অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-০২

0
73

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২.

তিন বছরের বাচ্চা ছেলেটা মায়ের আঁচলে মুখ গুজে রেখেছে। চোখ জোড়া ছলছল করছে তার। এইতো ঘন্টা খানেক আগে সিবিসি অর্থাৎ কম্পলিট ব্লাড কাউন্ট টেস্টের জন্য তার হাত থেকে সুঁচালো বস্তুটার মাধ্যমে এক শিশি রক্ত নেওয়া হয়েছে। ছোট্ট বাচ্চাটা তখন গলা ফাটিয়ে কান্না করছিলো ব্যথায়। সেই কান্নার ফলস্বরূপ এখনো মুখ জুড়ে লাল আভা ছড়িয়ে আছে।

মনন নিজের টেবিলে থাকা কম্পিউটারে বাচ্চাটার ফাইল নম্বর এন্টার করতেই তার লেটেস্ট রিপোর্টটা স্ক্রিনে দৃশ্যমান হয়ে ভেসে উঠে। এক এক করে রক্তের প্রতিটি উপাদানের কাউন্ট সে চেক করে। ডব্লিউবিসি, প্লাটিলেট সহ অন্যান্য উপাদানের কাউন্ট স্বাভাবিক মাত্রায় থাকলেও হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ৯ এ নেমে গিয়েছে। মনন তা দেখে চিন্তিত গলায় বলে,

“ হিমোগ্লোবিন দেখি লো হয়ে গিয়েছে। গত সপ্তাহেও তো হিমোগ্লোবিন ১১ এর ঘরে ছিলো। ৬ এর ঘরে নেমে গেলে কিন্তু ব্লাড দিতে হতে পারে। “

বাচ্চাটার মা’কে আতংকিত দেখালো। সে আতংকিত গলায় বলে,

“ এবারের কেমো দেওয়ার পর থেকে মুখের রুচি নষ্ট হয়ে গিয়েছে সেলিমের। কিচ্ছু মুখে নিতে চায় না। জোর করে কিছু খাওয়ালেও তা বমি করে ফেলে দিচ্ছে। আমরা কি করবো ডক্টর? “

মনন মনযোগ দিয়ে শুনে সবটা। পরপর বলে,

“ ও একটা তিন বছরের বাচ্চা ম্যাডাম। কেমোতে মুখের টেস্ট বাড নষ্ট হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। ওর খাবার নিয়ে মর্জি করাটাও স্বাভাবিক। কেমোথেরাপির ফলে পেশেন্টের মেজাজ খিটখিটে থাকবেই। কিন্তু তা-ই বলে চেষ্টা না করে বসে থাকা যাবে না। ভুলিয়ে কিংবা যেভাবেই খেতে চায়, সেভাবেই খাওয়াবেন। বমি করলে কিছুক্ষণ ব্রেক নিয়ে আবার খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন। মনে রাখবেন ওর শরীরে যাওয়া কেমো, মেডিসিন, বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট এগুলো একমাত্র তখনই কাজ করবে যখন ওর ইমিউনিটি সিস্টেম স্ট্রং থাকবে। সেটার জন্য ডায়েট চার্ট মাফিক খাওয়াদাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। “

চোখের চশমাটা কিছুটা ঠিক করে নিয়ে মনন ফাইলে একটা নতুন পৃষ্ঠায় ডেট লিখে তার নিচে কিছু নির্দেশনা এবং নতুন একটা মেডিসিনের নাম লিখে দিয়ে বলে,

“ একটা ওরাল ট্যাবলেট লিখে দিয়েছি। মুখের রুচি বাড়াতে সাহায্য করবে। প্রতিদিন তিনবেলা খাওয়ার পরে এটা ওকে খেতে দিবেন। কিন্তু পানি দিয়ে নয়, চুষে ক্যান্ডির মতো খেতে বলবেন। “

ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে ফাইলটা হাতে নিতেই মনন উঠে দাঁড়ায়। মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে ডাকে,

“ সেলিম? বাবা? আংকেলের কাছে আসবে? “

ছোট্ট বাচ্চাটা মাথা কিছুটা তুলে ছলছল চোখে ডক্টরকে দেখে। মননকে হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে থাকতে দেখে সে-ও নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়। মনন তাকে কোলে তুলে নিয়ে হেসে বলে,

“ মজার একটা ক্যান্ডি দিয়েছি। আম্মু প্রতিদিন খাওয়ার পর সেটা খেতে দিলে গুড বয়ের মতো খাবে, ওকে? চিন্তা করো না, ওটা তিতা না। “

