অপ্রাপ্তি পর্ব-২০

0
1169

#অপ্রাপ্তি 💔
#ইবনাত_আয়াত
~ পর্ব. ২০

রাত্রির প্রথম ভাগ। আধফালি চাঁদের হাসিতে মেতে আছে আকাশ। জ্বলজ্বলিত অজস্র তারা তাকে আরো সুন্দরে পরিণত করছে। তার দিকে মুখ করে রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিহির।

‘উহুম! মিহুপরি ঘুমাবে না?’

চমকে উঠল মিহির। পাশ ফিরে তানসীবকে দেখতে পেল। হেসে বলল, ‘আপনি যাবেন না?’

‘আসলে কী জানো? আমার না ঘুম হবে না।’

‘কেন?’

‘এতদিন একা একা শুয়েছি। আর এ ক’দিন বউ পেয়ে তার সঙ্গে শুয়েছি। তাই এখন বউ ছাড়া ঘুম আসে না।’

মিহির চোখ বড় বড় করে বলল, ‘কী বলছেন এসব আপনি?’

‘এই যা কী বললাম আবার?’

‘কিছু না।’

মিহির আবারো আকাশে মনোযোগ স্থাপন করে। তানসীব তার পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘কী হয়েছে মিহু? মন খারাপ?’

‘না না। মন খারাপ হবে কেন? আপনার মতো একজন বন্ধু পেলে মন খারাপ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।’

‘আচ্ছা? সত্যি আমায় বন্ধু ভাবো?’

‘কেন ভাববো না?’

‘না মানে আমি ভেবেছি তুমি আমায় সহ্যই করে পারো না।’

‘এই কী বলছেন এসব?’

‘কী?’

‘আমি আপনাকে সহ্য করতে পারব না কেন?’

‘ঠিক’ই তো বললাম।’

‘দেখুন প্লীজ উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না।’

‘উল্টাপাল্টার কী আছে গো বউ?’

‘কিছু না।’

হঠাৎ তানসীব কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘তাহলে বলে দাও না, ভালোবাসি!’

সর্বাঙ্গে কাঁপন ধরল মিহিরের। তানসীবের দিকে তাকানোর মতো সাহস নেই। এ কী বলল সে?

‘এ-এসব ক-কী বলছেন আপনি?’

‘কনফেস করতে বলছি।’

‘কনফেস করার মতো কিছু তো নেই।’

‘সত্যি ভালোবাসো না?’

মিহির মাথা নিচু করে বলল, ‘এর উত্তর আমার কাছে নেই।’

‘কেন নেই?’

‘জানি না।’

‘ঠিক আছে। তবে একদিন না একদিন তোমাকে বলতেই হবে মিহুরাণী।’

মিহির কিছু বলল না। তানসীব দূরে সরে গিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘শুতে আসো।’

.

‘এটা কে ইশি?’

ইশি চমকে যায় রিশানের কথা শুনে। রিশানের দিকে তাকাতেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। তার চুল উষ্কখুষ্ক। চোখ দু’টো ভীষণ রকমের লাল হয়ে আছে। যেন সে, সে রেগে আছে। পরণের শার্টের অবস্থাও ঠিক নেই। হাতে ইশির মোবাইল দেখে আরো বেশি চমকে গেল। ইশি আমতা আমতা করে বলল, ‘ক-কী রিশান?’

রিশান রেগে বলল, ‘আমি বলেছি এটা কে?’

ইশি আবারো কেঁপে উঠল। বলল, ‘ক-কোনটা?’

‘তোকে কী এখন যত্ন করে তুলে দেখাতে হবে? দেখতে পাচ্ছিস না?’

অনেক জোরে চেঁচিয়েই বলে রিশান। ইশি আরো ভয় পেয়ে যায়। রিশান এবার তার মোবাইল টা তার চোখের সামনে ধরল। ইশি এবার শেষ, যার ভয় ছিল তা সত্যি হলো। রিশান জেনে গেছে সব। ইশি ঢোক গিলে মোবাইলের দিকে তাকাল। সেখানে একজনের সঙ্গে ১৮+ কিছু চ্যাটের দৃশ্য, প্রেমমূলক চ্যাটের দৃশ্য আর মিসড কল। যেখানে তার নাম সেভ করা ছিল ‘বাবু’ দিয়ে। সত্যিই বিরক্তিকর। এখনকার ছেলে মেয়েরা কত টা অবনতির দিকে যাচ্ছে। গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড জোটাচ্ছে, এক এক বি’শ্রি নামে সম্বোধন করছে।

‘কী এসব? হ্যাঁ? বল শয়তান এসব কী? এসব চলছে তাহলে? আমার অগোচরে এসব চলছে? কী ভেবেছিলি আমি কিছুই জানতে পারব না? হা? বল! নাগর জুটিয়েছিস না? নতুন নাগর? এখন আমায় ভালো লাগে না। না?’

ইতোমধ্যে তার চিৎকারে সবাই তাদের রুমে এসে পৌছেছে। রাহেলা বেগম, নিশাত, রুমি আর রবিউল হাসান থমকে দাঁড়িয়ে রইল। রিশান এবার জোরে থাপ্পড় মারল ইশিকে। ইশি এবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ভালো লাগে না। ভালো লাগে না আমার তোমাকে। ভালোবাসি না এখন। আগে বাসতাম কিন্তু এখন না। ক্ষ্যাত মার্কা ছেলে তুমি। সারাদিন অফিসে বসে থাকো। ঘরে এসে কোথায় আমায় নিয়ে ঘুরতে যাবে, পার্টি করবে তা না। সারাদিন অফিসে বসে থেকে ফিরে এসে মোবাইল নিয়ে গুতাগুতি আর ঘুম৷ কী? আর কিছু আছে তোমার মাঝে? আর কোন গুণ আছে? ফিরে এসেই বলে, আমায় কফি দাও শরবত দাও। আমায় কী তোমার ওই আগের মডেলের বউ পেয়েছ? যে যা বলবে তাই করব? যেন চাকরানী তোমাদের। একটু বাহিরে বের হলেই তোমার আর তোমার ক্ষ্যাত মা’য়ের ফালতু কথায় টিকে থাকা যায় না। কী ফালতু কালচার!’

রিশানের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত বাকিরা হতভম্ব হয়ে গেল। কী বলছে এসব ইশি? রাহেলা বেগম মোটেও অবাক হন নি। তিনি জানেন ইশির মাঝে কোন না কোন ঝামেলা আছে। তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ইশি এবার উঠে গিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বের করল। রিশানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘নাও সাইন করো। মুক্ত করো আমাকে। আর পারছি এই ফালতু ক্ষ্যাত আর অসহ্যকর পরিস্থিতে থাকতে। কী দেখে এসেছি আল্লাহ্ মালুম।’

রিশান দেখল এটা ডিভোর্স পেপার। অবাকের চরম সীমানা পেরিয়ে গেল রিশানের৷ অবিশ্বাস্য স্বরে বলল, ‘এসব কী ইশি? কবে করলে?’

‘সে তো প্রায় তিন মাস ধরেই করে আসছি। পরশু দিন পেয়েছি। কিন্তু বলার সুযোগ হচ্ছিল না। আজ পেলাম তাই কাজে লাগিয়ে নিচ্ছি। নাও এবার সাইন করো।’

‘ত-তুমি এমন.. করতে পারো না ইশি!’

‘আমি সব পারি। এখন সাইন করো।’

রাহেলা বেগম এগিয়ে এসে রিশানকে শক্ত মুখে বললেন, ‘সাইন কর রিশান! এসব নষ্টা মেয়েকে ঘরে রাখার কোন মানে হয় না।’

ইশি চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘আপনি কাকে নষ্টা বলছেন? আমাকে? তাহলে আপনি কী? একজন খুনি? যে কী না নিজের আপন ছেলের প্রথম বউকেই খাবারে বিষ মিশিয়ে মারতে চেয়েছিলেন।’

রাহেলা বেগম থমকে গেলেন। ইশিও তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে কী ছিলো? কেমন ছিলো? কী করেছিল? রাহেলা বেগম রিশানকে ইশারায় সাইন করতে বলে। রিশান একবার মা’য়ের দিকে তাকিয়ে আরেকবার ইশির দিকে তাকিয়ে বিষন্ন মনে সাইন করে দিল। ইশি তার গুছিয়ে রাখা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। ইশি রুমিকে পাশ কাঁটিয়ে যাওয়ার সময় রুমি দাঁতে দাঁত চেঁপে শক্ত মুখে বলল, ‘এর সাজা তুমি পাবে।’

ইশি মুখ ভেংচি দেয়। তারপর বেরিয়ে গেল সেই নরক ছেড়ে, যা ছেড়ে আরো একজন বেরিয়ে এসেছিল বাঁচতে।
রাহেলা বেগম এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও ইশি বেরিয়ে যাওয়ার পর ছুটে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। তার খুব অনুশোচনা হচ্ছে সে’দিনের পর থেকে, যে’দিন ইবনাত রিশানকে ডিভোর্স দেওয়ার সময় কেঁদে কেঁদে সেই কথাগুলো বলেছিল। তিনি সে’দিনই বুঝতে পেরেছিলেন, আসলেই তিনি খুব বড় ভুল করেছিলেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে কপাল চাঁপড়িয়ে বললেন, ‘সত্যি রে মা। আমি মা নামে কালি লাগিয়েছি। আমি তোর সাথে অনেক অন্যায় আচরণ করেছি। মেরেও ফেলতে চেয়েছি। আমায় শয়তানে ধরেছিল। আমি আর পারছি না এসব কষ্ট নিতে। আল্লাহ্ আমার মরণ দাও তুমি আমার মরণ দাও আমি আর বাঁচতে চাই না গো। ইবনাত!! আমায় মাফ করে দিস রে। আমি এই কষ্ট আর সইতে পারছি না।’

অন্যদিকে রিশান! বদ্ধ রুমে বসে আছে সে। সে যেন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এই কী সেই ইশি? যে তাকে সব উজাড় করে ভালোবাসতো। এই কী সেই ইশি যার জন্য সে এক মূল্যবান জিনিস হারিয়েছিল। এই কী সেই ইশি যার জন্য সে ইবনাতকে অপমান করেছিল, বিচ্ছেদ করেছিল?

রিশান চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। ভাঙা হলায় চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘কেন আমি এমন করলাম? কেন কেন কেন? আমি কী লুজার? ইবনাতও আমায় ছেড়ে চলে গেছে এখন ইশিও? আমি কেন ধরে রাখতে পারিনি? কেন? আমার সাথেই কেন এমন হলো? ইবনাত! সত্যি আমি ভালো নেই। আমার ভালো থাকার জন্য তোমাকে চাই। প্লীজ ফিরে এসো। প্লীজ! আমি যে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। ইবনাত! আমায় ক্ষমা করে দাও প্লীজ ফিরে এসো।’

এরপর হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। চোখ মুছে শক্ত হয়ে বলল, ‘ইবনাতকে তো আমি আবার ফিরিয়েই আনব। এতে যা করার লাগে আমি করব। ও অন্য কারো হবে তা রিশান দেখবে? না না। ওকে তো আমি আবার আমার করেই ছাড়ব।’

.

প্রায় আরো দু’মাস, আমার জীবন থেকে চলে গেছে।
তাহসিন আর আমার মাঝে আগের মতোই সম্পর্ক। স্বাভাবিক। এ ক’দিনে তাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু.. জড়তা আর লজ্জার কারণে বলতে পারছি না। আচ্ছা সে কী ভাবে? সে কী আমায় স্ত্রী হিসেবে মানে? আমায় কী পছন্দ করে? আমায় কী…. ভালোবাসে? জানি না। হয়তো বা হয়তো না। জানি না আমার ভাগ্যে কী লেখা আছে। তবে আজ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি কনফেস করব। তাকে বলব যে আমি তাকে ভালোবাসি। হ্যাঁ আমি বলব আজ। সকালে স্কুলে আসার পর থেকেই ভেবে যাচ্ছি কীভাবে কী করব। নাহ্ আজ আমার বলতেই হবে যে, ড. সাহেব খুব ভালোবাসি আপনাকে।

স্কুল ছুটির পর বের হলাম। মন দুলে উঠছে যে আজ তাকে বলব।
বাসা থেকে দুই ভাবে আসা যাওয়া করা যায়। মেইন রোড দিয়ে নাহয় গলি দিয়ে। কিন্তু আমি গলি দিয়ে যাওয়া আসা করি না। হঠাৎ দেখলাম গলিতে ফুলের দোকান বসেছে। ভাবলাম তার জন্য পড়ব। যেই ভাবা সেই কাজ। গিয়ে একটা বেলি ফুলের মালা আর জুঁই ফুলের গাজরা কিনলাম। টাকা দিয়ে ভাবলাম এদিক দিয়েই চলে যাব।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ, কেউ পেছন থেকে মুখ চেঁপে ধরল আমার। অনেক ধস্তাধস্তি হলো আমাদের মাঝে। এদিকটা নির্জন তাই কেউ টের পায় না৷ সে অগান্তক ক্লোরোফর্ম যুক্ত কাপড় দ্বারা আমার মুখ চেঁপে ধরেছিল। যার দরুন মাথা ঘুরতে শুরু করল। শক্তি যেন লোপ পেয়েছে। ঢলে পড়লাম তার বুকে। এক পরিচিত সুবাস নাকে এলো। বেলি ফুল আর জুঁই ফুল দু’টো সেখানেই পড়ে রইল।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ্]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে