অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৫.
ঈদের পরদিন হওয়া সত্ত্বেও হসপিটালে পেশেন্টের সংখ্যা সামান্যতম কমে নি। অসুখ বিসুখ তো আর কোনো বিশেষ দিন মেনে চলে না। তাই তো ঈদের এই সময়টাতেও ডাক্তার এবং রোগীরা চিকিৎসা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে ব্যস্ত।
পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্টের সবথেকে সিনিয়র হেমাটোলজি অনকোলজিস্ট হলেন প্রফেসর মোহাম্মদ হায়াত। আজকে উনার ছুটিতে থাকার কথা থাকলেও আচমকা ইমারজেন্সি একটা কেসের কারণে উনার হসপিটালে আসতে হয়েছে। বয়স্ক হলেও ভদ্রলোকের হাঁটার গতি খুবই দ্রুত। উনার পায়ের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাশে হাঁটছেন আরো তিনজন ডক্টর। এদের মধ্যে সবথেকে জুনিয়র হলো ডক্টর ওয়াসিফ কায়সার মনন।
হাতে থাকা একজন পেশেন্টের রিপোর্ট হতে তার কেস নিয়ে সার্বিক তথ্য জানাতে জানাতে সিনিয়রদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটছিল মনন। বোন এন্ড সফট টিস্যু ডিপার্টমেন্টের ওপিডি এরিয়া ক্রস করার সময় আচানকই তার চোখ পড়ে একটা বেঞ্চির দিকে। বেখেয়াল বশত চোখ ফিরিয়ে নিলেও সঙ্গে সঙ্গে সে আবার ঘুরে তাকায়। দেখে মোহকে। সঙ্গে বসে আছে একজন ভদ্রলোক। বয়স দেখে অনুমান করা যাচ্ছে লোকটা সম্ভবত সম্পর্কে মোহর বাবা হন।
মোহকে দেখার সময়টা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সিনিয়রের ডাকে মনন চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে।
__________
ঈদের পরদিন উপলক্ষে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে শুভ্রর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে মায়া। গায়ে জড়ানো বাবার কিনে দেওয়া নীল চুরিদার। একই রকম দেখতে লাল রঙের একটা চুরিদার বাবা মোহর জন্যও নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু মোহকে জোর করেও সেটা পরানো সম্ভব হয় নি। ঈদের দিনটা ঘরের পোশাক পরে, নিজের রুমে বন্দী থেকেই কাটিয়ে দিয়েছে মেয়েটা।
মায়া বুঝতে পারে মোহ নিজের বাহ্যিক রূপটাকে নিয়ে ইদানীং খুব হীনমন্যতায় ভুগে। বিশেষ করে চুল কেটে ফেলার পর থেকে। কিন্তু এই ব্যাপারটা তো ক্ষণস্থায়ী তাই না? মোহ সুস্থ হয়ে গেলেই তো আবার আগের রূপ ফিরে পাবে। চুল বড়ো হয়ে যাবে, গায়ের রঙটা ফিরে আসবে, মুখের লাবণ্যও আবার লক্ষণীয় হবে। ক’টা মাস কিংবা বছরেরই তো ব্যাপার!
কলেজ পড়ুয়া শুভ্রকে দেখা গেলো পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায়। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মায়ার জন্যই অপেক্ষা করছিল। দূর হতে শুভ্রকে দেখতেই মায়া রিকশা থামিয়ে, ভাড়া মিটিয়ে নেমে পরে। ফুটপাত ধরে এগিয়ে যায় শুভ্রর দিকে। দূর হতেই লক্ষ্য করে শুভ্রর গাল জুড়ে উঁকি দেওয়া ছোট ছোট দাঁড়িগুলোকে। মায়ার হাসি পায় খুব।
শুভ্রর মাথায় ইদানিং বড়ো সাজার ভূত চেপেছে খুব। একই বয়সী হওয়া সত্ত্বেও মায়ার মুখের আদলে ম্যাচিওর ভাবটা তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। কিন্তু শুভ্রকে সেই তুলনায় মায়ার পাশে বাচ্চা বাচ্চা মনে হয়। এই সামান্যতম পার্থক্য মিটিয়ে নিজেকে মায়ার পাশে মানানসই দেখানোর জন্যই শুভ্রর এতো প্রয়াস!
মায়াকে খেয়াল করতেই শুভ্র চওড়া হাসে। এগিয়ে গিয়ে বলে,
“ ঈদ মোবারক দোস্ত। সুন্দর লাগতেসে তো তোরে! একদম ঈদের চাঁদের মতো! “
মায়া লাজুক হেসে বলে,
“ আচ্ছা। “
শুভ্র ভ্রু কুচকে বলে,
“ কিন্তু সামথিং ইজ মিসিং। “
মায়া ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো কি? শুভ্র উত্তর দেয় না। আশেপাশে তাকিয়ে চোখ বুলায় টিএসসি প্রাঙ্গন জুড়ে। মায়ার হাত ধরে রাস্তা পাড় করে চলে যায় অপর পাশটায়। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনে নেয় একটা বেলী ফুলের গাজরা। নিজ হাতে গাজরাটা পড়িয়ে দেয় মায়ার ডান হাতে। কিছুদূর যেতেই দেখে রাস্তার পাশে একজন বৃদ্ধা কাঁচের চুরি বিক্রি করছে। সেখান থেকে শুভ্র নীল রঙের এক ডজন কাঁচের চুড়ি কিনে মায়ার বাম হাতে পড়িয়ে দেয়।
মায়া ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ আংকেলের টাকা উড়াচ্ছিস তুই? “
“ এহ! মোটেও না। এইসব টাকা আমি গতকাল সালামি পেয়েছি। টোটাল তিন হাজার সাতশো সামথিং আছে। আজকের ডেটের বাজেট এক হাজার। চলবে না? “
মায়া হেসে বলে,
“ চলবে মানে? দৌড়াবে। “
শুভ্র হেসে পকেট থেকে দুটো খাম বের করে মায়ার হাতে দিয়ে বলে,
“ এখন এইটা ব্যাগে রাখ। “
মায়া জানতে চায়,
“ খামে কি আছে? “
“ সালামি। লাল খামটা তোর। গোলাপিটা মোহর। ওকে দিয়ে দিবি। “
“ আরে! আমি তো গতকাল মজা করে সালামি চাচ্ছিলাম। তুই সিরিয়াসলি নিয়ে নিলি কেন! সালামি লাগবে না। চাকরি বাকরি যখন করবি তখন সালামি দিস। “
শুভ্র চোখ রাঙিয়ে বলে,
“ আপাতত চুপচাপ সালামি রাখ। চাকরি পাইলে তখন সালামি টালামি দিতে পারবো না। তখন তোর দেনমোহরের টাকা জমাবো। “
__________
সকাল থেকে বিভিন্ন টেস্ট করিয়ে, অত:পর ডক্টর দেখিয়ে, হসপিটালে ভর্তি হতে হতে প্রায় দুপুর হয়ে গিয়েছে মোহর। আপাতত সব টেস্টের রিপোর্ট ঠিক আছে। ডক্টর বলেছে আগামীকাল থেকে মোহর দ্বিতীয় সাইকেল কেমোটা শুরু করা যাবে। অবশ্য মোহর প্রত্যেকটা কেমোর সাইকেলই এমন ভাবে প্ল্যান করা হয়েছে। একুশ দিন পরপর প্রতি সাইকেল দিতে হবে। এই একুশ দিনের মাঝে মোহকে সকল নিয়ম মেনে নিজেকে যথাসম্ভব ফিট রাখতে হবে। কারণ কোনো একটা রিপোর্ট উপর নিচ হলেই তার কেমো পিছিয়ে যাবে।
এইবার মোহ যেই কেবিনটা পেয়েছে সেটা হলো তেরো তলায়। কেবিন নং এক তিন শূন্য সাত। মোহ কেবিনের বিশাল কাঁচের জানালাটা গলে বাইরের শহরটা দেখতে ব্যস্ত। তার অবশ্য কেবিনে মন টিকছে না। ইচ্ছে করছে একছুটে ছাদে গিয়ে বিকেলের শহরটা দেখতে। কিন্তু এই মুহুর্তে এইটা সম্ভব নয়। শিহান তার সাথেই রুমে উপস্থিত আছে।
মোহ সাথে সাথেই একটা ফন্দি আঁটে। নিজের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ ওহো! কেবিনে তো পানির বোতলই নেই। আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছে। “
শিহান সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“ আমি পানির বোতল নিয়ে আসছি গিয়ে। “
মোহ সাথে সাথে বাঁধ সাধে।
“ তুমি কেনো যাবে? তুমি না কাজ করছিলে? আমাকে টাকা দিয়ে দাও। আমি গিয়ে নিচের ক্যান্টিন থেকে পানির বোতল নিয়ে আসছি। আমি সব চিনি। “
শিহান কপাল কুচকে বলে,
“ কোনো প্রয়োজন নেই। আমি যাচ্ছি। “
মোহ মুখ লটকে বলে,
“ আগামীকাল সকাল থেকে কেমো শুরু হবে। তখন তো সারাদিন শুয়ে বসেই কাটাতে হবে আমার। কেমোর আগের দিন এইটুকু স্বাধীনতা কি আমি পেতে পারি না? আমি জানি আমার এখনো আঠারো হয় নি। কিন্তু নিজে গিয়ে একটু পানির বোতল কিনে আনবো এইটুকু স্বাধীনতা পেতেও কি আমার আরো একবছর অপেক্ষা করতে হবে? “
শিহান নীরবে মেয়ের মুখটা দেখে। চুপচাপ পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে মেয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ তাড়াতাড়ি আসবে। আর সাবধানে যাবে। মাস্ক পড়ে নাও। “
মোহর লটকে যাওয়া মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে প্রফুল্ল মনে দ্রুত মাস্ক পড়ে, ফোন আর ওয়ালেট হাতে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে শিহান মৃদু হাসে। মোহর মুখ লটকে কথা বলার ধরণ দেখে তার খুব হাসি পাচ্ছিলো এতক্ষণ। খুব কষ্টে সেই হাসি চেপে রেখেছিল। হাসতে হাসতে ল্যাপটপ নিয়ে বসতেই শিহানের আচমকা মনে হয়, তার মেয়ের নিজের বাবার কাছে চাহিদার গন্ডি খুবই সামান্য। একা একা পানির বোতল কিনতে যাওয়ার স্বাধীনতা বাদে আর কি কি চাহিদা আছে মোহর নিজের বাবার কাছে?
__________
দুপুরে ইমারজেন্সি একটা কেস সামলানোর চক্করে লাঞ্চ করার সুযোগ হয়ে উঠে নি মননের। কেবিনে ফিরতেই পেন্ডিং পেশেন্টদের দেখে সবেমাত্র ফ্রি হয়ে ক্যান্টিনে এসেছে সে। ক্ষুধায় বুক জ্বলছে একদম। মনন খাবার নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসতেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই স্ক্রিনে ভাসমান নাম দেখে অবাক হলো। রিসিভ করে ফোন কানে চেপে ধরতেই অপর পাশ হতে চঞ্চল স্বর শোনা গেলো,
“ এই ডক্টর! হসপিটালে আছেন? “
মনন অবাক হলেও বাধ্যর মতো উত্তর দিলো,
“ হু, আছি। “
“ ব্যস্ত আপনি? পেশেন্ট দেখছেন? হাতে সময় হবে? “
“ ব্যস্ত না। পেশেন্ট দেখা শেষ হলো সবে। আপাতত হাতে চল্লিশ মিনিট ফ্রি টাইম আছে। “
মোহ এক অদৃশ্য অধিকারবোধ নিয়ে বলে উঠে,
“ আচ্ছা। তাহলে ছাদে চলে আসুন এখুনি। আর শুনেন, আসার সময় একটা পানির বোতল নিয়ে আসবেন ক্যান্টিন থেকে। তাড়াতাড়ি আসবেন। অপেক্ষা করছি। “
কলটা কেটে যায়। মনন কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে তো কিছুক্ষণ টেবিলে থাকা খাবারের দিকে। এটা ঠিক যে তার ক্ষিধে পেয়েছে খুব। আবার এটাও ধ্রুব সত্য যে সে চাইলেই ওই মেয়েটাকে উপেক্ষা করতে পারছে না। মনন আশ্চর্য হয়। নিজের মনের প্রতি চরম আশ্চর্য সে। তার মন এই মুহুর্তে তাকে বলছে,
“ মোহ অপেক্ষা করছে মনন। তোর শিগগিরই যাওয়া উচিত। ওই মেয়েটাকে অপেক্ষা করিয়ে এই মুহুর্তে খাওয়া দাওয়া করাটা চরম অনুচিত কাজ হবে। একবেলা না খেলে তুই মরে টরে যাবি না। “
মনের জোরের সামনে মননের মর্জি খাটে না। সে নীরবে টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে একটা পানির বোতল কিনে নেয়। অত:পর পা বাড়ায় ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এই কাজটা মনন কেন করছে তার জানা নেই। তার কেবল মনে হচ্ছে প্রতিদিন অন্তত চার ঘন্টা সময় ধরে ঘুমানো যেমন তার জন্য জরুরী, একইভাবে মোহর এরকম হুটহাট প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজনীয় ডাকে সাড়া দেওয়াটাও খুব জরুরী।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]