অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১২.
সেকেন্ড ইয়ারের মিড টার্ম পরীক্ষার ঝামেলা চুকিয়ে মায়ার মুক্ত বাতাসে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু মায়ার মাঝে সেরকম কোনো ভাব লক্ষণীয় নয়। বরং সে বিষণ্ণ মনে নদীর ধারের নিরিবিলি একটা জায়গায় বাঁশের পাটাতনে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। গায়ে কলেজ ইউনিফর্ম দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে সে কলেজ থেকে বাসায় না গিয়ে সোজা এখানে এসেছে। নদীর মুক্ত বাতাসে গলার আইডি কার্ডটা উড়ে অনেকটা নিজ জায়গা থেকে সরে গিয়েছে। সেদিকে মায়ার খেয়াল নেই অবশ্য। সে আপন জগতে ডুবে আছে উদাসীন হয়ে।
আচমকা তড়িঘড়ি করে কেউ এসে তার পাশের জায়গাটা দখল করে বসতেই তার ধ্যান ভাঙে। কলেজ ইউনিফর্ম পরিহিত ঘর্মাক্ত যুবক তখন বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে,
“ সরি রে। ফাহিমরা আটকে ধরেছিল। কোনো মতে ওদের থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছি। পরীক্ষা কেমন হইসে তোর? এম সি কিউ সব ঠিকঠাক দাগাইতে পারসিস? “
মায়া উদাস গলাতেই জবাব দেয়,
“ হু। খারাপ হয় নি। এম সি কিউ হয়তো আঠারোটা হবে। বাকিগুলো শিওর না। “
শুভ্র সূক্ষ্ণ চোখে তাকায় মায়ার মুখের দিকে। মন খারাপের আবহাওয়াটা আঁচ করতে পেরে প্রশ্ন করে,
“ মোহকে মিস করতেসিস দোস্ত? “
মায়া যেনো এই প্রশ্রয়টুকুর অপেক্ষাতেই ছিলো। মন খারাপের পাতা খুলে বসে বলতে শুরু করে,
“ পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। ঈদ সামনে। রোজার ঈদের সময়ও তো ও সুস্থ ছিলো। অথচ এখন… ঈদের আমেজ পাচ্ছি না আমি। “
শুভ্র এবার মায়ার হাতের উপর এক হাত রেখে বলে,
“ এই ঈদটায় ও অসুস্থ বলে কি হয়েছে? পরের ঈদে দেখবি, ও একদম সুস্থ ঘুরে বেড়াচ্ছে। “
মায়া যেনো আশ্বস্ত হয় না এতে। বলতে থাকে,
“ ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে। ও দেখাচ্ছে না সেটা। কিন্তু আমি তো অন্ধ না, তাই না? “
শুভ্র এবার আরেকটু দৃঢ় করে মায়ার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
“ আমি জানি তো, তুই বুঝিস। সবাইকে বুঝিস তুই। আংকেলকে, মোহকে, আমাকে। তুই বুঝিস বলেই আমাদের তিনটা মানুষের জীবন এতটা সহজ। ইন শা আল্লাহ মোহ সুস্থ হয়ে যাবে। ওর সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু ডিল আছে ভুলে গিয়েছিস? আমাদের বিয়ের গেটে ওর শালিগত হক আদায় করা বাকি আছে আমার। আমাদের বাচ্চা কাচ্চা ওর কাছে রেখে আমাদের ওয়ার্ল্ড ট্যুরে যাওয়াও বাকি এখনো। এসব টু ডু লিস্ট পূরণ করার জন্য হলেও ওকে সুস্থ হতে হবে। তুই শুধু মোহকে মেন্টাল সাপোর্ট দে একটু। ওর সামনে ভেঙে পড়িস না। যখন মনে হবে ভেঙে যাচ্ছিস, তাড়াতাড়ি তখন আমার কাছে এসে পড়বি। সুপার গ্লু, ফেভিকল দিয়ে আবার জোড়া দিয়ে দিবো। “
শুভ্রর বলা বাক্যের শেষটুকু শুনে মায়া না চাইতেও হেসে ফেলে। সেই হাসি দেখে শুভ্রও হাসে। পকেট হতে একটা বাদামে ঠাসা ঠোঙ্গা বের করে মায়ার সামনে ধরে। মায়া হাসতে হাসতেই বাদাম নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শুভ্র নিশ্চুপ দেখে সে-ই দৃশ্যটা। সে জানে এই হাসি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। ক্ষানিক বাদেই মায়া আবার বিষণ্ণ হয়ে যাবে। যার আপনজন মরণব্যাধিতে ভুগছে তার হাসিখুশি থাকাটা অনেকটা অমাবস্যার চাঁদের মতো ব্যাপার।
__________
আজ সকাল থেকেই শিহান এবং মোহর মাঝে তুমুল তর্কাতর্কি চলছে। তর্কের বিষয়বস্তু হলো মোহর বাড়ি ফেরা নিয়ে। শিহান চাইছে মোহকে বাড়ি নিয়ে যেতে। তার কাছে মোহর হসপিটালে থাকার জেদটা অহেতুক মনে হচ্ছে। ডক্টরের সঙ্গেও এই বিষয়ে শিহান কথা বলেছে। ডক্টরও বলেছে হসপিটালে এডমিট থাকার কোনো প্রয়োজন নেই মোহর। সে চাইলে বাসা থেকে আসা যাওয়া করেই ডক্টর দেখানো, টেস্টের কাজ গুলো সম্পন্ন করতে পারে। আর প্রত্যেক মাসের কেমোর সময়টাতে না-হয় ৫ দিন ভর্তি থাকলো।
কিন্তু মোহ মোটেও রাজি হচ্ছে না। তার একটাই কথা সে বাসায় ফিরবে না। শিহান স্বভাবসলুভ বিরক্তি নিয়ে বলে,
“ সামনের সপ্তাহে ঈদ। ঈদের দিন কি তুমি হসপিটালে থাকতে চাইছো? ঈদের আমেজটা নষ্ট করতে চাইছো? “
মোহ কিছুটা বিক্ষিপ্ত স্বরে বলে,
“ জোর করছো কেনো তুমি? তুমি বুঝতে পারছো না আমি কেনো বাসায় যেতে চাই না? আমি অযথা তোমাদের ঘাড়ে ঝামেলা হতে চাচ্ছি না। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও না কেনো? তোমাদের সবার এই চব্বিশ ঘণ্টা বেবি সিটিং করাটা আমার একটুও পছন্দ হচ্ছে না। “
মোহ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। জোরে কথা গুলো বলে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। দু একদিন ধরে অল্প কথাতেই রেগে যাচ্ছে সে। মেজাজ খুব খিটমিটে থাকে। হাই ডোজের কেমো এবং মেডিসিনের প্রভাব। শিহান তা বুঝতে পারে। মোহকে উত্তেজিত হতে দেখে বহুকষ্টে নিজেকে শান্ত করে।
এই মুহুর্তে তার শান্ত থাকতে হবে। ঠান্ডা মাথায় মেয়েকে সামলাতে হবে। মোহর এভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়াটা ঠিক নয়। তার হার্টের অবস্থা বর্তমানে খুব নাজুক। উত্তেজনার ফলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
শিহান নিজের জড়তা, রাগ, শাসন সব একপাশে রেখে মেয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে মোহর পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় শান্ত করার জন্য। মোহ সময় নেয়। ধাতস্থ হয়। ঠান্ডা হতেই ফের বলে,
“ আমি হসপিটালেই থাকবো। “
শিহান এবার গলার স্বর স্বাভাবিক করে বলে,
“ বাবা হিসেবে কখনো কিছু চাই নি। প্রথমবার চাইছি। ঈদের দিনটা আমি আমার পুরো পরিবারকে একসঙ্গে বাসায় চাই। সকালে নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে দুই মেয়েকেই একসঙ্গে দেখতে চাই। আশা করছি আমার চাওয়াটা রাখবে। “
মোহর চোখ থেকে জেদ উবে যায়। অদ্ভুৎ দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। শিহান অবশ্য অপেক্ষা করে না। চুপচাপ কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় মোহকে ভাবার সময় দিতে। তার যা করণীয় ছিলো সে তা করে ফেলেছে। তার বিশ্বাস মোহ নরম হবে। মুখে মুখে যতই জেদ দেখাক, মনের দিক দিয়ে তো তার মেয়ে নরম। শিহান জানে তা।
__________
রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মেঘে ঢাকা অন্ধকার আকাশটা দেখছে মোহ। বহুকষ্টে বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এখানে এসেছে সে। বাবাকে বলে কয়ে সুপারশপে পাঠিয়েছে জিনিসপাতির লম্বা লিস্ট সহ। সেসব কিনে শিহানের ফিরতে আধ ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা সময় লাগবে। এর আগে ওই ডক্টর আসবে তো?
মোহর অবশ্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মননকে দেখা গেলো দরজা দিয়ে ছাদে প্রবেশ করতে। গায়ে হসপিটালের অন ডিউটি পোশাক জড়ানো। মনন দূর হতে এগিয়ে আসতে আসতে মোহকে লক্ষ্য করে। আচমকা তার মনে হয় একটা বিষন্ন রাজকুমারী রাতের আঁধারে ওই দূরটায় দাঁড়িয়ে আছে। মননের অপেক্ষায়। মনন বোধ করে অদৃশ্য কিছু একটা সে অনুভব করছে।
মনন কাছাকাছি আসতেই মোহ হেসে বলে,
“ আরে! লং টাইম নো সি। “
মনন দূরত্ব রেখে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে,
“ কাল রাতেই তো দেখা হলো। “
“ সেটাতো অলমোস্ট চব্বিশ ঘণ্টা আগের ঘটনা। “
মনন আড়চোখে লক্ষ্য করে প্রশ্ন ছুড়ে,
“ শরীর কেমন? “
“ আপনার সামনে যেহেতু জিন্দা দাঁড়িয়ে আছি তারমানে একদম ফিট এন্ড ফাইন। “
“ দাঁড়িয়ে আছেন কতক্ষণ ধরে? “
“ পনেরো মিনিট হবে হয়তো। “
“ পায়ে ব্যথা করছে না? “
মোহ এবার ভ্রু কুচকে মননের দিকে তাকায়। মনন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মোহ আরেক কদম এগিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে মননকে দেখতে থাকে। অস্বস্তিতে কাট হয়ে মনন প্রশ্ন করে,
“ কি? “
“ আপনার কি আমার জন্য চিন্তা হচ্ছে? “
মনন অবাক হয়। পরমুহূর্তে দ্রুত উত্তর দেয়,
“ এজ এ হিউম্যান এন্ড ডক্টর। এর থেকে বেশি কিছু না। অন্য কিছু ভাববেন না। “
মোহ ভেংচি কেটে বলে,
“ অন্য কিছু ভাবিও নি আমি। আপনি অন্য কিছু ভাবার মতো ম্যাটেরিয়াল না। আপনি অনেকটা আংকেল টাইপ ম্যাটেরিয়াল। বাচ্চাদের আংকেল টাইপ, ইউ নো! “
মনন বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তাকায়। এসব কি হচ্ছে? এতদিন দাদু তার ইজ্জত নিলামে তুলতো, আর এখন এই মেয়েটা তার ইজ্জতের পাকোড়া ভাজছে। মননের রাগ উঠে খুব। বিরক্ত হয় সে। কিন্তু তা প্রকাশ করে না। তার প্রকাশিত রাগ কখনো দাদুর উপর তেমন একটা প্রভাব ফেলে নি। এই মেয়েটার উপরও ফেলবে না। তাই রাগ করাটা অহেতুক হবে।
মোহ আচমকা প্রবল আগ্রহ নিয়ে মননের দিকে এগিয়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই তার ঘাড়ে ঝুলানো বস্তুটা একটানে নিজের হাতে নিয়ে প্রফুল্ল গলায় বলে,
“ ওয়াও! টোটোস্কোপ! “
আকস্মিক ঘটনায় মনন যতটা না অবাক হয়, তার থেকে বেশি অবাক হয় মোহর ভুল উচ্চারণ শুনে। সঠিক করে দিয়ে বলে,
“ টোটোস্কোপ আবার কি জিনিস? স্টেথোস্কোপ হবে। আগে কখনো দেখেন নি? “
“ দেখেছি বহুবার। কিন্তু কখনো হাতে নেওয়ার সাহস পাই নি। এখন সুযোগ পাওয়ায় মনের অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করে নিলাম। আপনার টোটোস্কোপ কি কিউট! আপনারা এইটা কানে লাগিয়ে কি শুনেন বাই দ্যা ওয়ে? আদৌ কিছু শোনা যায়? “
বলতে বলতে মোহ আগ্রহ নিয়ে স্টেথোস্কোপ কানে লাগিয়ে নিজের বুকের বাম পাশে তা চেপে ধরতে নেয়। কিন্তু সাথে সাথে তার মনে পরে বুকের ভেতরে থাকা পোর্টের কথা। ভুলভাল কিছু যদি সে করে বসে? তাই মোহ সেটা আর নিজের বুকে চেপে না ধরে সাদা এপ্রোনের উপর দিয়ে মননের বুকের বাম পাশে ধরে।
মোহ আগ্রহ, মনযোগ দিয়ে শুনছে প্রতিটা স্পন্দন। ঢিপঢিপ, ঢিপঢিপ, ঢিপঢিপ। প্রতিটা স্পন্দন তাকে আরো কৌতূহলী করে তুলছে। মজা পাচ্ছে সে। কি স্পষ্ট পরিষ্কার একটা মানুষের হৃৎস্পন্দনের ধ্বনি তার কানে বাজছে! যেই লোকটা সবার হৃৎস্পন্দনের গতি মেপে থাকে তার হৃৎস্পন্দনের গতিবিধি মোহ মাপছে। কি অদ্ভুৎ চমৎকার ব্যাপার!
প্রবল আগ্রহে ভেসে যাওয়া মোহ তাকালো না, খেয়াল করলো না ডক্টরের সঙ্গিন পরিস্থিতি। অদ্ভুৎ কারণে হাসফাস করছে মনন। নিঃশ্বাস যেনো গলার কাছে আটকে আছে। এই মেয়েটা নির্বোধ হতে পারে। কিন্তু মনন তো নয়। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এক কদম পিছিয়ে যায়। মোহ হেসে কান থেকে স্টেথোস্কোপ খুলে নিজের গলায় ঝুলিয়ে বলে,
“ শুনলাম। অবস্থা তো ভালো না আপনার। বুকের ভেতর বেবি শার্ক গান বাজছে। “
বলেই মোহ হাসিতে ফেটে পড়ে। হাসতে হাসতে তার চোখের কোণে পানি জমে যায়। মনন কিছু বলে না। নীরব থেকে অজান্তেই মোহকে প্রশ্রয় দিচ্ছে সে। মোহ হাসি থামিয়ে বলে,
“ এই! আপনার এপ্রোণ পাঁচ মিনিটের জন্য ধার দেওয়া যাবে? জাস্ট ফাইভ মিনিটের জন্য। “
মনন কপাল কুচকে প্রশ্ন করে,
“ মতলব কি আপনার? “
“ আরে দেন না। “
মনন মিনিট খানেক মোহকে দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে নিজের এপ্রোনটা খুলে এগিয়ে দিতেই মোহ তা লুফে নিয়ে গাউনের উপর দিয়ে গায়ে জড়িয়ে নেয়। অত:পর কিছু না বলেই মননের চশমাটা একটানে নিয়ে চোখে পড়ে ডক্টরদের মতো গলা কিছুটা ভার করে বলতে শুরু করে,
“ এক্সকিউজ মি। শুনুন, আপনার উচিত নিঃশ্বাস না নেওয়া। আপনার কোনো ধারণা আছে আপনি যেই অক্সিজেন গ্রহণ করছেন সেইটা কতটা পলিউটেড? “
মনন মোহকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে নিজের চশমাটা কেড়ে নিয়ে চোখে পড়তে পড়তে বলে,
“ এইটায় পাওয়ার আছে। “
মোহ ফের হেসে বলে,
“ আপনার পাওয়ারওয়ালা চশমা আপনাকে মোবারক। বাই দ্যা ওয়ে একটা সত্যি কথা বলি? এই চশমায় না আপনাকে একদম নোবিতা টাইপ লাগে। একদম নার্ড। “
মনন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মেয়ের কাছে তাকে একটা স্বাভাবিক মানুষ বাদে সবই মনে হয়, সেটা মননের বুঝা হয়ে গিয়েছে। মোহ এবার হাসি থামিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার আসলেই পা ব্যথা করছিলো কিছুটা। তাই কিছু না ভেবে রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। মনন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
“ করছেন কি? “
“ পা ব্যথা করছে। “
মনন নিজেও এবার দূরত্ব রেখে রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে। মোহর বসার ধরন দেখে বলে,
“ পা এভাবে সোজা করে রেখে বসবেন না। মেঝে শক্ত। টিউমারটাও হাড়ের পেছন অংশে। চাপ লাগবে। বসার গেসচার বদলান। “
মোহ মননের কথা শুনে। পা ভেঙে এবার দ আকৃতিতে বসে সে। মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ আমি আগামীকাল বাসায় ফিরে যাবো। “
মনন অবাক হয় কিছুটা। তবে স্বাভাবিক গলায় বলে,
“ বাহ। ভালো তো। অনেকদিন ধরে হসপিটালে আছেন। বাসার এনভায়রনমেন্টটা মিস করছিলেন অবশ্যই। “
মোহ বলে,
“ ঈদ সামনে। বাবা চাচ্ছিলো ঈদটা সবাই একসাথে বাসায় উদযাপন করি। ইউ নো? বাবা এই প্রথমবার কিছু চেয়েছে আমার কাছে। ফেরাতে পারি নি। “
“ ভালো করেছেন। “
মোহ মন খারাপ করে বলে
“ কিন্তু ঈদের দিন সারাদিন বিফ রান্না চলবে বাসায়। আপনি জানেন আমি বিফের কতো বড়ো ফ্যান? ডাল গোস্ত তো আমার সবথেকে প্রিয়। চোখের সামনে সারাদিন বিফ দেখে নিজেকে কন্ট্রোল কিভাবে করবো? আই হেইট দিজ ডায়েট চার্ট। “
মননের খারাপ লাগে। তবুও বলে,
“ এইটা তো মানতেই হবে। শুধু ট্রিটমেন্ট চলাকালীন সময়ের জন্য না, ফুল লাইফ টাইমের জন্য। রেড মিট, সুগার এসব থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে আপনার এট এনি কোস্ট। কতটা ভয়ংকর ইফেক্ট ফেলতে পারে এগুলো আপনার উপর ধারণা আছে? বডির ভেতর ব্লু সেল ডেভেলপ করতে ভূমিকা রাখে এসব। “
মোহ আর কিছু বলবে তার পূর্বেই তার ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে তাকিয়ে বাবার নাম্বার দেখতেই সে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিয়ে বলে,
“ বাবা কল করছে। খুঁজছে হয়তো আমাকে। যেতে হবে এখন। “
বলেই মোহ উঠে দাঁড়ায়। মননও দাঁড়ায়। মোহ গায়ের এপ্রোনটা খোলার আগে নিজের ফোন বের করে ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে। হাসিমুখে নিজের একটা সেলফি তুলে নেয়। পাশে মননকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে উঠে,
“ একচুয়্যালি আমার ডক্টরের কস্টিউমে কোনো ছবি টবি নেই তো। তাই ছবি তুলে নিলাম। আপনিও তুলবেন? “
মনন সাথে সাথে মাথা নেড়ে বলে,
“ না। আমি ছবি তুলি না। পছন্দ না। “
মোহ এপ্রোনটা মননের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“ বুঝতে পেরেছি। নিজের আউটলুক নিয়ে ইনসিকিউরিটিসে ভুগেন আপনি। কিন্তু এতোটাও খারাপ না আপনি দেখতে। আই মিন একটু মদন টাইপ। কিন্তু চলে। “
মনন চোয়াল শক্ত করে বলে,
“ আমি কি একবারও বলেছি আমি নিজের ফেস নিয়ে ইনসিকিউরিটিসে ভুগি? “
মোহ পাত্তা দেয় না। বরং সরল গলায় বলে,
“ আপনার হাতটা এগিয়ে দিন তো। “
মনন ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
“ কেন? “
“ অতিরিক্ত প্রশ্ন করা কি আপনার ডক্টরগত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত? দিতে বলেছি দেন না। আমি আপনার হাত চুরি করবো না। “
মনন অজান্তেই নিজের ডান হাতটা এগিয়ে দেয়। এপ্রোনের বুকপকেটে থাকা কলমটা মোহর হাতে রয়ে গিয়েছিলো। সেটা দিয়ে মোহ দ্রুত মননের হাতের তালুতে একটা এগারো ডিজিটের নাম্বার লিখে ফেলে। অত:পর কলমটা মননের হাতে ধরিয়ে বলে,
“ ঈদের দিন পরিচিতদের শুভেচ্ছা জানানো একটা গুড ম্যানার্সের মধ্যে পরে। আমার বিশ্বাস আপনি অত্য ম্যানার্সপূর্ণ মানুষ। ঈদের দিন কসাইয়ের ডিউটি শেষে আমাকে ঈদ মোবারক জানাতে ভুলবেন না। ভয় পাবেন না। আমি সালামি চাইবো না আপনার থেকে। “
বলেই মোহ দ্রুত পায়ে হেঁটে মননের সামনে থেকে চলে যায়। মনন দেখে তা। বিস্ময়তা চিরে সতর্ক করতে পিছন থেকে ডাকে,
“ আস্তে হাঁটুন। হাঁপিয়ে যাবেন… “
মননের পুরো কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই মোহ ছাদের দরজা পেরিয়ে চলে যায়। মননের কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। সে একবার মোহর যাওয়ার পানে তাকায় তো আরেকবার নিজের হাতে লেখা নাম্বারের পানে। আচমকা কিছু মনে পড়তেই সে বলে উঠে,
“ আমার টোটোস্কোপ! “
মোহ মননের স্টেথোস্কোপ নিয়ে যাওয়ায় মনন যতটা না অবাক হয়েছে, তার থেকেও অবাক হয়ে যায় সে নিজে স্টেথোস্কোপকে টোটোস্কোপ উচ্চারণ করে। লক্ষ্মণ ভালো না। আজকে স্টেথোস্কোপকে টোটোস্কোপ বলে বসছে সে, আগামীকাল দেখা যাবে কাউকে নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় মননের জায়গায় মরণ কিংবা মদন বলে বসবে সে। মনন বিড়বিড়িয়ে বলে,
“ কারেক্ট ইউরসেল্ফ মনন।
কারেক্ট ইউরসেল্ফ… “
চলবে…