#অপেক্ষার_প্রিয়_প্রহর
#পর্বঃ৪
#সাদিয়া_ইসলাম
ওয়াজিহা এবং রাবিয়া দু বান্ধবী-তে মিলে ফুচকা খেয়ে বাসায় ফিরছে হেঁটে হেঁটে৷ রাস্তার পাশ ঘেষে একে অপরের হাতে আঙুল পেঁচিয়ে হাঁটছে। দিনদিন এরা বড় হওয়ার বদলে নিজেদের মাঝে বাচ্চামি স্বভাবগুলো যেনো বৃদ্ধি করছে। বাসার কাছাকাছি আসতেই রাবিয়ার বাবা আলম সাহেবের সাথে দেখা হয়ে যায় দুজনের। বাবাকে দেখতে পেয়ে দু বান্ধবী-ই মাথা নিচু করে দাড়িয়ে পরে। আলম সাহেব দুজনকে একসাথে দেখেই নিজের গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বললেন,
‘তো দুই টইটই কোম্পানির বাড়ি ফেরার কথা হুশ হলো! তোৃরা ভুলে যাও তোমরা মেয়ে! যাদের সন্ধ্যার পর একা পেলে এই সমাজের মানুষ রুপী কিছু হায়েনা ছিড়ে খেতে পিছু নেয়৷ তোমাদের কি ঘরের কথা হুশ থাকে না?’
‘আসলে বাবা, দুজনে অনেকদিন পর ক্লাস শেষে একসাথে থাকতে পারলাম। এজন্য একটু ঘোরাঘুরি, খাওয়া দাওয়া করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেলো। প্লিজ রাগ করো না।’
রাবিয়া মুখটা কাচুমাচু করে বাচ্চাদের মতো আহ্লাদ করে বাবাকে কথা-টা বললো। ওয়াজিহা তো চুপচাপ দাড়িয়েই আছে। আলম সাহেব দুইজনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘যাও বাসায় ঢোকো। বাবা মায়েরও তোমাদের নিয়ে চিন্তা হয়। এবার তো এটা বুঝতে শিখো একটু! আর কতো টেনশনে রাখবে! বয়স তো বাড়ছে বই কমছেনা আমার।’
আলম সাহেব কথাটুকু বলেই দুজনকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। তিনি যেতেই দু বান্ধবী হাফ ছেড়ে বাঁচে। এমনিতে তিনি রাগী, গম্ভীর মানুষ। কিন্তু তিনি মেয়েকে এবং মেয়ের বান্ধবী ওয়াজিহাকে নিজের মেয়ের থেকে কোনো অঃশে কম দেখেন না। উনি মেনেই নিয়েছেন, উনার দুই মেয়ে, রাবিয়া এবং ওয়াজিহা। রাবিয়ার আর ভাইবোন নেই, যার ফলে ওয়াজিহা উনাদের কাছে আরও একটি মেয়ের মতোই। রাবিয়া এবং।ওয়াজিহা বাসায় ঢুকতেই রাবিয়ার মা মিসেস আমেনা কিচেন থেকে তেড়েফুঁড়ে আসলেন। হাতে খুন্তি। রাবিয়া মায়ের অগ্নিমূর্তি দেখে ভীত সশস্ত্র চাহনীতে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো। ওয়াজিহা উনার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বললো,
‘আম্মা! এতো রেগে আছো কেনো তুমি?’
‘দুইটা ধামড়ি ধামড়ি মাইয়া থাকতে মায়ের এ বয়সে এসে কাজ করা লাগে! দুইটা মেয়ের একটা মেয়েরও খবর থাকেনা! একটা তো কাছেই থাকেনা। আরেকটা! তারে তো হারিকেন দিয়েও খুজে পাওয়া যায়না। তাহলে আমি রাগবো না তো তোদের পাশের বাসার চাচী রাগবে?’
মিসেস আমেনা খ্যাঁকখ্যাঁক করে কথাগুলো বলে উঠলেন। ওয়াজিহা কপাল চাপড়ে বললো,
‘আর এই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তাড়ানোর জন্য লাফাও? আর মেয়ে বাইরে থাকলেই চিল্লাও। তোমরা মায়েরা না পারোও বটে।’
ওয়াজিহা সোফায় বসতে বসতে কথাটা বললো। রাবিয়া চোখ কান বন্ধ করে নিজের রুমে দৌড় দিলো। মিসেস আমেনা ফের কিচেনের দিকে পা বাড়িয়ে যেতে যেতে বললেন,
‘ মা হয়ে নে, মায়ের যন্ত্রণা বুঝবি।’
‘কমন ডায়লগ আম্মা। নতুন কিছু বলো।’
ওয়াজিহার কথা শুনে মিসেস আমেনা পিছন ফিরে একবার তাকালেন। মেয়েটা হাঁটুর উপর ভর দিয়ে গালে দিয়ে বসে আছে। মৃদু হাসলেন, বললেন,
‘ আমার মা-ও বলতেন। তখন আমিও বলতাম নতুন কিছু বলতে। তোদের সন্তান হবে! তখন সে-ও বলবে তুই এমন কিছু বললে।’
মিসেস আমেনা রান্না শেষ করতে চলে গেলেন। ওয়াজিহা আসবে বলে রান্নার পসরা সাজিয়ে বসেছেন মিসেস আমেনা। রাবিয়া যেই ফোন দিয়ে বলেছে সে আসবে! হয়তো শুরু করে দিয়েছেন তার জন্য এত রান্না। পুরো বাসা খাবারের গন্ধে মৌ মৌ করছে। ওয়াজিহা এসব ভেবেই খুশিতে হালকা শব্দ করে হাসলো। ভাগ্য করে বান্ধবী পেয়েছে। সে না বুঝতে দেয় ছোটো বোন বা সমবয়সী বোনের অভাব! না বুঝতে দেয় মা বাবার অভাব। কিন্তু এতো সুখ সইবে তো তার কপালে! তার কপাল তো ফাঁটা কপাল। যেখানেই যায় ফাঁটল ধরে যায়। আনমনে কথাটুকু ভেবে তাচ্ছিল্য সহিত হাসে ওয়াজিহা। তখুনি রাবিয়া নিজের রুম থেকে ওয়াজিহাকে ডাক দেয়। ওয়াজিহা রুমে গেলেই রাবিয়া ওয়াজিহার হাতে ড্রেস ধরিয়ে দিয়ে বলে,
‘ যা ফ্রেশ হয়ে আয়। এসেই বসেছে মায়ের বকবক শুনতে।’
ওয়াজিহা বললো,
‘সারাদিন আম্মা বাসায় একা থাকে। কথা বলার জন্য মানুষ পায় না। মেয়েদের কাছে পান দিনশেষে। তবুও আমি আসি-ই না। এতদিন পর আসছি! গল্প করবোনা?’
‘ক্ষমা চাই, কিছু বলাও যাবেনা। মায়ের মেয়ে এক্কেরে। যা ফ্রেশ হ আগে।’
ওয়াজিহা রাবিয়ার কথামতো ফ্রেশ হতে চলে গেলো। রাবিয়া বিছানায় বসে পরলো ফোন নিয়ে। ফোনে গেমস খেলা তার বদ অভ্যাস। সেটাতেই লেগে পরেছে সে।
…….
‘ শুনলাম তুমি নাকি রাফা বউমার ছোটো বোন ওয়াজিহা মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাচ্ছো?’
ফোনের ওপাশ হতে বাবার থেকে আচমকা প্রশ্নটি শুনে উত্তর দেবার ভাষা হারালো ইরাদ। সে আন্দাজ করেছিলো তার মা তার বাবার কাছে কথাটা বলেছে। কিন্তু আন্দাজটা ঠিক জায়গায় গিয়ে লাগবে! বুঝতে পারেনি। ফজলু শেখ ছেলের নিরবতা বুঝে আবারও খানিকটা শব্দ করেই প্রশ্ন করলেন,
‘আমি কিছু জিগাসা করেছি ইরাদ!’
‘হ্যাঁ বাবা, আপনি যা শুনেছেন ঠিকই শুনেছেন। আমি উনাকে পছন্দ করি, বলতে পারেন ভালোই বাসি।’
ইরাদ নিচুস্বরে উত্তর দিলো। ফজলু শেখ ছেলের কথার জবাবে প্রশ্ন করলেন,
‘কতদিন যাবত ভালোবাসো?’
‘ বছর দুয়েক হয়ে আসলো বাবা।’
‘বেশ পুরোনো দিনের ভালোবাসা। মেয়েটি জানে?’
‘না বাবা, উনি জানেন না। আমাদের মাঝে তপমন কথাও হয়না। আমাদের যা জানাশোনা, সবটুকুই ফর্মালিটির সম্পর্ক।’
‘ তোমার মা-কে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম জানো তো!’
‘জি বাবা।’
‘আমিও চাই না আমার পুত্রের ভালোবাসা অপূর্ণ থাকুক। তোমার মা-কে পাবার লড়াইয়ে নেমে হারানোর যে ভয়টা! সেটা উপরওয়ালা আর আমি ব্যতিত কেউ জানতোনা ইরাদ। আমি চাই না পুত্র হয়ে তুমি সেই যন্ত্রণা টা পাও। পরশের সাথে কথা বলো। আমি দেশে আসছি শিগগিরই। গিয়ে ছেলের বিয়ে দিয়েই তবে দম নেবো।’
‘কিন্তু মা তো রেগে আছেন বাবা।’
‘দেশে আসি! তোমার মা-কে মানানোর দায়িত্ব আমার ইরাদ। আপাতড রাখছি। কাজ শেষ, বাসায় ফিরছিলাম। ফিরতে ফিরতেই কথা বললাম তোমার সাথে।’
‘নিজের খেয়াল রাখবেন বাবা। আপনাকে নিয়ে চিন্তা হয়।’
‘তুমিও নিজের খেয়াল রেখো। মায়ের সাথে রাগারাগি করো না। বাবা আছি তো! সামলে নেবো। তুমি আমার একমাত্র ছেলে। আমার ছেলের কষ্ট আমি মানতে পারবোনা। রাখছি।’
‘ আপনি পৃথিবীর বেস্ট বাবা। ভালো থাকবেন, আসসালামু আলাইকুম। ‘
ইরাদ খুশিতে বসা থেকে লাফিয়ে উঠলো। রাতের খাবার শেষে রুমে বসে অফিসের কিছু কাজ সারতে বসেই তার বাবার কল আসায় কল।রিসিভ করে। এরপর কথাগুলো হয় তাদের মাঝে। ফজলু শেখ সালামের জবাব নিয়ে হাসিমুখে কল রাখলেন। পরশের সাথে পরশদের বাসায় যাওয়ার কথা থাকলেও রাফা কল করায় এদিকে না এসেই পরশ ইরাদকে জানিয়ে সোজা বাসায় চলে যায়। সকালবেলায় অফিসে যাওয়ার আগে আগে তার মা-কে পরশদের বাসায় ছেড়ে আসতে বলেছে পরশ। বাসায় এসে মায়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলে খেয়েদেয়ে পরশদের বাসায় যাওয়ার কথা জানিয়ে রুমে এসেছে ইরাদ। বাবার সাথে তার সম্পর্ক এতটা ফ্রি নয়, যেভাবে আজ কথা বললো তার বাবা। যাক যেমনই হোক! বাবা যখন রাজী এবার মা-কে রাজী করানোর পালা। ওয়াজিহাকে বলার আগে নিজের পরিবারকে মানিয়ে নিতে চায় ইরাদ। কারণ ওয়াজিহাকে বিষয়টা জানানোর পর, ওয়াজিহা যদি বলে বসে! ইরাদের পরিবার তাে মানবে কিনা! যেনো বুক ফুলিয়ে বলতে পারে ইরাদ, তার বাবা-মা সবাই রাজী। তখন তো ওয়াজিহাকে মানানো সহজ হবে একটু। ইরাদ খুশিমনে কাজ ফেলে বিছানায় শুয়ে পরলো। আপাতত কাজে আর মন বসবেনা তার। সে ফোনের গ্যালারি ঘেটে অতি যত্নে গোপনে রাখা ওয়াজিহার একটা ছবি বের করে জুম করে দেখতে শুরু করে। ছবিটা সে অলির ৩য় তম জন্মদিনের দাওয়াতে পরশদের বাসায় গিয়ে লুকোচুপি করে তুলেছিলো। আসমানী রঙের একটা সুতির শাড়ি পরেছিলো ওয়াজিহা। চোখ ফেরানো দায় ছিলো ইরাদের৷ সেই ছবি টা দেখে আজও ইরাদের চোখ ফেরানো দায় হয়ে পরে। সে ছবিটা জুম করে ওয়াজিহার চোখ দুটো চোখের সামনে এনে ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বলে,
‘আপনার জন্য অপেক্ষায় কাটানো প্রতিটা প্রহর-ই আমার জন্য আনন্দের ওয়াজিহা। আপনাকে ইনশা আল্লাহ একদিন আমার #অপেক্ষার_প্রিয়_প্রহর এ পেয়ে যাবো। সেদিন আপনাকে না পাওয়ার আক্ষেপ-টা আর রইবেনা।’
চলবে?