অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-১৭

0
46

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৭.

সময় সকাল ছয়টা বেজে সাতচল্লিশ মিনিট। লিভিং রুমের সিঙ্গেল সোফাটায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন আলী আকবর সাহেব। এটা উনার নিত্যদিনের রুটিন। ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করে ঘরময় পায়চারি করতে থাকেন। খবরের কাগজ এলে তাতে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে নিয়ে রুমে গিয়ে হসপিটালে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নেয়। অত:পর বেরিয়ে যাওয়ার আগে সোজা নাস্তা করে রওনা হোন তিনি। তবে আজ ভাবছেন হসপিটাল যাবেন না। বরং নাস্তা করে সোজা রুমে গিয়ে আরেক দফা ঘুমাবেন তিনি।

হঠাৎ টের পান কেউ একজন লিভিং রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে। আলী আকবর সাহেব টের পেয়েও চোখ তুলে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন না। বরং খবরের কাগজের প্রতিই মনযোগ স্থির রাখেন। উনার মনযোগ ভাঙ্গেন যখন কেউ একজন উনার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে নরম গলায় ডাকে,

“ দাদু? “

এই পর্যায়ে আলী আকবর কায়সার না চাইতেও খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে নাতির মুখপানে তাকায় সরাসরি। অবাক হোন তিনি। গতরাতের হসপিটাল ফেরত শার্ট, প্যান্ট গায়ে এখনো মননের। চশমা পড়ে না থাকায় সরাসরি দেখা যাচ্ছে অতিরিক্ত লাল চোখ দুটো। চুলগুলোও এলোমেলো।

গতরাতে রুমে যাওয়ার পর মনন আর রুম থেকে বের হয় নি। আলী আকবর সাহেব কিংবা আরিফ সাহেবও আর তাকে ডাকে নি। মননের প্রাইভেট লাইফ কি-না! এই মুহুর্তে নাতির এই অবস্থা দেখে আলী আকবর সাহেব উৎকণ্ঠা বোধ করেন। তবে তা প্রকাশ করে না, নীরব রয়।

মনন নিজ থেকেই নীরবতা ভেঙে বলে,

“ আই এম সরি দাদু। গতরাতে আমার ওভাবে কথা বলাটা ঠিক হয় নি। আই ওয়াজ নট ইন মাই মাইন্ড। “

“ তা তো বুঝাই যাচ্ছিলো। “

“ এগেইন সরি দাদু। কিন্তু এই বিয়ের টপিকটা বারবার আমার সামনে তুলো না। আই এম নট রেডি ফর এনি কমিটমেন্ট। “

“ অভিভাবক হিসেবে আমি এবং তোমার বাবা সর্বোচ্চ তোমাকে বিয়ের কথা বলতে পারি, পাত্রীর ছবিও দেখাতে পারি। কিন্তু কখনো জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবো না এতটুকু নিশ্চিত থাকতে পারো। কিন্তু আমাদের বলা কওয়া নিয়েও যদি তোমার আপত্তি থাকে তাহলে সেটাও বাদ দিয়ে দিবো না-হয়। আফটার অল তুমি বড়ো হয়েছো। তোমার নিজের ব্যক্তিগত জীবন আছে। “

“ তোমাদের কিছু বলতে নিষেধ করি নি আমি। অবশ্যই তোমরা আমার ব্যাপারে কথা বলার অধিকার রাখো। কিন্তু দাদু সবকিছুর একটা সঠিক সময় থাকে। সঠিক সময় আসুক। তখন না-হয় এই টপিক নিয়ে কথা হবে আমাদের? “

আলী আকবর কায়সার না চাইতেও হঠাৎ গলে যান বরফের মতো। এই একটা সমস্যা তার! বেশিক্ষণ রাগ পুষে বসে থাকতে পারেন না তিনি। নোবিতার মতো দেখতে এই একমাত্র আদুরে নাতির বেলায় তো আরো না। তিনি কিছুটা মুখ ভার করে বলে,

“ এভাবে সরি চলবে না। আমার ইন্সটাগ্রামে ফলোয়ার বাড়ছে না। আমাকে ইন্সটায় ট্যাগ মেরে একটা পোস্ট বা স্টোরি দাও তো। “

মনন কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই শব্দ করে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে জবাব দেয়,

“ আমার ইন্সটা একাউন্ট নেই দাদু। একটা ছিলো, কিন্তু ব্যবহার করা হতো না। তাই ডিলিট করে দিয়েছি। “

