। মনে পড়ে যায় মোহকে দেওয়া ফুলের কথা। সে তো কেবল ফুল দিয়েছে, আর এই মেয়ে সোজা ফুলের গাছ দিয়ে গেলো তাকে।

ব্যাপারটা অবশ্য অর্থবহ লাগে মননের কাছে। গাছহীন ফুলের যত্ন নিলেও সেটা মরে যায়। কিন্তু ফুল গাছের যত্ন ঠিকঠাক ভাবে নিলে সেটা কখনো মরে না। বরং প্রতি বছর ঋতু এলে সেই যত্নের বিনিময়ে দেয় অজস্র ফুল।

মনন হেসে উঠে রুমে ফিরে আসে। মনে মনে ঠিক করে আজ বিকেলেই গিয়ে একটা নতুন টব কিনে নিয়ে আসবে সে চারাগাছটার জন্য। একটা সুন্দর টব। ভাবতে ভাবতে টেবিলের দিকে চোখ পড়তেই মনন দেখে জুসের মগটা। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তখন সে এই মগটা সহ মোহকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

মনন এগিয়ে গিয়ে দেখে মগটা খালি। অর্থাৎ মোহ একা রুমে বসে জুসটুকু খেয়েছিল। মনন মগটা হাতে তুলে নিতেই দেখে সেটার নিচে একটা চিরকুট ভাজ করা। মনন কিছুটা অবাক হয়। চিরকুটটা হাতে তুলে নিয়ে ভাজ খুলতেই দেখে সেখানে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা,

“ টেস্ট খারাপ না। রেটিংস ৭/১০। তিন পয়েন্ট কাটলাম কারণ আমার মাল্টা পছন্দ না। “

মনন চিরকুটটা পড়ে হেসে দেয়। অর্থাৎ সাত পয়েন্টটা একান্তই মননের। মগটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হতে নিয়েও আর বের হলো না সে। এই মগটা ক’দিন আগে ইতালি থেকে আসার সময় নিজের জন্য নিয়ে এসেছিল দাদু। এখনো যদিও এটা ব্যবহার করা হয় নি। তখন বেখায়েলিতে মনন এই মগেই জুস সার্ভ করে দেয় মোহকে। এখন এই মগটা ফেরত জায়গায় রেখে আসলে ক’দিনের মধ্যেই দাদু এটা ইউজ করা শুরু করবে। মননের ইচ্ছে হলো না মোহর ব্যবহার করা মগটা দাদুর জন্য তুলে রাখতে। তাই সে এটাকে ওয়াশরুমে নিয়ে ধুয়ে নিজের রুমেই গোপন বাক্সে পাচার করে দিলো। সেই সঙ্গে চিরকুটটাকেও।

__________

বাতাসে উড়তে থাকা চুলগুলোর প্রতি বিরক্ত হয়ে সেগুলোকে হাত খোপা করতে নিলো মোহ। কিন্তু হঠাৎ কারো বাঁধায় তার হাত থেমে যায়। কানের কাছে কেউ ফিসফিসিয়ে বলছে,

“ খবরদার চুল আটকাবে না। “

মোহর রাগ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে রাগ হলো না। বরং চমৎকার করে হাসলো। তার পিছনে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার নৈকট্য বেশ উপভোগ করছে সে। মানুষটার চোখে মুখে প্রেমময় ঘোর লেপ্টে আছে। ঠোঁটের কোণে হাসি।

মোহ এবার পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায় মানুষটার দিকে। হেসে বলে,

“ চাঁদ দেখার নাম করে বারান্দায় ডেকে এনে অযথা দাঁড় করিয়ে রেখেছো। কোনো চাঁদ ফাঁদ দেখছো না তুমি। শুধু আমাকে বিরক্ত করছো। “

পুরুষটা ঘোর লাগা গলায় বলে,

“ কে বললো চাঁদ দেখছি না? “

কথার অর্থ বুঝতে পেয়ে মোহ লাজুক হাসলো। টের পেলো আরো নৈকট্যতা। মানুষটা যখন তার অধর ছুঁই ছুঁই পর্যায়ে ঠিক সেই সময় চোখের সামনে সবটা অন্ধকার হয়ে গেলো। মোহ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। ঘামছে সে। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলছে। মননকে ঘিরে এমন একটা নির্লজ্জ স্বপ্ন দেখার অপরাধে লজ্জায় চোখ মুখ শক্ত করে বসে থাকলো বেশ কতক্ষণ। মনে মনে সবটুকু দোষ নিয়ে ফেললো কে ড্রামার উপর। ঘুমানোর পূর্বে একটা ড্রামা দেখছিল সে। সেই ড্রামায় নায়কের নায়িকাকে চুমু খাওয়ার দৃশ্যটার প্রভাবই বোধহয় তার মস্তিষ্কে পড়েছে। না-হয় এতো বাজে একটা স্বপ্ন কেউ দেখে না-কি? মোহ মনে মনে ঠিক করলো সে আর এসব ড্রামা ট্রামা দেখবে না। দিনদিন তার মস্তিষ্ক লাটে উঠছে খুব। ড্রামা না দেখার সিদ্ধান্তটা নিতেই মোহর মনে প্রশ্ন জাগলো, স্বপ্নের এরকম একটা পরিস্থিতিতে সে নিজেকে মননের সঙ্গেই কেন আবিষ্কার করলো?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে