অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৫.
সারারাত ধরে সোজা হয়ে শুয়ে কেমো পোর্টের মাধ্যমে এক ব্যাগ ব্লাড নেওয়ার পর থেকে মোহ দুই চোখে সব অন্ধকার দেখছে। সারারাত একটানে সোজা হয়ে শুয়ে থাকার কারণে কমোর আর পা ব্যথায় কামড়াচ্ছে। নির্ঘুম রাত্রি পাড় করার ফলস্বরূপ মাথাও ভার হয়ে আছে।
সেই যন্ত্রণা নিয়ে তাকে এখন আবার বিকেল থেকে দ্বিতীয় ব্যাগ ব্লাড নিতে হচ্ছে। এই ব্যাগ শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে। তীব্র মাথা ব্যথার মাঝেও মোহর মনে প্রশ্ন জাগে আচ্ছা তার শরীরে যেই রক্তটা যাচ্ছে সেটা কার? কোনো ছেলের নাকি মেয়ের? মানুষটার ধর্ম কি? মুসলমান? হিন্দু? বৌদ্ধ? খ্রিষ্টান? নাকি ইহুদী?
মোহ জানে যে তার এসব ভাবনা গুলো নেহাৎই অবান্তর। রক্ত দেওয়া নেওয়ার সময় জাত, ধর্ম, গোত্র মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য হলো রক্তদাতার নিয়ত। একটা মানুষ নিজের শরীরের রক্ত দান করছে কারো জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে সেটাই আসল।
শিহান বারবার ঘুরে ঘুরে ব্লাড ব্যাগটা চেক করছে। মোহ শুয়ে শুয়ে দেখছে নিজের উৎসাহী তবে চিন্তিত বাবাকে। শুকনো মুখে প্রশ্ন করে,
“ তোমার কি ইদানিং অফিসে কাজ থাকে না? “
শিহান অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে মেয়ের আচানক প্রশ্নে। বলতে পারে না যে সে অফিসের কাজগুলো এখন যথাসম্ভব হসপিটালে বসেই কাভার করার চেষ্টা করে। শিহান উত্তর না দিয়ে বরং গ্লাসে কিছুটা পানি ঢেলে নিয়ে বলে,
“ অনেকক্ষণ ধরে পানি খাওয়া হচ্ছে না তোমার। চলো উঠো। পানি খেয়ে নাও। “
মোহ সংকোচ নিয়ে শুয়ে থাকে। পোর্ট নিয়ে নড়াচড়া করতে তার খুব ভয়। মনে হয় এই বুঝি কিছু হয়ে গেলো! আর তাছাড়া এভাবে একা উঠে বসতেও তার অসুবিধা হয়। কারো সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে।
শিহান বোধহয় ব্যাপারটা ধরতে পারে। এগিয়ে এসে নিজেই মোহকে ধরে কিছুটা মাথা তুলে বসতে সাহায্য করে। একহাতে মোহকে আগলে রেখে আরেক হাতে পানির গ্লাসটা মোহর মুখের কাছে নিয়ে ধরে। কিছুটা পানি খেয়ে মোহ আবার গা ছেড়ে শুয়ে পড়ে সোজা হয়ে।
শিহানও গিয়ে সোফায় বসে একটা ছুরি এবং আপেল নিয়ে। এমন সময় হঠাৎ করে তার গুরুত্বপূর্ণ কল আসায় সে মোহকে বলে ফোন নিয়ে কেবিনের বাহিরে চলে যায়। মোহ একা শুয়ে জানালার বাহিরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকে। এই সেপ্টেম্বর মাস পুরোটা বোধহয় বৃষ্টির সঙ্গেই কাটবে।
মোহর ভাবনার মাঝে আচমকাই কেবিনের দরজা খোলার শব্দ হয়। মোহ ফিরে তাকায় না। ধরে নেয় বাবা এসেছে। কিন্তু হঠাৎই তার শিয়রে এস্ব দাঁড়ানো মানুষটা বলে উঠে,
“ বৃষ্টি সুন্দর না? “
মোহ চমকে পাশ ফিরে তাকায়। দেখে মনন হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। মোহ দ্রুত আশেপাশে তাকায়। নিজের স্কার্ফ হাতের কাছে খুঁজে না পেয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠে,
“ আপনি এখানে কি করছেন? “
মনন হকচকিয়ে যায়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এগিয়ে গিয়ে সোফার পাশ থেকে মোহর স্কার্ফটা নিয়ে এসে তা মোহর কাছে রেখে বলে,
“ সরি। আমি এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই। “
মোহ দ্রুত স্কার্ফটা দিয়ে মাথা ঢেকে নিয়ে বলে,
“ আপনি ইদানিং খুব দুঃসাহস দেখাচ্ছেন বলে মনে হয় না আপনার? “
মনন মৃদু হেসে বলে,
“ তা অবশ্য ঠিক। “
মনন ব্লাড ব্যাগটা একবার দেখে নিয়ে বলে,
“ বেশিক্ষণ লাগবে না, আর মাত্র তিন চার ঘন্টা লাগবে। “
মননের কথা শেষ হতে না হতেই কেবিনের দরজা খুলে শিহান প্রবেশ করে। মেয়ের শিয়রে অপরিচিত ডাক্তারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। মোহ এবং মননও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। শিহান এসে প্রশ্ন করে,
“ আপনি কে? “
মনন মিথ্যা বলতে অপটু। তবে তাকে বাঁচিয়ে দেয় মোহ। চঞ্চল গলায় বলে,
“ আরে উনি তো ডক্টর! সব কেবিনে গিয়ে নাকি রুটিন চেকাপ করছে। আমাকেও টুকটাক প্রশ্ন করলো। “
শিহান কিছুক্ষণ সরু দৃষ্টি মেলে মননকে দেখে। মনন তখন ভয়ে ঘামছে। মোহকে দেখতে এসে এ কোন বিপদে পড়লো সে! এজন্যই বোধহয় বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। মনন যখন ভয়ে মনে মনে দোয়া পড়ছে ঠিক সেসময় হঠাৎ শিহান বলে উঠে,
“ তুমি ওয়াসিফ না? কায়সার সাহেবের নাতি? “
মনন চমকায়। পরপর মাথা নেড়ে বলে,
“ জি। আমি ওয়াসিফ। ওয়াসিফ কায়সার। “
শিহানের কপালের ভাজ মিলিয়ে যায়। বেশ হাসিমুখে বলে উঠে,
“ কায়সার সাহেবের সাথে আমার পরিচয় আছে। গতবছর ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার সময় ফ্লাইটে আমাদের সিট পাশাপাশি ছিল। পুরো পথ আড্ডা দিতে দিতে যাই আমরা। ফেসবুকে উনার সঙ্গে তোমার বেশ কয়েকটা ছবিই দেখেছি। কিন্তু হঠাৎ দেখা হওয়ায় চিনতে পারি নি। “
মনন যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে বিনয়ের সঙ্গে হেসে বলে,
“ অসুবিধা নেই স্যার। আমি আসলে এই হসপিটালেই জব করি। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগলো। “
শিহান দ্রুত বলে,
“ আরে, আরে! স্যার বলছো কেন? ইউ ক্যান কল মি আংকেল। আমার মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হও। মেহনামা। “
মনন মোহকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
“ নাইস টু মিট ইউ মেহনামা। “
মোহ মনে মনে হাসে। মননকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো সে এইমাত্র মোহর নাম জানলো। ইতিপূর্বে মেহনামা নামের কাউকে সে চিনতোই না। মননের সঙ্গে শিহানের আলাপ আরো বেশ কতক্ষণ স্থায়ী হয়। পুরোটা সময় মোহ কেবল শুয়ে শুয়ে দেখে দু’জনকে। কথার ফাঁকে আড়চোখে মননকে এক দু’বার তাকাতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
__________
মনন আজ বাসায় ফিরে বেশ ফুরফুরে মেজাজে। সারাদিনের ক্লান্তির লেশমাত্র তার মাঝে সাদৃশ্য নয়। ঘরে প্রবেশ করতেই সবার আগে দাদুকে টিভির রুমে দেখতে পেয়ে বলে,
“ দাদু? শিহান ফেরদৌসকে চিনো তুমি? গত বছর ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার পথে ফ্লাইটে যার সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছিল। “
আলী আকবর কায়সারের মনে পড়তেই তিনি বলেন,
“ শিহান, দ্যা বিজনেসম্যান? চিনি তো। উনার মেয়ে বর্তমানে আমাদের হসপিটালে ভর্তি। “
মনন বলে,
“ উনার সঙ্গে দেখা হলো আজ। বেশ অনেকক্ষণ কথাও হয়েছে। তোমাকে সালাম জানাতে বললো। “
বলেই মনন হাসিমুখে পানি খেতে থাকে। আলী আকবর সাহেব নাতিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে পরখ করে। শিহানের সঙ্গে দেখা হওয়াতে এতো খুশি হওয়ার কি আছে? নাকি অন্য কোনো বিষয়? আলী আকবর সাহেব অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে প্রশ্ন করে,
“ হঠাৎ এতো খুশি দেখাচ্ছে তোমাকে! ঘটনা কি? ওই মেয়েটা তোমার বশে এসে পড়েছে নাকি? “
মননের হাসি এবার গাঢ় হয়। গ্লাসটা রেখে দাদুর দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলে,
“ না। সে আমার বশে আসে নি। আমি তার বশে চলে গিয়েছি। “
বলেই মনন শিস বাজাতে বাজাতে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। আলী আকবর কায়সার বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। তার নাতি শিস বাজাচ্ছে? অসম্ভব ব্যাপার এটা! আলী আকবর সাহেব দ্রুত নিজের ছেলেকে কল করে বলেন,
“ গাধার বাচ্চা! দ্রুত একটা ভালো হুজুর খুঁজে বের করো। আমার ধারণামতে তোমার ছেলেকে বদ পেত্নী আছর করেছে। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]