অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১. ( অবতরণিকা )
প্রকৃতিতে কেবল নতুন ঋতুর আগমন ঘটেছে। শরতের প্রাণজুড়ানো হাওয়া বইছে চারিদিকে। রাতের আবহাওয়াটা নির্মল, শুদ্ধ হয়ে ধরা দিয়েছে যেনো। রাজধানীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পনেরো তলা বহুতল ভবনটা আধুনিকতা এবং পরিচ্ছন্নতায় মোড়ানো। ভবনের গায়ে উজ্জ্বল বড়ো বড়ো অক্ষর দ্বারা লেখা নামটা বেশ দূর থেকেও স্পষ্ট পড়তে পারবে যে-কেউ।
লাইফ কেয়ার হসপিটাল। বাংলাদেশের সনামধন্য প্রাইভেট হসপিটাল গুলোর মধ্যে একটি। সময় তখন রাত আটটা বেজে বত্রিশ মিনিট। হসপিটালের ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। চাঁদের রূপালি আলোয় তার কাটকাট মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দৃষ্টি তার জাদুর শহরের পানে নিবদ্ধ। বুক ভর্তি চাপা নিঃশ্বাস খুব নিভৃতে বেরিয়ে আসে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে নির্গত হয় নিষ্ঠুর হৃদয়ঘটিত পীড়াও।
পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফেসবুকে প্রবেশ করে সে। ফিডের সর্বপ্রথম পোস্টটা দেখতেই মিনিট খানিকের জন্য থমকায়। ছবিতে থাকা বিয়ের সাজে সজ্জিত লাল লেহেঙ্গা পরিহিত মেয়েটাকে দেখে বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করে। কিন্তু ছবিতে থাকা মেয়েটার মুখে কোনো কষ্টের লেশমাত্র নেই। সে পৃথিবীর সবথেকে সুখী বধূর হাসিটা মুখে নিয়েই পাশে বসে থাকা জীবনসঙ্গীর দিকে তাকিয়ে আছে।
ছবিটা দেখে শেষবারের মতো হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে যুবকটি। ইশ! একবার যদি অন্তত নিজের মনের কথা জানানোর সাহসটা জোগাড় করতে পারতো সে! তাহলে কি আজ এই মেয়েটার পাশে সে থাকতে পারতো না? হয়তো, কে জানে!
আচমকা নিজের এমন ভাবনার প্রতি বিরক্ত হয় যুবকটি। পরশি এখন অন্য কারো স্ত্রী। অন্যের স্ত্রী’র পাশে নিজেকে ভাবাটাও এক ধরণের ছোটলকি রূপের বহিঃপ্রকাশ। এতো বছর ধরে যেহেতু সে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে চুপ ছিলো, আজ তাহলে আফসোস করছে কেন? আফসোস করলে কি বিধির লিখন বদলে যাবে?
যুবকটা ফট করে নিজের ফোনটা পকেটে ভরে নিয়ে মনে মনে আওড়ায়,
“ চির সুখী হ তুই পরশি। “
উন্মাদ বাতাস বইছে। যুবকটা দু’হাতে রেলিং শক্ত করে ধরে চোখ বুজে নেয়। মাথাটা কিছুটা বাইরের দিকে নুইয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালায়। আচমকাই নিস্তব্ধতা চিরে একটা চঞ্চল নারী স্বর বলে উঠে,
“ ওহ শিট! ওয়েট মিস্টার! সরি টু ডিস্টার্ব ইউ। কিন্তু এখুনি ঝাঁপ দিবেন না প্লিজ। হুদাই আপনার সুইসাইড কেসে পরে সাক্ষী সরূপ আমার নাম এসে পড়বে। “
নির্জন হসপিটাল ছাদটায় আচমকা অনাকাঙ্ক্ষিত কারো গলার স্বর শুনে ভড়কে যায় যুবকটি। চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। ছাদের দরজার কাছে একটা নারী ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে থাকায় মুখটা অস্পষ্ট।
যুবকটা সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই এবার সেই ছায়ামূর্তিটা তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় তার মুখখানি। মেয়েটার মুখ দেখে আরো একদফা চমকায় যুবকটা। তার সূক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি জানান দিচ্ছে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির বয়স সতেরো থেকে আঠারোর ঘরে হবে খুব সম্ভবত। গায়ের কালো রঙের কুর্তিটার কারণে চাঁদের আলোয় শুভ্র মুখশ্রীটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে খুব। অবাধ্য উন্মুক্ত কেশ যার দৈর্ঘ্য কাধের কিছুটা নিচ পর্যন্ত তা বাতাসের তালে দুলছে।
যুবক কিছু বলার পূর্বেই মেয়েটা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে তার পাশ কেটে রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। নিচের দিকে উঁকি দিয়ে কিছু একটা ভেবে শুধায়,
“ এখান থেকে লাফ দিয়ে সুইসাইড করার আইডিয়াটা খুব বাজে। অনেক অসুবিধা আছে। প্রথমত হসপিটালের অথরিটিদের বিনা কারণে গণমাধ্যম ও পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হবে। দ্বিতীয়ত অযথা আপনার সুইসাইড কেসকে অনেকে মার্ডার কেস হিসেবে সাসপেক্ট করতে পারে। আর তৃতীয়ত আপনার ফিগার আর মুখের নকশা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে। আমি আপনাকে বেটার কোনো অপশন সাজেস্ট করতে পারি। ইফ ইউ ইনসিস্ট আরকি! এতে করে আপনি সুইসাইড করলেও অযথা কারো হয়রানির শিকার হতে হবে না আর আপনার সুন্দর ফেস আর বডির নকশাও ঠিক থাকবে। “
এতক্ষণ ধরে ভ্রু কুচকে মেয়েটার এই আউট অফ কনটেক্সট কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলো যুবকটা। কথাগুলো বলে মেয়েটা হাসি হাসি মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে এমন একটা ভাব যেনো সে খুব বড়ো কোনো মানবসেবা করছে। মেয়েটার হাসি হাসি মুখটা দেখে যুবকটা বিরক্তবোধ করে। মুখ খুলে বলে,
“ থ্যাংকস ফর ইউর কনসার্ন। কিন্তু আমি সুইসাইড করার এটেম্পট করছিলাম না। “
মেয়েটা অবাক চোখে যুবকটাকে দেখে। হসপিটালের হালকা নীল রঙের জামা এবং পাজামা গায়ে। তার উপর পরে আছে সাদা রঙের একটা এপ্রোন। বাতাসের দমকে যার শেষাংশ কিছুটা উড়ছে। পায়ে বেশ সাধারণ একজোড়া হসপিটালে পরিধেয় যোগ্য স্যান্ডেল। গলায় ঝুলে আছে একটা স্টেথোস্কোপ। চোখ মুখে একধরণের হতাশার ছাপ লেপ্টে আছে।
মেয়েটাকে এভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে যুবকটা অস্বস্তি বোধ করে। তার অস্বস্তি বাড়িয়ে দিতে মেয়েটা বলে উঠে,
“ আপনাকে দেখে তো পাক্কা ছ্যাঁকাখোর মনে হচ্ছে। আমার জায়গায় অন্য যে কেউ দেখলেও ভাবতো আপনি সুইসাইড করতেই এসেছেন। অথচ আপনি বলছেন আপনি না-কি সুইসাইড করতে আসেন নি। আপনার কি মুড সুইং হচ্ছে? কিন্তু মুড সুইং তো মেয়েদের হয় আমার জানামতে। ছেলেদের মুড সুইং হওয়াটা খুবই অস্বাভাবিক বিষয়। “
যুবকটা বিরক্তি নিয়ে কিছুটা রাগী স্বরে শুধায়,
“ মিস, আপনি এখানে হাজির হওয়ার পর থেকে একের পর এক ভুলভাল আন্দাজ করেই চলেছেন আমার ব্যাপারে। লেট মি মেক ইট ক্লিয়ার। না আমি সুইসাইড করতে এসেছি আর না আমার মুড সুইং হচ্ছে। আমাকে নিয়ে ভুলভাল ধারণা ব্যাখ্যা করা বন্ধ করুন। আই এম নান অফ ইউর বিজনেস। “
মেয়েটার মুখ কালো হয়ে আসে। সে চুপচাপ সেখান থেকে সরে গিয়ে ছাদের চারিদিকটা ঘুরে দেখতে থাকে। যুবকটা তা দেখে নীরবে। উপলব্ধি করে এভাবে অপরিচিত একটা মেয়ের সঙ্গে রাগ দেখানোটা বোধহয় ঠিক হয় নি। সে কিছুটা নরম স্বরে এবার বলে,
“ এক্সকিউজ মি মিস। আই এম সরি। আমার আসলে এরকম রাগ দেখিয়ে কথা বলাটা ঠিক হয় নি। “
মেয়েটা স্বাভাবিক গলায় বলে,
“ ইট’স ওকে। আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কোনো ব্যাপারে ফ্রাস্ট্রেটেড। তাই আপনার কথায় আমি মাইন্ড করি নি। ইনফ্যাক্ট আমি কারো কথায়ই মাইন্ড করি না। সো টেক এ চিল পিল। “
যুবকটা আরো এক দফা হতাশ হয়। বিগত কিছুক্ষণে সে এই অপরিচিত মেয়ের ব্যাপারে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছে। তা হলো মেয়েটা নিজের মতো করে সব বুঝে নিতে পছন্দ করে। আর একটু অতিরিক্ত কথা বলাও তার স্বভাব অন্তর্ভুক্ত বিষয়। যুবকটা তাই এই ব্যাপারে কথা না বাড়িয়ে সরাসরি প্রশ্ন করে,
“ আপনি এইখানে ছাদে কি করছেন? “
মেয়েটা কৌতূহলী চোখে চারিদিকটা দেখতে দেখতে বলে,
“ ছাদটা ঘুরে দেখতে এসেছি। আই মাস্ট সে রুফটপটা আসলেই সুন্দর। কি জোস সিটি ভিউ পাওয়া যায় এখান থেকে! “
“ আপনি কি হসপিটালে ছাদ ঘুরে দেখতে এসেছেন? “
মেয়েটা হাঁটা থামিয়ে ঘুরে তাকায়। যুবকটার দিকে এগিয়ে এসে বিস্ময় নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। যুবকটা আবারও অস্বস্তিতে পড়ে যায়। জড়তা নিয়ে পিছু হটে বলে,
“ আপনি প্লিজ বারবার এভাবে আমার মুখের দিকে তাকাবেন না। ব্যাপারটা খুব অস্বস্তিদায়ক। “
মেয়েটা ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে,
“ আপনি কি পরীক্ষায় চিটিং করে ডক্টর হয়েছেন? লজ্জা পাবেন না। আমাকে বলতে পারেন, আমি কাউকে বলবো না। “
“ অদ্ভুৎ তো! আপনার কেনো মনে হলো আমি পরীক্ষায় চিটিং করে এসেছি? “
“ তাহলে এরকম বলদের মতো আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেনো, হসপিটালে ছাদ ঘুরে দেখতে এসেছি কি-না? হসপিটালে মানুষ কেনো আসে আপনি জানেন না? “
যুবকের ঠোঁট যুগল নিজ শক্তিতে হা হয়ে গেলো। কিছু বলতে নিয়েও আর বললো না। মেয়েটা আবার তার কথায় ভুল ধরবে না-হয়। তার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে মেয়েটা ছাদের একপাশে চলে যায়। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজের জিন্সের পকেট হতে ফোনটা বের করে ক্যামেরা অন করে। এই অত্যন্ত সুন্দর ভিউটা নিজের ক্যামেরায় বন্দী করতে সে প্রবল আগ্রহী।
যুবকটা দূর হতে তা দেখে। অত:পর সেখান থেকে প্রস্থানের জন্য দরজার দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু কি ভেবে যেনো থেমে যায়। ঘুরে আবার সে-ই মেয়েটার দিকে তাকায়। হাত উঁচু করে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ছবি তুলতে ব্যস্ত সে। যুবকটা নিভৃতে মেয়েটার বাম হাতের কব্জির কাছে হসপিটালের আইডেন্টিটি বেইডটা লক্ষ্য করে। তার মানে এই মেয়েটা অসুস্থ? অসুস্থ হলে একা একা ছাদে কি করছে? অভিভাবক কোথায় মেয়েটির?
যুবকটা কিছুটা গলা উঁচু করে ডাকে,
“ এক্সকিউজ মি মিস। আপনি প্লিজ সেখান থেকে সরে আসুন। আমার যেতে হবে, আপনারও ছাদে একা থাকাটা ঠিক হবে না। “
মেয়েটা ফোন পকেটে ভরে তার দিকে এগিয়ে এসে আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করে,
“ আপনি কি ভয় পাচ্ছেন যে আপনি চলে গেলে আমি ছাদ থেকে ঝাপ দিবো? “
মেয়েটা কাছে এসে দাঁড়ানোতে এবার তার হাতে পরিহিত রিস্ট বেইডটা আরো কাছ থেকে দেখতে পারে সে। সেখানে স্পষ্ট করে ইংরেজিতে একটা চার অক্ষরের নাম লেখা।
‘M O H O’
আর কিছু লক্ষ্য করার পূর্বেই মেয়েটা হেসে বলে উঠে,
“ চিন্তা করবেন না। আমার মরার প্ল্যান নেই এতো তাড়াতাড়ি। আমার তো এখনো… “
পুরো কথাটা শেষ করার পূর্বেই মোহর ফোন বেজে উঠে। সে পকেট থেকে ফোন বের করে কলটা রিসিভ করে। অপর পাশের মানুষটা কিছু বলতেই মোহ বলে উঠে,
“ হসপিটালেই আছি। ঘুরে দেখছিলাম একটু। এতো প্যানিক করার কি আছে? “
ফোনের অপর পাশ হতে আরো কিছু বলে। মোহ ‘আসছি’ বলে কলটা কেটে দেয়। যুবকের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
“ ইট ওয়াজ নাইস টু মিট ইউ। আমার এখন যেতে হবে। টাটাহ। “
বলেই মোহ দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজার কাছে গিয়েই সে কিছু মনে পড়েছে ভঙ্গিতে থেমে যায়। পিছু ফিরে বলে,
“ ওহ শিট! আপনার নামটাই তো জানা হলো না। আপনার নাম কি? কোন ডিপার্টমেন্টের ডক্টর আপনি? “
যুবকটা এবার স্বাভাবিক গলায় জবাব দেয়,
“ মনন। পোস্ট গ্রেজুয়েট। পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট। “
মোহ হাসি চওড়া করে বলো,
“ ওওও! বাচ্চাদের ডক্টর। নাইস, ক্যারি অন। “
মোহ আর অপেক্ষা করে না। কল করা মানুষটা নাহয় তাকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে এসে পরবে। সে আর পিছু না ফিরে সেখান থেকে প্রস্থান করে। মনন দাঁড়িয়ে রয় আপন জায়গায়। মেয়েটার বলা ‘বাচ্চাদের ডক্টর’ কথাটা এখনো তার কানে বাজছে। বাচ্চাদের ডক্টর আবার কি জিনিস? ডক্টর তো ডক্টরই হয়।
পরমুহূর্তেই তার খেয়াল হয়, মেয়েটার হাতে থাকা সেই ব্রেসলেটটার কথা। মেয়েটা সত্যিই অসুস্থ? দেখে তো সেরকম কিছু মনে হচ্ছিলো না। এই হসপিটালের প্রতিটা পেশেন্ট একই রোগে আক্রান্ত। তবে ডিপার্টমেন্ট ভিন্ন। এই মেয়েটা কোন ডিপার্টমেন্টের কে জানে!
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]