অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২১

0
59

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২১.

দরজা লক করে রুমের ভেতর বসে আছে মোহ। ওদিকে দরজায় জোরে করাঘাতের শুরু ভেসে আসছে। দরজার অপর পাশ হতে চেঁচাচ্ছে শিহান।

“ দরজা লাগিয়ে বসে থেকে পাড় পাবে না তুমি। এক্ষুণি দরজা খুলো। আমাকে রাগাবে না মোহ। দরজা খুলতে বলেছি তোমাকে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলো। “

মায়া নিজের বাবাকে শান্ত করার চেষ্টা করে জানতে চায়,

“ তুমি রেগে আছো কেন? কি হয়েছে? কি করেছে মোহ? “

শিহানের রাগে গমগমে স্বর,

“ কি হয়েছে জানতে চাও? তোমার বোনকে আমি ফল খেতে দিয়ে গিয়েছিলাম। ও লুকিয়ে জানালা দিয়ে সেই খাবার ফেলে দেয়। আমি ব্যাক ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম কলে। ওই ফল সব আমার মাথায় পড়েছে। শুধু ফল ফেলে ক্ষান্ত হয় নি ও। ফলের বাটিও আমার মাথায় ফেলে দেয়। ভাগ্যিস বাটিটা কাঁচের ছিলো না। নাহলে কি হতো বুঝতে পারছো? “

মেয়ের কাছে লম্বা অভিযোগ আর নালিশ সম্পন্ন করে শান্ত হয় শিহান। মায়া আর শায়লা এতক্ষণ গভীর মনযোগ দিয়ে শুনেছে সবটা। আর শোনা শেষে দু’জনেই না চাইতেও পেট চেপে ধরে অট্টহাসিতে ফেটে পরে। শিহান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। বুঝে উঠতে পারে না এখানে হাসির কি আছে?

দরজার ভেতরে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সবটা শুনছিলো মোহ। বাবার কথা শেষ হতেই সে নিজের সাফাই গেয়ে বলে উঠে,

“ এখানে আমার দোষটা কোথায়? এতো বড়ো বাসায় নিজের রুম, লিভিং রুম, ফ্রন্ট ইয়ার্ড, ছাদ, ওয়াশরুম সব ছেড়ে তোমাকে ব্যাক ইয়ার্ডে গিয়ে কথা বলতে হবে কেন? পুরো দোষটাই তো তোমার। “

মোহর কথা শুনে মায়ার হাসির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। শিহানের রাগের পারদের মাত্রা এবার বিপদ সীমা অতিক্রম করে। সে ভয়ংকর স্বরে ধমকে উঠে,

“ তোমার দোষ খুঁজে পাচ্ছো না তুমি? তুমি না খেয়ে খাবার জানালা দিয়ে ফেলে দাও। এটা দোষের না? “

এই পর্যায়ে মোহ ধমক শুনে ভয়ে সিটিয়ে যায়। আচমকা বজ্রকণ্ঠের ধমকে তার হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়ে। ভয়ে সে দ্রুত বিছানায় বসে বুকের বা পাশটায় আলতো ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু শান্ত হতে পারে না। উল্টো মনে হয় হৃৎপিণ্ড বোধহয় এভাবে লাফাতে লাফাতে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে।

শিহানের ধমকের তোপে মায়া আর শায়লাও চুপ হয়ে যায়। মায়া কিছুটা ভয় পেলেও সে নিজেকে সামলে নিয়ে শিহানকে সেখান থেকে টেনে সরিয়ে বলে,

“ এতো ভয়ংকর ভাবে ধমক কেনো দিলে? ওর সামনে ডক্টর চিৎকার চেঁচামেচি করতে নিষেধ করেছে ভুলে গিয়েছো? ও না-হয় ভুল করেছে, কিন্তু তুমি কি ওর উপর রাগ দেখিয়ে ঠিক করছো? “

মুহুর্তেই শিহানের হুশ ফিরে। রাগের মাথায় আসলেই জোরে ধমক দিয়ে ফেলেছে সে। মোহর উপর এভাবে চিল্লানোটা উচিত হয় নি বোধ হতেই অপরাধ বোধ তাকে ঘিরে ধরে। মায়া নিজের বাবার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায় দরজার কাছে। ধীরে দরজায় নক করে প্রশ্ন করে,

“ এই মোহ? ঠিক আছিস? বেরিয়ে আয়। বাবা আর রাগবে না। খাওয়া নিয়েও আর জোর করবে না। “

ভয়ে তখন মোহর চোখ উপচে জল পড়ছে। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক গতিতে লাফাচ্ছে। সবটা অনুভব করতে পারছে সে। বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে তার সাথে। সে কি মারা যাচ্ছে? মোহ এই অবস্থায় বাবা, মায়া কারো সামনেই পরতে চায় না। তাই কোনো মতে উত্তর দেয়,

“ পরে আসছি… “

এতদূর বলেই সে বিছানার হেড সাইডে পিঠ এলিয়ে দেয়। চোখের সামনে সবটা অন্ধকার হয়ে আসছে। কিন্তু মন বারবার বলছে, তাকে ঠিক থাকতে হবে। এভাবে মৃত্যু হতে পারে না। এই অবস্থায় তো ভুলেও না। বাবা দোষটা নিজের ঘাড়ে তুলে নিবে না-হয়। ভাববে হয়তো উনার কারণেই মোহর ক্ষতি হয়েছে।

দরজার অপর পাশে আর কেউ নেই টের পেতেই মোহ হাতড়ে ফোনটা নেয়। কিছু না ভেবেই কল করে বসে মননকে। ওই লোকটা তো ডক্টর। নিশ্চয়ই একটা সমাধান দিতে পারবে? মোহ মনে মনে বারবার নিজের উদ্দেশ্যে আওড়াচ্ছে,

“ হোল্ড অন মোহ! ইউ হ্যাভ টু লিভ। বাবাকে গিল্ট ট্র্যাপে ফেলে মরলে ইউ উইল বি দ্যা ওরস্ট ডটার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড। “

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। রিং হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই রিসিভ করে মনন। স্বভাবসলুভ শান্ত গলায় বলে,

“ আমার দোষ কি সেটা জানাতে কল করেছেন? “

মোহ অক্সিজেন ইনহ্যাল এবং এক্সহ্যাল করতে করতে অস্ফুটে বলে উঠে,

“ হেল্প মি… “

মনন অবাক হয়। সে টিভির রুমে বসে খেলা দেখছিলো। কিছু বলবে এমন সময়ই দেখে তার দাদু টিভির রুমের দিকে আসছে। তাই সে সাথে সাথে উঠে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লক করে দেয়। উদ্বেগ নিয়ে জানতে চায়,

“ কি হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন? অসুবিধা হচ্ছে কোনো? “

“ পোর্ট যেখানে… বুকের বাম পাশে হার্ট অনেক জোরে জোরে বিট করছে। অস্বাভাবিক ভাবে। মনে হচ্ছে গলা দিয়ে এক লাফে বেরিয়ে আসবে। আমিও ঘামছি। শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। আমি… আমি বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে? এটা নরমাল? নাকি আমি মারা যাচ্ছি? “

মোহ কোনো মতে থেমে থেমে কথা গুলো বলে। মনন এক সেকেন্ডের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। কিন্তু সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে জানতে চায়,

“ আপনি চিৎকার চেঁচামেচি করেছেন? এই মোহ? আপনি কি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছেন? “

মোহ কেবল দু’দিকে মাথা নাড়ে। মুখে উত্তর দিতে পারছে না সে। ভয়ে হুট করেই যেনো শব্দ হারিয়ে ফেলেছে। দু চোখ ছাপিয়ে কেবল মৃত্যু ভয়ে অশ্রু বইছে। নিজেকে মনে হচ্ছে সবথেকে অসহায়!

মনন কোনো উত্তর না পেয়ে নিজেই বলতে থাকে,

“ আচ্ছা! ইট’স ওকে। কিছু বলতে হবে না আপনার। আপনি আমার কথা শুনুন। যেই অবস্থায় আছেন ওভাবেই থাকুন। নড়বেন না মোটেও। নড়াচড়া করলে বুকে চাপ অনুভব করে শ্বাসরোধ অনুভব হতে পারে। তাই কষ্ট হলেও নড়বেন না। আর নিজেকে মেন্টালি স্ট্রং রাখুন। কিচ্ছু হয় নি। ইউ উইল বি ফাইন। বডি রিল্যাক্স রাখুন। মাইন্ড বডি কোনটাতেই প্রেশার দিবেন না। ওকে? আপনি কল কাটবেন না। লাইনে থাকুন। আমি এক্ষুণি পোর্ট স্পেশালিষ্টকে কল করছি। উনার ইন্সট্রাকশন জরুরী। একটু কলে থাকুন। ওকে? “

মোহ শুনে সবটা। জবাব দিতে পারে না। মনন মোহকে কলে রেখেই দ্রুত দৌড়ে রুম থেকে বের হয়। সামনে দাদুকে পেতেই দ্রুত উনার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয় হসপিটালে নিজের পরিচিত পোর্ট সার্জনকে কল করার উদ্দেশ্যে। আলী আকবর সাহেব চেঁচিয়ে উঠেন,

“ আরে! আমি লুডু ম্যাচ খেলছিলাম! “

মনন কেবল নিজের রুমের দিকে দৌড়ে যেতে যেতে জবাব দেয়,

“ তোমার ম্যাচ এর থেকে কারো জীবন আমার কাছে বেশি ম্যাটার করে। “

___________

মাথার উপরের দেওয়ালের মধ্যিখানে ফ্যানটা আপন গতিতে ঘুরে শীতল বাতাস বিলিয়ে দিচ্ছে। সেই শীতল বাতাস প্রাণ ভরে কুড়িয়ে নিচ্ছে মোহ। দু চোখের কার্ণিশে অশ্রু শুকিয়ে গেলেও তার অস্তিত্ব পুরোপুরি মুছে যায় নি এখনো। বুকের ভেতরের ভয়টাও পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায় নি এখনো।

এই তো কিছুক্ষণ আগেও মোহর মনে হচ্ছিলো হয়তো সে মারা যাচ্ছে। এই বুঝি সব ফুরিয়ে এলো। অথচ এখন সবটা শান্ত। হৃৎস্পন্দনের গতিও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মোহ সোজা হয়ে বিছানার মাঝটায় শুয়ে আছে। চোখ বুজে রেখে কানে ফোন চেপে ধরে রেখেছে এক হাতে। অপর হাতে এখনো বুকে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।

পুরোটা সময় মনন কলের অপর পাশে উপস্থিত ছিল। মাঝখানে মোহর ফোনের ব্যালেন্স শেষ হয়ে যাওয়ায় কলটা কেটে গিয়েছিল। তবে সাথে সাথেই মনন কল ব্যাক করেছে তাকে। চিন্তা মাথায় নিয়েও বেশ শান্ত গলায় মোহকে সকল ইন্সট্রাকশন বুঝিয়ে বলেছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে জুগিয়েছে আশ্বাস।

লম্বা সময় ধরে মোহকে স্বাভাবিক হওয়ার সময় দিয়ে অত:পর মনন প্রশ্ন করে,

“ মোহ? এখন বেটার ফিল হচ্ছে? অসুবিধা হচ্ছে আর কোনো? “

মোহ ছোট করে উত্তর দেয়,

“ ঠিক আছি। “

মনন এইবার বলে উঠে,

“ আপনার ফ্যামিলি কোথায় থাকে মোহ? ইউ নিড কেয়ার। এরকম সিচুয়েশন গুলোতে উনাদের আপনার পাশে থাকা উচিত। “

“ না। আমি চাই না উনারা কখনো আমাকে এরকম অবস্থায় দেখুক। অলরেডি বাবা আর মায়া নিজেদের কাজ, পড়াশোনা ফেলে সারাদিন আমার পিছনে পড়ে থাকে। এরকমটা দেখলে উনারা এসব ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকবে ২৪ ঘন্টা। আমি চাই না আমার কারণে কারো জীবন থেমে যাক। “

মনন অজান্তে প্রশ্ন করে বসে,

“ আমার সামনে দূর্বলতা প্রকাশ করতে অসুবিধা নেই? “

মোহ এবার সামান্য হেসে বলে,

“ আমার কারণে আপনার জীবন থেমে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। উনারা আমার পরিবার। আপনার সাথে তো কোনো সম্পর্ক নেই। “

মনন হঠাৎ নীরবতায় ডুব দিলো। মোহর বলা কথাটা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো। আসলেই তো তাদের মাঝে সম্পর্ক নেই! নাকি আছি? জীবন মরণ পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই মানুষ সম্পর্কহীন কাউকে স্মরণ করে না? পরমুহূর্তেই মননের মস্তিষ্ক বলে উঠে,

“ মেয়েটা তোকে শুধুমাত্র এজ এ ডক্টর স্মরণ করেছে। “

কিন্তু মন মস্তিষ্ককে শাসিয়ে বলে,

“ পৃথিবীতে কি মননই একমাত্র ডক্টর? আরোও তো ডক্টর আছে! কিন্তু তবুও মোহ কলটা স্পেসেফিকলি মননকেই করেছে। “

মননের মন ও মস্তিষ্কের বাকবিতন্ডার মাঝে মোহর স্বর শোনা গেলো,

“ প্রথমত অসময়ে কল করার জন্য সরি। দ্বিতীয়ত আপনার মূল্যবান সময় চুরি করার জন্য সরি। আর তৃতীয়ত আপনার ফোনের ব্যালেন্স খরচ করার জন্য সরি। “

মনন এই পর্যায়ে বিরক্ত হয়। পর মুহুর্তেই মনে পড়ে যায় ওদিন মোহর সাথে হসপিটালের ছাদে করা আচরণটার কথা। ওই কারণেই বোধহয় এতো গুলো সরি বলে বেড়াচ্ছে মেয়েটা। মনন বেশ শান্ত গলায় বললো,

“ আপনার অসুবিধা, খারাপ লাগা, দূর্বলতা গুলো চাইলে সম্পর্কহীন মানুষটার কাছে মেলে ধরতে পারেন মোহ। আপনার সমস্যা গুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে টুইয়েন্টি ফোর আওয়ারের জন্য এভেলেবল থাকবো। সেটার জন্য ফি কিংবা সরির প্রয়োজন নেই। আপনার এখন রেস্ট করা উচিত। আমি রাখছি, আচ্ছা? প্রয়োজন হলে কল দিবেন। মনে দ্বিধা রাখবেন না। “

বলেই কলটা কেটে বিছানায় বসলো মনন। দু’হাতে মুখ ঢেকে দীর্ঘ সময় বসে রইলো। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে মাশুকের বলা কথাটা। তার আর মোহর মাঝে কিছু নেই। অথচ তবুও তাদের মাঝে কিছু একটা আছে। খুব প্রখর সেটা। মনন টের পাচ্ছে তা। ফট করেই সে একা ঘরে নিজেকে প্রশ্ন করে বসলো,

“ ইউ লাভ হার মনন? “

প্রশ্নটা করে মনন নিজেই কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেলো। থমথমে হয়ে গেলো মুখটা। তার আর মোহর মাঝে থাকা কিছু একটাকে খুঁজে পেয়ে যেনো সে আরো দিশেহারা হয়ে পড়লো। অসম্ভব! মোহকে ভালোবাসা অসম্ভব একটা ব্যাপার! ও-ই টুকুন একটা বাচ্চা মেয়ে। মননের থেকে কম করে হলেও বছর দশেকের ছোট। ওই মেয়েটাকে মনন কখনোই ভালোবাসতে পারে না। সে একজন শিক্ষিত ডক্টর। এরকম আক্কেলহীন কাজ তার সঙ্গে সাজে না। আর তাছাড়াও সে তো পরশিকে… এতদূর ভাবতেই মনন আরেকদফা নিশ্চুপ হয়ে যায়। আরো নীরবতায় তলিয়ে যায়। বোধ করে গত এক মাসে পরশি নামক মেয়েটার কথা এক মুহুর্তের জন্যও সে মনে করে নি। এক মুহুর্তের জন্যও পরশি তার মন কিংবা মস্তিষ্কে হানা দেয় নি। কিন্তু কেন? এরকমটা কি করে সম্ভব? মননের মন এবং মস্তিষ্ক কখন পরশির পথ ভুলে মোহর পথে হাঁটা শুরু করলো? মননের হুট করেই নিজের মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে মন চাইলো। এই মনটা আদৌ কখনো পরশির ছিলো? কোনটা সত্যি তার জীবনের? পরশি নাকি মোহ?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে