অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৬.
জাদুর শহরের বিকাল বেলাটা সাজে ভিন্ন রূপে। পরিষ্কার নীল আকাশের বুকে উঁড়ে বেড়াচ্ছে পেজা পেজা মেঘ। রাস্তায় সারি সারি গাড়ি আটকে আছে জ্যামে। ঢাকা শহরের খুব পরিচিত একটা দৃশ্য এটা। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজের ফোনে সেসব দৃশ্যই ভিডিও করছিলো মোহ। ঘুরে ঘুরে চারিদিকটা রেকর্ড করতে করতে আচমকা দরজার দিকে ফোনটা ফেরাতেই সে থেমে যায়। ক্যামেরা থেকে চোখ তুলে তাকায় সরাসরি সামনে। মননের পানে।
মোহ ফোনটা অফ করে রেখে হেসে বলে,
“ এতো তাড়াতাড়ি এসে পরেছেন! আমি ভেবেছিলাম অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। “
মনন এগিয়ে এসে মোহর হাতে বোতলটা ধরিয়ে দিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। অতি উঁচু দালানের ছাদে দাঁড়িয়ে শহরটা দেখতে দেখতে শুধায়,
“ আজকে কি ওপিডি ছিল আপনার? “
মোহ বোতল থেকে ঢকঢক করে কিছুটা পানি পান করে নিয়ে জবাব দেয়,
“ রুটিন চেকাপ টেস্ট আর ওপিডি এসব ছিল। ডক্টর দেখিয়ে সোজা এডমিট হয়ে গেলাম। আগামীকাল থেকে আবার কেমো শুরু হবে। তেরো তলায় কেবিন পেয়েছি। আগামী পাঁচ দিন হসপিটালে আমার দেখা পাবেন আপনি। “
মন মস্তিষ্কের টানাপোড়নে ডুব দেওয়া মনন প্রতুত্তর করে না। জানতে চায় না মোহ কেন প্রয়োজন অপ্রোয়জনে তার সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতে চায়। মননকে ভাবনায় বিভোর দেখে মোহ প্রশ্ন করে বসে,
“ কি হয়েছে? কার কথা ভাবছেন? এই আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে? আচ্ছা ওয়েট। আপনার বলতে হবে না। আমি গেস করছি… “
মোহর কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মনন সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার আপনার ম্যাটার অফ কনসার্ন হওয়ার কথা নয় মোহ। “
মোহ আচমকা থেমে যায়। দেখে মননের শক্ত মুখটা। ব্যাপারটাকে খুব একটা গরু গম্ভীর কিছু না ভেবে ফের হেসে বলে,
“ এই! আপনি কি রেগে আছেন? গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া হয়েছে? “
মনন এবার আরো দৃঢ় গলায় চোখ মুখ শক্ত করে বলে,
“ দ্যাট ইজ নট ইউর বিজনেস মোহ। আপনি প্লিজ বারবার আমার ব্যক্তিগত লাইফ নিয়ে কথা বলাটা বন্ধ করুন। ব্যাপারটা আমাকে খুবই অস্বস্তি ফিল করাচ্ছে। আপনার সঙ্গে আমার সেরকম কোনো সম্পর্ক নেই যেটার বেসিসে আপনি আমাকে যখন তখন কল দিয়ে দেখা করতে চাইতে পারেন। ইউ শুড একনলেজ দ্যা বাউন্ডারিস। “
মোহকে নীরব দেখালো। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মননের দিকে। পর মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর গলায় বলে,
“ সরি। “
এতটুকু বলেই মোহ দ্রুত প্রস্থানের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েও থেমে যায়। শিহানের ওয়ালেট থেকে না দেখেই একটা নোট বের করে তা মননের এপ্রোনের বুকপকেটে গুজে দিয়ে বলে,
“ পানির বোতল নিয়ে আসার জন্য থ্যাঙ্কিউ। “
মোহ প্রস্থান করতেই মননের মুখভঙ্গি ধীরে ধীরে নমনীয় হয়ে আসে। দু-হাত দ্বারা রেলিঙে ভর দিয়ে বেশ অনেকক্ষণ চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে সে। নিজের প্রতি বিরক্ত সে। এইমাত্র সে মোহর সঙ্গে রুড বিহেভ করেছে। ব্যাপারটা উপলব্ধি করতেই সে নিজের প্রতি আরো বিরক্ত হয়।
ওই মেয়ের কি দোষ? দোষ হচ্ছে সব মননের। ছাদে আসার পর সে ইচ্ছে করেই মোহর দিকে তেমন একটা তাকায় নি। নিজের দৃষ্টিকে অন্য সকল বিষয় বস্তুর উপর স্থির করতে চাইছিলো সে। কিন্তু লাভ হয় নি। আড়ালে আবডালে দৃষ্টি ঘুরেফিরে ওই চঞ্চল মুখপানে গিয়েই ঠেকছিল তার। দেখছিলো কেমোর প্রভাবে মূর্ছে যাওয়া মুখশ্রীতে লেপ্টে থাকা হাস্যজ্বল ভাবটা। দেখছিলো ঘন চোখের পাপড়ি গুলো কেমন হালকা হয়ে এসেছে। দেখছিলো চঞ্চলতাকে ছাপিয়ে চেহারায় লুকিয়ে থাকা নিষ্পাপ ভাবটা।
এতকিছু লক্ষ্য করার সময় আচমকাই মননের মনে হচ্ছিলো সে চুরি করে একটা মানুষকে দেখছে। ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তি এবং লজ্জাজনক। মোহ আর এক মুহুর্ত তার সামনে থাকলে হয়তো তার এই চুরি করে দেখাটা ধরা পরে যাবে। হয়তো হুট করেই মোহ চোখ রাঙিয়ে বলে বসবে,
“ এই মরণ! আপনি হ্যাবলা কান্তের মতো চার চোখ নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন কেনো? আপনাকে একদম ছ্যাচড়া মনে হচ্ছে। “
মনন তখন কি জবাব দিতো? কেন দেখছে সে? উত্তর তো মননেরও জানা নেই। সারাদিনের কাজের চাপ, ক্ষুধা এবং মস্তিষ্কের টানাপোড়নে মনন হঠাৎই অসহায় বোধ করে। ঘুমালে বোধহয় কিছুটা আরাম পাবে সে। কিন্তু সে-ই সুযোগ মিলে না আর। এর পূর্বেই তার ফোন বেজে উঠে। সিনিয়রের জরুরি ডাক পরে। সিনিয়রের ডাক এড়ানো সম্ভব নয় মননের পক্ষে। তাই অগ্যতা তার ঘুমানোর ইচ্ছেকে বালি চাপা দিতেই হয়।
__________
ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একটু পরপরই মেয়েকে আড়চোখে পরখ করছে শিহান। ক্যান্টিন থেকে ফেরার পর থেকেই কেমন অন্যরকম লাগছে মোহকে। এক জায়গায় পাঁচ মিনিটও স্থির থাকতে না চাওয়া মেয়ে কি-না মাথা পর্যন্ত চাদর টেনে গত দুই ঘন্টা ধরে শুয়ে আছে।
কিছু কি হয়েছে? নাকি শরীর খারাপ লাগছে মোহর? শিহান বুঝতে পারে না। মেয়ের নীরবতার পিছনে কারণটা শরীর খারাপ লাগা কি-না তা নিশ্চিত হতে হলে তাকে মোহর সঙ্গে কথা বলতে হবে। কিন্তু শিহান চাইলেও সহজ হতে পারছে না তেমন একটা। কোথাও একটা জড়তা রয়ে গিয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ দ্বিধায় কাটিয়ে শিহান ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে গিয়ে মোহর বেডের পাশে থামে। ছোট করে ডাকে,
“ মোহ? “
উত্তর না পেয়ে শিহান ধরে নেয় হয়তো মোহ ঘুমাচ্ছে। তাই মুখের উপর থেকে চাদরটা সরিয়ে দিতে নেয়। কিন্তু চাদর সরাতে নিলেই মোহ চাদর খামচে ধরে রাখে শক্ত করে। অর্থাৎ সে সরাতে দিবে না। শিহান অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,
“ কি হয়েছে? “
“ কিছু না। আমি একা থাকবো। একা থাকতে দাও একটু। “
শিহান টের পায় মেয়ের ভাঙা গলা। কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে কান্না করছে। শিহান কিছুটা চিন্তিত হয়ে পরে। কান্না কেন করছে? বেশি খারাপ লাগছে নাকি? আবারও কি পা ব্যথা হচ্ছে? শিহান আবারও মুখ থেকে চাদর সরানোর চেষ্টা করে বলে উঠে,
“ শরীর খারাপ লাগছে তোমার? ব্যথা হচ্ছে? ডক্টর ডাকবো? “
মোহ আরও শক্ত করে চাদর ধরে রেখে চেচিয়ে উঠে,
“ আমি একা থাকবো। একা মানে একা। বিরক্ত করব না কেউ আমাকে। চলে যাও। আর তুমি না গেলে আমি চলে যাবো। “
রাগে ফেটে পরে মোহ। শিহান স্থির ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অত:পর নীরবে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। ফোন বের করে মায়াকে একটা কল দিয়ে হসপিটালে আসতে বলে। হয়তো মায়া মোহকে বুঝবে, সামলাতে পারবে। শিহান হুট করেই হতাশ হয় নিজের প্রতি। কি জঘন্য পিতা সে! বিজনেসের আগাগোড়া বুঝতে পারলেও নিজের মেয়ের সমস্যাটা কোথায় সেটাই সে বুঝতে পারছে না। বিথী থাকলে হয়তো সবটা সহজ হতো তার জন্য।
__________
সদ্য ঘরে ফিরেছে মনন। আজকের দিনটা যেনো খুব দীর্ঘ ছিল। শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছিলো না। বাসায় ফেরার পথেও জ্যামে বসে থাকতে হয়েছে প্রায় ঘন্টা খানেক। মনে হচ্ছে এক্ষুণি মাথা ব্যথায় ফেটে যাবে। চশমার আড়ালে চোখ দুটোও লাল হয়ে গিয়েছে নির্ঘুম থাকায়।
আলী আকবর সাহেব সন্ধ্যা বেলায়ই হসপিটাল থেকে ফিরেছে। আরিফ কায়সারও কর্মস্থল থেকে ফিরেছে বেশ অনেকক্ষণ আগে। দু’জনে মিলে অসময়ে চা পান করতে ব্যস্ত ছিলো। মননকে প্রবেশ করতে দেখে আরিফ সাহেব ডাকেন,
“ মনন? ফ্রেশ হয়ে এসে চা খাবে? বসাবো আমি? “
“ না আব্বু। “
বলেই মনন চলে যেতে নেয়। আলী আকবর সাহেব সে-ই মুহুর্তে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে উঠে,
“ তোমার টেবিলের উপর একটা ফাইল রাখা আছে। সে-ই ফাইলে পাঁচটা মেয়ের ছবি এবং সিভি আছে। সময় করে দেখে নিও। যেটা পছন্দ হবে জানিয়ে দিও। তাহলে কথা আগাবো আমি। “
মননের সারাদিনের জমে থাকা ক্লান্তি, চাপ, মাথাব্যথা রাগ হয়ে প্রকাশ পায়। সে চেঁচিয়ে উঠে,
“ সমস্যা কি তোমাদের সবার? সবাই মিলে আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এতো মাথা ঘামাচ্ছো কেন? কোথাও কি একটু শান্তি পাবো না আমি? চব্বিশ ঘণ্টা কানের কাছে বিয়ে, বিয়ে শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। ফর গড সেক তোমরা থামো। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। নিজেদের একাকিত্ব আর এক্সপেকটেশন এর বোঝা আমার উপর চাপানো বন্ধ করো। তোমাদের এই পারফেক্ট ফ্যামিলি এলবাম কম্পলিট করা বাদেও আমার লাইফে অনেক কাজ আছে। আমার অসহ্যকর লাগছে রোজ রোজ তোমাদের এই একই আলাপ… “
রাগে ফেটে পরে এতদূর বলতেই মনন থেমে যায়। হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে আসে সে। কাধ থেকে ব্যাগটা ফেলে এসি ছেড়ে দেয়। পুরো দুনিয়াটা তার অসহ্যকর লাগছে। কি হচ্ছে তার? সবাই তাকে বুঝতে অক্ষম নাকি সে নিজেই নিজেকে বুঝে উঠতে পারছে না? মননের কিচ্ছু জানা নেই। টেবিলের উপর চোখ পড়তেই সে দেখে ফাইলটা। মনের আক্রোশ মেটাতে সেই ফাইলটা হাতে নিয়ে কাচি দিয়ে কুটি কুটি করে কাটতে শুরু করে সে। একবার খুলে দেখারও প্রয়োজন বোধ করে না। এই ফাইলটার কোনো গুরুত্ব নেই তার কাছে। না ফাইলের ভেতর থাকা ওই মেয়েগুলোর ছবি কিংবা সিভি। এসবই অত্যন্ত অপ্রয়োজনীয় জিনিস মননের কাছে।
কাটতে কাটতে ফাইলটার হাজারটা টুকরো করতেই যেনো মনন কিছুটা শান্ত হলো। পকেট থেকে ফোন, ওয়ালেট সব বের করে রাখার সময় একটা পাঁচশো টাকার নোটও বেরিয়ে আসে। মনন সে-ই নোটটা হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে পরে। বিকালে মোহর তার পকেটে গুজে দিয়ে যাওয়া নোট এটা। মনন বেশ কিছুক্ষণ নোটটার দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকাই মৃদু হাসে। ওই মেয়ের আই-কিউ লেভেল খুব বাজে। একটা বিশ টাকার পানির বোতলের বদলে পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। এই মেয়ে কখনো বাজার করতে গেলে তো এক কেজি আলু হাজার টাকায় কিনে নিয়ে আসবে।
ভাবতে ভাবতে মনন আরো একদফা হাসে। ফের আচমকাই তার হাসি মিলিয়ে যায়। বুক চিরে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস। পাঁচশো টাকার নোটটা ড্রয়ারে রেখে দেয় সে। রুমালে মোড়ানো মোহর চুলগুলোর সাথেই। অত:পর মনে করে এইমাত্র দাদু এবং আব্বুর সাথে করে আসা দুর্ব্যবহারের দৃশ্যটা। মননের হুট করেই নিজেকে অসহায় মনে হয়। একই দিনে সে তিনটা মানুষকে হার্ট করে ফেললো। আব্বু আর দাদুকে তাও না-হয় সে সরি বলে ব্যাপারটা মিটমাট করে নিবে। কিন্তু মোহ?
মনন আর ভাবতে পারে না। এই মানসিক টানাপোড়েনের কষ্টের ভার বইতে না পেরে একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেয়। বিরতি চাই তার একটু। ঘুম ছাড়া বিরতি পাওয়ার আর কোনো উপায় নেই। তাই দুনিয়ার থেকে সাময়িক বিরতি নিতে সে বেছে নেয় ঘুমকেই।
চলবে…