#অপ্রাপ্তি 💔
#ইবনাত_আয়াত
~ পর্ব. ০৪
হাতে টান অনুভব করতেই ঘুম ঘুম চোখে সামনে তাকালাম। রিশান হাত ধরে টানছে আর কিছু বলছে। কিন্তু ঘুমের ঘোরে কিছু শুনতে পাচ্ছি না। ঘুমের রেশ হালকা কাটতেই তার কথা কর্ণকুহরে বাজল। সে চিল্লিয়ে ডাকছে, ‘ইবনাত! ওঠো। ওঠো বলছি। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। কী হয়েছে ওঠছো না কেন?’
ঘুম ঘুম চোখে বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে? এত চেঁচামেচি করছো কেন? ঘুমাচ্ছি দেখতে পাচ্ছো না?’
রিশান চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ঘুমাচ্ছো মানে? ওঠো। আমার অফিসের দেরি হবে নাস্তা বানাও।’
আমি আবারো শুয়ে চোখ বুজে বললাম, ‘পারব না আমার এখন ঘুম পাচ্ছে। রুমিকে বলো।’
‘হোয়াট ইজ ইট ইবনাত? তোমার সাহস তো কম নয় তুমি আমার মুখের উপর না করছো?’
‘রিশান প্লীজ যাও এখান থেকে। প্রতিদিন প্রতিদিন সকালে উঠে নাস্তা বানাতে ইচ্ছা করে না। রুমিকে বলো ও বানাবে।’
‘ও কেন বানাবে তুমি থাকতে?’
‘আমি কেন বানাব ও থাকতে?’
‘দেখ ইবনাত মাথা খারাপ করো না যা বলছি তাই করো। যাও।’
‘দেখ রিশান মাথা খারাপ করো যা বলছি তাই করো। রুমিকে বলো। আর নয়তো নিজে বানিয়ে খাও গিয়ে।’
‘ইবনাত বেশি বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু।’
আমি কিছু না বলে চোখ বুজে রইলাম। রিশান হতাশ হয়ে উঠে গেল। হাসলাম। বুঝো মজা এবার।
বেলা প্রায় ন’টা। নীচ থেকে রিশানের মায়ের চিল্লানোর আওয়াজ পাচ্ছি। ভাবলাম এত সময় শুয়ে থাকলে ভালো লাগবে না। উঠে ফ্রেশ হয়ে নীচে গেলাম। রুমি, নিশাত আপু আর তাদের মা জড়ো হয়ে ডাইনিং রুমে দাঁড়িয়ে আছে। মিহির সোফায় বসে মোবাইল টিপছে। হাই তুলতে তুলতে নেমে এলাম। রিশানের মা চেঁচিয়ে বললেন, ‘এসেছেন নবাবজাদী! ঘুম হলো?’
‘হুম খুব ভালোই হয়েছে মা।’
‘চুপ মুখপুড়ি। বেলা কত হয়েছে খেয়াল আছে?’
‘আছে তো মা। ন’টা বেজেছে আরকি।’
‘তো? এত বেলা ঘুমাচ্ছিস কেন?’
‘তো কী হয়েছে এত বেলা ঘুমালে? আপনার প্রাণের ছেলে মেয়ে আর ছোট ছেলের বউ ঘুমায় না?’
রুমি বলল, ‘আমি আর তুমি সেইম না ভা-বী।’
‘হুম ঠিক বলেছো আমি আর তুমি সেইম না। তুমি হলে আমার ছোট। আর আমি তোমার বড়। বুঝেছো? পার্থক্য বিবেচনা করে সম্মান করতে শিখবে।’
মিহির মুচকি মুচকি হাসছে। তা দেখে আমিও হাসলাম। মা বললেন, ‘চুপ! তোর মতো মেয়েকে আবার সম্মান? যে কিনা নবাবজাদীর মতো বেলা তিনটে পর্যন্ত ঘুমায় কাজ কর্ম কিছুই নেই।’
‘আরে আম্মু! আমি কেন কাজ করব? আপনিই তো বললেন আমি নবাবজাদী। আমার কাজ তো বসে বস্ব খাওয়া।’
নিশাত আপু চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘এসব কী ইবনাত? তোমার মুখ দেখছি বেড়ে গেছে।’
শান্ত গলায় বললাম, ‘আমার মুখ কখনো ছোট ছিল না আপু৷ যে বেড়ে যাবে।’
‘এই এই! বেশি কথা বলবি না। মুখপুড়ির মুখে দেখি খই ফুঁটেছে? কার থেকে শিখেছিস এসব?’
হাই তুলে বললাম, ‘নিজেই!’
‘হয়েছে অনেক কথা। যা অনেক কাজ পড়ে আছে। আজ চিংড়ী আর গরুর মাংস গুলো রান্না করবি।’
ভাবলেশহীন ভাবে মিহিরের পাশে বসে বললাম, ‘ইচ্ছে করছে না মা। আপনার ছোট বউকে বলুন।’
নিশাত আপু বলল, ‘এই মেয়ে এই৷ তোর সমস্যা কী হ্যাঁ? সেই কখন থেকে বে-আদবী করেই যাচ্ছিস?’
‘বে-আদবীর কী দেখলে আপু? শুধু বললাম যে রুমিকে রাঁধতে। খারাপ কিছু তো বলিনি।’
তারা কিছু বলতে পারল না। আজ তো আমি জান গেলেও কোন কাজ করব না। মিহির আমার দিকে তাকিয়ে প্রাপ্তির হাসি দিল। আমিও হাসলাম। তারা তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি পাত্তা না দিয়ে ফোন টিপায় মনোযোগ দিলাম।
রুমি কিছুক্ষণ পর বলে উঠে, ‘আম্মু দেখো তোমার বড় ছেলের বউ কী শুরু করেছে এসব?’
মা বললেন, ‘এই কালনাগিনী এসব কার থেকে শিখেছে?’
মিহির বলে উঠে, ‘কারো থেকে শিখতে হয় না আম্মু। একটা মানুষকে যখন সব দিক থেকে কষ্ট, যন্ত্রণা দেওয়া হয় তখন সে নিজে থেকেই প্রতিবাদী হয়ে উঠে।’
‘ওহ্ আচ্ছা তাহলে তুই শিখিয়েছিস এসব?’
‘যা খুশি ভাবো। কিন্তু.. তোমরা ভাবীকে আর আগের মতো ভেবো না। ও এখন তোমাদের বউ নয়। একজন নারী। আর একজন মানুষ।’
তারা এমন ভাবে আমাদের পানে চেয়ে আছে যেন পারলে খেয়ে ফেলবে। তাতে আমার কী?
.
প্রায় দুপুর ১২ টা বাজতে চলল। কিছুর’ই খেয়াল নেই। এদিকে তারা অপেক্ষা করছে আর কিছুক্ষণ পর পর থ্রেট দিচ্ছে আমাকে যে কবে আমি রান্নাঘরে যাব আর কুকুরের মতো খাঁটব। কিন্তু আমি পাত্তা দিচ্ছি না। অবশেষে যখন বেলা গড়িয়ে যোহরের আজান দিয়ে দিল তখন তারা বুঝতে পারল আমি আজ রাঁধবো না। তারা না পারছে কিছু করতে আর না পারছে সইতে। এই অবস্থা দেখে মায়াও হচ্ছে আবার হাসিও পাচ্ছে। শোধ নিব! আমার সাথে করা সব কিছুর শোধ নিব আমি। ইবনাত মানেই মুখ বুজে সহ্য করব না।
তারপর ইশানের দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকেই খাবার আনল। যদিও আমার ভাগের খাবার ছিল না। আমি আর মিহির নামাজ সেরে কথা বলতে বলতে নিচে নামলাম। এসে দেখি মা আর নিশাত আপু খাবার সাজাচ্ছে। মিহির মিটিমিটি হাসল। সেখানে উপস্থিত ছিল মা, নিশাত আপু আর ইশান। মিহির নিজের খাবার নিয়ে নিল। প্লেটে সব সাজানো ছিল। আমিও সুযোগ বুঝে একটা প্লেট তুলে নিলাম। ওমনি মা চেঁচিয়ে উঠেন, ‘এই মেয়ে এই ফঁকিরের বাচ্চা। তুই কোন সাহসে রুমির খাবার নিয়ে যাচ্ছিস?’
আমি না বুঝার ভান করে বললাম, ‘কোন সাহসে মানে? বুঝলাম না মা!’
‘চুপ কর বে-আদব। একেতো রান্না করিস নি আমার ছেলের দিয়ে হোটেল থেকে আনিয়েছিস। তার উপর তার বউয়ের খাবার তুলে নিয়ে যাচ্ছিস ফঁকির কোথাকার।’
‘ফঁকির? তাহলে আপনার ছেলেও ফঁকিরের স্বামী।’
‘আমার ছেলেকে নিয়ে কিছু বলবি না।’
‘ঠিক আছে আমি গেলাম।’
‘এই এই! ওটা নিয়ে যাচ্ছিস কেন? রাখ। রাখ বলছি।’
‘কেন রাখব? এটা ওর খাবার কোথাও লেখা আছে?’
ইশান বলে ওঠে, ‘ভাবী! এটা রুমির খাবার সো তোমার নেওয়ার কোন প্রশ্নই আসেনা। আর এখানে নির্দিষ্ট খাবারই আছে। পরিমাণ মতো৷ তুমি পরিমাণ নষ্ট করলে অন্য কিছু করতে বাধ্য হবো।’
শান্ত স্বরে বললাম, ‘তা ভাইয়া! আপনার কী নূন্যতম দায়িত্ববোধ নেই যে ঘরে কে আছে না আছে। আপনার বউ যেমন এই বাড়ির বউ তেমনি আমিও। তাই আমার ভাগ টা থাকা অবশ্যই উচিত অন্যথায় আমি নিজেই নিজের ভাগ নিয়ে নেব। যেহেতু আমার কথা আপনারা চিন্তা করছেন না সো আমিও চিন্তা করব না আপনার বউ কী খাবে না খাবে, আপনার বোন কী খাবে না খাবে, আপনার মা কী খাবে না খাবে, আর আপনি কী খাবেন বা না খাবেন। কথা টা আমি বুঝাতে পেরেছি?’
সবাই চুপ করে রইল। মিহির হেসে ফেলল। সবাই তার দিকে দৃষ্টি স্থাপন করল। মিহির খাবার নিয়ে ওঠে আমাকে ইশারা করে উপরে উঠতে থাকে। সাথে আমিও তার সঙ্গে উপরে উঠে গেলাম। রুমে এসে মিহির হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খেতে শুরু করল। হাসতে হাসতে যেন পেটে খিল ধরে গেছে। বলল, ‘ভাবী রে এটা কী করলে তুমি? আল্লাহ্! আমি আর পারছি না। ওদের রিয়েকশন দেখেছো? একদম দেখার মতো। হাহাহা!’
‘বলেছি না? এখন এক নতুন আমিকে দেখবে।’
‘একদম গ্রেট ভাবী। আমি তোমাকে এমনই চেয়েছিলাম।’
দু’জন খেয়ে দেয়ে নীচে নেমে এলাম। রুমি, নিশাত আপু আর মা সোফায় বসে আছে। ইশান হয়তো তার কাজে গেছে৷ রুমি আমাকে দেখতেই তেড়ে এলো, ‘ছোটলোক বাপের মেয়ে! আমার খাবার খেয়ে তো ভালোই পেট ফুলিয়েছিস।’
সঙ্গে সঙ্গে বিকট জোড়ে ‘ঠাস’ করে আওয়াজ হলো। দূরে ছিটকে সরে গেল রুমি। উপস্থিত সবাই হতভম্ব। সাথে মিহিরও বাকরুদ্ধ। আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘নিজের দিকে তাকা। আর নিজের ফ্যামিলির দিকে তাকা। আমার বাবাকে ছোটলোক বলার আগে শতবার ভেবে দেখবি৷ মাইন্ড ইট।’
মা তেড়ে এলেন, ‘তোর সাহস তো কম নয় তুই আমার বউমাকে থাপ্পড় মেরেছিস?’
‘না না না মিসেস. রাহেলা। এ কথা আপনার মুখে মানায় না। আপনার বউমা? সে আপনার বউমা হলে আমি ইবনাত! আমার পরিচয় মিসেস. রিশান না শুধুই ইবনাত। বুঝেছেন? আর আপনার বউমার গায়ে হাত তুলতে সাহস কেন লাগবে আমার? কে আপনার বউমা? কী ওর পরিচয়? যে ও আমার ফ্যামিলিকে অপমান করবে, আমার সম্মানি বাবাকে ছোটলোক বলবে আর আমি কিছুই করতে পারব না?’
‘না কিছুই করতে পারবি না তুই। তোর বাবা ছোটলোক তাই তোর বাবাকে ছোটলোক বলেছে।’
‘স্টপ! আমার বাবা ছোটলোক? একজন বিশিষ্ট সার্জেন্ট কে ছোটলোক বলছেন? শেইম অন ইউ অল! আমি আমার বাবার পরিচয় কখনো কাউকে দিই না। চাইনি বাবার নাম ট্যাগ দিয়ে থাকতে। কিন্তু আজ দিতে হলো। আমার বাবার মতো একজন সার্জেন্টকে ছোটলোক বলতে কী লজ্জা করল না?’
সবাই বাকরুদ্ধ। মিহিরের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। হাতে থাকা প্লেট টা টেবিলে রেখে বললাম, ‘প্লেট গুলো ধুঁয়ে নিও রুমি।’
উপরে চলে আসলাম আর অপেক্ষা না করে। এদের ফালতু কথা শুনার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আমার বাবা কে অপমান করে? বিয়ের পর থেকে বাবা আর মায়ের সঙ্গে আমার সর্বমোট চার বার কথা হয়েছে। এই দু’বছরে মাত্র চারবার। ভাবা যায়? আমি সব মুখ বুজে সহ্য করেছি রিশানের জন্য। কিন্তু আর নয়। অনেক হয়েছে।
.
‘ইবনাত!! ইবনাত!!’
রিশানের চিৎকার শুনে কিছুটা ভড়কে গেলাম। হঠাৎ এভাবে ডাকছে কেন? রিশান চিৎকার করতে করতে রুমে প্রবেশ করল। চমকে গেলাম। তার চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে আছে। সাথে মনে কিছুটা ভয়ও ঢুকল। রিশান এসে আমার গলা টিপে ধরল আর দাঁতে দাঁত চেঁপে বলল, ‘তোর সাহস তো কম নয়। তুই আজ কী করেছিস? রুমি আর আম্মুর সঙ্গে কী করেছিস? ওরা এখন আমাকে কেঁদে কেঁদে তোর কুকীর্তি বলছে। তোর খুব বাড় বেড়েছে না? কার থেকে শিখেছিস এসব? বল! ডানা গজিয়েছে তাই না?’
সহ্য হলো না। হাত দিয়ে তার বুকে আঘাত করে সজোড়ে ধাক্কা দিলাম। ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। কাঁশতে শুরু করলাম। স্বাভাবিক হতেই আমি চিল্লিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা? আমি তোমার মা আর তোমার প্রিয় ভাইয়ের বউকে কী বলেছি না বলেছি তা নিয়ে এত সেনসিটিভ? আর আমার বেলায়? কিছুই না? শুনো! এখন আমি তোমার বউ নই। আমি ইবনান চৌধুরীর মেয়ে শুনেছো তুমি? আমি এখানকার কোন কাজের মেয়ে নই আর না তোমাদের বান্দী। শুনেছো? সাহস কম নয় তোমার যে তুমি ইবনাত চৌধুরীর গলা টিপে ধরেছো? তাও আবার তোমার রুমির জন্য! হাও ডেয়ার ইউ।’
রিশান তেড়ে এসে চড় মারতে নিলেই তার হাত ধরে দূরে সরিয়ে দিলাম, ‘না মি. রিশান। আপনার এই নোংরা হাতে কখনো আমায় স্পর্শ করবেন না। আর আমার গায়ে হাত তোলার আগে এটলিস্ট একবার ভেবে দেখবেন। যদি আমার গায়ে হাত তুলেছেন? দেখবেন আপনার এই হাতের কী অবস্থা হয়।’
রিশান হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। দরজার উপাশে দেখলাম মিহির দাঁড়িয়ে। রিশানের চিৎকার শুনে ছুটে এসেছিল। কিন্তু আমার এ রূপ দেখে আটকে যায় আর তামাশা দেখতে শুরু করে। আমি আবারো বললাম, ‘আর হা! ফার্দার ওসব রুমি টুমি আর আপনার মা’র বিষয়ে আমার সাথে কোন কথা বলতে আসবেন না। ডিড ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?’
রিশান দাঁত দাঁত চেঁপে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হন হন করে মিহিরকে পাশ কেটে বেরিয়ে গেল। খুন প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে।
[চলবে.. ইনশা আল্লাহ্]
#অপ্রাপ্তি 💔
#ইবনাত_আয়াত
~ বোনাস পর্ব
চারদিকে পাখির কিচির’মিচির আওয়াজ, হালকা মিষ্টি রোদ্দুর আর নীলাভ আকাশ মিলিয়ে শুরু হলো এক নব্যদিনের সূচনা। সকাল নয়’টা। আজও রিশানের মা লাগিয়ে দিয়েছেন বাঁশির সুর। না মানে চিল্লা’চিল্লি আরকি। কিন্তু আমি চুপ করে আছি। নিজের মতই রেডি হচ্ছি। আজ স্কুলে যাব সব কনফার্ম করতে। রিশান সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আজ উঠতে দেরি করে ফেলেছে তাই দ্রুত রেডি হয়ে টাই পড়ছিলো আরকি। আমাকে রেডি হতে দেখে জিজ্ঞাস করল, ‘কোথায় যাচ্ছো তুমি?’
‘ঘুরতে।’
‘ঘুরতে মানে?’
‘ঘুরতে মানে ঘুরতে।’
‘ভীষণ উড়নচণ্ডী হয়ে যাচ্ছ তুমি। কিসের ঘুরতে হা? কাজ কর্ম নেই? এমনিতে কাল অনেক কিছু করে ফেলেছো। হয়েছে অনেক আর না। যাও আম্মুকে সাহায্য করো।’
‘পারব না।’
‘ইবনাত! অতিরিক্ত করে ফেলছো কিন্তু।’
‘কী অতিরিক্ত করলাম মি. রিশান? কী করলাম আমি? আপনারা সবাই আমাকে সব দিক থেকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। আমাকে বাঁচতে দিচ্ছেন না। আমি কী এই ঘরের চাকরানী? শুধুই কাজ করতে এসেছি? আপনার ভাইয়ের বউ যদি ব্যাংকে কাজ করার অধিকার পায় তাহলে আমারো অধিকার আছে মাস্টার্স করার। আপনার ভাইয়ের বউ যদি জেলায় জেলায় ঘুরার অধিকার পায় তাহলে আমারও অধিকার আছে দেশ বিদেশে ঘুরার। ইবনান চৌধুরীর মেয়ে ইবনাত চৌধুরী হয়ে সবাই আনন্দ করবে আর আমি বাদ পড়ব? নো ওয়ে মি. রিশান। দু’বছর ধরে কুকুরের মতো এখানে পড়ে আছি আর খাঁটছি। কিন্তু কারো মন পাইনি।’
কেঁদে ফেললাম। গলা আটকে আসছে। রিশান হতবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। আমি আবারো বললাম,’খুব তো বলেছিলেন কাজ করো তবেই মন পাবে সবার। কার পেয়েছি? না পেয়েছি আপনার মায়ের, না আপনার বোনের আর না আপনার প্রিয় ভাইয়ের বউয়ের। আর আপনার। ঠিক’ই আমাকে আপনি ধোঁ…’
থেমে গেলাম। তার নোংরামীর বিষয়টা আমি এখন বলব না। আরো অনেক কাজ বাকি আছে। রিশান কিছু বলল না। আমি চোখ মুছে আবারো নিজের কাজে মন দিলাম। নাহ্ তাকে কখনো আমার দূর্বলতা দেখাব না। রিশান কিছুক্ষণ এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর প্রস্থান করল। আমি রেডি হয়ে মিহিরের রুমের দিকে পা বাড়ালাম। মিহির তখনো রেডি হচ্ছে। আমাকে আসতে দেখে মুচকি হাসল। বলল, ‘ওয়াও ভাবী আমি বিশ্বাস করতে পারছি না এ যেন এক নতুন ইবনাত ভাবী।’
হাসলাম। মিহির রেডি হলে দু’জন নেমে এলাম। রুমি নেই। নিশাত আপুও নেই। মা নিচে বসে পান চিবুচ্ছেন। আমাদের রেডি হয়ে একসাথে নামতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘আবারো শুরু করেছিস তোরা? এই মিহির৷ যা রুমে যা।’
‘রুমে যাবে মানে? কেন রুমে যাবে? ও আমার সাথে যাবে।’
‘তোর সাথে যাবে? কে তুই যে আমার কথা ফেলে ও নাচতে নাচতে তোর সাথে চলে যাবে? তোর মতো বে-আদব মেয়ে তো আমি দু’টো দেখিনি। তোর মতো বে-আদবের সঙ্গে আমি আমার মেয়েকে যেতে দেব?’
‘আমি বে-আদব হলে আপনি সেই বে-আদবের স্বামীর মা। নিজের সঙ্গে সব মিলিয়ে ফেলছেন।’
উনি দাঁতে দাঁত চেঁপে বললেন, ‘তুই অতিরিক্ত করছিস ইবনাত। পস্তাবি তুই।’
‘পস্তাবো আমি না আপনারা। যারা আমার সঙ্গে দু’বছর ধরে অন্যায় অবিচার করে আসছেন।’
মিহির বলল, ‘হয়েছে হয়েছে আম্মু। বকবক না করে নিজের কাজে যাও। চলো ভাবী।’
মিহির টেনে নিয়ে এলো আমায়।
.
জুনিয়র পদে চাকরী হয়েছে আমার। কাল থেকে যোগদান করব। মিহির খুশিতে দু’প্লেট ফুচকা অর্ডার দিয়ে বসে আছে। রেস্টুরেন্টে এসেছি। দু’জন গল্প করছি। হঠাৎ দরজার দিকে নজর যেতেই বুকটা ধক করে উঠল। রিশান!! কালকের সেই মেয়েটাকে নিয়ে? আমার দেখাদেখি মিহিরও লক্ষ করল। চমকালাম দু’জন। মিহির ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এরা এখানে কী করছে ভাবী?’
‘আ-আমি তো জা-জানি না।’
‘তাহলে ভাইয়া অফিসের নাম করে এসব করে? তবে কী ভাইয়া অফিস করে না?’
‘হয়তো না মিহির। ও ওর প্রেমে এতটাই মত্ত হয়েছে যে, নিজের ভবিষ্যৎ আর পরিবারের খেয়াল ও রাখছে না।’
মিহির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘জানি না। এর পরিণতি কী।’
রিশান আমাদের সোজাসোজি দুই টেবিল পরের টেবিলে বসল। আমি আড়াল হয়ে বসলাম। মিহির তাদের দিকে পিঠ করে ছিল। কেন যেন বিষয়টা মানতে পারছি না যে রিশান.. কেন? আমি.. কখনোই ওর ছিলাম না। তবু কেন? পুরনো আবেগ কেন ভুলতে পারছি না? নাহ্ আমায় ভুলতে হবে। ভুলতেই হবে। যে করেই হোক। মিহির বলে উঠল, ‘হয়েছে আর এসব নিয়ে ভেবে মন খারাপ করো না। তোমার পুরো লাইফটা পড়ে আছে। আর তোমাকে তোমার বাবা মা’র কাছেও তো যেতে হবে।’
‘আমি.. পারব না মিহির। ওদের কাছে এই মুখ নিয়ে কীভাবে যাব? যে তাদের দু’বছরেও তার শশুড় শাশুড়ীর মন জয় করতে পারল না তার উপর যার সঙ্গে প্রেমের বিয়ে সে’ই তাকে ধোঁকা দিয়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে মা’স্তিতে ব্যস্ত। বলো কীভাবে যাব আমি?’
‘ভাবী এভাবে বলো না। বাবা মা তো বাবা মা’ই হয় তাই না? শতহোক তারা তোমার সবচেয়ে কাছের। শত অভিমান করলেও ঠিক’ই বুকে জড়িয়ে নেবে পরম যত্নে।’
ফুচকা এসে গেছে। কিন্তু খাওয়ার মুড আমার নেই। মিহির জোড় করে খাইয়ে দিল। হঠাৎ দেখতে পেলাম রিশান একাই বেরিয়ে যাচ্ছে মেয়েটাকে ফ্লায়িং কিস দিতে দিতে। মেয়েটা টেবিলেই বসে রেসপন্স করছে। মিহির বলল, ‘ভাবী দেখো ভাই.. মানে রিশান আহমেদ চলে গেছে। ওই মেয়েটাকে এই বিষয়ে বলা উচিত।’
‘না মিহির কিছু বলো না।’
‘ভাবী! চলো বলছি।’
‘আচ্ছা তুমি যাও আমি থাকি?’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। বসো এখানে।’
দূর থেকে লক্ষ করতে থাকি। মিহির গিয়ে মেয়েটার টেবিলে গিয়ে তার সোজাসুজি যেখানে রিশান বসে ছিল সেখানে বসল। আমি কাছের টেবিলে গিয়ে বসলাম। তাদের কথোপকথন শুনার জন্য। মিহির সালাম দিল প্রথমে। মেয়েটা সালাম নেয়। মিহির বলে, ‘হ্যালো আপু আমি মিহির।’
মেয়েটা হেসে বলল, ‘হাই! আমি ইশি।’
‘কেমন আছো ইশি আপু?’
‘জ্বী ভালো আছি। তুমি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই আছি।’
‘ঠিক চিনলাম না আপু তোমায়।’
‘জানবে জানবে। তা রিশান তোমার কে হয় আপু?’
‘রিশান? আমার উড’বি হাসবেন্ড।’
‘আচ্ছা?’
‘তুমি ওকে চেনো?’
‘খুব ভালো করেই চিনি।’
‘ওহ্! কে হয় তোমার?’
‘আপাতত আমার ভাই। কিন্তু টাইটেল টা কিছুদিনের মাঝেই মুছে যাবে।’
‘মানে?’
‘মানে কিছু না। আচ্ছা আপু একটা প্রশ্ন করি?’
‘হুম করো।’
‘তুমি কী জানো ভাইয়া বিবাহিত?’
‘হুম জানি।’
‘জানো? তবু ভাইয়ার পেছনে কেন লেগে আছো? তোমার কী মনে হয় না একজন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন?’
‘ও বিবাহিত হোক আর যাই হোক। ও আমায় ভালোবাসে আর আমি ওকে ভালোবাসি। এটাই যথেষ্ঠ।’
‘তো আপু? ভাইয়া ভাবীকে ধোঁকা দিয়ে তোমার সঙ্গে বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও সম্পর্কে জড়ালো। তোমার জন্য ভাবীকে ধোঁকা দিল। তো তোমার কী মনে হয় না ও আরেকজন মেয়ের জন্য তোমাকে ছেড়ে দিতে পারে? কী গ্যারান্টি আছে যে ছাড়বে না?’
ইশি চুপ করে রইল। একটু পর বলল, ‘আমার ভালোবাসা কোন ন্যাকি নয় যে আমায় অন্য মেয়ের জন্য ছেড়ে যাবে। তোমার ভাবীই হয়তো তোমার ভাইয়াকে পারফেক্ট ভাবে ভালোবাসতে পারেনি। হয়তো কমতি ছিল তার মাঝে।’
‘ওহ্ আচ্ছা? তাই? তা তুমি কেমন ভালোবাসো ভাইয়াকে?’
‘সেটা তোমায় বলব কেন?’
‘আচ্ছা হয়েছে অনেক কথা। তোমার সঙ্গে এত কথা বলে লাভ নেই৷ কুকুরের লেজ টেনে ছিঁড়ে ফেললেও কখনো সোজা হবে না। আমার বলা কথাগুলো একটু ভেবে দেখ। আসি আজ৷ ভাইয়াকে এই বিষয়ে বলো না। নিজেই ফেঁসে যাবে। আল্লাহ্ হাফেজ।’
মিহির আমায় ইশারা করতেই আমি তার সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। আর রওনা দিলাম সেই নীড়ের উদ্দেশ্যে যা কিছু সময়ের ব্যবধানেই অন্যের হয়ে যাবে।
[চলবে.. ইনশা আল্লাহ]