অপ্রাপ্তি পর্ব-২৩

0
1192

#অপ্রাপ্তি 💔
#ইবনাত_আয়াত
~ পর্ব. ২৩

আস্তে আস্তে নেত্রপল্লব বিচ্ছিন করলাম একে অপর থেকে। মাথা টা ভীষণ যন্ত্রণা করছে। ঝাপসা দেখছি সব। প্রায় কিয়ৎক্ষণ পর ঝাপসা ভাব টা কমে এলো। উঠে বসার প্রয়াস করলাম। কিন্তু সক্ষম হলাম না। আশেপাশে চোখ বুলালাম। তাহসিনের ঘুমন্ত চেহারা খানা নজরে এলো। একি! ইনি আমায় পায়ের কাছে মাথা দিয়ে শুয়ে আছেন?
একটু নড়াচড়া করতেই তিনি হকচকিয়ে উঠলেন। দ্রুত উঠে আমার কাছে এসে বসলেন, ‘তোমার জ্ঞান ফিরেছে? সত্যি! ওয়েট আমি ডক্টর ডাকছি।’

আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি থামিয়ে বললেন, ‘কী করছ ইবনাত? উঠছ কেন? শুয়ে থাকো।’

তিনি দ্রুত ডাক্তার ডেকে নিয়ে এলেন। তার অস্থিরতা টা বরাবরই আমায় কনফিউশনে ফেলছে। কেন? তিনি এত অস্থির কেন?

ডাক্তার তার নিজের কার্য সেরে চলে গেলেন। তার গায়ের টি-শার্ট রক্তে মাখামাখি। তিনি ক্লান্ত ভঙ্গিতে আমার পাশে চেয়ারে বসলেন। করুন দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, ‘এমন কেন করলে বলো তো? জানো? প্রায় ৩৬ ঘন্টা ধরে তুমি সেন্সলেস ছিলে।’

চমকালাম। কিন্তু.. কী হয়েছিল আমার? প্রশ্ন করলাম, ‘কেন? কী হয়েছে আমার?’

‘তোমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল ইবনাত।’

‘কীহ্? কবে?’

‘পরশু দিন রাতে।’

‘কীহ্? আমি এতক্ষণ..’

‘হ্যাঁ বেহুশ ছিলে।’

ধীরে ধীরে মনে পড়ল কিছু কথা। রিশান আমায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল। খারাপ কিছু করতে চেয়েছিল। তারপর.. আমি সার্ভাইব করলাম। কিন্তু রাস্তায়.. উফ সব গুলিয়ে যাচ্ছে। অকপটে প্রশ্ন করলাম, ‘রিশান? ও..’

‘ভয় পেও না। ওকে পুলিশ নিয়ে গেছে।’

‘মানে?’

‘ও.. তোমাকে রেপ করতে চেয়েছিল ইবনাত। ওকে কোর্টে নেওয়া হবে।’

‘স-সত্যি?’

‘হুম হৃদরাণী সত্যি।’

আবারো থমকালাম। সেই নামে আবারো? তিনি আমায় রেস্ট নেওয়ার আদেশ দিয়ে খাবার আনতে চলে গেলেন।

.

প্রায় পাঁচ দিন যাবৎ হসপিটালেই ছিলাম। এই ক’দিন আমার যত্নের ত্রুটি রাখেন নি ড. তাহসিন সাহেব। কিন্তু তার অস্থিরতা, যত্ন, মুগ্ধ চাহনী, খুব ভাবায় আমাকে। এটা কী আমার প্রতি তার অনুভূতি? নাকি দায়িত্ববোধ?

আজ ডিসচার্জ করা হবে আমাকে। এই ক’দিনে মিহির, তানসীব ভাইয়া, তনিমা আপু, শশুড় আব্বু আম্মু, আর আমার বাবা মাও এসে দেখে গেছে। রিশানকে আজ কোর্টে নেওয়া হচ্ছে। আমাকেও নেওয়া হবে।

.

বিপরীত পক্ষ জয়ী হয়েছে৷ মানে আমরা। তার জেল হয়ে ছয় বছরের। ধর্ষনের চেষ্টার দায়ে। রিশানকে নিয়ে যাওয়ার সময় সে আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। সে যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। বাসায় ফিরে এলাম।

মধ্য রজনী। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশপানে মুখ করে আছে মিহির। মনে হাজারো চিন্তা। কীভাবে সে মি. হাসবেন্ড কে বলবে যে সে তাকে ভালোবাসে। তার মনে শুধু এই একটা কথাই ঘুর ঘুর করছে। তখন’ই শীতল অনুভূতি ছেঁয়ে গেল পাশে এসে দাঁড়ানো লোকটার প্রতি। তানসীব এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। মিহির তার দিকে তাকায় না। তানসীব বলল, ‘আজও দাঁড়িয়ে আছো এখানে? ঘুমুবে না?’

‘নাহ্! ঘুম আসছে না।’

‘কেন? বরের চিন্তায় বুঝি?’

‘এই যাহ্ কী বলছেন এসব?’

‘তুমি এখনো বুঝতে পারছ না মিহুপাখি?’

‘ক-কী?’

তানসীব কিছু বলে না। সে বুঝে গেছে মিহির বুঝেও না বুঝার ভান করছে। না চাইতেও মনে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হলো। মিহির আমতা আমতা করে বলল, ‘কিছু.. বলছেন না.. যে?’

‘কী বলব? যা বলার তুমিই বলো। আমার কিছু বলার নেই।’

‘আমারও কিছু বলার নেই।’

তানসীব আবারো ব্যথিত হলো, ‘সত্যি কিছু বলার নেই?’

‘নাহ্।’

‘ঠিক আছে। নো প্রবলেম।’

তানসীব পেছন ঘুরে চলে গেল। মিহির কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার হৃদয়েও তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হলো। কেন?

.

‘কী হয়েছে ইবনাত? মন খারাপ?’

তাহসিনের কথায় ধ্যান ভাঙল। হেসে বললাম, ‘নাহ্। মন খারাপ কেন হবে। এমনি।’

‘এমনি কী?’

‘না কিছু না।’

‘ওহ্।’

‘কিছু বলবেন?’

‘কই না তো।’

‘ওহ্!’

মন বিষন্ন হলো। ভেবেছিলাম তিনি আমায় তার মনে জমানো সকল কথা বলবেন। কিন্তু.. তিনি কী কখনোই বলবেন না? আমায়ই কী বলতে হবে?

.

স্কুল থেকে বাসায় ফিরে এসে চমকে গেলাম। এ কাকে দেখছি আমি? এ এখানে কী করছে? কেন এসেছে? এই মুহুর্তে রুমে সে ছাড়া কেউ নেই। মিহির বোধহয় রান্না ঘরে। আমি এগিয়ে যেতেই সে আমায় দেখে চমকাল। ভ্রু কুঁচকে ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি? তুমি এখনো এখানে কী করছ শুনি?’

‘কী করছি মানে? আমি এখানে কী করছি তাতে কিছু যায় আসে না। তুমি এখানে কী করছ?’

‘আমি আমার ননদের শশুড় বাড়ী তে এসেছি।’

‘ননদের শশুড় বাড়ী মানে? শুনো মিস. ইশি। মিহির এখন আর তোমার ননদ নেই।’

‘মানে?’

‘কী? বাচ্চা নাকি তুমি? ও এখন তোমার ননদ নয়। সেই সম্পর্ক তো দু’মাস আগেই শেষ হয়ে গেছে।’

‘কী বলতে চাইছ টা কী তুমি?’

তন্মধ্যে মিহির এলো নাস্তা নিয়ে। আমায় দেখে হেসে বলল, ‘আরে ভাবী? চলে এসেছ?’

মিহিরকে প্রশ্ন করলাম, ‘ও এখানে কী করছে মিহির? কেন এসেছে?’

মিহির নাস্তার ট্রে টেবিলে রেখে বলল, ‘আঁধঘন্টা আগেই এসেছে।’

কিছু বললাম না। ওর উদ্দেশ্য কী তা আগে জানতে হবে। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তানসীব অফিসে। তাহসিন হসপিটালে। আম্মু অসুস্থ তাই রেস্ট নিচ্ছে। প্রায় দুপুর গড়িয়ে এসেছে। গোসল করে বেরিয়ে এলাম। ততক্ষণে মিহির কাজ কর্ম রান্নাবান্না সেরে নিয়েছে। আম্মু কে নিয়ে খেতে বসলাম। ইশিও বসেছে। আম্মুকে দেখে হেসে সালাম দিল। আম্মু সালাম নিয়ে অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি কবে এলে মা?’

‘এই তো আন্টি। একটু আগেই।’

মিহির আর আমি চোখ উল্টে বিরক্তি প্রকাশ করলাম। খেতে খেতে অনেক প্রশ্নই করল ইশিকে। যে সে একা কেন এসেছে? স্বামীকে কেন আনে নি?
কেমন নির্লজ্জ টাইপ যেন। না বলে না কয়ে বেহায়ার মতো একা একা চলে এসেছে। ব্যাপার টা আমার মোটেও ভালো লাগছে না। এ কেমন কথা? বিয়ের দু’মাস হতে না হতেই একা একা না বলে কয়ে চলে এসেছে কোন সম্পর্কের ধরা-বাঁধা ছাড়া?

খেয়ে দেয়ে আমি আর মিহির ছাদে চলে এলাম। কিন্তু গপ্পের আসর টা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বেয়াদ্দপ মেয়েটা এসে যোগ দিল, ‘হ্যালো মিহির। কী করছ?’

মিহির বিরক্তির সাথে প্রকাশ করল, ‘দেখতেই তো পাচ্ছেন কী করছি।’

‘হুম। আচ্ছা ও এখানে কী করছে মিহির?’

‘ও এখানে কী করছে তা নিয়ে আপনার কাজ কী? আপনি গেস্ট হিসেবে এসেছেন গেস্টের মতোই থাকুন না।’

‘এভাবে বলছ কেন মিহির?’

‘তো কীভাবে বলব? আপনি এমন প্রশ্ন কেন করবেন?’

‘উফ মিহির। ভাবীর সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে?’

হেসে ফেললাম। ভাবী? যাক এখন কিছু বললাম না। আগে তার উদ্দেশ্য জানব। তারপরই তো সব প্রকাশ করব। অপমান করতে খুব মজা লাগবে। হাহা! মিহির বিরক্তি প্রকাশ করল আবারো। বলল, ‘দেখুন। আমি আপনার সাথে ঠিক ভাবেই কথা বলছি। দয়া করে এখান থেকে যান। আপনার এখানে অ্যাড হওয়াও লাগবে না, এখানে থেকে উল্টাপাল্টা কথা বলাও লাগবে না।’

ইশি অপমান বোধ করল। আমাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেঁপে চলে গেল। আমি আর মিহির হেসে ফেললাম।
ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘আচ্ছা তোমার কী মনে হয় মিহির? ও কেন এসেছে এখানে? তাও আবার.. কাউকে ছাড়া। একা এসেছে।’

‘আমি সেটাই বুঝার চেষ্টা করছি। কো উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে এখানে?’

‘দেখা যাক কী করে এই মেয়েটা। উদ্দেশ্য ভালো ঠেকছে না।’

‘হুম।’

.

সন্ধ্যা সাত টা। কলিং বেল বাজতেই হাসি মুখে দরজা খুলে দিলাম। তাহসিন ভেতরে প্রবেশ করলেন। আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললেন, ‘কেমন কাঁটল আজকের দিন?’

‘জ্বী ভালো। আপনার?’

‘হুম।’

‘ফ্রেশ হয়ে আসুন। আপনার জন্য আপনার ফেভারিট ফালুদা করেছি।’

‘সত্যি? ওপস! থ্যাংক ইউ ইবনাত।’

‘আচ্ছা যান।’

তাহসিন উপরে চলে গেলেন। মাগরীব প্রায় শেষ কিন্তু এই ইশি এখনো যায় নি। বুঝতে পারছি না কিছু। আজ কী থাকাত উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে নাকি? মিহিরকে প্রশ্ন করলাম, ‘ব্যাপার কী মিহির? এই ইশি কী যাবে না?’

‘বোধহয় যাবে না ভাবী৷ ব্যাগ নিয়ে এসেছে দেখেছিলাম ছোট থেকে।’

‘কীহ্? কী নির্লজ্জ! এভাবে কেউ থাকতে আসে তাও দু’দিনের চেনা বাড়িতে এসেছে থাকতে লেগেছে। কী বেহায়া?’

‘যাক আগে দেখি কী করতে চাইছে আসলে।’

‘হুম ওকে নজরে রাখতে হবে।’

তাহসিন ফ্রেশ হয়ে শুয়েছেন। আমি তার জন্য ফালুদা নিয়ে গেলাম। তিনি হাসিমুখে তা নিলেন। খেতে খেতে প্রশ্ন করলেন, ‘বাসায় কী কেউ এসেছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কে?’

‘রিশানের প্রাক্তন।’

‘কী? রিশানের প্রাক্তন মানে?’

‘মানে রিশান আমায় ছেঁ’ড়ে যাকে বিয়ে করে নিয়েছে সে।’

‘কেন এসেছে?’

‘ননদের কাছে এসেছে।’

‘ওহ্। থাকবে নাকি আজ?’

‘জানি না। কিছু বুঝতে পারছি না।’

তাহসিন কিছু বললেন না। তার এঁটো প্লেট টা নিয়ে নিচে নেমে এলাম।

.

নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো তাহসিন। সিড়ির গলি দিয়ে তাকে আসতে দেখে ইশি হাসল। কিছু একটা ভেবে এগিয়ে গেল। তাহসিন ফোনের দিকে তাকিয়েই আসছিল। এবার ইশি ইচ্ছে করে ধাক্কা খেল। তাহসিন কিছু বুঝে উঠার আগেই ইশি তাকে আঁকড়ে ধরল। তাহসিন বুঝতে পারল কোন পরনারী তাকে স্পর্শ করেছে। তাহসিন ইশির এমন কান্ডে বিরক্ত হলো। বিরক্তিতে ‘হোয়াট দ্যা হেল’ বলেই দ্রুত ইশির হাত ছাড়ালো। এতে ইশি ব্যালেন্স রাখতে না পেরে নিচে পড়ে গেলো। তাহসিন বলল, ‘দেখে চলাফেরা করতে পারেন না নাকি? আর আপনি? আপনি এখানে কী করছেন?’

‘উফ! পড়ে গেছি। কোথায় তুলবেন তা না প্রশ্ন করছেন আমি এখানে কী করছি?’

‘কেন আপনার শক্তি নেই? হাত পা নেই উঠার?’

ইশি দাঁতে জিভ কেঁটে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘কেমন আছেন?’

‘ভালো আছি।’

‘জিজ্ঞেস করবেন না আমি কেমন আছি?’

‘আমি দেখতেই পাচ্ছি আপনি ভালো আছেন তাই প্রয়োজন মনে করছি না।’

বলেই পাশ কাঁটিয়ে চলে গেল নিচে। ইশি বলতে নিল, ‘আরে শুনুন!’

কিন্তু তাহসিন শুনে না। ইশি নিজেই নিজের মাথায় বারি দিল, ‘ধুর তুই আসলেই গর্দভ! কোথায় মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ফাঁদে ফেলবি তা না। উল্টাপাল্টা কথা বলছিস কেন? ধুর!’
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ্]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে