অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৯.
সকাল থেকে দু’বার বমি করে গা ভাসিয়েছে মোহ। গতকাল কেমো দিয়ে আসার পর থেকে মনে হচ্ছে মুখের রুচি যেনো পুরোপুরি মরে গিয়েছে। যা-ই খাচ্ছে তা পেটে সইছে না। ঠেলেঠুলে আবার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। উৎকৃষ্ট খাবারের অংশ মাখা জামা বদলে, পরিষ্কার একটা জামা পড়ে বিছানায় শুয়ে আছে মোহ। মন, মেজাজ দুটোই বিক্ষিপ্ত। শরীরটা দূর্বল। খিদে পাচ্ছে, কিন্তু খাবার দেখলে আবার খাওয়ার ইচ্ছে মরে যাচ্ছে। কি অদ্ভুৎ এক সমস্যা!
মোহর সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় ব্যস্ত শায়লা। বারবার এইটা সেইটা বানিয়ে নিয়ে আসছে মোহর জন্য। হয়তো একটা কিছু মেয়েটা একটু তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারবে। শিহান অফিসে গিয়েছে সকাল বেলায়। আর মায়া ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে। কাল বাদে পরশু কলেজ খোলা। কোচিং এরও বহু পড়া জমে আছে তার।
বিশাল ঘরটায় একা অনুভব করে মোহ বিছানা ছেড়ে নামে। একবার ভাবে মায়ার কাছে যাবে। কিন্তু পরক্ষণে মনে হয়, মায়াকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। শায়লা নিচে রান্নাঘরে আছে। ওখানে যেতেও ইচ্ছে হয় না মোহর। মশলার ধাগে কাশি আসে তার। তাই সে সরাসরি চলে যায় নিজের দাদুর রুমে।
পরিষ্কার বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে আছেন একজন সত্তর বছরের পৌঢ় নারী। অসুস্থতার ভারে চেহারায় তার ভাঙা ছাপ। খোলা চোখ জোড়া সিলিং এর দিকে নিবদ্ধ। বিগত বেশ অনেক গুলো বছর ধরেই বৃদ্ধার জীবনটা এই বিছানার মাঝেই সীমাবদ্ধ। প্রাণ থাকতেও এক নিষ্প্রাণ, অচল জীবন পাড় করতে করতে মৃত্যুর সময় গুণছেন তিনি।
মোহ সরাসরি বিছানায় উঠে দাদুর পাশে শুয়ে পড়ে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে তার দাদুকে। কিন্তু সে তা করে না। যদি দাদুর অস্বস্তি বা ব্যথা লাগে? মুখ ফুটে তো তা বলতে পারবে না দাদু। মোহ অনিচ্ছাকৃত ভাভেও কাউকে কষ্ট দিতে আগ্রহী নয়। তাই সে নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে,
“ আমার কিছু ভালো লাগে না কেন দাদু? “
বৃদ্ধার কানে পৌঁছায় নাতনির কথা। তবে তিনি জবাব দিতে অপারগ। তাই কেবল শুনে যায় নীরবে। মোহ বলতে থাকে,
“ আমি এখন তোমার পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছি। জীবন মৃত্যুর মাঝে ঝুলে থাকাটা খুব যন্ত্রণার হয়। আমরা দু’জন একই যন্ত্রণা পাচ্ছি। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি একটাই। হয় এপার, নাহয় ওপারে চলে যাওয়া। বাবা আমাকে এপারে ধরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ওপার থেকেও তো আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানছে। মাঝেমধ্যে কি মনে হয় জানো? এই দুই পাশের টানাটানিতে আমি হয়তো দুইভাগ হয়ে দু’দিকে চলে যাবো। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না তাই না? জানো? বাবা তোমাকেও ধরে রাখার সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এতো বছর ধরে। কারণটা কি জানো? তোমার ছেলে খুব ভীতু দাদু। সে আমাদের হারাতে হয়তো খুব ভয় পায়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছার থেকে তো পৃথিবীর কোনো মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট বড়ো নয়, তাই-না? যদি মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টই যথেষ্ট হতো তাহলে তো মা-ও আমাদের ছেড়ে যেতো না। কিন্তু আল্লাহর মর্জি ছিলো বলেই মা উনার কাছে চলে গিয়েছে। কে জানে? হয়তো তুমি, আমিও চলে যাবো। অবশ্য বাবাকে নিয়ে আমাদের চিন্তা করার কিছু নেই। বাবার কাছে মায়া আছে। মায়া বাবাকে সামলাতে পারবে। মায়া অবশ্য সবাইকেই সামলাতে পারে। ও একদম তোমার আর মা-র মতো হয়েছে। আমি তোমাদের মতো হলাম না কেন? আমি তোমাদের মতো হলে কি বাবা আমাকেও ভালোবাসতো? “
এতদূর বলতেই থেমে যায় মোহ। চোখ ছলছল করছে তার। তাকিয়ে দেখে দাদুরও চোখের কোণায় পানি। মোহ হাত দিয়ে তা মুছে দিয়ে হেসে বলে,
“ কি মনে হয় তোমার? আমি টাইটানিক ২ এর কাহিনী লিখতে পারবো? দেখো, কি ইজিলি তোমাকে ইমোশনাল করে দিলাম। সেম টাইপ ডায়লগ লিখলে মুভির দর্শকদেরও কাঁদাতে পারবো। মুভি হিট, স্ক্রিপ্ট রাইটার হিট। জোস হবে না ব্যাপারটা? “
বলেই মোহ আরেক দফা হাসতে থাকে। সে নিছক মজা করেই এই কথাগুলো বলেছে। ঠিক সেই মুহুর্তে দরজার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মায়া দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে। নিজের রুমে এসে দরজা লক করে বিছানায় বসে পড়ে সে। চোখ ছলছল করছে তার। দাদুকে বলা মোহর কথা সবটাই শুনেছে সে। আর শোনার পর থেকেই তার খুব কান্না পাচ্ছে। কান্নাটা ঠিক কি কারণে আসতে চাইছে তা মায়ার জানা নেই। সে কেবল জানে তার এখন হালকা হওয়ার জন্য কাঁদতে হবে।
মায়া যখন বাঁধহারা নীরব কান্নায় মগ্ন তখন আচমকাই তার ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে শুভ্রর নামটা ভেসে আছে। মায়া অপেক্ষা না করে ফোনটা তুলে। অপর পাশ হতে শুভ্র তার নাক টানার শব্দ শুনে জানতে চায়,
“ দোস্ত কি হইসে? সব ঠিক আছে? মোহ ঠিক আছে? “
মায়া উত্তর দিতে পারে না। তার কান্নার গতি বাড়ে। বাবার মতো তারও খুব ভয় হয়। কাউকে হারাতে চায় না সে। সে সবাইকে সুস্থভাবে নিজের জীবনে চায়।
__________
গভীর রাত তখন। জানালার পর্দার ফাঁক গলে পূর্ণ চাঁদের আলোয় রুমটা আলোকিত হয়ে আছে। বিছানায় গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকা রমণীর ঘুম ভাঙে আচানক। খুব অস্থির অনুভব করছে সে। চোখ খোলার চেষ্টা করতে নিয়ে টের পেলো চোখের পাতা খুব ভারী অনুভূত হচ্ছে। সেই সাথে জ্বালাও করছে।
একা রুমটায় মোহ উপলব্ধি করলো হুট করে বিনা নোটিশে জ্বর এসে হাজির হয়েছে। শরীরের প্রতিটা ভাজে সেই জ্বর নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। কি এক মুশকিল! মোহ চেষ্টা করে একা উঠে বসার। কিন্তু শরীরে সামান্যতম বল খুঁজে পায় না সে।
মোহর আফসোস হয়। মায়া বারবার করে তার সঙ্গে থাকতে চাইছিলো। কিন্তু সে-ই ঠেলেঠুলে মায়াকে নিজের রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন কি করবে সে? অন্য কোনো উপায় না পেয়ে মোহ হাতড়ে ফোনটা খুঁজে বের করে বালিশের ভাজ থেকে। জোর করে চোখ মেলে তাকিয়ে ফোনটা সুইচ অন করে সে। গতকাল থেকে সে নিজের ফোন সুইচ অফ করে ফেলে রেখেছিল। কারণ হলো তার ক্লাসমেটরা। ওদের কৌতূহলী ম্যাসেজ এবং কল এড়ানোর জন্য এটাই সবথেকে সহজ উপায় মনে হয়েছে মোহর।
ফোন অন করতেই মিসড কলের নোটিফিকেশনে স্ক্রিন ফুল হয়ে যায়। মোহ সেসব উপেক্ষা করে কনট্যাক্ট লিস্টে চলে যায়। ঝাপসা, উত্তপ্ত চোখে কিছুটা স্ক্রল করে একটা নাম্বার ডায়াল করে। কানে ফোনটা চেপে ধরে ফের চোখ বুজে নেয় সে। এসির ভিতরেও মনে হচ্ছে সে পুড়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ রিং হতেই ফোনটা রিসিভ হয়। মোহ অপর পাশের মানুষের কিছু বলার অপেক্ষা না করে নিজেই দূর্বল গলায় বলে,
“ একটু রুমে আয় তো। কাউকে ডেকে বিরক্ত করিস না। জ্বর এসেছে মনে হয় সামান্য। সাথে করে একটু পানি নিয়ে আয়। মেডিসিন খেয়ে নিবো। “
বলেই মোহ চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ নীরবতা বজায় থাকে। অত:পর তাকে অবাক করে দিয়ে একটা পুরুষ স্বর বলে উঠে,
“ আমাকে আসতে বলছেন? “
মোহ জ্বরের ঘোরে চমকায়। ফোনটা কান থেকে সরিয়ে চোখের সামনে ধরে দেখে সে মায়ার জায়গায় ভুল করে অনাকাঙ্ক্ষিত নাম্বারে ডায়াল করে ফেলেছে। সাথে সাথে সে ফোন কানে চেপে ধরে বলে,
“ সরি। ভুলে। নাম্বার ডিলিট করে দিচ্ছি। ভুলেও আর কখনো কল যাবে না। এগেইন সরি… “
মোহর সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই অপর পাশের ব্যক্তিটি বলে উঠে,
“ আই এম সরি মোহ। ওদিনের জন্য সরি। হার্ট করার জন্য সরি। “
মোহ কিছু বলতে পারে না। বুঝে উঠতে পারছে না কিছু। কেবল টের পাচ্ছে তার ঘাড়ের নিচে বালিশের দিকটা শরীরের উত্তাপে গরম হয়ে গিয়েছে। মোহকে অবশ্য আর কিছু বলতেও হয় না। মনন নিজেই বলে উঠে,
“ কখন থেকে জ্বর আপনার? জ্বর মেপে দেখেছেন? “
মোহ এবারও নিরুত্তর রয়। মনন এবার গলার স্বর কিছুটা নরম করে প্রশ্ন করে,
“ কথা বলবেন না, মোহ? “
মোহ আসলেই আর কথা বলে না। বরং সোজা কলটা কেটে দেয়। কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে মননের নাম্বারটাও ডিলিট করে দেয়। মনে এসে ভীড় করে অভিমান। ভীড় জমানো অভিমান বুকে পুষে মোহ ঠিক করে সে কখনো এই লোকের সাথে কথা বলবে না। কেনো বলবে না সে জানে না। মোহর ভাবনার মাঝেই আরো একবার তার ফোন বেজে উঠে। এইবার সে সোজা ফোন সুইচ অফ করে ফেলে। কারো কল রিসিভ করবে না সে। কারো সাথে কথা বলবে না।
__________
মনন হতাশ ভঙ্গিতে ফোন হাতে বিছানায় বসে আছে। আচমকা কলের শব্দে ঘুম ভেঙে স্ক্রিনে মোহর নাম দেখে যেমন খুশি হয়েছিলো সে, এখন একই রকম শূন্যতা অনুভব করছে। মেয়েটা আসলেই তার সাথে আর কথা বলতে চায় না? দায় কি সম্পূর্ণ মননের?
মনন অন্ধকার রুমে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থেকে উপলব্ধি করে, বুকের ভেতর ক্রমাগত কিছু একটা ভেঙে চলেছে। ঠিক নদীর পাড় ভাঙার মতো। মনন টের পায় বুকের ওখানটায় বড়ো একটা গড়মিল ঘটে গিয়েছে ইতিমধ্যে। কিন্তু তা কি সেটা তার বুঝে আসছে না। মননের স্থির দৃষ্টিতে কোনো হেলদোল দেখা যায় না। কেবল বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসটা লক্ষণীয় হয়।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]