অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২৬

0
9

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৬.

তারাখচিত আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে মোহ। নিজ রুমের জানালার ধারে বেতের সোফা পেতে বসে আছে সে। আজ বহুদিন পর আকাশে তারার দেখা মিললো। বিগত তিন চারদিন ধরে তো আকাশে জমা হওয়া মেঘের কারণে চাঁদের দেখাও মিলে নি। তবে আজকে সারাদিন বৃষ্টি না হওয়ায় আকাশটা বেশ পরিষ্কার দেখাচ্ছে।

মোহর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন এলোমেলো ভাবনা। যদি সে সুস্থ হয়? তারপর তার জীবনটা কেমন হবে? জীবনটা কি পুরোপুরি আবার আগের মতো হয়ে যাবে? মোহর বাহ্যিক রূপ, জীবন, স্বপ্ন সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে তো? নাকি কিছুই ফিরে পাবে না সে?

মোহ আকাশ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে আয়নার দিকে তাকায়। ভালো করে দেখে নিজেকে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয় নিজের গালটা। গায়ের রঙটা কেমন ময়লা হয়ে গিয়েছে। মাথার চুলের পাশাপাশি চোখের পাতা থেকে পাপড়ি এবং ভ্রু ও সব ঝরে পড়ে গিয়েছে। হাতে পায়ের শুভ্র নখ গুলোও কেমন কালো রঙ ধারণ করেছে।

মোহ জানে সবটাই কেমোর পার্শ প্রতিক্রিয়া। তবে ডক্টর তাকে আরেকটা সাইড ইফেক্ট সম্পর্কেও জানিয়েছিল। সেটা হচ্ছে কেমোর কারণে অনেক সময় ক্ষেত্র ভেদে অনেক নারীদের ঋতুস্রাব সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। অনেক নারীদের স্থায়ী ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। স্থায়ী ভাবে যাদের বন্ধ হয়ে যায়, সে-সকল মেয়েদের ভবিষ্যতে মা হওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় চলে যায়।

মোহকে এই ক্ষেত্রে ভাগ্যবতী বলা যায়। এতো এতো সাইড ইফেক্টের মাঝে এই একটা সাইড ইফেক্ট থেকে সে রেহাই পেয়েছে। যদিও বাচ্চাদের প্রতি তার বিশেষ কোনো টান নেই, তবুও অদূর ভবিষ্যতে একটা বাচ্চা সকল মেয়েরই কাম্য। মোহও তার ব্যতিক্রম নয়। মায়ার জোরাজুরিতে মাস কয়েক আগে দুই বোন মিলে নিজেদের বাচ্চার নামও ঠিক করে রেখেছে। মোহ বহু ভেবে ঠিক করেছে তার কখনো ছেলে হলে নাম রাখবে মেসুত ওজিল। আর মেয়ে হলে নাম রাখবে শাকিরা। এরকম উদ্ভট নাম শুনে মায়া হতভম্ব হলেও মোহর মাঝে তেমন একটা ভাবান্তর দেখা যায় নি কখনো। ছেলের নাম ভাবতে গিয়ে তার মাথায় সর্ব প্রথম মাদ্রিদের প্রাক্তন এই মুসলিম খেলোয়াড়ের কথাই মনে পড়েছিল। আর মেয়ের নাম ভাবতে গিয়ে তার ২০১০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের ওয়াকা ওয়াকা গানের কথা মনে পড়েছিল।

মোহর অবান্তর ভাবনার ভীড়ে ভাটা পড়ে ফোনকলের কর্কশ শব্দে। মোহ ফোনের দিকে না তাকিয়েই বুঝে যায় কার কাছ থেকে কলটা আসছে। ইদানিং কল করে তার খোঁজ খবর নেওয়ার এক অদ্ভুৎ বাতিক রোগ হয়েছে ডক্টরের। মোহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অত:পর কলটা রিসিভ করে। ফোনের অপর পাশ থেকে একটা খোশমেজাজ পুরুষ শুধালো,

“ কেমন আছেন? শরীর ভালো? এলার্জি জনিত কোনো সমস্যা হয় নি তো পরে? “

“ ভালো আছি। শরীরও ঠিকঠাক। উঁহু, কোনো অসুবিধা হয় নি। “

“ যাক আলহামদুলিল্লাহ! কি করছিলেন? খাওয়া দাওয়া করেছেন? ওষুধ খেয়েছেন? “

“ খেয়েছি। ওষুধও খেয়েছি। আপাতত বসে আয়নায় নিজেকে দেখছিলাম। “

শেষ বাক্যে মোহর কণ্ঠে হতাশা ঠিকরে পড়ে। মনন স্পষ্ট টের পায় তা। নিশ্চয়ই এই মেয়ে আবারও নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছে? মনন কথা ঘুরিয়ে বলে,

“ আজকে একটা বাচ্চা এসেছিল। বাচ্চাটা স্টেথোস্কোপকে কি বলছিলো জানেন? হরোস্কোপ। কি একটা অবস্থা! কেউ টোটোস্কোপ বলে তো কেউ হরোস্কোপ! “

বলে মনন হাসতে থাকে। মোহর কপাল কুচকে আসে। সন্দিহান গলায় জানতে চায়,

“ আপনি কি আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছেন? “

“ উঁহু। মোটেও না। সত্যি বলতে টোটোস্কোপ শব্দটা বেশি কিউট! “

মোহ এবার আগ্রহী গলায় বলে,

“ জানেন? আমি ছোট বেলা থেকেই ভুলভাল উচ্চারণ করি। জানালা আছে না? ছোটবেলায় ওটাকে জালানা বলতাম আমি। আবার রিকশাকে রিশকা বলতাম। এমনকি একবার জেনারেল নলেজ এক্সামে বাংলাদেশের রাজধানী কি জানতে চাওয়ার পরে আমি কি উত্তর দিয়েছিলাম জানেন? কাকা! “

বলেই মোহ হাসিতে ফেটে পড়ে। হাসে মননও, তবে নীরবে। বলে,

“ অভ্যাসটা তাহলে ছোটবেলারই! “

“ হ্যাঁ। আবার কাচ্চি আছে না? ছোটবেলায় ওটাকে আমি হাচ্চি বলতাম। “

নিজের ভুলভাল উচ্চারণের চ্যাপ্টার খুলে বসা মোহ সাময়িকের জন্য ভুলে গেলো নিজের অসুস্থতা। ভুলে গেলো তার জীবনে কি চলছে। নিজের বর্তমানটাকে ভুলে গিয়ে ফিরে গেলো অতীতে। মননকে শোনাতে থাকলো নিজের শৈশব কথন। মননও কফির মগে চুমুক বসিয়ে নীরব শ্রোতার মতো শুনতে থাকলো মোহর কথা। কথায় কথায় মোহ বললো,

“ জানেন? আমার না পাইলট হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু এখন তো আর সম্ভব না। ফিজিক্যাল ফিটনেস টেস্টে আন্ডা পাবো আমি। আকাশে উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছা আর পূরণ হবে না আমার। “

“ আকাশে ভ্রমণের জন্য পাইলট হওয়াটা জরুরী নয়। পেসেঞ্জার হয়েও আকাশের বুকে আপনি উড়তে পারবেন। আকাশ উপভোগ করতে পারবেন। “

মোহ হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে প্রশ্ন করে,

“ আপনার আমার জন্য মায়া হয় তাই না? আমার জন্য খারাপ লাগে আপনার। এই কারণে আপনি আমার এতো চিন্তা করেন, ঠিক বলেছি? “

মনন জবাব দিতে পারে না। মোহকে নিজের মনের খবর না জানানোর পিছনে এটাও একটা কারণ। এই মেয়ে ভেবে বসবে মননের মনে যা আছে তা কেবল দয়া মায়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। মননের অনুভূতির গভীরতা বোঝার মতো বোধ এখনো এই মেয়ের হয় নি। আর তাছাড়া মোহর সম্পূর্ণ মনযোগ এখন শুধুমাত্র কিভাবে সুস্থ হওয়া যায় এই ব্যাপারেই হওয়া উচিত বলে মনে করে মনন। এসব জটিল অনুভূতির ভার এই মুহুর্তে সে মোহর উপর চাপাতে চাইছে না।

“ এই, আছেন? “

মোহর ডাকে মননের ধ্যান ভাঙে। ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বলে,

“ জি। বলুন। আছি। “

মোহ আর ওই ব্যাপারে কথা আগায় না। কথা ঘুরিয়ে অন্য বিষয়ে চলে যায় সে।

__________

অদ্ভুৎ ভাবে হুট করেই গতরাত থেকে মননের প্রচুর জ্বর এসেছে। বাধ্য হয়ে সে হসপিটাল থেকে একটা দিনের ছুটিও নিয়ে নিয়েছে। নাওয়া খাওয়া দাওয়া সব কিছু বাদ দিয়ে সকাল থেকে জ্বরে কাবু হয়ে কেবল ঘুমোচ্ছে। ছেলের হঠাৎ জ্বরে আরিফ কায়সারও বেশ চিন্তিত। তার ছেলে ছোটবেলা থেকেই স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ায় খুব একটা অসুস্থ হয় না। তাই ছেলের আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়াতে উনি বিচলিত বোধ করে।

আলী আকবর কায়সার সকাল থেকে কয়েকবার নাতির রুমের চক্কর কেটে গিয়েছে। রাতারাতি জ্বরে কাবু হয়ে গিয়েছে তার আদরের দুলাল। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। দেখতেও কেমন রোগা-সোগা লাগছে।

শুক্রবার হওয়ায় আরিফ সাহেব এবং আলী আকবর সাহেব দু’জনেই আজ বাসায় আছে। মননের এরকম অবস্থা দেখে জীবনে প্রথম বারের মতো তার দাদু ডক্টরকে তলব না করে পরিচিত, বিশ্বস্ত এক হুজুরকে তলব করেন। বাসায় ডেকে এনে বলেন,

“ আমার নাতির উপর সম্ভবত কিছু একটা আছর করেছে হুজুর। ইদানিং ওর আচার-আচরণ কেমন বদলে গিয়েছে। একা একা হাসে। আপনি একটু ওকে দেখে বলুন তো আমার নাতির কি হয়েছে। “

আরিফ কায়সার পড়েছেন বিপাকে। না পারছে নিজের বাপের মুখের উপর কিছু বলতে আর না পারছে এসব সহ্য করতে। কে জানে মনন এসব দেখলে কেমন রিয়েক্ট করবে!

মননের রুমে যখন হুজুরকে নিয়ে প্রবেশ করে তার দাদু, তখন মনন অর্ধ ঘুমে নিমজ্জিত। তবে হুজুর বেশের একজনকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে তার মস্তিষ্ক সজাগ হয়। নম্র কণ্ঠে হুজুরকে সালাম দিয়ে বলে,

“ হুজুর? আপনি হঠাৎ? “

পাঞ্জাবি এবং লুঙ্গি পরিহিত হুজুর ভদ্রলোক মননকে দেখে নিয়ে দোয়া পড়তে শুরু করে। মনন বোকার মতো তাকিয়ে থাকে কেবল। বেশ কতক্ষণ কুরআনের কালাম পড়ে মননকে ভালো মতো দেখে হুজুর আলী আকবর সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আপনার নাতি ঠিক আছে সম্পূর্ণ। খারাপ কিছুর ছায়া নেই ওর উপর। আপনি অযথা চিন্তা করছিলেন। “

মনন পুরো ঘটনা বুঝতে পেরে তপ্ত দৃষ্টি মেলে নিজের দাদুর দিকে তাকায়। সেই দৃষ্টি লক্ষ্য করে আলী আকবর কায়সার দ্রুত হুজুরকে নিয়ে মননের রুম থেকে বিদায় হয়। মনে মনে বলতে থাকে,

“ সব যদি ঠিকই থেকে থাকে তাহলে এই ছেলের আচরণ কেমন সন্দেহজনক কেনো? “

__________

বিকালে হুজুরের সেই ঘটনার পর থেকে মননের সামনে আসছে না তার বাপ, দাদা কেউ-ই। মননও আর তেমন একটা রাগারাগি করে নি। দুপুরে ওষুধ খাওয়ার পর থেকে ঘাম ছেড়ে ধীরে ধীরে জ্বর কমে আসছে এতেই সন্তুষ্ট সে। রুমে শুয়ে বসে অসুস্থ সময় পাড় করা মনন সন্ধ্যার পরপরই মোহকে কল করলো। কিন্তু ফোনটা বন্ধ পেয়ে সে বেশ অবাক হলো।

মনন ধরে নেয় হয়তো ফোনে চার্জ নেই তাই ফোন বন্ধ। মনন আর ব্যাপারটাকে তেমন একটা ঘাটায় না। তবে তার চিন্তা বাড়ে রাতে। খাওয়ার পর মোহর নাম্বারে আরো একবার কল করে মনন। এবারও ফোনটা বন্ধ পেয়ে মননের চিন্তা হয়। অদ্ভুৎ তো! গতরাতেও তো তাদের কথা হলো! হুট করে মেয়েটার ফোন বন্ধ আসছে কেন? মোহ ঠিক আছে তো?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে