অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৮.
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনটায় মুখোমুখি বসে আছে দু’জন যুবক। আজকে লাইফ কেয়ার হসপিটালে অনুষ্ঠিত সেমিনারে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দু’জনের সাক্ষাৎ হয়েছে। মননের সামনে বসে থাকা যুবকটা তার কলেজ লাইফের ক্লাসমেট। বর্তমানে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের পেশায় ডক্টর হিসেবে নিযুক্ত আছেন। নাম ডক্টর মাশুক মৃধা। হুট করে এতো বছর পর দেখা হওয়ায় দু’জনেই যেনো খুব খুশি। কথায় কথায় মনন জেনেছে মাশুক বর্তমানে বিবাহিত। স্ত্রী রয়েছে তার।
সেমিনার শেষে পেশেন্ট ভিজিটের জন্য মনন তেরো তলায় গিয়েছিলো। সঙ্গে ছিল মাশুক। ফেরার পথে আচমকা একটা নির্দিষ্ট কেবিনের সামনে এসে মনন অজান্তেই থেমে গিয়েছিলো। তাকিয়ে ছিল কেবিনের দরজার পানে। সেই ব্যাপারটা মাশুক লক্ষ্য করে জানতে চায় দাঁড়িয়ে পড়ার কারণ। মনন সেখানে আর কথা বাড়ায় নি। বরং মাশুককে নিজের কেবিনে কফির জন্য অফার করে। কফি খেতে খেতেই না-হয় মাশুকের প্রশ্নের জবাব দেওয়া যাবে সেই ভাবনা থেকে।
ধোঁয়া উঠা গরম কফির মগে একটা চুমুক বসিয়ে মনন বলে উঠে,
“ এক তিন শূন্য সাত নং কেবিনে একজন পেশেন্ট এডমিট আছে। একটা মেয়ে। আমি ওই মেয়েটাকে হার্ট করেছি। নিজের কথা দ্বারা। কখনো মনে হয় ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত, কখনো মনে হয় ওর মুখোমুখি আর না হওয়াই ভালো। “
মননের কলেজ লাইফের ক্লাসমেট, বর্তমানে ডক্টর মাশুক মৃধা নীরবে শুনে সবটা। সূক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করে মননের মুখের অভিব্যক্তি। অত:পর প্রশ্ন করে,
“ পেশেন্টের সিচুয়েশন কি? “
“ ফিমারে টিউমার। টিউমারে ক্যান্সারের জীবাণু রয়েছে। থার্ড স্টেজ ক্যান্সার। “
“ ফিমারে টিউমার? কিন্তু আমার জানামতে তো তুমি ব্লাড ক্যান্সারের পেশেন্টদের ডিল করো। বোন এন্ড সফট টিস্যু ডিপার্টমেন্ট এর পেশেন্টের সঙ্গে তোমার সূত্রটা মেলাতে পারছি না। “
মনন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ সে এক লম্বা ঘটনা। তোমাকে ছোট করে বলি। প্রথমে কাকতালীয়ভাবে তিনবার আমাদের দেখা হয়। তারপর থেকে সামহাও ব্যাপারটা আর কাকতালীয় থাকে না। ও মাঝেমধ্যে দেখা করতে চাইতো, হয়তো আমিও মনে মনে চাইতাম। ও দেখা করতে চাইলে কখনো নিষেধ করতে পারতাম না কেনো জানি। ও আমার আশেপাশে প্রশ্রয় খুঁজতো, না চাইতেও আমি কিভাবে কিভাবে যেনো ওকে প্রশ্রয় দিতে থাকি। ব্যাপারগুলো খুব কনফিউজিং। ওর সাথে তো আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই ভেবে নিলাম দূরত্ব বজিয়ে চলাটাই বেটার। “
মাশুক আনমনে হাসে। নীরবে হাসতে হাসতে কফির মগে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করে,
“ প্রথম কাকতালীয় দেখাটা কবে হয়েছে তোমাদের? “
মননের তরফ থেকে আসে সঙ্গে সঙ্গে জবাব,
“ ঠিক একমাস আগে। “
“ আচ্ছা। কি পরেছিলো সেদিন সে? “
“ কালো রঙের একটা জামা। “
মননের জবাবে এবারও কোনো জড়তা নেই। তবে জবাবটুকু দিয়েই সে অবাক হয়। মাশুককে প্রশ্ন করে,
“ এসব কেনো জানতে চাইছো? “
মাশুক জবাব দেয় না। বরং পাল্টা প্রশ্ন করে,
“ তুমি ওকে নিয়ে খুব কনফিউশানে ভুগছো, তাই না? “
মনন এবার কেবল মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। মাশুক কিছুটা গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসে। সরাসরি মননের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ কোনটার সমাধান আগে চাও? ওকে নিয়ে নিজের দ্বিধার নাকি ক্ষমা চাওয়াটা উচিত হবে নাকি অনুচিত সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত? “
মনন কিছুক্ষণ মাশুকের দিকে তাকিয়ে থেকে জবাব দেয়,
“ দ্বিতীয়টার। “
মাশুক কোনো ভনিতা না করে বলে,
“ আমার সাজেশন চাইলে আমি সাজেস্ট করবো, ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে ওর সিচুয়েশনটা। থার্ড স্টেজ ক্যান্সার আছে ওর। সার্ভাইভাল চান্সেস সম্পর্কে তোমার ধারণা আমার থেকেও বেশি। তাই বলবো সুযোগটা হাতছাড়া করো না। খুব বেশি দেরি হয়ে গেলে আজীবন আফসোস থেকে যাবে। আমি চাই না তুমি আফসোস করো। “
মনন আচমকাই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় মোহর কেসের সার্ভাইভাল রেট সম্পর্কে। অনুভব করলো তার বুক কাঁপছে। অদ্ভুৎ অসহায়ত্ব যেনো তাকে গ্রাস করে ফেলছে। আবারও মনে পড়ে যায় মোহর মুখটা। ওই জ্বলজ্যান্ত মানুষটার না থাকার সম্ভাবনায় যে তার যায় আসছে তা তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠে। মাশুক লক্ষ্য করে সবটা। সে বলে উঠে,
“ এবার আসি তোমার মনে চলতে থাকা দ্বিধা দ্বন্দ্বের আলাপে। তুমি ইচ্ছা অনিচ্ছায় মেয়েটার সঙ্গে জড়িয়ে পরেছো। তুমি স্বীকার করো কিংবা না করো, দিজ ইজ ফ্যাক্ট। খালি চোখে দেখতে গেলে তোমাদের মাঝে কিছু নেই এইটা সত্য। কিন্তু দৃষ্টির আড়ালে তোমাদের মাঝে কিছু না থেকেও অনেক কিছু একটা আছে এইটাও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তোমার দ্বিধা দ্বন্দ্বের সমাধান হিসেবে আমি শুধু এতটুকুই বলতে পারি। তোমাদের মাঝে থাকা সেই কিছু একটাকে এখন তোমারই খুঁজে বের করতে হবে। ইট ইজ টোটালি আপ টু ইউ। “
মনন শুনে সবটা। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর পূর্বেই তাকে গভীর ভাবনায় ডুবতে দেখা যায়। মাশুক তা লক্ষ্য করতেই হঠাৎ তার মন খারাপ হয়ে যায়। তার সামনে বসা এই ছেলে যদি সেই কিছু একটাকে খুঁজে পায় তারপর কি হবে? কি হতে পারে তার পরিণতি? মেয়েটার জীবনের স্পষ্ট নিশ্চয়তা নেই কোনো। পরিণতিটা যদি করুণ হয়?
ভাবতে ভাবতেই মাশুক ধীর গলায় প্রশ্ন করে,
“ এক তিন শূন্য সাত নং কেবিনের পেশেন্টের নামটা কি বাই দ্যা ওয়ে? “
মনন ভাবনা থেকে বেরিয়ে জবাব দেয়,
“ মোহ। “
__________
মাশুককে বিদায় করেই মনন ব্যস্ত পায়ে দ্রুত লিফটের দিকে হাঁটা ধরে। দুটো লিফটেরই বাটন চেপে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। মস্তিষ্কে বারবার আলোড়িত হচ্ছে মাশুকের বলা কথাগুলো।
“ সুযোগটা হাতছাড়া করো না। খুব বেশি দেরি হয়ে গেলে আজীবন আফসোস থেকে যাবে। আমি চাই না তুমি আফসোস করো। “
হঠাৎই মনে ভয় হয় মননের। যদি… যদি দেরি হয়ে যায়? লিফট আসতে দেরি হচ্ছে দেখে অধৈর্য্য হয়ে যায় মনন। তাকিয়ে দেখে একটা লিফট এখনো বারো তলায় দাঁড়িয়ে আছে, অপরটা আট তলায়। ভিন্ন ভিন্ন ফ্লোরে থেমে লিফটের নামতে খুব সময় লাগবে। এতটা সময়ের তর সয় না মননের। সে কয়েক কদম পাশেই ইমারজেন্সি স্টেরওয়ের দিকে চলে যায়।
খালি সিঁড়ি বেয়ে একপ্রকার দৌড়ে উঠছে মনন। মাত্র সাত তলায় উঠেছে সে। এক চাপে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠার কারণে নিঃশ্বাসে টান পড়েছে তার। থেমে কিছুক্ষণ দম ফেলে সে আবার দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে।
তার পা জোড়া থামে একেবারে তেরো তলায় পৌঁছে। দ্রুত করিডর পেরিয়ে মোহর কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। মুহুর্তেই তীব্র অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে। কেবিনের ভেতর থাকা মানুষ গুলোও অবাক হয়ে দেখছে তাকে। মনন আড়ষ্ট গলায় বলে,
“ সরি ফর ডিস্টার্বিং। “
কথাটুকু বলেই মনন কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। সোজা চলে যায় তেরো তলার নার্স কাউন্টার এরিয়াতে। গিয়ে একজনকে প্রশ্ন করে,
“ রুম নং ওয়ান থ্রি জিরো সেভেন এর পেশেন্ট কোথায়? “
কাউন্টারে বসে থাকা নার্স প্রশ্ন করে,
“ পেশেন্টের নাম? “
“ মেহনামা ফেরদৌস মোহ। “
নার্সটা কম্পিউটারে কিছু একটা চেক করে জানায়,
“ স্যার, উনি তো কেমো শেষ করে বিকেলেই ডিসচার্জ নিয়ে চলে গিয়েছেন। কোনো প্রয়োজন? “
মনন আর কিছু বলতে পারে না। নীরবে সেখান থেকে প্রস্থান করে সোজা ছাদে চলে যায়। ছাদে দমকা হাওয়া চলছে। মনন তোয়াক্কা করলো না, বরং কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে। দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভুলে মোহর নাম্বারে কল করে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ফোনের অপর পাশ থেকে নারী কণ্ঠ বলে উঠে,
“ দ্যা নাম্বার ইউ আর ট্রায়িং টু কল ইট’স আনরিচেবল। প্লিজ ট্রাই এগেইন লেটার। “
মননের বুকের ভেতর অদ্ভুৎ এক সর্বনাশা ধ্বনি বাজতে থাকলো। মোহ চলে গিয়েছে। সে কি খুব দেরি করে ফেললো? সুযোগ কি হাতছাড়া হয়ে গেলো? অসহায়ত্ব বোধ ঘিরে ধরলো মননকে। অদ্ভুৎ অসহায়ত্ব বোধ। এই অসহায়ত্ব বোধ থেকে মুক্তি শুধুমাত্র মোহ তাকে দিতে পারবে। কিন্তু কোথায় পাবে সে মোহকে? কোথায় খুঁজবে?
চলবে…