সেলিম ঠোঁট উল্টে কিছুক্ষণ মননের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার বলা কথাগুলোকে উপেক্ষা করে হঠাৎই ছোট হাতে থাবা বসিয়ে মননের চোখের চশমাটা খুলে নিজের হাতে নিয়ে নেয় সে। সঙ্গে সঙ্গে গোলগাল লাল মুখটায় ফুটে উঠে হাসি। যেনো খুব বড়ো কিছু জয় করে ফেলেছে সে।

মনন বিব্রত হয়ে যায়। এটা তার জন্য নতুন কিছু না। তার কোলে ওঠা সকল বাচ্চারাই সুযোগ পেলে থাবা মেরে তার চোখের চশমা খুলে নেয়। যেনো এইটা খুব মজার কোনো খেলনা। সেলিমের আম্মু দ্রুত ছেলের হাত থেকে চশমা ছাড়াতে চাইলেই মনন ভদ্রতাসূচক স্বরে বলে,

“ সমস্যা নেই। বাচ্চা মানুষ। খেলুক। “

__________

হসপিটালের ক্যান্টিনটা বেশ পরিচ্ছন্নতা এবং নির্জনতায় ঘেরা। গুটি কয়েক পেশেন্ট, অভিভাবক এবং ডক্টরা দুপুরের খাবার খেতে একেক টেবিল দখল করে বসেছে। প্রত্যেকটা টেবিল থেকেই ভেসে আসছে মৃদু গুঞ্জনের স্বর।

অসামাজিক টাইটেল খ্যাত ডক্টর ওয়াসিফ কায়সার মনন ক্যান্টিনের এক কোণে একটা টেবিলে একা বসে আছে। মনযোগ তার টেবিলের উপর থাকা লাঞ্চ মেনুর প্রতি স্থির। নিজের চাপা ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবটার কারণে খুব সহজে মানুষের সঙ্গে মিশতে তার বড্ড অস্বস্তি। পরশিকে নিজের মনের কথা জানাতে না পারার এটাও অন্যতম একটা কারণ।

লাইফ কেয়ার হসপিটালের খাবারের মান ভালো হলেও, হসপিটালের খাবারে বাসার স্বাদটা খুঁজে পায় না মনন। কেমন মেডিসিনের একটা গন্ধ সবসময় নাকে লাগে। তবে বিগত কয়েক বছর দিনের একটা লম্বা সময় হসপিটালে পাড় করার দরুণ এই গন্ধটা এখন তার সয়ে গিয়েছে। খুব একটা অসুবিধা হয় না।

খাওয়ার মাঝে আচানক ফোনটা বেজে উঠতেই মনন টেবিলের উপর থাকা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। পরিচিত নামটা দেখতেই সে ফোনটা টেবিলের কেচাপের বোতলের সাথে দাঁড় করিয়ে রেখে কানে ইয়ার বাড গুজে কলটা রিসিভ করে। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠে একটা বৃদ্ধের মুখ। হাসি মুখে নিজের পিছনের দৃশ্যটা ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে বলে,

“ তোমার আগে আমি নায়াগ্রা দেখে ফেললাম। জীবন যুদ্ধে আমার থেকে আরো কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেলে তুমি। কষ্ট পেও না। আমার মতো বড়ো হও। তুমিও সুযোগ পাবে পৃথিবীটা ঘুরে দেখার। “

মনন চোখ জোড়া ছোট করে বলে,

“ তুমি আমার থেকে চল্লিশ বছরেরও বড়ো দাদু। জীবন যুদ্ধে আমার পিছিয়ে থাকাটা কি স্বাভাবিক না? আমার বয়সে তুমিও কিন্তু নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলে। “

মননের দাদু আলী আকবর কায়সার বলে উঠে,

“ আমার সাথে নিজের তুলনা দিও না। তোমার বয়সে কাজের পাশাপাশি একটা প্রেমিকাও সামলেছি আমি। পরবর্তীতে তাকে বিয়ে করেছি। তোমার বাপের বাপও হয়েছি। সে-ও বড়ো হয়ে তোমার বয়সে কাজের পাশাপাশি একটা প্রেমিকা সামলেছে। সেই মেয়েটা অর্থাৎ তোমার মা’কে বিয়ে করে তোমার বাপও হয়েছে। কিন্তু তোমার মাঝে সেরকম কোনো লক্ষ্মণ দেখছি না। বাপ, দাদার নাম ডুবাবে দেখছি। “

মনন দাদুর মশকরাকে পাত্তা না দিয়ে বলে,

“ পোস্ট গ্রেজুয়েশন এখনো শেষ হয় নি আমার। সারাদিন ল্যাব, ওয়ার্ড, কেবিনের চক্কর কাটছি তোমাদের এবং তোমার এই হসপিটালের মুখই উজ্জ্বল করতে। সেটা তোমাদের চোখে পড়ছে না? “

“ চক্করই কাটতে থাকো। বয়স পেরিয়ে যাবে, কিন্তু এই চক্কর কাটা আর শেষ হবে না তোমার। বুড়ো বয়সে আমার মতো নায়াগ্রা ঘুরতে আসার সুযোগ পাবে, কিন্তু তখন দেখবে তোমার সাথে কোনো সাথী নেই। “

মনন এবার কিছুটা হেসে দিয়ে বলে,

“ তোমারও কিন্তু সাথী নেই দাদু। একা একাই নায়গ্রার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হচ্ছে তোমাকে। আব্বুকে সাথে নিলেও পারতে। সিঙ্গেল দু’জন একে অপরকে কোম্পানি দিতে পারতে। “

“ এখন সাথী নেই। কিন্তু এককালে তো ঠিকই ছিলো। আমার জীবনে তোমার দাদী ছিলো, তোমার আব্বুর জীবনেও তোমার আম্মু ছিলো। মানুষ দুটো বেশি ভালো ছিলো দেখে তাদের তাড়াতাড়ি ডাক পড়ে গিয়েছে। এই আরকি। কিন্তু নিজেকে দেখো। আগে পিছে কেউ নেই তোমার। এরকম চলতে থাকলে আমার বংশের ফুল স্টপ হয়ে যাবে। ব্যাংকের এতো টাকা গুলো সব আমাদের তিন জনের মিলেই পরে শেষ করতে হবে। “

মনন হেসে আরো কিছু বলতে নিবে এমন সময় সে লক্ষ্য করে তার ডানপাশের সারির তৃতীয় টেবিলে বসে লাঞ্চ করতে ব্যস্ত মেয়েটাকে। গপাগপ বসে গরুর গোস্তো মেখে সাদা ভাত খাচ্ছে। মনন বিস্মিত নয়নে মেয়েটাকে দেখে। এটাই গত রাতের সে-ই মেয়েটা না? কি যেনো নাম? মোহ! হ্যাঁ, মোহ।

মেয়েটা না অসুস্থ? তাহলে এসব খাচ্ছে কেনো? এই মেয়েকে কি কেউ বলে নি, যে এই হসপিটালের প্রত্যেক পেশেন্টের জন্য রেড মিট হচ্ছে বিষ সরূপ? মননের দাদু ফোনে তখন কিছু বলছিলো। মনন দ্রুত গলায় বলে,

“ পরে কথা বলছি দাদু। “

বলেই কলটা কেটে দেয়। মননের খাওয়া প্রায় শেষ। সে চরম অস্বস্তি নিয়ে মোহ নামক মেয়েটাকে দেখছে। তার একবার ইচ্ছে করছে যে উঠে গিয়ে মেয়েটাকে এই খাবারটা খেতে নিষেধ করতে। পর মুহুর্তেই ভাবছে মেয়েটা যদি আবারও তার প্রতি ভুলভাল ধারণার ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করে? ক্যান্টিনে মননের ডিপার্টমেন্টের একজন সিনিয়র ডক্টরও বসে লাঞ্চ করছে। অযথা ইজ্জত যাবে। কিন্তু তা-ই বলে কি সে চোখের সামনে একটা পেশেন্টকে নিজের ক্ষতি করতে দেখেও চুপ করে থাকবে?

বেশ কিছুক্ষণ দ্বিধা দ্বন্দ্বে কাটিয়ে মনন উঠে দাঁড়ায়। টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে এগিয়ে যায় সেই মেয়েটির টেবিলের কাছে। টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মেয়েটা খাওয়া থামিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকায়। মনন অস্বস্তি কাটিয়ে ফটাফট বলে বসে,

“ এই হসপিটালের প্রতিটা পেশেন্টের জন্য রেড মিট নিষিদ্ধ। বিষের মতো শরীরে বাসা বাঁধা রোগটাকে আরো শক্তিশালী করে তুলে। আপনি হয়তো বিষয়টা জানেন না, তাই জানিয়ে দিলাম। এসব খেলে আপনার ক্ষতি হবে। দ্রুত নিজের নিউট্রিশনের সঙ্গে দেখা করে নিজের ডায়েট চার্টটা বুঝে নিন। রেড মিট, কোল্ড ড্রিংকস, চিনি জাতীয় খাবার সহ আর যা যা নিষিদ্ধ তা এভয়েড করুন। আসি। আল্লাহ হাফেজ। “

প্রফেশনাল ভঙ্গিতে বলা লম্বা পরামর্শের ইতি টেনে মনন ফটাফট সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। টেবিলে বসে থাকা মেয়েটাকে পাল্টা কিছু বলার সুযোগটুকুও দেয় না। নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পরিহিতা ক্লান্ত মুখশ্রীর মেয়েটা লোকমা হাতে হা করে লোকটার যাওয়ার পানে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে,

“ পাগল নাকি? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে