#অপ্রাপ্তি 💔
#ইবনাত_আয়াত
~ পর্ব. ১৫
বিয়ের ঝামেলা শেষ হলো। প্রায় দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। তনিমা আপুও চলে গেছে। তার বিয়ে হয়েছে প্রায় তিন বছর। একটা ছেলেও আছে। আর এখন আমি তাহসিন আর তাহসিনের মায়ের আদেশেই স্কুল কন্টিনিউ করছি। এতে প্রতিবেশীর সমালোচনার শেষ নেই। তাদের মন্তব্য এমন যে, প্রথমত একজন পূর্ব ডিভোর্সীকে তারা তার ছেলের বউ বানিয়েছে। দ্বিতীয়ত আমাকে তারা পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে স্কুলে শিক্ষকতা করার অনুমতি দিয়েছেন। এটা যেন তাদের সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু মা সঠিক জবাবই দিয়েছেন, আমাদের ছেলের বউ। আমাদের যেমন ইচ্ছা তেমনই চলাব ওকে। কারো কোন সমস্যা আছে? তারা চুপ করে প্রস্থান করে।
.
স্কুল থেকে বেরিয়ে আসতেই মিহিরকে দেখতে পেলাম গেটের পাশে। দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেলাম। ‘মিহির’ বলে তাকে জড়িয়ে ধরলাম, ‘কেমন আছো মিহির?’
‘ভালো আছি আপু। তুমি কেমন আছো?’
‘এই তো ভালো আছি৷ তাহলে স্কুল চলছে?’
‘হুম তা তো চলছে।’
‘বাহ্। ভাইয়া আর আন্টি তাহলে করতে দিল তোমায়? বেশ ভালোই আছো আপু। আমাদের টাই তো নরকে পরিণত হচ্ছে।’
‘যাক সেসব ভেবে লাভ নেই মিহির। আচ্ছা চলো। বাসায় চলো।’
‘আরে না আপু। আজ নয়। এমনি চলো রেস্টুরেন্টে বসি।’
‘আচ্ছা চলো।’
দু’জন স্কুলের সামনেই রোডের অপজিট সাইডে থাকা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। খাবার অর্ডার দিয়ে মিহির বলল, ‘আপু। ওরা সত্যিই আমায় কলেজ পড়তে দেবে না।’
‘মানে?’
‘বিয়ে নিয়ে আজকাল অনেক কথা বলছে ওরা আমার। আমার নাকি বয়স অনেক হচ্ছে। এখন ঘর থেকে বিদেয় হওয়া উচিত আরো কত! আমার তো ইচ্ছে করছে পালিয়ে যেতে।’
‘পাত্রের খোঁজ পেয়েছে?’
‘নাহ্ এখনো অবদি না।’
‘তুমি না করছ না?’
‘না করেছি। কিন্তু তারা শুনছে না।’
‘চিন্তা করো না মিহির। তুমি আমার সঙ্গেই থাকবে।’
মিহির তাচ্ছিল্য হেসে বলল, ‘তোমার সঙ্গে? ওদিন বলেছিলাম, যদি নিজেদের থেকে দূরে রাখতে চাও তাহলে বলো। আমি নিজেই চলে যাব। কিন্তু তারা বলেছে, তারা আর দু’মাসের মধ্যেই আমার বিয়ে ঠিক করবে।’
‘বললাম তো মিহির। চিন্তা করো না। তুমি আমার সঙ্গেই থাকতে পারবে। শুধু অপেক্ষা, আর ধৈর্য ধরো। দেখবে, সবুরে মেওয়া ফলে।’
‘তুমি কী করতে চলেছ আপু?’
‘দেখে যাও। আচ্ছা! চলো বাসায় চলো।’
‘না আপু এখন না।’
‘হুম এখন না। তবে একদিন তো আসতেই হবে। হয় একদিনের জন্য, নয় আজীবনের জন্য।’
‘মানে?’
‘আরে এমনি মশকরা করলাম বোনু। আচ্ছা তাহলে এখন যাও। ফিরে যাও।’
‘আল্লাহ্ হাফেজ আপু।’
‘আল্লাহ্ হাফেজ।’
মিহির চলে যেতেই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গভীর ভাবনায় মনোযোগী হলাম। মিহিরের জন্য কিছু তো করতেই হবে।
.
এদিক ওদিক হাসফাস করছি। তাহসিন ওপাশ ফিরে আছেন৷ ঘুম কী না বুঝতে পারছি না। ভাবতে ভাবতে উঠে বসলাম। নিস্তব্ধ রাত। সব প্রাণীই ঘুমে মগ্ন আমি আর কুকুর ছাড়া। সে ডাকছে বহুদূর থেকে। বারান্দায় মানে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রায় কিয়ৎক্ষণ কাঁটল। হঠাৎ শুনতে পেলাম তাহসিনের গলা, ‘এই মেয়ে তুমি এখানে কী করছ?’
ইতোমধ্যে তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি আবারো প্রশ্ন করলেন, ‘ইবনাত। এখানে কী করছ তুমি? ঘুমাচ্ছ না কেন?’
‘এমনি ঘুম আসছে না।’
‘কেন?’
‘জানি না।’
‘ঘুম আসবে। চলো রুমে চলো।’
‘থাকি না একটু।’
‘উহু!’
‘আপনার ঘুম আসলে আপনি যান না।’
‘ওই’দিন যে আমায় ছা’ড়া যাচ্ছিলে না, আজও আমি তোমাকে ছে’ড়ে যাচ্ছি না।’
কিয়ৎক্ষণ নিরবতা। মৌনতা কাটিয়ে বললাম, ‘একটা কথা বলব তাহসিন?’
আমার মুখে ‘তাহসিন’ শব্দ টা শুনে বোধহয় বেশ চমকালেন উনি। বললেন, ‘কী বলো?’
‘তা.. [অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে] তানসীব ভাইয়ার বিয়ে কবে করাবেন?’
তিনি থতমত খেলেন। বললেন, ‘এটা কেমন প্রশ্ন?’
‘হ্যাঁ এটাও একটা প্রশ্ন। বলুন না।’
‘তার ঠিক নেই ইবনাত।’
‘কেন নেই? ওনি এখন সেটেল। বাবার অফিসেও বসেন ওনি। পরিপূর্ণ লাইনে আছেন। তাহলে থেমে আছেন কেন? তা’ছাড়া বয়সও তো কম হচ্ছে না।’
‘হুম তা তো ভেবে দেখিনি।’
‘একটা কথা রাখবেন?’
‘এভাবে বলছ কেন?’
‘বলুন না।’
‘কী বলো?’
‘তানসীব ভাইয়ার বিয়ে মিহিরের সঙ্গে ঠিক করুন। প্লীজ!’
‘মানে?’
‘প্লীজ। মেয়েটা খুব কষ্টে আছে। তা’ছাড়া যদি নিশাত আপুর মতোই তাকে কোন বয়স্ক লোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়। তাহলে ওর পুরো লাইফ টা’ই বর’বাদ হয়ে যাবে তাহসিন। প্লীজ না করবেন না।’
‘আব.. এভাবে আমার কাছে অনুরোধ করো না ইবনাত। তোমাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে না।’
‘তাহলে বলুন। আমার কথা রাখছেন?’
‘আচ্ছা আচ্ছা আমি বলব।’
হাত বাড়িয়ে বললাম, ‘প্রমিজ?’
তিনি কিছু আমার হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হাত মিলিয়ে হেসে বললেন, ‘পাক্কা প্রমিজ।’
হেসে দিলাম। বললাম, ‘ঠিক আছে। তাহলে কাল’ই এই বিষয়ে বলবেন।’
‘আচ্ছা এবার চলো। ঘুমুতে চলো।’
‘জ্বী।’
.
স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে এলাম। ইতোমধ্যে আব্বু, তাহসিন আর তানসীব ভাইয়া টেবিলে বসে পড়েছে। আমি আর আম্মুও গিয়ে বসলাম৷ খাওয়ার মাঝেই হঠাৎ তাহসিন বলে উঠলেন, ‘আব্বু, তানসীব। কিছু বলার ছিল।’
শুনেই ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি ফুঁটে উঠল। আব্বু প্রশ্ন করলেন, ‘কী?’
তাহসিন শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, ‘আমি.. তানসীবের বিয়ের বিষয়ে কিছু বলতে চাই।’
তানসীব ভাইয়া বিষম খেলেন। তাহসিন পানি এগিয়ে দিলেন। তানসীব ভাইয়া পানি পান করে বললেন, ‘এসব কী বলছ ভাইয়া? তোমার বিয়ে হয়েছে এখনো এক মাস হচ্ছে না তার মাঝে আমার বিয়ে.. কী এসব?’
তাহসিন গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আমার বিয়ে হয়েছে এক মাস হয়নি তাতে কী তোর বিয়ে আটকে থাকবে?’
তানসীব ভাইয়া অসহায় কন্ঠে বললেন, ‘হোয়াট ইজ ইট ভাইয়া? আমি এখনো ছোট।’
‘এক থাপ্পড় দিব ধরে একদম। তুই ছোট এখনো?’
‘ভাইয়া!!’
‘তানসীব।’
বাবার শীতল কন্ঠে সবাই নড়েচড়ে বসল। বাবা বললেন, ‘তোমার আর তাহসিনের বয়সে ডিফারেন্স কত? মাত্র তিন বছর। আর তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে। তাই আমি বলছি, এই বিষয়ে ভাবা উচিত।’
‘আব্বু তুমিও?’
‘হ্যাঁ আমিও। কেন অসুবিধা কিসের? তোমার কী কাউকে পছন্দ?’
‘না তা না কিন্তু..’
‘কোন কিন্তু না তানসীব। যা বলছে তাই হবে। ঠিক আছে তাহসিন। আমরা পাত্রী দেখা শুরু করব।’
তাহসিনকে ইশারা করলাম। তাহসিন বললেন, ‘অবশ্য আমার জানামতে একজন মেয়ে আছে। খুব ভালো। ওর সঙ্গে মানাবে ওকে। বলো তো তাদের বলতে পারি।’
‘কে? নাম কী? কিসে পড়ে?’
‘আপাতত.. এস’এস’সি দিয়েছে।’
‘কীহ্? এত ছোট মেয়েকে বিয়ে দিবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘না না। এভাবে তো চলবে না।’
‘আব্বু প্লীজ। মেয়েটা খুব ভালো জানো? আর ইবনাতের পরিচিত।’
‘কী বলো মা? কে হয় তোমার?’
আমি বললাম, ‘আব.. বোন হয় বাবা। খুব ভালো মেয়ে ও। তাই তানসীবের জন্য দেখছিলাম। তা’ছাড়া দেখতেও সুন্দর।’
‘কিন্তু এই বয়সে বিয়ে দিচ্ছে?’
‘ওর আর দু’মাস বাদেই আঠারো বছর পূর্ণ হবে।’
‘ওহ্ আচ্ছা। বাড়ী কোথায়?’
‘তার মানে কী আপনারা যাচ্ছেন ওখানে?’
‘হ্যাঁ তবে এখন না। আগে খোঁজ খবর তো নিই কী বলো?’
‘আচ্ছা ওর ব্যাপারে আমি আপনাকে সব ইনফরমেশন দেব বাবা।’
‘আচ্ছা।’
.
রাতে মিহিরকে ফোন দিলাম। রিসিভ হতেই সে বলল, ‘কী আপু? কেমন আছো?’
‘অনেক অনেক ভালো আছি মিহির। তুমি কেমন আছো?’
‘ভালো আছি। অনেক অনেক ভালো কেন?’
‘কী বলব তোমাকে আর। ধরে নাও সারপ্রাইজ।’
‘মানে?’
‘মানে তোমার জন্য সারপ্রাইজ।’
‘কী বলছ এসব? আমার জন্য আবার কিসের সারপ্রাইজ?’
‘সবর করো বনু সবর করো। অনেক বড় সারপ্রাইজ আছে।’
‘হুম। সারপ্রাইজ তো সেই অপেক্ষা করছে আমার জন্য।’
‘আহ হা! ওসব ভেবে আবার মন খারাপ করছ মিহির?’
‘নাহ্। সেসব আর ভাবি না।’
‘ওটা নিয়েই একটা সারপ্রাইজ আছে মিহির।’
‘মানে? বিয়ে নিয়ে?’
‘হুম।’
‘কী?’
‘এখন বলে দিলে কী চলবে? দেখে যাও কী হয়। তোমার বাবা মাও চমকাবে। তোমার বড় ভাইও চমকাবে দেখে নিও। আর আমিও আমার কিছু কার্য সেরে নিতে পারব। রেডি থেকো।’
‘মানে কী? কিসব যা’তা বলছ আপু?’
‘আচ্ছা যাক গে এখন রাখি। পরে দেখা যাবে। ভালো থাকার চেষ্টা করো কিন্তু।’
‘আরে আপু..’
কেটে দিলাম। এখন অনেক প্রশ্ন করবে আপাতত তার উত্তর দিতে পারব না। এদিকে তাহসিন রুমে প্রবেশ করলেন। বললেন, ‘কী ব্যাপার? এত হাসছ কেন?’
‘কী আর বলব। বোন টার জন্য এত ভালো কিছু হতে চলেছে। হাসব না?’
‘তা কী হতে চলেছে বলবেন মহারাণী?’
তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘সব তো আপনিই করেছেন। থ্যাংক ইউ ড. রিয়েলি থ্যাংক ইউ।’
‘আচ্ছা আচ্ছা। এখন শুয়ে পড়ো।’
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ্]