অপ্রাপ্তি পর্ব-২২

0
1219

#অপ্রাপ্তি 💔
#ইবনাত_আয়াত
~ পর্ব. ২২

আজ খুব মেঘ জমেছে আকাশে। বজ্রপাত হচ্ছে। একটু পর বর্ষন শুরু হলো। সাথে তাহসিনের নেত্রপল্লবেও বর্ষনের ধারা বইতে লাগল। চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘হৃদরাণী কোথায় তুমি? কেন এভাবে আমায় ফেলে চলে গেলে? কোথায় লুকিয়ে আছো? প্লীজ বেরিয়ে এসো লুকোচুরি খেলো না। তুমি জানো আমি এসব পছন্দ করি না। আমার ইমোশন নিয়ে খেলছ? দয়া করো প্লীজ বেরিয়ে এসো।’

কাঁদতে লাগল তাহসিন। একটু পর নিজেকে শান্ত করল কিন্তু অশ্রুপাত যেন বন্ধই হচ্ছে না। হঠাৎ তার মাথায় কিছু একটা আসতেই সে থমকে দাঁড়াল। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল, ‘রিশান! এতদিন অনেক সহ্য করেছি। আর নয়। তোকে আজ আমি ছাড়ব না। যদি আমার হৃদরাণীর কিছু হয় তো আজ আমার চেয়ে খারাপ লোক আর এই পৃথিবীতে কেউ হবে না।’

নিজেকে শক্ত করল তাহসিন। ব্যাগ আর ফুলগুলো একটা তার চেনা গুপ্ত জায়গায় রেখে চোখ মুছে সেই জায়গায় আবার আসল। ফ্ল্যাশলাইট অন করে সব জায়গা সার্চ করতে থাকল। এই রাস্তায় সচরাচর কেউ যাওয়া আসা করেনা। হঠাৎ তাহসিনের কিছু চিহ্নের উপর চোখ পড়ল। জুতার দাগ। যদিও জুতোর দাগের অভাব নেই এখানে। কিন্তু এই দাগ টা অন্য কোথাও যাচ্ছে। তাহসিন সন্দিহান ভাবে এগিয়ে গেল তা ফলো করতে করতে। কিন্তু…

.

‘দেখো রিশান প্লীজ এমন করো না। প্লীজ আমায় ছেঁ’ড়ে দাও তোমার কাছে হাতজোড় করছি প্লীজ!’

‘না ইবুপরি! আমার কাছে আর কোন রাস্তা নেই। তোমাকে নষ্ট না করা ছাড়া কোন উপায় আমার নেই।’

কেঁদে ফেললাম আমি, ‘প্লীজ রিশান ছেঁ’ড়ে দাও। আমাকে উনার কাছে নিচু করো না প্লীজ। কেন এমন করছ আমার সাথে? কী করেছি আমি তোমার সাথে? তিন টা বছর নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছি। কোন দাম দাও নি। ঠিকই অন্যকে বিয়ে করে নিয়েছ। তাহলে এখন কেন আমার সাথে এমন করছ বলো?’

‘তোমাকে আমার চাই ইবনাত। যেকোন মুল্যে হোক। একবার তোমাকে হারিয়েছি। এবার পেয়েও হারাতে চাই না।’

‘তারমানে আমার দেহ চাও তুমি?’

রিশান থমকে গেল। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। সে বলল, ‘চাই তো তোমার মন। কিন্তু তা তো এত সহজে পাব না।’

‘হ্যাঁ ঠিক বলেছ এত সহজে কেন? কোনদিনও পাবে না কারণ আমার মনে এখন অন্যের বসবাস শুনেছ?’

রিশান আবারো এগিয়ে আসতে লাগল। এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। তার মতো নোংরা এমন কাজ করতে দু’বার ভাববে না। পা খোলাই ছিল। জানি না কেমন বে-আকুবী করে সে আমার পা খোলা রেখেছে। কাছে আসতেই সজোরে লাথি মারলাম তার পায়ে। দূরে গিয়ে ছি’টকে পড়ল সে। পায়ে বেশ লেগেছে। উঠতেই পারছে না ভালোভাবে। সে চেঁচিয়ে বলল, ‘এটা কী করলি তুই?’

‘ছাঁ’ড়ো নয়তো অনেক ক্ষ’তি হবে তোমার।’

রিশান ওঠার চেষ্টা করল কিন্তু কোনমতে পারল না। পা ধরে বসে পড়ল। এদিকে তার এই অবস্থায় কোনমতে বাঁধন খোলার চেষ্টা করছি কিন্তু হয়ে উঠছে না। ঘষা’ঘষি করে একটু হালকা করলাম বাঁধনটা। হালকা হতেই হাত সরিয়ে ফেললাম। অন্য হাত তাড়াতাড়ি খোলে উঠে দাঁড়ালাম। রিশান চিল্লিয়ে বলল, ‘ইবনাত দাঁড়াও! ইবনাত!!!’

রিশানের দিকে ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমি নির্লজ্জ, খারাপ জানতাম। কিন্তু এতটা খারাপ সেটা জানতাম না। ছিঃ!’

তার মুখে থু থু ছুঁ’ড়ে বেরিয়ে এলাম। দৌড়াতে লাগলাম। বাসায় পৌছাতে হবে আমাকে। কিন্তু এটা কোন জায়গা? রাত হওয়ায় তেমন চিনতে পারছি না। এ কোথায় ফেঁসে গেলাম আমি? ইয়া আল্লাহ্ রক্ষা করো। খুড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেকটা দূর এসে পৌছেছি। একটা সরু রাস্তায় পৌছালাম। বসে পড়লাম সেখানে। আর চলার মতো শক্তি আমার নেই।

.

তাহসিন দাগ টা অনুসরণ করতে করতে একটা ঘরের সামনে পৌছাল। আশার আলো জাগল মনে। নিশ্চয়ই তার হৃদরাণী এখানে আছে। তাহসিন এগিয়ে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। তাহসিন দেখল দরজা বন্ধ আর ভেতরে লাইট জ্বলছে। আস্তে করে জানালায় উঁকি দিতেই সে থমকে গেল। নাহ্ এখানে তার হৃদরাণী নেই। কিন্তু একটা মেয়ে বাঁধা অবস্থায় আছে। তার সামনে দু’টো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে আর বি’শ্রি কথা বলছে। উদ্দেশ্য ভালো নয় তাহসিন বুঝতে পারল। একবার ভাবল, তারই বউ বিপদে তাহলে তাকে ফেলে ওকে কেন বাঁচাবে? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, মেয়েটাও তো বিপদে। তাকে ফেলে কীভাবে যাবে সে? আশেপাশে কিছু খুঁজল। ঢিল জাতীয় কিছু পেয়ে জানালা দিয়ে ছুঁ’ড়ে মারল। গিয়ে পড়ল একজনের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে সে মাথায় হাত দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই কে রে?’

তাহসিন চুপ করে তাদের কার্যকলাপ দেখতে লাগল। তারা আবারো নিজ কাজে মন দিল। তাহসিন আবারো একটা ঢিল ছুঁ’ড়ে মারল। এবারও সেই লোকটার মাথায়ই পড়ল। তারা এবার সন্দেহের চোখে একে অপরের দিকে তাকাল। তারপর দরজার দিকে এগিয়ে এলো। তাহসিন তো এটাই চাইছিল। তারা দরজা খোলে বেরিয়ে আসতেই হাতে থাকা গাছের ভাঙা ডাল দিয়ে সজোড়ে একজনের মাথায় আ’ঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অন্যজন কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকেও আ’ঘাত করতেই সেও মাটিতে পড়ে গেল। দু’জন অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাহসিন দ্রুত গিয়ে মেয়েটার হাতের বাঁধন খুলতে গিয়ে থমকে গেল। এ তো ইশি! তাহসিন অবিশ্বাসের সাথে প্রশ্ন করল, ‘আপনি?’

ইশি চমকে বলল, ‘আপনি আমায় চেনেন?’

‘কেন চিনব না? আপনি মিহিরের ভাবী না?’

‘মিহির কে চেনেন আপনি?’

‘হ্যাঁ ও আমার ভাইয়ের স্ত্রী।’

‘কীহ্? তাহলে আপনি মিহিরের ভাসুর?’

তাহসিন তার বাঁধন গুলো খোলে দিয়ে মাথা নাড়ল। ইশি ছা’ড়া পেয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার জান বাঁচিয়েছেন। এরা তো আমার ইজ্জত আজ নিয়েই নিচ্ছিল।’

বলতে বলতে গায়ে পড়ছিল তাহসিনের। ব্যাপার টা তার মোটেও ভালো লাগল না। সে সরে গিয়ে বলল, ‘আহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে। কিন্তু এই অবস্থা কেন আপনার? কীভাবে হলো এসব?’

‘আসলে আমি পার্টিতে গিয়েছিলাম। এই গলি দিয়ে আসছিলাম তখনই ওরা আমায় তুলে নিয়ে এলো।’

‘আচ্ছা। ঠিক আছে আপনি যান।’

‘কিন্তু আমি একা কীভাবে যাব? আবার যদি হামলা করে?’

তাহসিন আশাহত হলো। সে তো ইবনাতের খোঁজে এসেছে। এই নতুন ঝামেলা। সে আগে গিয়ে লোক দু’টোকে তুলে এনে চেয়ারে বেঁধে দিল। ইশিকে বলল, ‘আপনি পুলিশ কে ফোন করে আসতে বলুন। আমি যাচ্ছি।’

‘আরে আরে..’

তাহসিন তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। এদিকে ইশি ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘হাউ হ্যান্ডসাম! এর সাথেই আমাকে মানাবে।’

তাহসিন কিছু দূর গিয়ে হঠাৎ আবারো থমকে দাঁড়াল। রিশান একটা ঘর থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বের হচ্ছে। তাহসিন দ্রুত গিয়ে রিশানের কলার চেঁপে প্রথমেই একটা ঘুষি বসিয়ে দিল। তারপর তার কলার ধরে ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ইউ ব্লাডি বিচ! বল ইবনাত কোথায়? বল!’

একেতো পায়ে ব্যথা তার উপর ঘুষি, পর পর এত আঘাত নিতে পারল না রিশান, ‘ও.. ও পা-লিয়ে গে-ছে।’

তাহসিন চমকে বলল, ‘হোয়াট? তার মানে তুই ওকে এখানে এনেছিস?’

‘হ-হ্যাঁ।’

‘ওহ্ নো। কোথায় গেছে ও?’

‘জানি না।’

‘ড্যাম ইট!’

বলেই আরো একটা ঘুষি বসিয়ে দিল ওর নাক বরাবর। রক্ত ছুটতে শুরু করল তার নাক দিয়ে। তাহসিন পুলিশকে ফোন দিল। প্রায় দশ মিনিটের মধ্যেই ইমার্জেন্সি পুলিশ চলে এলো। তাহসিন রিশানকে তাদের হাতে ধর্ষক হিসেবে ধরিয়ে দিল। তারপর বেরিয়ে পড়ল ইবনাতের খোঁজে।

.

অনেক্ষণ যাবৎ বসে রইলাম। পায়ে কাঁটা বিঁধেছে। তাই উঠে দাঁড়াতে পারছি না। হঠাৎ সামনে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়ালাম। রাস্তার উপারে তাহসিন! সত্যি এটা উনি? উনি এসেছেন আমায় বাঁচাতে? দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। কাঁটা ঢুকা জায়গা টায় বেশ জ্বালা করছে। তবুও আমাকে তো উনার কাছে যেতেই হবে। আমি ‘তাহসিন’ বলে চেঁচিয়ে ছুটে গেলাম। রাস্তা যে পার হচ্ছি তা ভুলেই গেছি। দ্রুত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম। এদিকে আমার ডাক শুনে তাহসিন আমার দিকে ফিরেছেন। তিনি অবাক হলেন। তারপর আমার দিকে হেসে এগিয়ে আসতে নিলে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ইবনাত! সরে যাও। ইবনাত!!’

আমি থমকে দাঁড়ালাম তার এমন ভয়ার্ত মুখ দেখে। হঠাৎ ধাক্কা খেলাম আমি সজোড়ে। ছি’টকে পড়লাম রাস্তার উপারে। শক্তি হারিয়ে ফেলেছি আমি। বড় একটা ট্রাকের ধা’ক্কা লেগেছে।
সারা রাস্তা রক্তে মাখামাখি। অবশ হয়ে আসছে শরীর। এদিকে তাহসিন ‘ইবনাত!!’ বলে চিল্লিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তিনি এসে আমার মাথা টা কোলে নিয়ে বললেন, ‘এ-এটা কী করলে.. তুমি? দেখ.. হৃদরাণী তোমার কিছু হবে না.. আমি আছি না?’

তিনি কাঁদছেন? কিন্তু.. তার কথা আর শুনতে পাচ্ছি না আমি। চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে এলো আমার। হয়তো আমার এই দুনিয়ায় ভ্রমণ শেষ!
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ্]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে