অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২২

0
53

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২২.

মোহর দ্বিতীয় সাইকেল কেমো নেওয়ার এক সপ্তাহ পেরিয়েছে। আজ আবার হসপিটালের চক্কর কাটতে হবে তার। ব্লাড টেস্ট সহ যাবতীয় দু একটা টেস্ট করে একবার কেমোর ডক্টরকে দেখাতে হবে তারপর আবার সার্জারীর ডক্টর দেখাতে হবে। সব মিলিয়ে দিনের একটা লম্বা সময় আজ তার হসপিটালেই পাড় হবে।

শিহানের জরুরী কিছু কাজ থাকায় তাকে ঢাকার বাহিরে যেতে হয়েছে। তিনি শায়লাকে মোহর সঙ্গে হসপিটালে যেতে বলেছিল। কিন্তু মায়া জোরাজুরি করে শায়লার বদলে নিজেই মোহর সঙ্গে এসেছে। শুভ্রকেও কল করে জানিয়েছে যেনো হসপিটালে পৌঁছে যায়। এই কাজটা অবশ্য মোহর অনুমতি নিয়েই করেছে সে। মোহও আপত্তি জানায় নি কোনো।

মায়া আর মোহ হসপিটালে এসে আগে মোহর টেস্ট গুলো করিয়ে নেয়। ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট আসতে অন্তত এক থেকে দেড় ঘন্টা সময় লাগবে। রিপোর্ট আসলে তারপর ডক্টর দেখাতে হবে। তাই ততক্ষণের জন্য তারা ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে বসে। শুভ্রও এরই মাঝে এসে হাজির হয়ে যায়। হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে মায়ার মুখোমুখি বসে। মায়ার পাশের চেয়ারে বসা মোহ কপাল কুচকে প্রশ্ন করে,

“ তুই কি বাজার থেকে আসছোস? “

শুভ্র জবাব দেয়,

“ না দোস্ত! তোর ভাইয়ের এতো টাকা আছে? এসব তো আম্মুর ছাদে লাগানো গাছের ফলমূল। তোর জন্য নিয়া আসছি। একদম অরগানিক! বাজারের ফলমূল খাবি না একদম। শালারা ফরমালিন দিয়া ভরায় রাখে সব। “

মোহ সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ ডক্টর হওয়ার শখ জাগসে তোর? “

“ আরে না! ডাক্তারি পড়ে পাগলে। আমাকে কি তোর পাগল মনে হয়? “

“ তাহলে অরগানিক আর ফরমালিনের জ্ঞান ঝাড়তেসিস কেন? “

“ আমি তো তোর কথা ভেবেই বলছিলাম। “

“ উহু৷ আসল কাহিনী হচ্ছে মায়ার সাথে থাকতে থাকতে তুই ওর মতো হয়ে যাচ্ছিস। এই মেয়ে সারাদিন আমার আম্মা সেজে ঘুরে বেড়ায়, আর এখন তুই আসছিস আব্বা সাজতে। “

শুভ্র দাঁত বের করে হাসে। তিনজনই যখন আড্ডায় মশগুল তখন মোহ আলগোছে নিজের ফোনটা হাতে নেয়। ম্যাসেজ নোটিফিকেশন চেক করতেই পরিচিত নাম্বার দেখে কৌতূহল বোধ করে সে। সোজা নোটিফিকেশন হতে ম্যাসেজে প্রবেশ করে।

“ টেস্ট ডান? “

হঠাৎ মননের ম্যাসেজ পেয়ে মোহ অবাক হয়। এই লোক কিভাবে জানলো আজ মোহর টেস্ট আছে? মোহ তো একবারও এই বিষয়ে কিছু বলে নি। এমনকি গত চার দিনে মনন কেবল চার বার তাকে ম্যাসেজ করেছিলো তার শারীরিক অবস্থা জানতে। প্রতিবারই মোহ জবাবে শুধু বলেছে,

“ ঠিক আছি। “

এর থেকে বেশি এক লাইনও কথা হয় নি তাদের। মোহ যখন কিছুটা বিস্ময় নিয়ে এসব ভাবছিলো তখনই আরো একটা ম্যাসেজ আসে মননের তরফ থেকে।

“ পিছনে তাকান। ডান পাশের সারির ফিফথ টেবিল। “

মোহ সাথে সাথে ঘুরে পিছনে তাকায়। দেখতে পায় মননকে। এক হাতে ফোন আর অন্য হাতে স্যান্ডউইচ নিয়ে বসে আছে। মোহকে দেখে সামান্য হাসে। মোহ সাথে সাথে আবার সামনে ফিরে বসে। ম্যাসেজের রিপ্লাই করে,

“ হু। ডান। “

“ ডক্টর দেখাবেন কখন? “

মননের আগ্রহ দেখে মোহ কিছুটা সংকোচে পড়ে। তবুও জবাব দেয়,

“ এক ঘন্টা পর। “

“ ওকে। আপনার সময় হবে? দেখা করতে পারবেন? বেশি সময় নিবো না আপনার। আই জাস্ট নিড টু টক টু ইউ। “

মোহ আরেক দফা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। এই আগ বাড়িয়ে নিজ থেকে দেখা করতে চাওয়া মনন তাকে খুব অস্বস্তি দিচ্ছে। তবুও কি ভেবে যেনো রাজি হয়ে যায়। মনন ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে যেতেই মোহও ফোন ও ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ তোরা বসে গল্প কর। আমি আসছি। “

মায়া প্রশ্ন করে,

“ কোথায় যাচ্ছিস? “

মোহ বিরক্তি নিয়ে জবাব দেয়,

“ ওয়াশরুমে যাচ্ছি। এখন কি তুই ওইখানেও আমার পিছুপিছু যাবি? তোর কি মনে হয় আমি পথ ভুলে যাবো? “

“ উঁহু। যা তুই। তাড়াতাড়ি আসবি। “

মোহ ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুমের দিকে না গিয়ে বরং লিফটের দিকে চলে যায়। মননের ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী থার্ড ফ্লোরে পৌঁছে পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট এর ওপিডি এরিয়ায় চলে যায় সে। মননের কেবিনের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অত:পর কেবিনের বাহিরে থাকা এসিস্ট্যান্টকে বলে,

“ ডক্টর ভেতরে আছেন? “

“ জি, আছে। আপনার নাম? “

“ মেহনামা ফেরদৌস। “

“ ওহ, হ্যাঁ। ডক্টর আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনি যেতে পারেন। “

মোহ নির্বিকার ভঙ্গিতে দরজা ঠেলে কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখে মননকে। টেবিলের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চার চোখ দিয়ে একটা ফাইল দেখছিল। মোহকে দেখতেই ফাইলটা হাত থেকে রেখে দিয়ে হেসে বলে,

“ হাই। প্লিজ হ্যাভ এ সিট। কেমন আছেন? “

মোহ চোখ সরু করে এগিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসতে বসতে জবাব দেয়,

“ ভালো। “

“ সরি। আপনাকে চা কফি অফার করতে পারছি না। উম্ম পানি খাবেন? “

মোহ প্রশ্ন করে,

“ আপনি কি চা, কফি, পানি অফার করার জন্য দেখা করতে চেয়েছেন? “

“ উঁহু। আমি তো… “

“ ওহ। বুঝতে পেরেছি। টোটোস্কোপ ব্যাক চাই? ডোন্ট ওয়ারি। দিয়ে দিবো ফেরত আমি। “

মনন মোহর মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলে উঠে,

“ নাহ। ওইটা আপনার হয়ে গিয়েছে। আপনিই রাখুন। আমার কাছে নতুন টোটোস্কোপ আছে। সরি আই মিন স্টেথোস্কোপ আছে। আমি তো সব সর্ট আউট করার জন্য দেখা করতে চাইছিলাম। “

“ কি সর্ট আউট করতে চান? “

“ মোহ লুক আই এম সরি… “

“ ওয়েট! আপনার ওই সরির ভূত এখনো মাথা থেকে নামে নি? ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু বি সরি। ভুল কিছু তো বলেন নি আপনি। আমাকে রিয়েলিটি চেক দিয়েছেন শুধু। আমার এটার প্রয়োজন ছিল টু রিমেম্বার মাই বাউন্ডারিস। থ্যাংকস ফর দ্যাট। “

“ মোহ আই ওয়াজ টায়ার্ড দ্যাট ডে। “

“ আই এম এগেইন সরি ফর দ্যাট ডে। আমি এখানে দেখা করতে এসেছি শুধুমাত্র আপনাকে থ্যাংকস বলতে। ওদিন রাতে আমাকে হেল্প করার জন্য। “

বলতে বলতে মোহ নিজের ব্যাগে কিছু একটা খুঁজতে থাকে। মনন বলে,

“ থ্যাংকস বলতে হবে না। ইউ ক্যান কল মি এনিটাইম ইফ ইউ নিড এনি হেল্প। আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো… “

মননের সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই মোহ একটা হলুদ রঙের স্ট্রেস রিলিফ বল বের করে মননের হাতে ধরিয়ে দেয়। মনন একবার হাতের বলটার দিকে তাকায় আরেকবার মোহর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। মোহ বলে উঠে,

“ থ্যাঙ্কিউ গিফট হিসেবে এটা বাদে আর কিছু পাই নি দেওয়ার মতো। ডক্টর আপনি, সারাদিন বিভিন্ন স্ট্রেসে থাকেন। ইট উইল হেল্প ইউ। এখন আই গেস সবকিছু সর্ট আউট করা হয়ে গিয়েছে আমাদের মাঝে। এখন থেকে আপনি আপনার রাস্তায় আর আমি আমার। টাটাহ। “

বলেই মোহ উঠে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। মনন বসে থাকে সম্পূর্ণ একা। নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে হাতের স্মাইলি ইমুজির ডিজাইন করা স্ট্রেস রিলিফ বলটার দিকে। মোহর এই সর্ট আউটের নাম করে আলাদা আলাদা পথ মাপার ব্যাপারটায় বেজায় বিরক্ত এবং অসহ্যকর বোধ করছে সে। বেলাজ মনটা তাকে টিটকারি মেরে বলছে,

“ কি মদন? অসহ্যকর লাগছে না? দিজ ইজ সাইন। ইউ আর ইন লাভ উইথ হার ম্যান। একদিন না একদিন অবশ্যই স্বীকার করবি তুই। “

__________

রাতের খাবার টেবিলে বেশ অমনোযোগী দেখা যায় মননকে। ভাত মেখে শুধু নাড়াচাড়া করছে। খাবারের দিকে মনোযোগ নেই তার। উল্টো গভীর এক ভাবনায় বিভোর সে।

টেবিলে উপস্থিত আলী আকবর কায়সার এবং আরিফ কায়সারের চোখ এড়ায় না ব্যাপারটা। আলী আকবর সাহেব চোখের ইশারায় ছেলেকে কিছু একটা বলে। আরিফ সাহেব ইশারায় মাথা নেড়ে তাতে অসম্মতি জানায়। আলী আকবর সাহেব চোখ পাকিয়ে তাকাতেই আরিফ সাহেব ভয়ে নিজের ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ মনন, মেয়েটার নাম কি? “

মনন ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। কপাল কুচকে শুধায়,

“ হু? “

“ তোমার দাদু বলেছে তোমার রুমে একটা মেয়ের চুল পেয়েছে। মেয়েটার নাম, পরিচয় বলো আমাদের। আমরা প্রস্তাব নিয়ে যা-ই। তুমি চিন্তা করো না আমরা সবাইকে রাজি করিয়ে নিবো। কিন্তু কালোজাদু এসব করা কোনো সমাধান নয়। “

মনন বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে একবার নিজের আব্বুকে দেখে অত:পর নিজের দাদুকে। রাগে কিছুটা চেঁচিয়ে উঠে,

“ সিরিয়াসলি? লাইক সিরিয়াসলি? আমাকে দেখে মনে হয়, আমি কুফরি কালাম করি? “

আরিফ সাহেব নিজের বাপ ও ছেলের মাঝে কাচুমাচু করে বলে,

“ তাহলে একটা মেয়ের চুল তোমার কাছে কি করছে? “

“ সেটা জেনে তোমাদের কি লাভ আব্বু? “

আলী আকবর কায়সার মুরগীর রানে কামড় বসিয়ে বলে উঠে,

“ তোমার বাপ প্রেমে পড়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আমি তা ধরে ফেলেছিলাম। তোমার কি মনে হয় আমার চুলগুলো বাতাসে সাদা হয়েছে? অভিজ্ঞতা বলতেও একটা ব্যাপার আছে। তোমার আচার আচরণে একটা পরিবর্তন এসেছে যেটা বাসার সবাই দেখতে পাচ্ছি। প্রেমে পড়া ছেলেদের মতো আচরণ করছো তুমি। “

মনন বিরক্ত হয়ে খাবার ছেড়ে উঠে যেতে নিলে দাদু থমথমে গলায় বলে উঠে,

“ খাবার নষ্ট করা মানুষদের আমি অপছন্দ করি। আমাদের কথা বিরক্তিকর লাগলে খাবার নিয়ে রুমে গিয়ে বসে খাও। তবুও যাতে একটা ভাতের দানা নষ্ট না হয়। “

মনন রাগ দেখিয়ে তা-ই করে। প্লেট নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে টেবিলে বসে। খাবার খেতে খেতেও তার রাগ কমে না। আশেপাশে তাকাতেই টেবিলের উপর মোহর দেওয়া ওই স্ট্রেস রিলিফ বলটা দেখতে পায়। সেটাকে বাম হাতে নিয়ে সে শক্ত করে চেপে ধরে। জিনিসটা আসলেই কাজের। দাদু আর আব্বু যেভাবে তার পিছনে হাত ধুয়ে পড়েছে, মননের এখন প্রায় প্রতিদিনই এটার প্রয়োজন পড়তে পারে। কিন্তু এটাকে এভাবে বাইরে ফেলে রাখা যাবে না। দাদু কিংবা আব্বু দেখে নিলে এই বলের পিছনেও গোয়েন্দাদের মতো হাত ধুয়ে উঠে পড়ে লাগবে।

__________

অঘটনটা ঘটলো ঠিক দু’দিন পর। মননের ধৈর্য্যের পারদ চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছাতেই সে না পেরে মোহর নাম্বারে কল করে। বেশ কিছুক্ষণ পর কলটা রিসিভ হতেই মনন দ্রুত ভঙ্গিতে বলে,

“ মোহ দেখা করতে পারবেন আমার সাথে? রাইট নাও? ইট ইজ আর্জেন্ট। “

মোহ কিছু জবাব দেওয়ার আগেই মনন ফের বলে উঠে,

“ প্লিজ ডোন্ট সে নো। “

মোহ ইচ্ছে করে না চেনার অভিনয় করলো,

“ হ্যালো? কে আপনি? আমার সাথে দেখা করতে কেন চাইছেন? “

“ মোহ আই এম সিরিয়াস। “

“ সিরিয়াস তো আমিও। আমার কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে আমি হাসছি? কে আপনি? “

“ ওয়াসিফ কায়সার মনন। “

“ ওহ! এই নামের একটা লোকের সাথে তো দুইদিন আগেই সব মিটমিট করে এলাম। আবার কেন কল দিয়েছেন তাহলে? “

“ কিছু মিটমাট হয় নি তাই। দেখা করতে পারবেন কি-না বলুন। ফ্রি আছেন আপনি? “

মোহ ফ্রি আছে। সে চাইলে এখন কিছু একটা বলে বাবাকে রাজি করিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হতেও পারবে। কিন্তু সে সেটা মননকে জানায় না। বরং বলে,

“ না। আগামী পাঁচ দিন আমি খুব ব্যস্ত। আমার প্রচুর রেস্ট দরকার। পাঁচ দিনের আগে কারো সাথে দেখা করা সম্ভব না আমার পক্ষে। পাঁচ দিন পর পারবো। “

যদিও মননের ধৈর্য্য কুলাচ্ছে না। তবুও সে রাজি হয়ে যায়। মোহকে বলে,

“ আচ্ছা। কোথায় আর কখন দেখা করতে চান আমাকে জানিয়ে দিবেন। টেক কেয়ার। “

কলটা কেটে কেবিনে থম মেরে বসে থাকে মনন। নিজেকে কিছুটা হ্যাংলা প্রকৃতির মানুষ মনে হচ্ছে তার। এভাবে কল করে ডেস্পারেট হয়ে দেখা করতে চাওয়াটা তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না। কিন্তু তবুও এই কাজটা সে করেছে। অবশ্য সে বহু কিছুই করেছে যা তার করার কথা ছিলো না। হয়তো সামনেও করবে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে