#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ৪০
#তানিশা সুলতানা
আলতো করে ছোঁয়ার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দেয় সাদি। চমকে ওঠে ছোঁয়া। খিঁচে বন্ধ করে রাখা চোখ জোড়া আপনাআপনি বড়বড় হয়ে যায়। সাদির মুখটা গম্ভীর। যেনো কিছুই হয় নি। গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার দিকে।
ছোঁয়া হাঁসফাঁস করছে। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। ছাড়াতে চাইছে নিজেকে সাদির থেকে। ছোঁয়া যত সরার জন্য নরাচরা করছে সাদি ততই আঁকড়ে ধরছে। ছোঁয়ার দৃষ্টি সাদির বুকের দিকে।
“একদম ছটফট করবে না। সারাক্ষণ বাড়িতেই থাকবে পরির সাথে। বুঝলে?
ফিসফিস করে বলে সাদি। ছোঁয়া শুকনো ঢোক গিলে মাথা নারায়। সাদি ছোঁয়ার নাক টেনে দিয়ে ছেড়ে দেয়। ছোঁয়া খানিকটা দুরে গিয়ে দাঁড়ায়। জোরে জোরে শ্বাস টানতে থাকে। যেনো এতখন শ্বাস বন্ধ ছিলো। সাদি বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছে।
” কফি বানিয়ে দাও।
সাদি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে। ছোঁয়া লজ্জায় নরতে পর্যন্ত পারছে না। মাথা নিচু করে জামা মুঠ করে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট চিপে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া।
অস্বস্তিকর পরিবেশ। এখান থেকে ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে। এই লোকটার সামনে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মারাই যাবে।
“কি হলো বানাও কফি?
সাদি ছোঁয়ার নরাচরা না দেখে আবারও বলে। চমকে ওঠে ছোঁয়া৷ শ্বাস নেওয়ার শব্দ বেরে যায়। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।
” আআমি পারি না কফি বানাতে।
আমতা আমতা করে চোখ বন্ধ করে বলে ছোঁয়া। সাদি ভ্রু কুচকে তাকায়।
“জাস্ট পানি গরম করে কফি ছেড়ে দেবে তাতে। করো।
মাথা চুলকে বলে সাদি। ছোঁয়ার এবার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। লজ্জায় ফেলে এখন মজা নেওয়া হচ্ছে।
দাঁতে দাঁত চেপে সাদির দিকে এক পলক তাকিয়ে এক দৌড়ে চলে যায় ওখান থেকে। সাদি ছোঁয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
” এতে পিচ্চি কেনো ইডিয়েটটা?
বিরবির করে বলে সাদি।
তারপর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কফি বানাতে লেগে পড়ে।
ছোঁয়া রুমে এসে দরজা লক করে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে বুকে হাত দিয়ে। ইসসস কি করলো লোকটা? লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে ছোঁয়ার।
“কি রে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? নামাজ পড়বি না?
সিমি জায়নামাজ বিছাতে বিছাতে বলে। ছোঁয়া চোখ খোলে। সাবিনা বেগম তজবি হাতে তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার দিকে। বুঝে যায় নি তো?
ছোঁয়া বুকে হাত দিয়ে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করে এক দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। সিমি আর সাবিনা বেগম নামাজে দাঁড়িয়ে যায়।
সাবিনা বেগম রান্না করেছে। ছোঁয়া খাবে না বলেছে। হাইচে বমি হয় ছোঁয়ার। কিছু খেতে বমিও আরও বেশি হয়ে। সাদি বেঁছে বেছে হাইচই ভাড়া করেছে।
খাবার টেবিলে ছোঁয়াকে দেখবে আশা করেছিলো সাদি। কিন্তু আশা বিফলে গেলো। সিফাতও খায় নি। খাবার গলা দিয়ে নামছে না ওর। পরি সিফাতের কোলে বসে আছে। জেদ ধরেছে বাবাকে ছাড়া যাবেই না। কিছুতেই যাবে না। পরির আবদার ফেলার সাধ্য সিফাতের নেই। সিমি ভ্রু কুচকে সিফাতের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা হিসেবে কতটা নিখুঁত এই লোকটা। কে বলবে এক সময় এই বাচ্চাটার মাকেই ছেড়ে দিয়েছিলো এই অমানুষটা?
পরির মুখের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করে সবটা ঠিক করে নিতে। সবটা বলতে শুধু সিফাতকে নিজের আশেপাশে থাকতে দিতে। মেয়ের স্কুলে দুজনের মিলে মেয়েকে নিয়ে যেতে। বিকেল বেলা দুজন মেয়ের দুহাত ধরে ঘুরতে।
কিন্তু বিবেক বাঁধা দেয়। বেইমানদের হ্মমা করতে নেই।
” পরি খেয়ে নাও
সিমি সিফাতের পাশে বসে বলে। সিফাত আড়চোখে তাকায় সিমির দিকে। সিমি একবারও তাকায় না। পরি সিফাতের বুক থেকে মুখ তুলে। চোখের কোনে পানি।
“কাঁদছো কেনো তুমি?
সিমি চোখ মুখ শক্ত করে বলে।
” বাবা যাবে না।
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বলে পরি। সিফাত দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সিমি সিফাতের দিকে তাকায়।
“ঠিক আছে তোমাকেও যেতে হবে না।
ভাত পরির মুখের সামনে ধরে বলে সিমি।
” আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
শব্দ করে কেঁদে ওঠে বলে পরি। সিমি দাঁতে দাঁত চেপে তাকায় সিফাতের দিকে। সিমির দৃষ্টিতে ভয় পেয়ে যায় সিফাত।
“কে বলেছে যাবো না? যাবো তো আমি।
সিফাত হাসার চেষ্টা করে বলে। মুহুর্তেই পরির কান্না শেষ হয়ে যায়। টুস করে সিফাতের গালে চুমু দিয়ে দেয়।
সিফাতও হেসে ফেলে। বাবা মেয়ের খুনশুটি দেখে ভালো লাগা ছুঁয়ে যায় সিমির মনে। কিন্তু সেটা বুঝতে দেয় না। চুপচাপ পরির মুখে খাবার পুরে দেয়।
পরিও খুশি মনে সিফাতের সাথে কথা বলতে বলতে খেয়ে নেয়।
ছোঁয়া রেডি হয়ে নেয়। জামাকাপড় সব লাগেজে পুরে নেয়। সিমি কাপড় পড়েছে। ছোঁয়া থ্রি পিছ পড়েছে। শাড়ি ক্যারি করা ভীষণ অস্বস্তিকর।
পরি সিফাতের সাথে মেচিং করে সাদা ফ্রক পড়েছে।
এখানে শুধুমাত্র সাদি একা থাকবে। সাদি মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে চলে যায় সাতটার সময়। এত আগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলেন না সাবিনা বেগম। কিন্তু ছোঁয়ার মন খচখচ করছে। যাওয়ার আগে দেখাও করে গেলো না ছোঁয়ার সাথে। গাল ফুলিয়ে ফেলে ছোঁয়া।
কথাই বলবে আর ওই লোকটার সাথে।
অফিসে বসে হাসফাস করছে সাদি। কোনোকিছুতেই ভালো লাগছে না। বাড়িতে গেলেই ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। সব কিছু মাথা থেকে ঝেড়ে কাজে ফোকাস করার চেষ্টা করে।
তখনই কেবিনের দরজায় কেউ নক করে।
সাদি বিরক্ত হয়। ফাইলে চোখ রেখেই কাম ইন বলে।
মেঘা হাঁটু ওবদি জামাটা টেনেটুনে চুল ঠিক করে ঢুকে পড়ে।
“গুড মর্নিং সাদি।
এক গাল হেসে বলে মেঘা। সাদি ভ্রু কুচকে তাকায় মেঘার দিকে।
” এখন তো অফিস টাইম না। কেউ নেই ও অফিসে। তাহলে তুমি কি করছো?
কলম ঘোরাতে ঘোরাতে কপালে তিনটে ভাজ ফেলে বলে সাদি।
“চলে আসলাম।
সাদির সামনে চেয়ার টেনে বসে বলে মেঘা।
” কি করে আসলে সেটাই জিজ্ঞেস করেছি। জানলেই বা কি করে আমি এখন অফিসে?
সাদির প্রশ্ন শুনে মেঘা কিছু বলে না। তাকিয়ে থাকে সাদির দিকে।
“কি বলতে চাইছি সেটা জানা ইমপটেন্ট? না কি কি করে আসলাম সেটা জানা জরুরি?
দুই হাত টেবিলের ওপর রেখে বলে মেঘা।
” বলো কি বলবে?
ফাইল খুলে তাতে মনোযোগ দিয়ে বলে সাদি।
“আমার আপনাকে দরকার। বিয়ে করবেন আমায়?
মেঘা সোজাসাপ্টা বলে দেয়।
সাদি ফাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেঘার দিকে তাকায়।
” আমি বিবাহিত। ভুলে যাও নি নিশ্চয়?
দাঁতে দাঁত চেপে বলে সাদি।
“হুম ভুলি নি। আরে ওই মেয়ে আপনাকে কি দিতে পারবে? বাচ্চা একটা। ওর তো ফিটার খাওয়া উচিৎ। কিচ্ছু বোঝে না৷ কখনো সুখী হতে পারবেন না আপনি।
মেঘা জোর গলায় বলে।
” আউট
হাতের কাছে থাকা কাঁচের গ্লাসটা আছাড় মেরে চিৎকার করে বলে সাদি। ভয় পেয়ে যায় মেঘা। শুকনো ঢোক গিলে।
“আমার বউকে নিয়ে একটা কথা শুনবো না আমি। আমাকে প্রপোজ করতে এসেছিস তুই? আমাকে? বের করছি তোর প্রপোজ
সাদি আশেপাশে কিছু খুঁজে। রাগে শরীর কাঁপছে।
চলবে
#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ৪১
#তানিশা সুলতানা
বাড়িতে এসেও মন ভালে নেই ছোঁয়ার। মেঘলা আকাশের মতো কালো হয়ে আছে মুখখানা। এতদিন বাড়িতে আসার জন্য কত পাগল ছিলো। এখন সেই বাড়িটাই অসয্য লাগছে। সাবিনা বেগম ছোঁয়া দের বাড়িতেই নামিয়ে দিয়ে গেছে ওদের। এখানে দুই দিন থেকে বাড়ি নিয়ে যাবে বলে গেছে।
বাবা মায়ের সাথে কোনো রকমে একটু কথা বলে নিজের রুমে চলে এসেছে। বুকের বা পাশটায় অসম্ভব চিনচিন ব্যাথা করছে। সব কিছুই বিষ্ষন্ন লাগছে। ফোনের দিকে বারবার তাকাচ্ছে। কিন্তু ফোনের আলোটাও জ্বলছে না।
এখনো জামা কাপড় পাল্টায় নি।
সাদির নাম্বারটাও নেই। এক বাড়িতে থাকলেও কখনো নাম্বার নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে নি। বা সাদিও দেয় নি। ছোঁয়ার নাম্বারও হয় তো সাদির কাছে নেই।
তাহলে কি কথা হবে না?
আতঙ্কে ওঠে ছোঁয়া। চোখ দুটো ভিজে ওঠে। ফোনটা ছুঁড়ে মারে বিছানায়। নিজের কপালেও দু’চারটা থাপ্পড় দেয়।
কথা না বলে থাকবে কি করে? মনের গহীনে যে ওই লোকটার জন্য এক অকাশ সমান জায়গা তৈরি হয়ে গেছে। সেখানে শুধুই লোকটার বিচরণ।
সিমি এখনো বাবা মাকে বলে নি কিছুই। নিজের সাথে ঘটে যাওয়া একটা কথাও বলে নি। বললে বাবা মা ভীষণ কষ্ট পাবে। নাজমা বেগম ভীষণ রেগে আছে সিমির ওপর বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সাইফুল রহমান একটুও রাগ করে নি। জীবনটা সিমির তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারটাও সিমির। কোনো কিছু চাপিয়ে দেবে না। ছোট মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিয়ে খুব বড় ভুল করেছে সেটা হারে হারে টের পাচ্ছেন উনি।
ওই টুকুনি মেয়ে যে মানিয়ে গুছিয়ে সংসার করছে এটাই অনেক।
সাদি কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মেঘাকে কিছু বলার আগেই দৌড়ে চলে গেছে। কোনো কাজেই মন বসাতে পারছে না সাদি। বাড়ি ফিরবে কি করে সেটাই ভাবছে। পুরো বাড়িটা ফাঁকা। এতদিন তো একা থাকারই অব্ভাস ছিলো সাদির। হঠাৎ করে পুচকে মেয়ের পাল্লায় পড়ে অব্ভ্যাসটা পাল্টে গেলো।
“সাদি আসবো?
ইভা নক করে বলে। কপাল থেকে হাত সরিয়ে নরে চরে বসে সাদি।
” আয়
বলেই কলম হাতে তুলে নেয় ফাইলে মনোযোগ দেবে বলে।
“শুনলাম বউ না কি চলে গেছে?
চেয়ার টেনে বসে বলে ইভা।
” চলে গেছে কেমন কথা? বাড়িতে গেছে।
কপাল রাগ দেখিয়ে বলে সাদি। ইভা ঠোঁট টিপে হাসে। খুব ভালো ভাবেই ফেসে গেছে সাদি এটা ভালোই বুঝতে পারছে।
“ওই একই হলো। গেছে তো?
হাত দিয়ে চুল গুলো নেরে এক গাল হেসে বলে ইভা।
সাদি ফাইল বন্ধ করে।
” ওই মেয়ে কি জাদু জানে না কি রে?
দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে সাদি।
“তা তো একটু জানেই। নাহলে কি তোকে বশ করতে পারতো?
” মিথিও এতো ভালোবাসা ফিল করেও আমার মন গললো না। আর এই মেয়ের রাগ আর বদমাইশি দেখে পাগল হইলাম?
ইভার মনটা খারাপ হয়ে যায় মিথি নামটা শুনে। হাসিমাখা মুখটা কালো হয়ে যায়।
“ওর কথা কেনো তুলিস?
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে ইভা।
” ইদানীং খুব মনে পড়ে। কালকে ওর বোনকে দেখলাম। বড় হয়ে গেছে।
সাদি উদাসীন ভঙিতে বলে।
“আচ্ছা বাদ দে। কথা বলেছিস ছোঁয়ার সাথে?
” রাতে কল করবো। এতখনে ছটফট করুক।
মৃদু হেসে বলে সাদি।
“বাবা হাসাতেও শিখে গেছিস দেখি।
ভেঙিয়ে বলে ইভা। সাদি খানিকটা লজ্জা পেয়ে যায়। কখনো এভাবে হাসা হয় নি। কিন্তু ইদানীং খুব হাসি পায়। আবার কারো সামনে হাসতেও লজ্জা করে।
লজ্জা পাওয়া নিয়েও অনেকখন হাসে ইভা। তারপর দুজনে মিলে বেশ কিছুখন গল্প করে সাথে কাজও করে নেয় গল্পের ফাঁকে।
দুপুরে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে ছোঁয়াকে ওর বাবা। খাবারের প্রতি কেনো নজর নেই ছোঁয়ার৷ খালি সাদির কথা মনে পড়ছে। উনি খেয়েছে? কি করছে? আমাকে মিস করছে?
মনের মধ্যে এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এতে আরও বেশি বিরক্ত ছোঁয়া। এত মনে কেনো পড়বে? ওনার তো মনে পড়ছে না। উনি তো দিব্যি ভালো আছে।
নাজমা বেগম খাবার বেরে দিচ্ছে। সিমি পরিকে খাওয়াচ্ছে আর নিজে খাচ্ছে। পরির মনটা খারাপ। বাবাকে দেখে না দুই ঘন্টা হয়ে গেলো। কি করছে বাবা?
সিমি মুখে খাবার গুঁজে দিচ্ছে আর পরি মন মরা হয়ে চিবচ্ছে।
সিমি পরির মনের কথা বুঝতে পারে।
” খাওয়া শেষ করে বাবার সারকথা বলিয়ে দেবো।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে সিমি। হাসি ফুটে ওঠে পরির মুখে।ফোঁকলা দাঁত বের করে এক গলা হাসে। পরির হাসি দেখে সিমি আর ছোঁয়াও মুচকি হাসে।
রাত দশটা বাজে। আজকে ছোঁয়া একা থাকবে জেদ ধরেছে। সিমি বলেছিলো ওদের সাথে থাকতে কিন্তু ছোঁয়া থাকবে না।
কোনো রকমে খাবার খেয়েই নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। নাজমা বেগম আর সাইফুল এসে দরজা ধাক্কিয়েছে অনেকখন কিন্তু দরজা খুলে নি।
কথাও বলে নি।
বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে ছোঁয়া। রাগ হচ্ছে নিজের প্রতি। উনি কল দেবে না এটা জানা ছোঁয়ার। কিন্তু নিজে কি করে পারলো নাম্বার আনার কথা ভুলে যেতে?
নাম্বার আনলে তো কল করতে পারতো। খবরটা জানতে পারতো।
বুক ফেটে কান্না আসছে ছোঁয়ার। হারে হারে টের পাচ্ছে ওই লোকটাকে ছাড়া ওর একটা দিনও চলবে না।
বেশ কিছুখন কান্না করার পরে বুঝতে পারে ওর ফোন বাজছে। ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না। প্রভা আর শাশুড়ি ছাড়া আর কেউ কল করে না ওর ফোনে। ভেবে নেয় ওরাই হয়ত কল করেছে।
ভীষণ বিরক্ত হয়। কান্না করেও শান্তি নেই। কান্নার মাঝেও বাঁধা দেবে এরা।
দুই বার কল দেওয়ার পরে সাদি কটমট চোখে তাকায় ফোনের দিকে। দুপুরে খাওয়া হয় নি রাতেও খায় নি এখনো। অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েই কল করেছে। কিন্তু ইডিয়েটটার কল ধরার নামই নেই। সারা বাড়ি খুঁজে ছোঁয়ার একটা জামা পায় না সাদি। এতে আরও বেশি বিরক্ত হয়। সব কিছু নিয়ে যাওয়ার কি আছে?
বেলকনিতে ফ্লোরে গোল হয়ে বসে সাদি। এখন কল না ধরা ওবদি কল দিতেই থাকবে।
ইচ্ছে করছে ঠুস করে কানের নিচে কয়েকটা থাপ্পড় দিতে।
আবার কল দেওয়া শুরু করে। এবার ছোঁয়ার বিরক্ত আকাশ ছুঁই ছুঁই। ধাপ করে উঠে বসে ফোনটা ধরে
“সমস্যা কি তোর? কান্না করছি বুঝতে পারছিস না? কান্নার মধ্যেও তোর বিরক্ত করা লাগবে?
কানে ফোন নিয়েই ঝাঁঝালো গলায় বলে। কন্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ কান্না করেছে। সাদি মুচকি হাসে।
” কান্না কেনো করেছো?
শীতল গলায় জিজ্ঞেস করে সাদি। বুকের ভেতর ধক করে ওঠে ছোঁয়ার। চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায়। শুকনো ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে।
“আপনি কল করেছেন?
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
” কেনো করতে পারি না?
সাদি পাল্টা জিজ্ঞেস করে।
ছোঁয়া লজ্জা পেয়ে যায়। মাথা নিচু করে মুচকি হাসে।
“ভিডিও কল দেই?
সাদি বলে।
” এমবি নেই।
ছোঁয়া রিনরিনিয়ে বলে।
“আচ্ছা আমি এমবি দিচ্ছি। ততখনে তুমি চোখে মুখে পানি দিয়ে এসো।
সাদি কল কেটে দেয়। ছোঁয়া ফোনটা বুকে জড়িয়ে দুই মিনিট বসে থাকে। তারপর মুচকি হেসে ওয়াশরুমে চলে যায়।
চলবে
#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ৪২
#তানিশা সুলতানা
দুই মিনিটেই চোখে মুখে পানি দিয়ে চলে আসে ছোঁয়া। আর তর সইছে না। মনের মধ্যে মানুষটাকে দেখার জন্য উতলা শুরু করে গেছে। সারাটা দিন গেলো দেখতে পারে নি।
কোনোরকমে চোখ মুখ মুছে তোয়ালে ছুঁড়ে মারে আলনার দিকে। তোয়ালে আলনায় না পড়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। বিরক্ত হয় ছোঁয়া। চোখ মুখ কুঁচকে আবার গিয়ে আলনায় রেখে আসে। এবার ফোনটা হাতে নেবে তখনই বাবার ডাক।
“মা ঘুমিয়েছিস? দরজাটা খোল না।
শফিক রহমান দরজায় কড়া নেরে ডাকে। ছোঁয়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ভেবে নেয় কথা বলবে না। বাবা ভাববে ঘুমিয়ে পড়েছে। যেই ভাবা সেই কাজ। দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে। এদিকে শফিক রহমান ডেকেই যাচ্ছে। যেনো পণ করেছে মেয়ে দরজা না খোলা ওবদি এখান থেকে এক পা নরবে না।
এবার আর ছোঁয়া চুপ করে থাকতে পারে না। বুক ভরে শ্বাস নেয়।
” বাবা ঘুমচ্ছি আমি। সকালে কথা বলবো। যাও তুমি।
নিচু স্বরে বলে ছোঁয়া।
“একবার দরজা খোল। দেখেই চলে যাবে তোকে।
আগত্য ছোঁয়া ওড়না মাথায় দিয়ে দরজা খুলে। শফিক রহমান মুচকি হাসে। হাত বুলিয়ে দেয় ছোঁয়ার মাথায়।
” রাগ করেছিস? দরজা কেনো বন্ধ করে ছিলি?
ছোঁয়ার গালে হাত দিয়ে বলেন উনি।
“নাহহ বাবা রাগ করি নি। একটু মাথা ব্যাথা করছিলো তাই।
ছোঁয়া একটু হাসার চেষ্টা করে বলে।
” এখন ঠিক লাগছে?
“হুমম একদম ফিটফাট আছি।
” মা তোর সাথে একটু কথা বলতে চাইছিলাম।
মুখটা কালো করে বলেন উনি।
“কি কথা?
” তোর আপির বেপারে। কি হয়েছে বল তো? বিয়েটা ভেঙে দিলো। এখন আবার তোর ভাসুরের মেয়েকে নিয়ে এসেছে। বাচ্চাটাও ওকে মা বলে ডাকে।
চিন্তিত ভঙিতে বলেন উনি। ছোঁয়া কি বলবে বুঝতে পারছে না। কি বলা উচিৎ? এদিকে সাদি অপেক্ষা করছে। বাবাকেও বলতে পারছে না তুমি যাও। দ্বিধায় ভুগছে ছোঁয়া।
“সকালে বলবো তোমায়। এখন ঘুমাও।
মাথা নিচু করে রিনরিনিয়ে বলে ছোঁয়া।
” খুব ঘুম পেয়েছে?
“হুমম।
” আচ্ছা যাচ্ছি। শুভ রাত্রি
“শুভ রাত্রি
ছোঁয়া মুচকি হেসে বলে। বাবা চলে যেতেই ছোঁয়া বুকে হাত দিয়ে জোরে শ্বাস টানে। ঠাপ করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এক লাফে বিছানায় গিয়ে বসে।
ফোনটা হাতে নিতেই দেখতে পায় সাদির বাইশটা কল। গলা শুকিয়ে যায় ছোঁয়ার। শুকনো ঢোক গিলে কল ব্যাক করে।
ভিডিও কল দেয়। সাদি সাথে সাথে রিসিভ করে। ছোঁয়ার চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায়। তারাহুরো করে কল কেটে দেয়।
” জলহস্তি জানেও না বউ কল করলে কল কেটে ব্যাক করতে হয়।
ছোঁয়া বিরবির করে বলে। সাথে সাথে ফোন বেজে ওঠে। ছোঁয়া কানে হেডফোন গুঁজে ফোন রিসিভ করে সামনে বালিশে রেখে দেয়।
“কল কেনো রিসিভ করলেন? জানেন না বউ কল করলে কেটে কল ব্যাগ করতে হয়?
সাদি ভ্রু কুচকে তাকায় ছোঁয়ার দিকে। WhatsApp এ কল করলেও কেটে কল ব্যাক করতে হয় জানা ছিলো না সাদির।
” কল ব্যাক কেনো করবো?
সাদি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“এটাই নিয়ম। পরের বার থেকে কল রিসিভ করলে কথাই বলবো না।
গাল ফুলিয়ে বলে ছোঁয়।
” তো নিয়ম টাকি তুমি বানিয়েছো?
সাদি মুচকি হেসে বলে।
“হুম বানিয়েছি।
মুখ বাঁকিয়ে বলে ছোঁয়া।
সাদি ছোঁয়াকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।এলোমেলো চুল। হালকা অন্ধকার রুম থাকায় ছোঁয়াকে কালো দেখাচ্ছে। তবু সাদির কাছে খুব মিষ্টি লাগছে।
ছোঁয়া এবার সাদির দিকে ভালো করে তাকায়৷ সাথে সাথে এক রাশ লজ্জা এসে জড়ো হয় ছোঁয়ার মুখে।
মাথা নিচু করে ফেলে। সাদি খালি গায়ে৷ ফর্সা বুকের কালো লোম দেখেই ছোঁয় লজ্জা পেয়েছে।
” আচ্ছা এর পর থেকে রিসিভ করবো ন। এবার বলো খাইছো?
সাদি গম্ভীর গলায় বলে।
“হুম। আপনি খাইছেন?
ছোঁয়া মাথা নিচু করেই বলে
” নাহহ এখনো খাওয়া হয় নাই৷ পরে খাবো।
সাদি একটা ফাইল হাতে নিয়ে বলে।
“কেনো খান নাই?
” এমনিতেই।
কল রিসিভ করতে এত দেরি হলো যে?
“বাবা এসেছিলো। কথা বললাম।
ছোঁয়া এখনো মাথা নিচু করে আছে। কথা গুলোও রিনরিনিয়ে বলেছে।
” ওহহ আচ্ছা। তো কান্না কেনো করছিলে?
ছোঁয়ার লজ্জা এবার বেরে যায়। আরও একটু নুয়িয়ে ফেলে মাথাটা। একদম গলা আর থুতনি মিশে গেছে। গাল দুটো লাল আকার ধারণ করছে। সাদি সামনে থাকলে ঠিকই বুঝতে পারতো। কিন্তু এতটা দুরে থেকে বুঝতে পারলো না।
“আমায় মিস করছেন?
ছোঁয়া প্রশ্ন করে বসে। সাদি তাকায় ছোঁয়ার দিকে। দুই গালে হাত দিয়ে ফোনের স্কিনের দিকে একটু ঝুঁকে।
ছোঁয়া সাদির দিকে তাকিয়ে আছে উওর শোনার অপেক্ষায়।
” নাহহহ তো
তোমায় কেনো মিস করবো?
সাদির কথা শুনে ছোঁয়ার মনটা খারাপ হয়ে যায়। ভীষণ রাগ হয়। এতখনে য়ে গা দুটোতে লজ্জা ছিলো তা এখন রাগে শক্ত করে ফেলে।
দাঁতে দাঁত কটমট করে।
“তাহলে কল কেনো দিছেন?
দাঁতে দাঁত চেপে বলে ছোঁয়া।
” ভুল করে চলে গেছে। আমি তো মেঘার নাম্বারে ডায়াল করেছিলাম।
সাদির কথা শুনে খট করে কল কেটে দেয় ছোঁয়া। গাল বেয়ে পানি পড়ছে।
সাদি হতদম্ভ হয়ে যায়। এইটুকু কথায় কল কেটে দেবে ভাবে নি৷ মানুষ এতটা ইডিয়েট কি করে হয়?
WhatsApp এ কেউ ভুল নাম্বারে ডায়াল করে?
এই টুকু কমনসেন্স নেই।
“এই বাচ্চাকে নিয়ে বাকিটা জীবন কাটাবো কি করে? এর অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতেই তো জীবন পার হয়ে যাবে।
সাদি দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বিরবির করে বলে।
ছোঁয়া ঠিক করে ফেলেছে আর কাঁদবে না। কেনো কাঁদবে? রং নাম্বারে ডায়াল করেছে?
বজ্জাত বেটা আর কথাই বলতো না ওনার সাথে।
মনে মনে বলে ছোঁয়া৷ তরপর ফোনটা সুইচঅফ করে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ে।
হঠাৎ মনে হয়।
” উনি তো ভুল করে দেয় নাই কল। তাহলে কি আমাকে রাগানোর জন্য বললো?
ছোঁয়ার এবার নিজের কপাল নিজেই চাপকাতে মন চাইছে। এতোটা গাঁধি কেনে ও? সামান্য মজা বুঝে না?
সকাল সকাল সিফাত এসে হাজির৷ নাজমা বেগম সবে ফজরের নামাজ শেষ করে বেরিয়েছে তখনই দরজায় কড়া নারার শব্দ পায়। আর দরজা খুলেই সিফাতকে দেখতে পায়।
উনি সিফাতকে দেখে একটুও অবাক হয় না।
“ভেতরে এসো বাবা।
মুচকি হেসে বলেন উনি।
সিফাত ইতস্তত বোধ করছিলো। কিন্তু ওনার হাসিমুখ দেখে খানিকটা স্বাভাবিক হয়।
একটু হাসার চেষ্টা করে ওনার পেছন পেছন ভেতরে ঢুকে।
” ওই আসলে আন্টি পরিকে ছাড়া কখনো থাকি নি।
চেয়ার টেনে গুটিশুটি মেরে বসে বলে সিফাত।
“হ্যাঁ বাবা বুঝতে পেরেছি আমি।
তুমি বসো। পরি এখনো ঘুম থেকে উঠে নি।
” আমি যাবো? একটু দেখবো।
সিফাত মাথা নিচু করে বলে।
“হুমম যাও না। ওইদিকের রুমটা।
উনি কিচেনে চলে যায়। সিফাত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বুকে ফু দিয়ে হাঁটা শুরু করে সিমির রুমের দিকে।
দরজাটা খোলাই ছিলো। দরজা ঠেলে ভেতরে পা রাখে সিফাত। নীল ড্রিম লাইট জ্বলছে। পরির সিমির ওপর হাত পা তুলে ঘুমচ্ছে।
সিফাত মুচকি হাসে।
গুটিগুটি পায়ে সিমির কাছে যায়। ফ্লোরে হাঁটু মুরে বসে পড়ে।
সিটির মুখের ওপর পরে থাকা ছোট চুল গুলো কানের পেছনে গুঁজে দেয়।
তারপর সিমির কপালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে অনুভব করতে থাকে সিমির শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ।
” কি করে ভুল শুধরে নেবো আমি? কোনো একটা উপায় বলো না প্লিজ?
আমি সয্য করতে পারছি না। মরে যাচ্ছি আমি।
বিরবির করে বলে সিফাত। চোখ দুটো ভরে আসে। টুস করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে সিমির চোখে।
সাথে সাথে সিফাত সিটকে দুরে সরে যায়। পরির পাশে গিয়ে বসে পড়ে।
সিমি আড়মোড়া ভেঙে চোখ পিটপিট করে চোখ খুলে। অন্ধকার এখনো কাটে নি।
সিমি পাশ ফিরে পরির দিকে তাকায়৷ পরির পাশে সিফাতকে দেখে স্বাভাবিক নজরেই তাকায়।
“পারমিশন ছাড়া কারো রুমে ঢুকতে হয় না। জানেন না?
ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে সিমি।
সিফাত মুচকি হাসে।
” নাহহহ জানি না। শিখতে চাইছি তোমার থেকে। শিখাবে?
সিমি বিরক্ত হয়। নিজের থেকে পরিকে সরিয়ে উঠে বসে।
“সিমি ফেলে দেওয়া জিনিস কুড়িয়ে নেয় না।
বলেই গটগট করে চলে যেতে নেয় সিমি।
” তাহলে আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও
পা থেমে যায় সিমির। কপালে তিনটে ভাজ ফেলে সিফাতের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
“হয় মেয়েকে ছেড়ে বিয়ে করে নাও। নয়ত মেয়ের বাবাকে গ্রহণ করে নাও।
সিফাত সিমির সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলে।
সিমি কথা বলে না। চোখও সরায় না সিফাতের থেকে।
” বিয়ে করে নিলে আবারও মেয়ে হয়ে যাবে সমস্যা নেই। ভুলেও যাবে পুরোনো মেয়েকে। আর খুব সুখেই
সিমি দাঁতে দাঁত চেপে থাপ্পড় দিতে যায় সিফাতকে। সিফাত মুচকি হেসে সিমির হাতটা ধরে ফেলে।
“খারাপ আমি। তো এবার আমার খারাপ রুপটাই দেখো।
বাঁকা হেসে বলে সিফাত।
চলবে