আলী আকবর কায়সারকে হতাশ দেখালো। উনি আফসোসের সুরে বলেন,

“ ওই দুইশো প্লাস ফলোয়ারের একাউন্টটা তুমি ডিলিট করে দিলে? আমাকে দিলেও তো পারতে! আমার একাউন্টে মাত্র সাতাশ জন ফলোয়ার। আগে বত্রিশ জন ছিলো। কিন্তু যারা যারা রিয়েক্ট দেয় না তাদের আনফ্রেন্ড করে দিয়েছি আমি। “

মনন হাসতে হাসতে বলে,

“ উঠো। চলো, আজকে আমি নাস্তা রেডি করবো। ফ্রেঞ্চ স্যান্ডউইচ। রাতে আমি খাই নি দেখে যে তুমি আর আব্বুও খাও নি তা আমার জানা আছে। খিদে পায়নি? “

আলী আকবর সাহেব নাক মুখ কুচকে বলে,

“ ভুলেও না। তোমার গা থেকে ঘাম আর হসপিটালের বাজে গন্ধ আসছে। তোমার হাতের খাবার খেলে আমাকে হসপিটালে ভর্তি হতে হবে। তুমি গিয়ে গোছল করে নিজের এই গাঁজাখোরদের মতো হুলিয়া বদলাও। আমি গিয়ে তোমার বাপকে ডাকছি। ওর কাজ করা উচিত, দিনদিন ভুড়ি বেড়ে কি বিশ্রী দেখাচ্ছে। ওই বুড়োকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পাবো দু’দিন পর। “

বলতে বলতে আলী আকবর সাহেব পত্রিকা রেখে উঠে চলে যান। মনন হতাশ হয়ে দেখে নিজের দাদুকে। মিনিটের মধ্যে তার এবং তার আব্বুর ইজ্জতের রফাদফা করে দিলো এই বুড়ো!

__________

স্যালাইনের ড্রিপ হয়ে ধীর গতিতে বিন্দু বিন্দু স্বচ্ছ তরল নলার মতো চিকন বস্তুতে প্রবেশ করছে। সেই নলা একটা সুঁইয়ের মাধ্যমে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে কেমো পোর্টে। গত দুই ঘন্টা ধরে এভাবেই চলছে মোহর দ্বিতীয় সাইকেল কেমোর প্রথম দিনের ডোজটা। নার্সের ভাষ্যমতে আরো তিন থেকে চার ঘন্টা এভাবেই চলবে।

মোহর যেনো দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। সে সোজা হয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে। নড়াচড়া করার কোনো উপায় নেই। কারণ কেমোটা হাতে করে ক্যানেলার মাধ্যমে নয় বরং বুকে সরাসরি কেমো পোর্টের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে মোহর মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবথেকে ভয়ংকর শাস্তি বোধহয় এটাই। আর কোনো যন্ত্রণা এর থেকে বড়ো হতে পারে না। রোগটা যতটা না ভয়ংকর, তার থেকেও এর চিকিৎসা প্রক্রিয়া আরো বেশি যন্ত্রণাদায়ক। মনে মনে বারবার আওড়াচ্ছে,

“ কেউ এই শাস্তি না পাক কখনো। আমার চরম শত্রুও না। কেউ ভোগ না করুক এই যন্ত্রণা কখনো। “

ভেতরে ভেতরে ঝড় বয়ে চললেও উপরে তার সিঁকি ভাগও প্রকাশ করছে না মোহ। বরং নীরবে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। মায়া ছিলো তার পাশেই। বারবার মোহকে জিজ্ঞেস করছে,

“ আপেল খাবি? কেটে দেই একটু? নাকি কমলা ছিলবো? একটু পানি খাবি? ডক্টর কিন্তু দিনে তোকে দুই থেকে তিন লিটার পানি খেতে বলেছে। যত বেশি পানি খাবি তত তাড়াতাড়ি ইউরিনের সাথে শরীরের এক্সেস মেডিসিন, জীবাণু সব বের হয়ে যাবে। “

মোহ শুনে সব। প্রতুত্তর করে না। মায়াকে সে বুঝাতে পারবে না। যে এই মুহুর্তে উঠে বসার চেষ্টা করলে তার বুকে কেমন অনুভূত হবে। না সে এটা বুঝাতে পারবে যে, তার কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। লোভনীয় সব খাবারের প্রতিও তার রুচি কাজ করছে না। বরং বিষ মনে হচ্ছে সেসবকে। অবশ্য যে ভোগ করছে সে বাদে কেউ কখনো বুঝবেও না এর জটিলতা। কেবলমাত্র শব্দ গুচ্ছ কম হয়ে যাবে কাউকে মোহর এই অনুভূতি গুলো বুঝাতে।

মোহর তরফ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মায়া হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়ায়। ইমারজেন্সি নার্স কল করার ওয়্যারড রিমোটটা মোহর হাতের কাছে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“ ওয়াশরুম থেকে আসছি আমি। খারাপ লাগলে রিমোট চেপে দিবি। সাথে সাথে নার্স এসে পরবে। আর তাছাড়া বাবাও দরজার ওপাশে আছে। বাবাকেও ডাকতে পারিস। “

মায়া ওয়াশরুমে চলে যেতেই মোহ আবার সিলিং এর দিকে দৃষ্টি স্থির করে। নিজেকে হুট করেই পৃথিবীর বুকে একটা উটকো ঝামেলা মনে হচ্ছে তার। ওই লোকটার সাথে কেনো এরকম গায়ে পড়া আচরণ করলো সে? কি কারণে? কি কারণে নিজেকে এতটা সস্তা হিসেবে তুলে ধরলো সে? লোকটার নিশ্চয়ই ধারণা হয়েছে, মোহ খুব ছ্যাচড়া স্বভাবের একটা গায়ে পড়া মেয়ে।

অথচ মোহ? তার মাথায় এতদিন এক মুহুর্তের জন্যও এমন চিন্তা আসে নি। সে শুধু জানতো, সে ওই লোকটার সঙ্গ উপভোগ করছে। অনেকটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। ক্ষণিকের কথা, ক্ষণিকের আলাপ সবটাই কেবল মোহর ভাল্লাগতো। কোথাও না কোথাও তার মন ধরে নিয়েছিলো ওই লোকটা বোধহয় তার যন্ত্রণাটা না বলা সত্ত্বেও বুঝতে পারবে। ডক্টর মানুষ তো! পেশেন্টদের উপর গভীর পড়াশোনা আছে তাদের। কোন রোগে রোগী কতটুকু কষ্ট পাচ্ছে ওই ধারণাটুকু নিশ্চয়ই উনাদের আছে?

কিন্তু গতকাল মোহ উপলব্ধি করেছে তার এবং ওই ডাক্তারের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। মোহর কাছে যা ছিলো উপভোগ তুল্য, ওই লোকের কাছে সেই একই বিষয় ছিলো বিরক্তির কারণ। তবে এইবার মোহর চোখ খুলে গিয়েছে। আর কারো বিরক্তির কারণ হবে না সে। তার কারণে সবার ব্যক্তিগত জীবনে অসুবিধা হচ্ছে। মোহ কারো অসুবিধার কারণ হতে চায় না। তাই আচমকাই সে মনে মনে একটা কিছুর কামনা করে বসে। এই কামনা কিংবা চাওয়া তার খুবই একান্ত আবদার সৃষ্টিকর্তার প্রতি। খুবই একান্ত।

__________

মননের রাগের বশে তার দাদু এবং আব্বুর সাথে করে ফেলা ব্যবহারটা নিয়ে তাদের সঙ্গে মিটমাট হয়ে গিয়েছে পরের দিন সকালেই। যদি কিছু অমীমাংসিত থেকে যায়, তাহলে সেটা হলো মোহ।

মোহকে ঘিরে মননের সবকিছুই কেমন যেনো অমীমাংসিত! কোনো কূল কিনারা খুঁজে পায় না সে। সেদিন বিকালে দেখা মোহর মুখটা হুটহাটই তার সামনে ভেসে উঠে। ওই তারার মতো জ্বলজ্বল করা মেয়েটার মুখখানি আঁধারে নিভে যাওয়ার দৃশ্যটা মননকে তাড়া করে। অবশ হয়ে আসে মস্তিষ্ক এবং চিত্ত।

অনুভব করে খুব বড়ো একটা ভুল করে ফেলেছে সে। তার জন্য হয়তো মেয়েটার মন খারাপ হয়েছে। সেই মন খারাপের দায় সম্পূর্ণটাই মননের। পর মুহুর্তেই তার মনে হয়, সে অতিরিক্ত ভাবছে। মোহর জীবনে সে বিশেষ কেউ নয় যার কারণে মোহ দীর্ঘক্ষণ মন খারাপ দিবস পালন করবে।

কেবিনের টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতে মোহকে ঘিরে মননের ভাবনা গুলো তার মন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকলো। দ্বিধা, দ্বন্দ্ব আর মন ও মস্তিষ্কের মাঝে চলা যুদ্ধ নিয়ে মনন আর মোহমুখী হলো না। হয়তো বা আর হবেও না। ঝিম ধরা রবে কেটে যায় চার চারটা দিন। মনন ব্যস্ত হয়ে পরে নিজের কর্মজীবন নিয়ে পুরোপুরি। মোহর অবস্থা রয় অজানা। খুব আকস্মিকভাবে দেখা হওয়া মানুষ দুটোর পথ আলাদা হয়ে গেলো যেনো আরো আকস্মিকভাবে। আদৌ পথ আলাদা হয়েছে? কে জানে!

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে