#অন্যরকম তুমি
#তানিশা সুলতানা
#পর্বঃ৪৯
সিফাত বাড়িতে এসেছিলো এক বুক আশা নিয়ে। ভেবেছিলো সব কিছু মিটমাট হয়ে গেছে। বাবা মা আলাদা করবে না ওদের এটাই বিশ্বাস ছিলো। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানসম্মানটাই আগে। কিন্তু বোকা সিফাত এক বারও ভাবলো না মধ্যবিত্তদের আত্মসম্মানও বেশি।
হাতে এক গুচ্ছ কাঠগোলাপ। কখনো সিমিকে ফুল দেওয়া হয় নি। সিমিকে নিয়ে কখনো ঘুরতে যাওয়া হয় নি। ওই তো কলেজের মাঠ, শিশুপার্ক আর বেড রুম এই তো।
কখনো মেয়েটার অভিমান শোনা হয় নি। কখনো ভালোবেসে খোঁপায় বেলি ফুলের মালা জড়িয়ে দেওয়া হয় নি। মেয়েটা একা একা রান্না করেছে কখনো ঘুম ছেড়ে উঠে মেয়েটাকে সাহায্য করে নি।
মেয়েটার ঘামে ভেজা মুখটা দেখা হয় নি।
জীবনটা সুন্দর। কিন্তু সেটা উপভোগ করতে জানতে হয়। জীবনকে তুমি যেভাবে সাজাবে জীবনটা ঠিক সেভাবেই রঙিন হবে।
সাদি আর ছোঁয়াকে দেখে খুব ভালো লাগে সিফাতের। কতো বুঝে দুজন দুজনকে। কত সুন্দর জীবন ওদের। সিফাত চাইলে তো ওর জীবনটা ওদের থেকেও বেশি সুন্দর হতো।
সিমির উঁচু পেটটা উপভোগ করতে পারতো সিফাত। সিমি যখন উঁচু পেটটা ধরে একটু একটু করে হাঁটতো তখন তো সিফাত নিজের হাতটা এগিয়ে দিতে পারতো।
হাত ধরে খানিকটা পথ এগিয়ে দিতে পারতো।
কিন্তু তা না করে মাঝ পথে মেয়েটার হাত ছেড়ে দিয়েছে। শূন্যে ভাসিয়ে দিয়েছিলো মেয়েটা। এখন সময় এসেছে সব ভুল সুধরে নেওয়ার। এক ফোঁটা পানি পড়তে দেবে না সিমির চোখ থেকে। বাকিটা জীবন বুকের সাথে আগলে রাখবে।
সিফাত হাসিমাখা মুখ নিয়ে দরজার কলিং বেল বাজায়। হাসফাস করছে সিফাত। দরজা খুলতে লেট কেনো হচ্ছে বুঝতে পারছে না। অথচ অন্য দিন তিন চার বার কলিং বেল বাজার পরেও দরজা না খুললে সিফাতের মনে হতো হয়ত সবাই ব্যস্ত।
দ্বিতীয় বার কলিং বেল বাজাতে যেতেই থমথমে মুখে দরজা খুলে দেয় তনু। তনুর চোখ মুখ ফুলে গেছে। এখনো চোখের পাঁপড়ি গুলো ভিজে জাবুথাবু হয়ে আছে।
বুকের ভেতর ধক করে ওঠে সিফাতের। খুব খারাপ কিছু হয়েছে সেটা ভালোই বুঝতে পারছে।
তনু সিফাতের হাতের দিকে তাকায়। হাতে কাঠ গোলাপ দেখে বুকটা হু হু করে ওঠে তনুর। ভাই যে সিমির জন্য এনেছে এটা জানা তনুর।
“সব শেষ হয়ে গেছে দাভাই
হু হু কেঁদে সিফাতের বুকের ওপর মাথা রাখে তনু।
সিফাতের হাত থেকে ফুল গুলো পড়ে যায়। দুই হাতে তনুকে আগলে নেয়।
” পরিকে আর কখনো দেবে না ওরা। তুই বাঁচবি কিভাবে দাভাই।
কাঁদতে কাঁদতে বলে তনু। সিফাতের চোখেও পানি টলমল করছে।
“পরির জামাটাও খুলে রেখে গেছে। ছোট ভাবিকেও নিয়ে যাবে বলেছে।
সিফাত বুক থেকে তনুর মাথাটা তুলে। দুই হাতে চোখের পানি মুছে নেয়। তনু ফুঁপিয়েই যাচ্ছে।
” কাঁদিস না বোন। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সিফাত বা হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নিজের রুমের দিকে চলে যায়।
রুমে গিয়ে ধাপ করে দরজা আটলে দরজায় ঠেস দিয়ে বসে পড়ে।
তারপর হু হু করে কেঁদে ওঠে।
“এটা কি হয়ো গেলো?
সাদি ছোঁয়াকে নিয়ে পার্কে এসেছে। কেনো নিয়ে এসেছে ছোঁয়া জানে না। জানতেও চায় না। এউ মুহুর্তে ভীষণ রেগে আছে ছোঁয়া। সাদি কি করে ড্রেসের দাম জানলো? আবার বলে কি না “আমি মেঘাকে নিয়ে ঘুরতে যায় নি”
বেপারটা এমন হলো “ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা নি”
ছোঁয়ার তো মাথাতেই ছিলো এই কথা। ছোঁয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কখনোই সাদির সাথে কথা বলবে না। করুক অন্য মেয়েদের সাথে নিকনিক। তাতে ছোঁয়ার কি?
হুহহহহহ ছোঁয়া পেছনে ঘোরার ছেলেও অভাব নেই।
কড়ই গাছের নিয়ে ইট সিমেন্টের ব্রেঞ্চে বসে আছে ছোঁয়া। তার পাশেই সাদি বসেছে। ছোঁয়ার হাতে সেই ড্রেসের প্যাকেট। সাদি ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা তুলে বিল দিয়েছে। এ নিয়ে ছোঁয়া একটা কথাও বলে নি। আর বলবেও না।
“ওয়েদারটা দারুণ বলো?
সাদি ছোঁয়ার সাথে একটু ঘেসে বসে বলে। ছোঁয়া কিছুই বলে না। এক মনে ঘাস ছিঁড়তে থাকে।
“একটা ঘটনা শুনবে? বেলি ফুলের মালা আর ওই ওড়নার ঘটনা?
সাদির কথায় চট করে ছোঁয়া তাকায় সাদির দিকে। সাদি মুচকি হেসে ছোঁয়ার হাত জড়িয়ে ধরে।
” আজকে আমার জীবনের স্পেশাল দিন। অনেক সারপ্রাইজ আছে তোমার জন।
ছোঁয়া মন দিয়ে শুনছে। কিন্তু কিছু বলে না।
“তোমার বোনদের সাথে একটা মেয়ে পড়তো।নাম মিথি। দারুণ চঞ্চল আর হাসিখুশি ছিলো মেয়েটা। আমাকে খুব ভালোবাসতো। খুব মানে খুব। ভীষণ পাগলামি ছিলো মেয়েটার মধ্যে।
জানো প্রতিদিন সবার আগে ক্লাসে এসে টেবিলের ওপর বেলি ফুলের মালা রেখে যেতো।
প্রথম প্রথন আমি ফেলে দিতাম। আস্তে আস্তে ভালো লাগতে শুরু করলো বেলি ফুলকে।
আমি আগে থেকেই জানতাম মালাটা মিথি রাখে। মিথিও জানে যে আমি জানি।
আস্তে আস্তে বেপারটা পুরো কলেজ ছড়িয়ে গেলো। কানাঘুষা শুরু হলো। কিন্তু ফুলের মালা রাখতে ভুলতো না মেয়েটা।
তবে কখনো আমার সামনে এসে কথা বলে নি। আমিও বলার প্রয়োজন মনে করি নি।
তারপর একদিন মেয়েটা খুব অস্বাভাবিক একটা কাজ করে বসলো। ভরা কলেজের মাঠে প্রপোজ করে দিলো আমায়। আর আমি সেদিনই জানতে পেরেছিলাম আমার ভাইয়ের কাহিনি। ভীষণ রেগে ছিলাম।
সেই রাগ আর মিথি প্রপোজ করা দুটো রাগ মিশিয়ে পর পর দুটো চর বসিয়ে দেই মিথির গালে।
মেয়েটা গালে হাত দিয়ে লাল লাল চোখ জোড়া দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বলেছিলো ” আর কখনো আসবো না আপনার সামনে”
থামে সাদি। ছোঁয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাদির দিকে। সাদির চোখে পানি। কাঁদছে সাদি? ওই মেয়েটার জন্য?
ছোঁয়ার হাতটা আরও একটু শক্ত করে মুঠো করে ধরে সাদি।
“ভালো লাগা ভালোবাসাটা ভেতর থেকে আসে। চাইলে জোর করে আমি ভালো লাগাতে পারি না। মিথিকে আমার ভালো লাগতো এটা আমি অস্বীকার করবো না। কিন্তু ভালোবাসতে পারি নি।
“এখন কোথায় মিথি?
ছোঁয়া ধরে আসা গলায় বলে। সাদি চোখ বন্ধ করে নেয়।
” নেই
অস্পষ্ট স্বরে বলে সাদি। চমকে ওঠে ছোঁয়া।
“নেই মানে?
বিচলিত হয়ে বলে ছোঁয়া। সাদি হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে নেয়।
” অন্য এক সময় বলবো। আজকে আমার আর তোমার দিন। চাইছি না মুড অফ করতে।
সাদি মুচকি হেসে বলে। ছোঁয়া আর কিছুই বলে না। চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
সাদির ফোন বেজে ওঠে। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে ইভার কল।
“কতদূর?
সাদি রিসিভ করেই জিজ্ঞেস করে।
” ভাইরে ভাই। এত এত সাজানো যায়? বাই দ্যা ওয়ে বাসরঘরও সাজবো না কি?
রোমাঞ্চ টোমাঞ্চ করবি না কি? অবশ্য তা আগেই করে নিয়েছিস।
“সাট আপ ইভা। আমাদের এখনো বাসর হয় নি।
সাদি ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে। ছোঁয়া বড়বড় চোখ করে তাকায় সাদির দিকে।
” বলিস কি? তুই আমিষ হস নি?
ইভা অবাক হয়ে বলে।
“রাখ তুই। আসছি আমরা।
চলবে
#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ৫০
#তানিশা সুলতানা
পরি বাবার কাছে যাওয়ার জন্য কান্না শুরু করে দিছে। কিছুতেই থাকবে না এখানে। সিমি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে পরির কান্না দেখেও কিন্তু বলছে না। যেনো ও পরির কান্না শুনতেই পাচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে পরির। এখন আর কান্না আসতেছে না। শুধু ফুঁপিয়েই যাচ্ছে।
একটু কাঁদলেই পরির জ্বর চলে আসে। আর আজ সেখানে অনেকখন যাবত কান্না করেই যাচ্ছে।
অবশেষে সিমির ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনটা চার্জে বসানো ছিলো। রিংটোন পরির কানে আসতেই পরির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তারাহুরো করে ফোনটা রিসিভ করে।
“বাবা আমাকে নিয়ে যাও
ফুঁপিয়ে বলে ওঠে পরি। সিফাতের বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। মেয়ের কন্ঠ শুনেই বুঝে গেছে মেয়েটা অনেকখন যাবত কান্না করছে।
“কান্না কেনো করছো মামনি?
শান্ত গলায় বলে সিফাত।
” তো কাঁদবো না আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না।
চেঁচিয়ে বলে ওঠে পরি। সিমি হকচকিয়ে উঠে বসে। পরির কানে ফোন দেখে বুঝতে বাকি নেই পরি সিফাতের সাথে কথা বলছে। বুক ভরে শ্বাস নেয় সিমি।
“মা আস্তে কথা বলো।
সিফাত বলে
“মা কে কল করছে?
সিমি জিজ্ঞেস করে।
পরি কান্না ভেজা চোখে তাকায় সিমির দিকে। সিমি পরির চোখের পানি মুছে দেয় আলতো করে। তারপর ঘাড় ওবদি পড়া চুলগুলো হাত দিয়ে একটু ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করে।
” বাবা কল দিছে।
পরি বলে।
সিমি পরির হাত থেকে ফোনটা নেয়। তারপর পরিকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
“হেলো
চোখ দুটো বন্ধ করে বলে সিমি।
” পরি কাঁদছে কেনো?
শক্ত গলায় বলে সিফাত।
“কাঁদবে না? বশ করে নিয়েছেন তো।
সিমি তাচ্ছিল্য হেসে বলে।
সিফাত মুচকি হাসে।
” তোমাকে কেনো বশ করতে পারছি না বল তো?
“আর কখনো কল করবেন না আপনি।
সিমি চোয়াল শক্ত করে বলে।
” এত দিন তো কল করি নি। এখন কেনো করি?
কারণ আমার মেয়ে তোমার কাছে। আবারও আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও আমি কল করবো না।
সিফাতের কথা শুনে মনটা ভেঙে চুরে যায় সিমির। সত্যিই সিফাতের মনে একটুও ভালোবাসা নেই সিমির জন্য। থাকলে এমনটা বলতো না। অথচ সিমি এতখন কত কিছুই না ভেবেছে।
নিজের ভাবনায় নিজেরই রাগ হয় সিমির।
“রেগে যাচ্ছেন কেনো ম্যাডাম? এখনো তো রেগে যাওয়ার মতো কিছুই বলি নি। আমার মেয়েকে ফেরত চাই আমার।
চোয়াল শক্ত করে বলে সিফাত।
” মেয়ে আপনার একার না?
সিমি দাঁতে দাঁত চেপে বলে। সিফাত খিলখিল করো হেসে ওঠে। চমকে যায় সিমি। পাগলের মতো হাসছে কেনো লোকটা?
“তো মেয়ে নিয়ে চলে এসো।
হাসি থামিয়ে বলে সিফাত।
” ইডিয়েট
দাঁত কটমট করে বলে সিমি।
“ডিভোর্স কিন্তু এখনো আমাদের হয় নি।
সিফাত খুব শীতল গলায় বলে। চমকে ওঠে সিমি। কিছু বলতে যাবে সাথে সাথে সিফাত কল কেটে দেয়।
🥀🥀🥀
বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই চমকে ওঠে ছোঁয়া। পুরো বাড়িটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর সাদিটাও পেছন থেকে উধাও। কোথায় গেলো?
একটু একটু ভয় করছে ছোঁয়ার। রাত প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই হয়ত বারোটা বেজেও গেছে৷ এত সময় বাড়ির সামনে বাগানে ছোঁয়াকে নিয়ে বসে ছিলো সাদি। ছোঁয়াও কারণ জিজ্ঞেস করে নি।
তারপর হঠাৎ ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়ায় আর ছোঁয়ার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে চলো বলেই সরাসরি রুমে নিয়ে আসে।
আর এখন তার খবরই নেই। ছোঁয়া শুকনো ঢোক গিলে।
” সাদু আপনি কই গেলেন?
কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকে ছোঁয়া। কিন্তু কোনো শব্দ নেই। অন্ধকারে পা ও বাড়াতে পারছে না। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস টানছে ছোঁয়া।
হঠাৎ লাইট জ্বলে ওঠে। হকচকিয়ে যায় ছোঁয়া। বুকে থু থু দিয়ে রুমে দিকে তাকায়৷ পুরো রুমটা বেলুন আর মোমবাতি দিয়ে সাজানো। আর ছোঁয়ার ঠিক সামনে সুন্দর একটা কেক। অবাক হয়ে যায় ছোঁয়া। এসব কিসের জন্য বুঝতে পারছে না।
শুধু চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে ছোঁয়া। প্রতিটি বেলুনে Happy Birthday Shoya লিখা। দুই গালে হাত দিয়ে মুচকি হাসে ছোঁয়া।
“happy birthday কলিজা।
সাদি হাতে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে ছোঁয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলে। ছোঁয়া ফুল গুলো হাতে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সাদিকে। সাদিও দুই হাতে আগলে নেয় ছোঁয়া।
” থ্যাংক ইউ সো মাচ
ছোঁয়া খুশি হয়ে বলে।
“আমরা আমরাই তো।
সাদি ছোঁয়াকে ছাড়িয়ে ছোঁয়ার দুই গালে হাত দেয়।
” আজকেই বাড়িতে চলে যেতাম তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে। কিন্তু তুমিই চলে এসে আমাকে সারপ্রাইজ দিতে।
ছোঁয়ার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে সাদি৷ ছোঁয়া মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
“ড্রেস পাল্টে এসো। আমার বন্ধুরা ওয়েট করছে।
ছোঁয়ার কপালে চুমু দিয়ে বলে সাদি। তারপর ছেড়ে দেয়।
ছোঁয়া খাটের ওপর থেকে নিজের কেনা ড্রেসটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে যায় সাদি হাত টেনে ধরে।
ভ্রু কুচকে সাদির দিকে তাকায় ছোঁয়া।
” কি হলো?
“এটা পড়ো না।
সাদি মাথা চুলকে বলে। ছোঁয়ার শান্ত শিষ্ট মুখটা হঠাৎ রাগে আগুন হয়ে যায়।
” কেনো?
দাঁতে দাঁত চেপে বলে।
“ওরা চলে গেলে পইড়ো না। শুধু আমি দেখবো। ওদের দেখাতে চাইছি না বউয়ের হটনেস।
সাদি ছোঁয়ার গাল টেনে দিয়ে মুচকি হেসে বলে। ছোঁয়া ভেংচি কাটে। সাদি কাবাড থেকে একটা প্যাকেট এনে ছোঁয়ার হাতে ধরিয়ে দেয়।
চোখের ইশারায় ছোঁয়াকে যেতে বলে। ছোঁয়া আবারও সাদিকে ভেংচি কেটে চলে যায়।
দশ মিনিট পরেই ছোঁয়া বেরিয়ে আসে। পরনে কালো গাউন। সাদিও কালো শার্ট পড়েছে। ছোঁয়া বেরুনোর পর দেখতে পায় রুমে দুইজন ছেলে আর ইভা কেট সাজাচ্ছে।
ছোঁয়া মুচকি হেসে এগিয়ে যায়। সাদি ছোঁয়াকে ছেলে দুজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারপর সবাই মিলে ঘিড়ে দাঁড়ায় ওদের। ছোঁয়া কেক কেটে সাদিকে প্রথমে খাইয়ে দেয়। সাদিও খাইয়ে দেয়। তারপর সবাইকেই খাইয়ে দেয়। এইটুকু সময়ে ছেলে দুটো রাকিব আর কবিরের সাথে বোন পাতিয়ে ফেলেছে ছোঁয়া।
তারপর সবাই মিলে কেক খাওয়া শেষ করে ডাইনিং এ চলে যায়। বিরিয়ানি অর্ডার করা হয়েছিলো। কবির রাকিব আর সাদি বিরিয়ানি খাচ্ছে।
ইভা ছোঁয়া নিয়ে রুমে চলে গেছে আর দরজাটাও বন্ধ করে দিয়েছে। ভেতরে কি হচ্ছে ওরা কেউ জানে না।
ওদের খাওয়া শেষ হতেই ইভা বেরিয়ে আসে। কিন্তু ছোঁয়া আসে না।
“আমার বউকে কোথায় রেখে আসলি?
সাদি টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলে।
“একটু পরেই দেখতে পাবি। আমরা এখন যাচ্ছি।
চল চল তোরা।
ইভা ওদের তাড়া দিয়ে বলে। সাদির সন্দেহ হয়। কি একটা গন্ডগোল পাকিয়েছে এরা। কিন্তু কি গন্ডগোল এটাই বুঝতে পারছে না
অবশেষে চলে যায় ওরা। ইভা সাদিকে চোখ টিপ দেয়। সাদির টেনশন আরও বেরে যায়। কি হতে চলেছে?
দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এক দৌড়ে রুমে চলে যায় সাদি। দরজা খুলতেই চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায় সাদির। অগানোর কথা ভুলে গেছে। এটা কি দেখছে?
চলবে
#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ৫১
#তানিশা সুলতানা
পরিকে কিছুতেই থামাতে পারছেন না সিমি আর নাজমা বেগম। বাবার কাছে সে যাবেই যাবে। শরীরে ধবধব করছে জ্বর। তবুও সে শান্ত হচ্ছে না। ছটফট করছে। সিমি জাপ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। সিমির থেকে ছোটার চেষ্টা করছে পরি। নাজমা বেগম হতাশ হয়। মেয়ের মুখের দিকে তাকায়।
“এভাবে কি করে রাখবি তুমি এই মেয়েকে?
ও তোর কাছে থাকবে না। ওকে নিয়ে যেতে বল সিমি।
নাজমা বেগম হতাশ গলায় বলে। সিমি মায়ের কথা শুনে আরও একটু চেপে ধরে পরিকে।
” আমি ওকে যেতে দেবো না মা। ও আমার মেয়ে। আমার পরি।
পরির মাথায় পরপর কয়েকটা চুমু দিয়ে বলে সিমি।
রেগে যায় নাজমা বেগম।
“এসব ঢং ছাড় তুই। আমি হিমুর বাবার সাথে কথা বলে নিয়েছি। সামনের সপ্তাহেয় তোদের বিয়ে দিয়ে দেবো। এই মেয়েকে দিয়ে দিবি তুই।
বিয়ের পর তোরও মেয়ে হবে। সেই মেয়ে তোকে ভালোবাসবে। এই বাচ্চা তোকে ভালোবাসে না।
সিমির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন তিনি। সিমি রেগে যায়।।
” বারবার কেনো ওকে দেওয়ার কথা বলছো?
রেগে চেঁচিয়ে বলে সিমি। পরি কেঁপে ওঠে। জ্বরে হুশ নেই। সিমি বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় ওকে।
“আমার মেয়ের জ্বর হয়েছে। ডাক্তার না ডেকে ভুল ভাল কথা বলছো?
দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস বলে সিমি।
” ডাক্তার ডাকবোই তো। মানুষ আমরা। ওর বাবার মতো পশু না। ওই ছেলেটাকেও কল করে দিয়েছি। একটু পরে এসে নিয়ে যাবে এই মেয়ে। সাথে উকিল নিয়ে আসবে। যাতে তুই কখনোই আর এই মেয়ের দাবি নিয়ে যেতে ন পারিস।
বলেই হনহনিয়ে চলে যায় নাজমা বেগম। সিমির দুচোখ বেয়ে টপটপ পানি পড়তে থাকে। নিয়ে যাবে পরিকে? সিমি কি নিয়ে বাঁচবে? উকিলও নিয়ে আসবে?
রাত বারোটা। এতো রাতেও যে সিফাত আসবে এটা নিশ্চিত সিমি। এখানে থাকা যাবে না। কিছুতেই পরিকে দেবে না সিমি।
পরিকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে চুল গুলো হাত খোঁপা করে নেয়। তারপর পরির কপালে হাত দিয়ে জ্বর চেক করে। অসম্ভব গরম গা। এখনি ডাক্তার দেখাতে হবে বাবু টাকে। সিমি লম্বা দম নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হনহনিয়ে আলমারির কাছে গিয়ে আলমারি খুলে। তাতে কিছু টাকা আছে। টিউশনি করে জমিয়েছিলো সিমি। টাকা গুলো কোমরে গুঁজে নেয়।
তারপর ভালো করে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমন্ত পরিকে কোলে তুলে নেয় সিমি। দরজার দিকে এক পলক তাকিয়ে বেলকনির দরজাটা খুলে বের হয়। এখন এই রেলিঙ ডেঙাবে কিভাবে?
“পরিকে আমার কাছে দিয়ে তুমি নেমে আসো।
কারো ফিসফিস করে বলা কথা শুনে ভয় পেয়ে যায় সিমি। চমকে সেদিকে তাকায়। সিফাত হাত বারিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু কুচকে ফেলে সিমি।
” আরে পরে দেইখো আমাকে। আপাতত নেমে এসো।
তাড়া দিয়ে বলে সিফাত। সিমি পরির কপালে চুমু দিয়ে সিফাতের দিকে এগিয়ে দেয়। সিফাত কোলে নেয় পরিকে। তারপর সিমির দিকে আরেক হাত বারিয়ে দেয়।
“হাত ধরে নেমে এসো।
সিমি সিফাতের হাত না ধরেই নেমে পড়ে। সিফাত হাত গুটিয়ে নিয়ো মুচকি হাসে।
” তেঁজ আর কমবে না।
বিরবির করে বলে সিফাত।
“আপনি এখানে কেনো এসেছেন?
সিমি রাগে গিজগিজ করতে করতে বলে।
” ওই পাশে গাড়ি রেখে এসেছি। তালা দেয় নি। যদি চুরি টুরি হয়ে যায়? আগে গাড়িতে পৌঁছায় তারপর বলবো।
বলেই টুক করে সিমির হাতটা মুঠো করে ধরে। সিমি ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য মোচরামুচরি মুচকি করতে থাকে।
“আস্তে আস্তে মোচার মুচরি করো। নাহলে যে আমার মেয়ের ঘুম ভেঙে যাবে।
সিমির কানে ফিসফিস করে বলে সিফাত। সিমি স্তব্ধ হয়ে যায়৷ একদম স্যাচুর মতো হাঁটতে থাকে। আসুক টিপটিপ করছে।
” আজকে সব ভুল বোঝাবুঝি কুপিয়ে হত্যা করে ফেলবো সিমি। তরপর পরির জন্য ভাই আনার ব্যবস্থা করবো।
সিফাত সিমিকে চোখ টিপ দিয়ে বলে। কান দুটো হিস হিস করে ওঠে সিমির। গাল দুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। হলো কি লোকটার আজকে?
পাগল টাগল হয়ে গেলো না-কি?
🥀🥀🥀🥀
“আপনে কে আফা? চিনতেছি না আপনারে? আমার রুমে আইলেন কেমনে?
আমি ডরাই অচেনা আফাগো দেখলে।
সাদি শুকনো ঢোক গিলে বলে। ছোঁয়ার রেগে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু রাগে না। মুচকি হেসে মডেলদের মতো এগিয়ে আসতে থাকে সাদির দিকে। ছোঁয়াকে দেখে সাদির গলা শুকিয়ে আসছে। শর্ট ফ্রকে ষোল বছরের কিশোরীকে প্রাপ্ত বয়ষ্ক বউ মনে হচ্ছে। হাঁটার স্টাইল দেখে কে বলবে এই মেয়ে বাচ্চা?
মুখে কোনো মেকাপ নেই। কিন্তু ঠোঁটে গাড়ো লাল লিপস্টিক। কোমর ওবদি চুলগুলো চুল গুলো পেঁচিয়ে কাঠি দিয়ে আটকে দিয়েছে।
গোলুমলু গায়ে ড্রেসটা পারফেক্ট হয়েছে। মনে হয় ড্রেসটা ছোঁয়ার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।
” কেমন সাজিয়েছে রুমটা?
ছোঁয়া সাদির কাছে না গিয়ে খাটের কোনায় দাঁড়িয়ে বিছানার ওপরে রাখা টকটকে লাল গোলাপ টা সাদি দিকে ছুঁড়ে মেরে মিষ্টি করে হেসে বলে।
ব্যছ আজকে সাদিক কেউ বাঁচাতে পরবে না। ধপ করে ক্যাচ ধরে ফুলটা। ফুলটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছে সাদি। আজকে কি তাহলে বাসরটা সেরেই ফেলবে? বেশি কি দ্রুত হয়ে যাবে? কিন্তু বিয়ে তো অনেকদিন হয়ে গেছে। এবার অবশ্যই বাসরটা সারতে হবে।
“ওই সাদু বেবি বলো না।
ধরফরিয়ে ওঠে সাদি। বড়বড় চোখ করো তাকায় ছোঁয়ার দিকে। এই মেয়েকে আজকে খুনই করে ফেলবে সাদিকে। কিন্তু নিরিহ সাদি এত তাড়াতাড়ি প্রাণ হারাতে চায় না।
” বলবি তুই?
ছোঁয়া রেগে বলে।
শুকনো ঢোক গিলে সাদি। আপনি থেকে তুমি, তুমি থেকে তুই, এবার উওর না দিয়ে তুই থেকে যে কিসে নেমে যাবে আল্লাহ মালুম।
“খখখুব সুন্দর
বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলে সাদি।
ছোঁয়াও বাঁকা হাসে।
” বলেন তো কয়টা গোলাপ আছে পুরো রুমটাতে?
সাদির দিকে এক পা এগিয়ে বলে ছোঁয়া। সাদির হাসি মুখ কালো হয়ে গেছে। অনেক গুলো গোলাপ। পুরো রুমটা গোলাপ দিয়ে সাজানো। তো সাদি কি করে জানবে কত গুলো গোলাপ?
“কি বলতে পারবেন না?
ছোঁয়া সাদির গলা জড়িয়ে আদুরী ভঙিতে বলে। সাদি চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। খানিকটা বিরক্ত হয় ছোঁয়া। গলা থেকে হাত সরিয়ে সাদির হাত দুটো নিজের পিঠে রাখে। সাদি চোখ খুলে মুচকি হাসে। ছোঁয়া মুখ বাঁকায়।
” বলেন কয়টা গোলাপ আছে?
কপালে তিনটে ভাজ ফেলে বলে ছোঁয়া।
“এত গোলাপ এখানে কি করে বলবো।
সাদি ছোঁয়ার নাক টেনে বলে। সাথে সাথে ছোঁয়া সাদির থেকে সরে যায় এক ঝটকায়। রেগে আগুন হয়ে গেছে। সাদি হতদম্ভ হয়ে যায়। কি হলো বুঝতে পারলো না।
” ইভা আপু পই পই করে বলে গেছে। আপনি যদি এখানে কতগুলো গোলাপ আছে বলতে না পারেন তাহলে বুঝে নিতে আপনি আমায় ভালবাসেন না।
একটুও ভালোবাসেন না আমায় আপনি।
ছোঁয়া দুই হাত বুকে গুঁজে গাল ফুলিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টানতে থাকে। সাদি মনে মনে কয়েকটা গালি দেয় ইভাকে। হাতের কাছে পেলে টেনে দুটো থাপ্পড় মারতো। এতখনে বুঝতে পারলো দাঁত কেলানো কারণ। আস্ত একটা বড়দের হাড্ডি ওই মেয়েটা। এখন সাদি করবে টা কি?
কি করে এই অভিমানীকে বোঝাবে ইভা ডপ দিয়েছে।
সাদি বুকে হাত দিয়ে জোরে শ্বাস টেনে ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে যায়। পর পর দুটো ঢোক গিলে ছোঁয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। ছোঁয়া অগ্নি দৃষ্টিতে ঘাড় উঁচু করে তাকায় সাদির দিকে। সাথে সাথে সাদি নাকের ওপর চুমু খেয়ে বসে।
“ইভা ভুল বলেছে তোমায়।
সাদি ছোঁয়ার কাঁধে মাথা গুঁজে বলে৷ ছোঁয়া চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে।
” অনেক মেয়েকেই এভাবে দেখেছি ট্রাস্ট মি কখনো তাকাতেই ইচ্ছে হয় নি। কিন্তু আজকে নজর সরাতে ইচ্ছে করছে না। মন চাইছে গিলে খেয়ে ফেলি।
ছোঁয়ার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলে সাদি। জমে যায় ছোঁয়া। এই অনুভূতির সাথে পরিচিত নয় ছোঁয়া। এ কেমন অনুভূতি? ভালোও লাগবে আবার অন্য রকমও লাগছে।
“তোমার জন্য আরও একটা সারপ্রাইজ আছে জান।
বলেই সাদি পাঁজা করে কোলে তুলে নেয় ছোঁয়াকে।
চলবে