অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৩.
এতদিন বাদে ঘরের মেয়ের হসপিটাল হতে ঘরে ফেরা উপলক্ষে শায়লা সকাল থেকে এলাহি কান্ড লাগিয়ে দিয়েছে। মোহর রুমটার প্রতিটা কোণা নিজ হাতে ঝেড়ে পরিষ্কার করেছে। স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণু মুক্ত করেছে প্রতিটা জিনিস। বিছানার চাদর, রুমের পর্দা, কার্পেট থেকে শুরু করে সব বদলেছে।
এসব কাজে উনাকে সাহায্য করেছে মায়াও। মোহ বাড়ি ফিরতে রাজি হয়েছে শোনার পর থেকে খুশিতে বাক-বাকুম হয়ে আছে তার মন। ঘরদোর গোছানো শেষে শায়লা আন্টির সাথে রান্নাঘরে বসে সব রান্না দেখতে ব্যস্ত সে। বারবার করে বলে দিচ্ছে, কোন খাবারটা মোহ খেতে পারবে। কোন খাবারে কতটুকু মশলা দেওয়া যাবে।
শিং মাছ ভুনা, লাল শাক ভাজি, অল্প মশলা দিয়ে দেশি কবুতরের বাচ্চা, ছোট চিংড়ি দিয়ে কলমি শাক রান্না শেষ করতে করতে দুপুর প্রায় দুটো বেজে গিয়েছে। বাড়ির আঙিনায় গাড়ির হর্ণের শব্দ শুনতেই মায়া দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বের হলো। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো মোহকে। তার পিছু পিছু ব্যাগ হাতে এগিয়ে আসছে শিহান।
মায়া এগোতে নিলেই শিহান কিছুটা রাগী গলায় তাকে সতর্ক করে,
“ মাত্র হসপিটাল থেকে ফিরেছে। গোসল করে আগে ফ্রেশ হতে দাও ওকে। আর ওকে জড়িয়ে ধরবে না ভুলেও। চাপ লেগে পোর্টে সমস্যা হলে? “
মায়া সাথে সাথে বাধ্য মেয়ের মতো পিছিয়ে যায়। সত্যি বলতে এক মুহুর্তের জন্য সে ভুলে গিয়েছিলো এভাবে মোহকে জড়িয়ে ধরাটা ঠিক হবে না। বুকে চাপ লেগে ব্যথা পেলে অসুবিধা হতে পারে। শায়লাও ততক্ষণে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে। মোহকে দেখে প্রফুল্ল গলায় বলে,
“ কতদিন পর বাসায় এসেছে আমার আম্মু! “
মোহ কিছুটা ক্লান্ত বিধায় তেমন একটা কথা বলছে না। কেবল ক্ষীণ হাসে। শিহান তাড়া দিয়ে বলে,
“ শায়লা আপা, ওষুধের সময় হয়ে গিয়েছে ওর। আগে তাড়াতাড়ি গোসল সেড়ে এসে খেয়ে নিক। খেয়ে রেস্ট করার পর ওর সাথে গল্প করবেন। “
শায়লা এবং মায়া আর মোহকে আটকায় না। মোহ সরাসরি উপরে নিজের রুমে চলে যায়। শিহানও তার পিছু পিছু আসে। ব্যাগটা রুমের এককোনায় রেখে সে তাকায় মোহর দিকে। মোহ তখন নিজের রুম দেখতে ব্যস্ত৷ কি পরিপাটি করে গোছানো! যদিও বেশিক্ষণ রুমের নকশা এরকম থাকবে না। কয়েক ঘন্টার মাঝেই মোহ এই রুমের চিত্র বদলে দিবে অগোছালো করে। তবুও নিজের রুমে এতদিন পর ফিরে তার ভালো লাগা কাজ করছে খুব।
শিহান ব্যাগ থেকে ওষুধের বক্স, মেডিক্যাল ফাইল সহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস বের করে দিতে দিতে বলে উঠে,
“ ব্যাগের কাপড়চোপড় ধরো না আর। ওগুলো ধুতে দেওয়া হবে সরাসরি। আর আমি পানি রেডি করে দিয়ে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি গোসল করে নিচে আসো। “
মোহ অবাক নয়নে দেখতে থাকে নিজের বাবাকে। শিহান একটা লিকুইড মেডিসিনের বোতল হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। মোহও পা টিপে টিপে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়ায়। দেখে কিভাবে তার বাবা ধৈর্য্য সহকারে দাঁড়িয়ে বালতিতে দুই কল ছেড়ে ঠান্ডা এবং গরম পানি ভরার অপেক্ষা করছে। বালতি পানি ভর্তি হতেই শিহান মেডিসিনের বোতল হতে ঢাকনায় মেপে দুই ঢাকনা সমান ওষুধ মেশায় সেই পানিতে। এই জিনিসটা মোহর কেমোথেরাপির ডক্টর সাজেস্ট করেছে। ইনফেকশনের দায় এবং জীবাণু এড়ানোর জন্য এই মেডিসিন পানিতে মিশিয়ে গোসল করাটা বেশ কার্যকরী। মোহ একটুও বাঁধা দেয় না। গত কয়েক দিন ধরে বাবার এসব নীরব যত্ন সে খুব উপভোগ করছে। মনে হচ্ছে জীবনে প্রথমবারের মতো সে বাবার স্নেহ পাচ্ছে। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগে মোহর, বাবার এই স্নেহটা পাওয়ার জন্য কি মোহর অসুস্থ হওয়া খুব জরুরী ছিলো?
__________
দুপুরের খাবার সেড়ে ওষুধপত্র খেয়ে রুমে ফিরে এসি ছেড়ে বিছানায় চিত পটাং হয়ে শুয়ে পরেছে মোহ। শুয়ে শুয়ে দেখছিলো নিজের রুমটা। ঠিক সেই মুহুর্তে রুমে প্রবেশ করে মায়া। ভেজা চুল দেখে বোঝা যাচ্ছে সে-ও কেবল গোসল করে এলো। মোহর পাশের বালিশটা দখল করে শুয়ে পড়ে সে বলে উঠে,
“ কাহিল লাগছে তোর? ঘুমাবি? “
“ হু। ঘুমাবো। বিরক্ত না করে এখন যা তো। “
মায়া অন্যদিকে পাশ ফিরে হাই তুলতে তুলতে বলে,
“ ঘুমালে ঘুমা। কে বিরক্ত করছে তোকে? আমার নিজেরও ঘুম পেয়েছে খুব। “
মোহ বুঝতে পারে মায়ার ফন্দি। এতদিন পরে তার বাড়ি ফেরা উপলক্ষে মায়া এখন সারাদিন চুইংগামের মতো তার সাথে চিপকে থাকবে। উপরে উপরে বিরক্তি প্রকাশ করলেও মনে মনে মোহ উপভোগ করে বিষয়টা।
এসির হাওয়ায় ঠান্ডা লাগছিলো বিধায় সে গায়ে কাথা টেনে নিতে উঠে বসে। পায়ের প্লাজুটা কিছুটা উপরে উঠে যাওয়ায় মোহর চোখ গিয়ে স্থির হয় নিজের পায়ের দিকে। টিউমারের জানান দিতে কিছুটা ফুলে ওঠা পায়ের জায়গাটা দেখতে এখনো একই রকম দেখাচ্ছে। ফোলা কিছুটা কমেছে বলে মনে হচ্ছে না মোহর। অবশ্য তার কেবল একটা সাইকেল সম্পন্ন হয়েছে কেমোর। টিউমারের আকৃতি ছোট হয়ে আসতে খুব সম্ভবত আরো চার কিংবা পাঁচটা সাইকেল সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন।
মোহ প্লাজু ঠিক করে পা ঢেকে ফেলে নিজের। কাথা টেনে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই তার মনে পরে যায় দু বছরের পুরনো একটি দিনের কথা। মোহ যখন কেবল ক্লাস টেনে। সন্ধ্যায় পড়তে বসেছিলো সে। আচমকা তার পায়ের হাঁটুর কিছুটা নিচে ব্যথা অনুভূত হয়। খুবই সূক্ষ্ণ এবং চিনচিনে সেই ব্যথা। মোহ প্রথমে সাময়িক ব্যথা ভেবে পাত্তা না দিলেও ধীরে ধীরে ব্যথার পরিমাণ এবং ভয়াবহতা বাড়তে শুরু করে। পুরোটা পায়ে বিষের মতো ছড়িয়ে পরতে শুরু করে সেই মরণ ব্যথা।
মোহ টেবিল ছেড়ে বিছানায় এসে শোয়। মনে মনে ভাবে হয়তো তার চঞ্চলতা, দৌড়ঝাঁপই এই ব্যথার আসল কারণ। তবে যখন ব্যথাটা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় তখন সে না পেরে চিৎকার করে কান্না করে উঠে। পাশের রুম থেকে ছুটে এসেছিলো মায়া। বোনকে বিছানায় কুকড়ে পরে কাঁদতে দেখে ভীত হয়ে পরেছিলো সে। দ্রুত দৌড়ে ডেকে এনেছিলো শায়লা আন্টিকে।
শায়লাও এসে মোহর অবস্থা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কল করে শিহানকে জানায় ব্যাপারটা। শিহান তখন শহরের বাহিরে একটা কাজে ব্যস্ত ছিলো। সবটা শুনে মেয়ের দস্যিপনাকে দায়ী করে বলেছিলো,
“ আরও আশকারা দিয়ে মাথায় তুলুন ওকে আপনারা। আমি সাইকেল কিনে দিতে রাজি ছিলাম না। আপনারা জোর করে বলেছিলেন বলে দিয়েছি। সাইকেল পাওয়ার পর থেকে দিন-রাত এলাকায় সাইকেলে চড়ে বেড়ায়। অতিরিক্ত সাইকেল চালানোর ফলে বোধহয় মাংস পেশিতে চাপ পড়েছে। ওকে কিছু খাইয়ে পেইনকিলার খাইয়ে দিন। ঠিক হয়ে যাবে। “
শিহানের রাগী গলায় বলা আদেশ মেনে শায়লা মোহকে জোর করে দুটো বিস্কুট খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলো সেদিন। তবে অমানবিক ব্যথাটা নিজের তান্ডব চালিয়ে যায় রাত প্রায় দুটো পর্যন্ত। মধ্যরাতে হয়তো ওষুধের প্রভাবে ব্যথার প্রকোপটা যখন কমে এসেছিলো তখন অশ্রুসিক্ত ক্লান্ত মোহ ঘুমিয়ে পরেছিলো।
তারপর? তারপর বেশ ক’দিন মোহ সম্পূর্ণ ঠিক ছিলো। আর কোনো অসুবিধা হয় নি। বাবার দায়ী করা সাইকেলটাকেও লম্বা সময় সে ছুঁয়ে দেখে নি। মনে মনে সকলেই ধরে নিয়েছিলো মাংস পেশিতে চাপের ফলেই সেই ব্যথার সূত্রপাত ঘটেছিল।
কিন্তু সেই ব্যথাটা আবার ফিরে আসে। মোহর তখন পরীক্ষা ছিলো। সে কি অসহনীয় ব্যথা! সারারাত না পড়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলো সে। কোনো প্রস্তুতি ছাড়া। পরীক্ষার হলেও দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করে মোটামুটি এন্সার করে বেরিয়ে আসে সে।
বাবা তাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। বিভিন্ন টেস্ট করেও ডক্টর কোনো সমস্যা খুঁজে পায় না। ভিটামিনের অভাবের উপর চাপিয়ে দেয় ব্যথাটাকে। কিছু ভিটামিন এর সাপ্লিমেন্ট এবং পেইন কিলার ধরিয়ে দেয় মোহকে। এরপর থেকে প্রায়ই এক দু মাস অন্তর অন্তর ব্যথাটা এসে উঁকি মারতো। যখন ব্যথা হতো মোহর মনে হতো এই ব্যথার থেকে ভয়ংকর ব্যথা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই। দুনিয়ার সকল যন্ত্রণাকে এই ব্যথার সামনে অতি নগন্য মনে হতো তার। তবে তখন মোহর কাছে একটা হাতিয়ার ছিলো। ডক্টরের সাজেস্ট করা পেইনকিলার। ব্যথা উঠলেই সে পেইন কিলার খেয়ে নিতো। পাঁচ ছয় ঘন্টা পর ওষুধটা ব্যথা দমাতে সক্ষম হতো।
এভাবেই চলছিলো মোহর দিনগুলো। এর মাঝে আরো বেশ কয়েকবার ভিন্ন ভিন্ন হসপিটালে ডক্টর দেখানো হয়। তবে কেউ-ই কোনো সমস্যা খুঁজে পায় না মোহর রিপোর্টে। অবশেষে আসে সেই দিন। মাস দুইয়েক আগের ঘটনা। একদিন গোসল করতে গিয়ে মোহ লক্ষ্য করে তার পায়ের একটা অংশে কিছুটা ফোলা দেখা যাচ্ছে। ঠিক সেই জায়গাটাতে যেখান থেকে তার ব্যথা শুরু হতো। মোহ হাতে ছুঁয়ে দেখলে অনুভব করে ভেতরে শক্ত কিছু একটা আছে।
সেদিন আর মোহর গোসল সম্পূর্ণ হয় না। সাবান পানি গায়েই জামা গায়ে জড়িয়ে দৌড়ে বের হয় ওয়াশরুম থেকে। শায়লা আন্টিকে ডেকে পা দেখিয়ে সব বলতেই শায়লা আন্টি বিস্ময়ের সাথে বলে উঠে,
“ টিউমারের মতো মনে হচ্ছে! “
সতেরো বছরের জীবনে প্রথম এই শব্দটার নাম শুনেছিলো সেদিন মোহ। অর্থ বুঝে নি। কারণ আগে কখনো এরকম কিছুর নাম সে শুনে নি। তবে এরপর টেস্ট করানোর মাধ্যমে সে টিউমার হতে ক্যান্সার পর্যন্ত যাত্রার সাথে পরিচিত হয়। দু’দিন আগ পর্যন্তও জ্বর, ঠান্ডা, এলার্জির বাহিরে অন্য কোনো রোগের নাম না জানা মেয়েটা মেডিক্যাল জগতের সবথেকে কঠিন একটা রোগের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। জানতে পারে এর খুটিনাটি ব্যাপার।
মোহ মাঝেমধ্যে খুব ভাবে। তার এই ভয়াবহ রোগটা কেনো হলো? কিছু একটা ভুল তো সে অবশ্যই করেছে, যেই কারণে এই রোগের সৃষ্টি। এই ব্যাপারে সে ডক্টরকেও প্রশ্ন করেছিলো। ডক্টরের জবাব, নিজের ঘাটাঘাটি এবং উপলব্ধি থেকে মোহ নিজের উত্তর খুঁজে পায়। ক্যান্সার হতে কোনো কারণ লাগে না। এতে কারো দোষ নেই, কারো অবহেলা নেই। যাদের ভাগ্যে এই মরণব্যাধি লেখা আছে তাদের হবেই। ভাগ্যের লিখন বদলানোর সাধ্য কারই বা আছে?
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]