অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-১০

0
46

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১০.

রাত তখন আড়াইটা প্রায়। ক্লান্ত মনন সহকর্মীদের সঙ্গে হতাশ ভঙ্গিতে আই সি ইউ থেকে বেরিয়ে এলো মাত্র। প্রত্যেকের মুখের অবস্থা স্পষ্ট বলে দিচ্ছে এতক্ষণ আই সি ইউর ভেতর ছোট্ট পেশেন্টকে বাঁচানোর যুদ্ধে তারা হেরে গিয়েছে। বাচ্চাটা সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দিয়ে পাড়ি জমিয়েছে অনন্তকালের জগতে।

মননের সহকর্মীরা একে অপরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে নিজেদের শান্তনা দিচ্ছে। মনন আই সি ইউর বাহিরে এককোনায় একটা বেঞ্চিতে বসে আছে। চোখের চশমাটা খুলে মাথা নুইয়ে চোখ বুজে রেখেছে। তায়েফ নামক সহকর্মী এসে তাকে ডাকতেই চোখ তুলে তাকায়।

“ বাসায় যাবে না ওয়াসিফ? ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে। ঘুম প্রয়োজন। সকালে আবার ওপিডি আছে তোমার। না ঘুমালে আগামীকাল সারাদিন মাথা ব্যথায় ভুগবে। ”

মনন কেবল ক্লান্ত গলায় বললো,

“ তোমরা যাও। আমি আর আজ রাত বাসায় ফিরবো না। হসপিটালেই রেস্টিং রুমে ঘুমিয়ে নিবো। “

তায়েফ আর ঘাটে না। একে একে আই সি ইউ এরিয়াটা আবার নির্জনতা এবং নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়তেই মনন আবার মাথা তুলে। কি ভেবে যেনো চশমাটা চোখে পড়ে উঠে দাঁড়ায়। এন আই সি ইউ এরিয়ার ওদিকটায় হেঁটে যায় ধীর পায়ে।

মধ্যরাত হওয়ায় এন আই সি ইউ রুমটা মৃদু আলোয় আলোকিত। প্রত্যেকটা পেশেন্ট তখন ঘুমে নিমগ্ন। বাচ্চাদের ডক্টরটা নার্সদের কাউন্টার সেকশনে গিয়ে স্বাভাবিক গলায় জানতে চায়,

“ মেহনামা ফেরদৌস মোহ। ফাইল নং সি আর সিক্স জিরো নাইন সেভেন। বেড নম্বর কত? “

উপস্থিত নার্স পেশেন্টের তালিকা চেক করে জানায়,

“ বেড নং ফোর, স্যার। “

__________

মনিটরের সূক্ষ্ণ বিপ বিপ শব্দে মোহর চোখ মুখ কুচকে এলো। চোখ মেলে তাকাতে চাইছে সে কিন্তু মনে হচ্ছে চোখের পাতার উপর কয়েক মণ ভারী বস্তু যেনো রেখে দেওয়া। বহু প্রচেষ্টার পর সে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। শুরুতে চোখের সামনে সবটা ঘোলাটে এবং অস্পষ্ট মনে হলেও, ধীরে ধীরে সামনের দৃশ্যপটটা তার কাছে পরিষ্কার হয়।

বেডের ডানপাশে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে ডক্টর বেশের পুরুষটা। মনযোগী দৃষ্টি মোহর ফাইলের পাতায় স্থির। মুখের অভিব্যক্তি অনেকটা নির্লিপ্ত। মোহ সজাগ হয়েছে টের পেতেই ফাইল ছেড়ে মোহর দিকে দৃষ্টিপাত করে। সহজ গলায় প্রশ্ন করে,

“ কেমন ফিল করছেন? “

মোহ কিছুটা বিস্ময় এবং অবাক হয়ে দেখছে মননকে। প্রথমে ধারণা করে পুরো দৃশ্যটা তার কল্পনা। খুব সম্ভবত এনেস্থিসিয়ার প্রভাবে এই লোকটাকে দেখছে সে। কিন্তু যখন মোহ বুঝতে পারলো যে কল্পনা নয়, বরং মনন সত্যি সত্যি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তখন লজ্জা, সংকোচ, আড়ষ্টতায় অস্থির হয়ে উঠে। আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে ব্যস্ত গলায় বলে উঠে,

“ আমার স্কার্ফ! স্কার্ফ কোথায়? আমার… আহ! “

কথাটা উচ্চারণ করতে নিয়েও মোহ ব্যথায় চোখ বুজে নেয়। মনন স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলে,

“ গলার নিচে এবং বুকের এখানে কাঁচা ঘা এবং সেলাই। বেশি কথা বলবেন না। কষ্ট হবে। “

মনন ভুল বলে নি। আচমকা কথা বলে উঠায় এইমাত্র সেলাইয়ে ক্ষাণিকটা ব্যথা অনুভব করেছে মোহ। কিন্তু আপাতত সেটা তার ভাবনার বিষয় নয়। তার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। ওই লোকটা… ওই ডক্টরটা তাকে ন্যাড়া মাথায় দেখে নিলো? এই কুৎসিত অবস্থায় লোকটা মোহকে দেখে নিলো, ভাবতেই মোহর তীব্র অস্বস্তিতে কান্না পাচ্ছে।

মনন সম্ভবত আন্দাজ করতে পারে বিষয়টা। সে মোহকে সহজ করতে বলে,

“ ইনসিকিউরড ফিল করবেন না। হসপিটালের প্রতিটা পেশেন্টকে এই অবস্থায় দেখে অভ্যস্ত আমি। এন্ড ট্রাস্ট মি আপনাকে মোটেও কুৎসিত লাগছে না। “

মোহ অবশ্য মননের কথাটা বিশ্বাস করলো না। ডক্টরদের কাজই মিথ্যা শান্তনা দেওয়া। মোহ শান্তনায় ভুলে যাওয়া মেয়ে নয়। তীব্র অস্বস্তি নিয়েই সে বাম হাতটা তুলে ধীরে ধীরে নিজের গলার কাছে নিয়ে যায়। আলতো করে ছুঁয়ে দেখে গলার কাছের ব্যান্ডেজটা। হসপিটাল গাউনের ভেতর বুকের কাছের ব্যান্ডেজটাও সে অনুভব করতে পারছে স্পষ্ট। গলা থেকে হাতটা সামান্য নামিয়ে বুকের ডান পাশে ব্যান্ডেজটার এখানে রাখে। এইতো, ঠিক এই জায়গাটাতেই ব্যান্ডেজের ভেতর তার পাতলা ত্বকের নিচে প্রায় গোলাকার ওই বস্তুটার কিছুটা ভার টের পাচ্ছে সে।

মোহ বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে। অদ্ভুৎ অনুভূতি কাজ করছে তার মধ্যে। যেই অনুভূতির কোনো স্পষ্ট নাম তার জানা নেই। চিত্ত জুড়ে অনুভূতিটাও অদ্ভুৎ। মনন ফাইলটা জায়গা মতো রেখে দিয়ে বলে,

“ চিন্তার কিছু নেই। মাইনর সার্জারি ছিলো। মধ্যরাত বলে আপনাকে এখন কেবিনে শিফট করা পসিবল না। আগামীকাল সকালে ডক্টর এসে সামান্য চেক আপ করে গেলেই কেবিনে শিফট করে দেওয়া হবে। আপনি রেস্ট করুন। এনেস্থিসিয়ার কারণে মাথা ভার মনে হতে পারে। ঘুমিয়ে পড়ুন। কিছুটা ফুরফুরে লাগবে তাহলে। “

মোহ নিশ্চুপ দেখে মননকে। লোকটার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে এই লোকটা তারই ডক্টর। মোহকে তাকিয়ে থাকতে দেহে মনন ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কিছু বলবেন? কোনো অসুবিধা হচ্ছে? “

মোহ কিছুটা ধীর গলায় এবার জবাব দেয়,

“ সার্জারির কারণে দুপুর থেকে কিছু খাই নি। কিন্তু এখন খিদে পেয়েছে। এখন কিছু খাওয়া কি পসিবল? “

শুকনো মুখে বলা কথাটুকু শুনে মননের খুব মায়া হলো বুঝি। সে একবার দেয়ালের ঘড়ি হতে সময় দেখে নিয়ে বলে,

“ আপাতত তো পসিবল না। আর দু তিনটা ঘন্টা কষ্ট করতে পারবেন? ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে আপনার মিল টাইম দেওয়া দেখলাম। পেইনকিলারও তখন দেয়া হবে। “

মোহ আর কিছু বললো না। মনন উদাস মুখটা দেখে নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তবে পানি খেতে পারবেন চাইলে? তেষ্টা পেয়েছে? পানি আনাবো? “

মোহর আসলেই তেষ্টা পেয়েছিলো। সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। মনন সঙ্গে সঙ্গে ইশারায় একজন নার্সকে ডেকে পানি আনতে বলে। নার্সটা পানির বোতল নিয়ে আসতেই মনন তাকে বলে,

“ উনাকে হেল্প করুন একটু। “

নার্সটা বেডের একপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। অভিজ্ঞ ভঙ্গিতে মোহর পিঠের নিচে একহাত দিয়ে এবং অপর হাতে মোহর একটা হাত ধরে তাকে কিছুটা উঠে বসতে সাহায্য করে। নার্সের সাহায্যে বসার জন্য মাথা তোলার চেষ্টা করতেই মোহ ব্যথায় আরো এক দফা চাপা আর্তনাদ করে উঠে। চোখ মুখ খিচে রেখেছে সে। বুক এবং গলার সেলাইয়ে একসঙ্গে টান অনুভব করছে সে। সেই ব্যথাটুকু দম খিচে সহ্য করে নিয়েই তার উঠে বসতে হয়। সাপোর্ট দেওয়ার জন্য নার্স তাকে হাতের সাহায্যে পিছন থেকে আগলে রেখেছে। মনন বোতলের ছিপিটা খুলে মোহর মুখের সামনে ধরতেই মোহ আড়চোখে লোকটাকে একবার দেখে নেয়। পরপর সামান্য চুমুক দিয়ে কিছুটা পানি খেয়ে আবার গা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে। মনে মনে সে ভালোই টের পাচ্ছে এই সেলাই শুকানোর আগ পর্যন্ত তার শোয়া থেকে ওঠা বসা নিয়ে ভালোই ভোগান্তি পোহাতে হবে।

নার্স চলে যেতেই মনন ফের প্রশ্ন করে,

“ আর কিছু প্রয়োজন? “

মোহ এবার নিচু গলায় বললো,

“ এই মনিটরটার আওয়াজ বন্ধ করা যায় না? “

“ না। “

উত্তরটুকু দিয়ে কিছুক্ষণ থেমে মনন আরো একবার প্রশ্ন করে,

“ আর কিছু? “

মোহ কিছুক্ষণ মননকে দেখে। চোখে অজানা আবেগের রেশ। দূর্বল গলায় বলে,

“ আরেকটা কম্বলের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? এসির টেম্পারেচার খুব লো। ঠান্ডা লাগছে খুব। “

মনন কোমল গলায় বলে,

“ নার্সকে বলে দিচ্ছি। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আমি এখন যাই। ওকে? “

মোহ অবাক হয়। লোকটা কি এইমাত্র তার কাছে অনুমতি চাইলো? নাকি মোহরই এমনটা মনে হলো? কে জানে! হয়তো মোহই বেশি ভাবছে।

__________

মায়া বুঝদার মেয়ে। মোহ আর বাবার মাঝে স্থান করা নীরব দূরত্ব সম্পর্কে সে অবগত। সেই দূরত্ব দূর করতেই সে একটা ফন্দি এঁটেছে। ইচ্ছে করে পরীক্ষার উছিলা দিয়ে দু একদিন হসপিটালে যাবে না বলে ঠিক করেছে। অথবা গেলেও বেশিক্ষণ থাকবে না সেখানে। মোহর খেয়াল রাখার ব্যাপারটা ইনিয়েবিনিয়ে বাবার কাঁধে চাপিয়ে দিবে। এতে মোহ সাময়িক অস্বস্তিতে পরলেও অন্তত স্থায়ীভাবে দু’জনের মাঝের এই দূরত্ব তো মিটবে!

যে-ই ভাবনা, সেই অনুযায়ী কাজে লেগে পরলো মায়া। সকাল সকাল বাবাকে কল করে জানিয়ে দিলো তার পক্ষে আজ হসপিটাল যাওয়া সম্ভব হবে না। পদার্থবিজ্ঞান ২য় পত্র পরীক্ষার জন্য তার খুব পড়তে হবে। আজকে যেনো শিহান মোহর সাথেই থাকে সারাদিন।

শিহান কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়। প্রথমত এটা ভেবে যে মোহ কম্ফোর্ট ফিল করবে কি-না তার উপস্থিতিতে। দ্বিতীয়ত তার কিছু পেন্ডিং কাজও আছে। সেগুলো শেষ করাটাও তার জন্য জরুরী। মনে জড়তা কাজ করলেও শিহান আর মানা করে না। রাজি হয়ে যায় মোহর সাথে থাকতে।

__________

তখন দুপুর প্রায় ১ টা বাজে। মোহর লাঞ্চ কেবল দেওয়া হয়েছে। মোহ আড়চোখে একবার সোফায় বসে থাকা বাবাকে দেখে। শিহান তখন ল্যাপটপে কাজ করতে ব্যস্ত। অফিসের কাজ গুলো অনলাইনের মাধ্যমে নিজের তরফ থেকে যতটা সম্ভব কাভার করার চেষ্টা করছে সে।

মোহ বাবাকে বিরক্ত করে না। নিজেই একা একা উঠে বসে। এতে কিছুটা কষ্ট হয় তার, তবে নীরবে সয়ে নেয়। নিজেই আগ বাড়িয়ে ফোল্ডেবল টেবিলটা নিতে নিবে এমন সময় শিহান পাশ ফিরে তাকায়। ল্যাপটপটা কোল থেকে রেখে এগিয়ে এসে নিজে টেবিলটা হাতে নিয়ে নেয়। মোহর সামনে টেবিলে দুপুরের খাবার গুলো সাজিয়ে রাখে নিজ হাতে। সম্পূর্ণ কাজটাই সে নীরবে করে।

মোহও কিছু বলে না। শিহান গিয়ে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে। মোহ মুখ লটকে চামচ দিয়ে ভাত তরকারি নাড়াচাড়া করে মুখে দিতে থাকে। এই হসপিটালে তার সবথেকে অপ্রিয় জিনিসই হচ্ছে এখানকার খাবার। একটা তরকারিতেও মনে হয় মশলা দেওয়া হয় নি। কেমন সাদা সাদা দেখতে সব। যেনো শুধু সিদ্ধ করে সোজা মোহর সামনে পরিবেশন করা হয়েছে।

মোহ খেতে খেতে মুখ বিকৃত করে ফেলে। শিহানের দৃষ্টি এড়ায় না তা। সে চোখ কুচকে প্রশ্ন করে,

“ খাবার নিয়ে ঢং করছো কেন? “

মোহ অভিযোগের সুরে বলে,

“ এইটা কোনো খাবার হলো? কি বিশ্রী খেতে! এতো টাকা দেওয়া হয়, তবুও এরা এতো বাজে খাবার দেয়। “

“ বাজে খাবার কোথায় পেলে? হেলথি আর মানসম্মত খাবারই দেওয়া হয়। আমি নিজে পারমিশন নিয়ে হসপিটালের কিচেন এরিয়া ঘুরে দেখেছি। যথেষ্ট সচেতনতার সাথে রান্না করা হয়। চুপচাপ খাও। “

মোহ যেনো কিছুটা প্রশ্রয় পেলো। চটপটে স্বরে বলে,

“ না টেস্ট করে এরকম বড় বড় কথা সবাই বলতে পারে। সাহস থাকলে টেস্ট করে দেখো। তারপর দেখো আমি ঠিক নাকি ভুল। “

শিহান কিছুক্ষণ চোখ ছোট করে মোহকে দেখে উঠে আসে। মেয়ের মুখোমুখি বেডে বসে শক্ত মুখে একটা চামচ হাতে তুলে নেয়। ভাতের সঙ্গে কিছুটা লাউয়ের ঝোল মেখে চামচ দিয়ে তা মুখে ভরে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিহানের দৃঢ় মুখভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে। কিছুটা মিইয়ে গেলো যেনো সে।

এ কেমন তরকারি? লাউয়ের স্বাদ কোথায়? মরিচ গুঁড়ো কোথায়? হলুদ গুড়ো কোথায়? শিহান এবার লাউ ছেড়ে সজনে দিয়ে রান্না করা ডাল কিছুটা চামচে তুলে মুখে দেয়। টক দিয়ে ডাল খেয়ে অভ্যস্ত শিহানের মুখে এই ডাল খুব পানসে মনে হলো। আর কিছু খেলো না শিহান। উঠে চুপচাপ গিয়ে আবার সোফায় ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে পড়লো।

মোহ নীরবে পুরো দৃশ্যটা দেখে। বাবার চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে হঠাৎই খুব হাসি পেলো তার। বাকিটুকু খাবার সে তৃপ্তি নিয়ে না খেলেও, হাসিমুখেই খেলো।

__________

তখন প্রায় মধ্যরাত। ল্যাপটপের স্ক্রিনে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জোড়া লাল হয়ে গিয়েছে শিহানের। তবুও সে আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসে। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আগামী তিন দিনের জরুরী কাজ যতটা সম্ভব সে আগাম সম্পন্ন করে রেখেছে।

ল্যাপটপ অফ করে উঠে দাঁড়াতেই শিহানের চোখ যায় বেডের দিকে। মোহ তখন ঘুমোচ্ছে। গায়ের কম্বলটা হাঁটু পর্যন্ত টানা। শিহান এগিয়ে গিয়ে সেই কম্বলটা আরেকটু টেনে দেয়। সারাদিন স্কার্ফ দিয়ে ঢেকে রাখা মাথাটা এখন উন্মুক্ত। শিহান নিষ্পলক কিছুক্ষণ মেয়ের মুখটা দেখে। চেহারায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। হাই ডোজের কেমো এবং ওষুধের প্রভাবে যেনো চোখের পলকেই আরো কয়েক কেজি ওজন হ্রাস পেয়েছে মেয়েটার। চেহারাতেও লেপ্টে আছে অসুস্থতার ছাপ।

শিহানের আচমকা মনে পড়ে নিজ স্ত্রী’র কথা। বিথী খুব শখ করে মেয়ে দুটোর নাম রেখেছিলো মোহ এবং মায়া। জন্মলগ্ন থেকেই দুই বোনের মাঝে মোহ তুলনামূলক একটু দূর্বল এবং অসুস্থ ছিলো। বিথীর নিজের শারীরিক অবস্থাও তখন ভালো ছিলো না। তবুও সারাদিন দূর্বল মেয়েটাকে বুকে মিশিয়ে রাখতো। মৃত্যুর মুহুর্তেও এই মেয়েটাই বিথীর বুকে লেপ্টে ছিলো।

শিহানের আচমকা মনে হয় বিথী হয়তো আগে চলে যাওয়াতে ভালোই হয়েছে একদিক দিয়ে। না-হয় আজ নিজ চোখে নিজের মেয়েকে এই অবস্থায় দেখলে সে সহ্য করতে পারতো না কখনো। মায়েরা নরম মনের হয়। নিজ সন্তানের অসুস্থতায় তাদের কলিজা ছিড়ে আসে। বাবাদের কিছু হয় না সেই ধারণাটা অবশ্য ভুল। চোখের সামনে সুস্থ সন্তানকে অসুস্থ অবস্থায় দেখাটা কোনো বাবার জন্যও সহজ নয়। তবুও এই কঠিন ব্যাপারটা বাবারা সহ্য করে। কাঠিন্যতার আড়ালে নিজেদের উদ্বেগটা লুকিয়ে রাখে। কারণ বাবারা এমনই হয়। এরকমই হয়।

শিহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফা থেকে নিজের আরো দুটো বালিশ এনে মোহর হাতের দু’পাশে কিছুটা চেপে রেখে দেয়। যেনো বালিশের চাপে মোহ ঘুমের মাঝে কাথ না হয়ে যায়। ডক্টর বলেছে আপাতত কয়েকদিন একটু বুঝে শুনে ঘুমাতে। ঘুমের মাঝে গলা কিংবা বুকের সেলাইয়ে টান কিংবা চাপ লাগলে অসুবিধা হবে।

বালিশ দেওয়ার পরও শিহানের মনে খচখচানি ভাব রয়ে যায়। তার মেয়ের ঘুমের ধরণ সম্পর্কে তার ধারণা আছে। দেখা গেলো বালিশ জড়িয়ে ধরে উল্টো কাথ হয়ে গেলো! খচখচানি ভাব নিয়ে এভাবেও শিহান ঘুমাতে পারবে না। তাই একটা টুল টেনে বেডের ধারে বসে পড়লো সে। আর কয়েকটা ঘন্টাই তো! একটা রাতেরই ব্যাপার! একটা রাত না ঘুমালে শিহানের বিরাট কোনো লস হবে না। সারা রাত জেগে কাজ করতে জানা শিহানের জন্য, একটা রাত মেয়ের জন্য নাইট গার্ডের ডিউটি পালন করা কোনো ব্যাপারই নয়।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে