#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ৩৪
#তানিশা সুলতানা
“আচ্ছা জ্বালাই পড়লাম তো।
সাদি বিরক্ততে চোখ মুখ কুঁচকে বলে। ছোঁয়া সাদির বিরক্তিতে পাত্তা না দিয়ে তারাহুরো করে মাথা মুছছে সাদির।
সাদি ওয়াশরুমে ঢোকার পরে ছোঁয়া তোয়ালে হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। ছোঁয়া খেয়াল করেছে সাদি কখনোই ভালো করে মাথা মোছো না।
সাদি বের হতেই হাত ধরে টেনে খাটে বসিয়ে দিয়ে মাথা মোছা শুরু করে।
” এই মেয়ে পবলেম কি তোমার?
সাদি ছোঁয়ার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে ধমক দিয়ে বলে। ছোঁয়া কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ায়।
“ধমকান কেন? আপনার গা গরম হয়ে যাচ্ছে। তারাতাড়ি মাথা মুছে দিলে জ্বর আসবে না আর।
রিনরিনিয়ে বলে ছোঁয়া। সাদি ফোঁস করে শ্বাস টানে।
” আমি ঠিক আছি। এই টুকুনি জ্বরে আমার কিচ্ছু হয় না। এতো কেয়ার করার মতো কিছু হয় নি।
ধমক দিয়ে বলে সাদি। ছোঁয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। চোখের কোনে জমা হয় এক চিলতে জল। খুব করে কান্না পাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে ছোঁয়া। সেটা খেয়াল করে সাদি ভ্রু কুচকে ফেলে।
“আজিব
কান্না করার মতো কি বললাম?
কপালে তিনটে ভাজ ফেলে বলে সাদি। এবার আর ছোঁয়া কান্না আটকাতে পারে না। ফুঁপিয়ে ওঠে। ঘাবড়ে যায় সাদি। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলে।
” শোনো মেয়ে কান্না থামাও
কথায় কথায় প্যাঁচ প্যাঁচ করে কাঁদা আমার পছন্দ না। আর বরের যেটা পছন্দ না সেটা বউদের করতে নেয়।
ঠান্ডা গলায় বলে সাদি। ছোঁয়া ফুঁপানো কমিয়ে ফেলে। হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নেয়। কিন্তু মোছার সাথে সাথে আবার গড়ানো শুরু করে।
সাদি বুঝতে পারে এই কান্না সহজে থামবার নয়।
“শরীরটা কেমন ম্যাচ ম্যাচ করে। আবারও জ্বর এসে গেলো। তাড়াতাড়ি যাও খাবার রেডি করো। খেয়ো ঔষধ খেতে হবে তো।
ফট করে কান্না থেমে যায় ছোঁয়ার। সাদির কপালে হাত দিয়ে জ্বর চেক করে। তারপর তারাহুরো করো বেরিয়ে যায়। সাদি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
” এই আস্ত ইডিয়েটটা হঠাৎ অভিমানী মেঘকন্যা কেনো হয়ে গেলো?
তবে মন্দ না।
মুচকি হাসে সাদি। তোয়ালে রোখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করতে থাকে।
ছোঁয়া তারাহুরো করে করলা ভাজি দিয়ে ভাত নিয়ে হাজির। আর সিমিকে বলেছে একটু মাংসের তরকারি নিয়ে আসতে। নিজেও নিয়ে আসতে পারতো। কিন্তু মাংশ বারতে বারতে একটু দেরি হয়ে যাবে তো। আর এই মুহুর্তে এতটুকুও দেরি করতে চায় না ছোঁয়া।
খাটের ওপর প্লেট রেখে হাঁপাচ্ছে ছোঁয়া। বুকে হাত দিয়ে অনবরত শ্বাস টেনে যাচ্ছে।
“এতে তারাহুরো করার কি আছে?
ভ্রু কুচকে বলে সাদি। ছোঁয়া উওর দেয় না। সাদি খাটে গোল হয়ে বসে পড়ে। তখনই সিমি আসে মাংশের বাটি আর পানির জগতে নিয়ে।
হাত জোড়া থাকাতে আর পারমিশন নেয় না। সাদির এনে রাখে। প্রতিউওরে সিমির দিকে একটু তাকায় সাদি।
” আর কিছু লাগলে ডাকবেন স্যার
মুচকি হেসে বলে সিমি।
“স্যার বইলো না। সেই অনেক আগে স্যার ছিলাম। ভাইয়া বলেই ডেকো।
সাদি বলে।
” জ্বী
“মা আসছে। আমি মা কে বলেছি সব। আমার মা কখনো অন্যায়কে পশ্রয় দেয় না। মা যা সিদ্ধান্ত নেবে মেনে নিও। তোমার অসম্মান হবে এরকম সিদ্ধান্ত চাপাবে না আমার না। এই টুকু বিশ্বাস রাখতে পারে।
সিমি কিছু না বলে। মাথা নিচু করে ফেলে।
“আসছি
বলেই সিমি চলে যায়। ছোঁয়া সিমির দিকে তাকিয়ে থাকে। সাদি ভাত মেখে মুখে নেবে তখনই মনে পড়ে ছোঁয়াও তো খায় নি। বিরক্ত হয় সাদি। কেনো খায় নি?
” এই মেয়ে বসো।
ছোঁয়া সিমির কথা ভাবছিলো সাদির কথায় চমকে দেখে। তা দেখে সরু চোখে তাকায় সাদি।
“কি হলো বসো?
ছোঁয়া গুটিশুটি মেরে বসে পড়ে। সাদি ছোঁয়ার মুখের সামনে খাবার ধরে। মুখে এল চিলতে হাসি ফুটে ছোঁয়ার। ওনার হাতে খেতে দারুণ লাগে। ইচ্ছে করে প্রতিদিন খেতে। কিন্তু ওনাকে বলার সাহস হয়ে ওঠে না।
ছোঁয়া খাবার মুখে নেয়। সাদি একবার নিজে খাচ্ছে আরেকবার ছোঁয়াকে খাওয়াচ্ছে।
সিমি পরিকে খাওয়ানোর জন্য ভাত মাখছে। আর সিফাত পরির কানে কানে বুদ্ধি আটছে।
সিমি আড়চোখে বেশ কয়েকবার তাকিয়েছে ওদের দিকে।
” মা হা করো
পরির মুখের সামনে খাবার তুলে দিয়ে বলে সিমি।
“খাবো না।
পরি বুকে হাত গুঁজে গাল ফুলিয়ে বসে বলে।
” কেনো? তুমিই তো বললাম মাংশ খাবে? কপাল রাগ দেখিয়ে বলে সিমি।
“আমি ভাত খাবো কিন্তু তোমার হাতে খাবো না।
” তো কার হাতে খাবে?
“বাবার হাতে।
সিমি প্লেট নামিয়ে নেয়।
” খাও
সিমি খাট থেকে নামতে নিলে পরি ওড়না টেনে ধরে
ভ্রু কুচকে তাকায় সিমি।
“সমস্যা কি?
রেগে বলে।
” আজকে বাবা তোমাকে আর আমাকে খাইয়ে দেবে।
মুচকি হেসে বলে পরি।
“কোন দুঃখে?
সিফাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে।
” ও মা খাও না। বাবা খুব টেস্টি করে ভাত মাখে। খাবে তো বলো? তুমি না খেলে আমিও কিন্তু খাবো না
শুরু হয়ে গেলো মেয়ের আবদার। সিফাত মুচকি হাসে। মেয়ের আবদার কখনোই যে সিমি ফেলবে না এটা খুব ভালো করেই জানা ওর।
সিফাত বড় প্লেটে করে ভাত নিয়ে আসে। সিমি চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। পরি সিমির কোলে বসে গল্প জুড়ে দিছে।
সিফাত ভাত মেখে সিমির মুখের সামনে ধরে। সিমি তাকায় এল পলক সিফাতের দিকে। বুক চিরে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে।
“মা খাও না।
খাবার মুখে নেয় সিমি। পরি খুশিতে মাকে চুমু খায়। তারপর নিজেও মুখে নেয়। সিফাত মা আর মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে। আর তারা ব্লক খেলনা দিয়ে বাড়ি বানাচ্ছে। মেয়ের সাথে যেনো সিমিও আজকে বাচ্চা হয়ে গেছে। মেয়ের সাথে মিলে হাসছে আবার কখনো রাগছে কখনো পরির গাল টেনে দিচ্ছে।
সিফাত মুদ্ধ নয়নে দেখছে। ইসস কত সুখী সে। এই চেয়ে সুখ পৃথিবীতে আছে না কি?
বিকেলে সাদি ঘুমচ্ছে। আর ছোঁয়া পড়ছিলে তখনই কলিং বেল বেজে ওঠে। খুশিতে লাফিয়ে ওঠে ছোঁয়া। শশুড় শাশুড়ী চলে এসেছে। ইসসস কতদিন শাশুড়ীর বকা খাওয়া হয় না।
এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে ছোঁয়া। সাবিনা বেগম মুখ ভার করে ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আর শশুড় মশাইয়ের মুখে হাসি।
” বাবা কেমন আছেন? শাশুড়ী কেমন আছেন?
“আলহামদুলিল্লাহ মা। তোমার কেমন চলছে?
শশুড় মশাই ছোঁয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন।
” খুব ভালো।
ভেতরে আসুন।
ওনারা ভেতরে আসে। শশুড় মশাই চলে যায় সাদিকে দেখতে। ছোঁয়া দাঁত কেলিয়ে শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে আছে।
“এতে দাঁত কেলানো কিছু হয়নি। এখুনি তুমি যাবে আমার সাথে পার্লারে।
দাঁতে দাঁত চেপে বলেন সাবিনা বেগম।
” ও মা এখন সাজুগুজু করবো কেনো? ধরে বেঁধে আরেকটা বিয়ে দিয়ে দেবেন না কি?
ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে বলে ছোঁয়া।
“ইহহহহ বুদ্ধির কি বহর
নাক ফুটো করবো তোমার। নাক ফুল সাথে এনেছি।
ছোঁয়া মুচকি হাসে। নিজেও চাই ছিলো নাক ফুটো করতে। একবার মা বলেছিলো বিবাহিত নারীদের নাক ফুল না থাকা স্বামীর জন্য অমঙ্গল। যদি ছোঁয়া এসব বিশ্বাস করে না। তবুও শাশুড়ি তো বিশ্বাস করে। তার বিশ্বাসের জন্যই পড়বে।
” নাক তে ফুটো করবোই। আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন। তারপর বড়ছেলের বউকে দেখুন। তারপর যাবে নাক ফুটো করতে।
শাশুড়ীকে এক প্রকার টেনে রুমে নিয়ে যায়। লাগেজ খুলে শাশুড়ীর শাড়ি বের করে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর চলে যায় শরবত বানাতে।
চলবে
#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ৩৫
#তানিশা সুলতানা
সাবিনা বেগম ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে সিমির দিকে। সিমি কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। সামনে কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তি তো হবেই। পরি সিমির কোলে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ছোঁয়া শাশুড়ীর পায়ের কাছে বসে আছে।
“শাশুড়ী আমার আপি কিন্তু খুব ভালো। সব রান্না পারে। খুব কাজের মেয়ে।
এক গাল হেসে বলে ছোঁয়া।
” তুমি কি পারো সেটা বলো?
মুখ বাঁকিয়ে বলেন তিনি।
“আমি খেতে পারি। আপনি আর আপি রান্না করবেন আমি শুধু খাবো। দারুণ না বেপারটা?
হাতে তালি দিয়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলে ছোঁয়া। সিমি অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার দিকে। সাবিনা বেগম ওপরে কঠিন হয়ে থাকলেও ভেতরে হাসছে।
” শোনো মেয়ে আমি তোমাকে সোজাসাপ্টা কিছু প্রশ্ন করবো। বিনা সংকোচে উওর দিবা।
সিমির দিকে তাকিয়ে বলে সাবিনা বেগম। সিমি সময় না নিয়েই মাথা নারায়।
“তোমার কি নতুন করে সংসার বাঁধার ইচ্ছে আছে?
সিমি তাকায় সাবিনা বেগমের দিকে। এরকম প্রশ্ন করবে এটা যেনো সিমি জানতো। ছোঁয়া গোল হয়ো বসেছে রায় শোনার জন্য।
” ইচ্ছে থাকলে এতদিন অপেক্ষা করতাম না। অনেক আগেই বিয়ে করে নিতাম।
মাথা নিচু করে আলতো হেসে উওর দেয় সিমি।
“আমি কখনোই আমার ছেলেমেয়েদের ওপর কিছু চাপিয়ে দিয়েছি বলে তো মনে হয় না। হ্যাঁ সাদু বিয়ে করতে চাই নি। আমি জোর করেছি। সাদু যদি বলতো ওর পছন্দের কেউ আছে তাহলে কখনোই এমনটা করতাম না।
কিন্তু ওর পছন্দের কেউ ছিলো না।
সিফাত কখনো তোমার কথা আমাকে বলেই নি। কেনো মিথ্যে বললো ও তোমায়?
দুধের শিশু পরিকে কোলে নিয়ে সিফাত যখন বাড়িতে ঢুকে ছিলো আমি তখন শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম বাচ্চাটা কে? ও বলেছিলো ওর মেয়ে। ব্যাস আর কখনো কিছুই জিজ্ঞেস করি নি।
কোলে পিঠে করে বড় করেছি।
তাহলে আমার সেই সন্তান কেনো মায়ের নামে এতবড় মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তোমার মতো নিষ্পাপ মেয়েকে ঠকালো?
গলা ধরে আসে সাবিনা বেগমের। চোখ দুটো ভিজে ওঠে। সিমির চোখেও পানি। ছোঁয়া শাশুড়ীর পা জড়িয়ে ধরে কোলে মাথা রাখে।
” খুব খারাপ মা আমি হয়ত। ছেলেরা কখনোই আমাকে কিছু বলে না। আমার মেয়েও কখনো কিছু বলে না। যেনো আমি ওদের বোঝা।
এবার সাবিনা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে ফেলে।
“পরিকে আমরা সবাই খুব ভালোবাসি। ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
আমি চাই তুমি সারাজীবন আমাদের সাথে থাকো। আমার মেয়ে হয়ে।
সাবিনা বেগমের প্রস্তাবে ঘাবড়ে যায় সিমি। এটা কি করে সম্ভব?
করুন চোখে তাকায় সাবিনা বেগমের দিকে।
” ভেবে দেখো। তারপর বলো। জোর করা হবে না তোমায়।
আমার ছেলে কখনোই তোমার ধারে কাছেও আসবে না তুমি না চাইলে এটা আমি তোমায় কথা দিতে পারি।
সিমি মাথা নারায়। পরির মুখের দিকে তাকায়। এখানে এদের সাথে থাকতে চায় না সিমি। আবার পরিকে কি করে এদের থেকে আলাদা করবে? এতোগুলো বছর তো এরাই সামলেছে পরিকে।
“আমি বরং যাই। আপনার ছেলেকে গিয়ে দেখি কি করছে।
ছোঁয়া উঠে চলে যায়। সাবিনা বেগম সিমির সাথে টুকটাক গল্প জুড়ে দেয়। পড়ালেখা পরিবার স্বপ্ন এসব সম্পর্কে।
সাদি এখনো ঘুমিয়ে আছে। শরীর খারাপ থাকায় ঘুম ভাঙছে না।
ছোঁয়া রুমে এসে সাদির মাথায় হাত রাখে। এখনো কপাল গরম। চট করে কিচেনে চলে যায়। ঝাল করে নুডলস রান্না করে রুমে আসে।
সাদির মাথার কাছে নুডলসের বাটিটা রাখে।
” এই যে শুনছেন?
উঠুন না। শুনছেন?
মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় ডাকে ছোঁয়া।
সাদি এক লাফে উঠে বসে। ছিটকে কিছুটা দুরে সরে যায়। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ছোঁয়া ভয় পেয়ে যায়। এভাবে সিটকে কেনো গেলো?
“এভাবে একদম ডাকবা না আমায়।
বুকে হাত দিয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে বলে সাদি।
” ও মা কেনো? এভাবে না ডাকলে কিভাবে ডাকবো?
ভ্রু কুচকে বলে ছোঁয়া।
“যেভাবে খুশি ডাকো। কিন্তু এইভাবে ডাকবা না।
বিরক্ততে চোখ মুখ কুঁচকে বলে সাদি। ছোঁয়া মন খারাপ করে মাথা নিচু করে ফেলে।
” ডাকছো কেনো? মাএ না ঘুমাইলাম।
হাই তুলে বলে সাদি।
“খাবার খেয়ে ঔষধ খেতো হবে তাই।
মাথা নিচু করে বলে ছোঁয়া।
” এক ঘন্টা হয় নি ঔষধ খাইছি। এখন আবার কিসের ঔষধ?
কপালে তিনটে ভাজ ফেলে বলে সাদি।
“জ্বর তো কমে নাই তাই।
” জ্বর কমে নি বলে দুই মিনিট পরপর ঔষধ খেতে হবে? তোমার কি হয়েছে বল তো? মাথা খাচ্ছো কেনো আমার?
ধমক দিয়ে বলে সাদি। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ছোঁয়া। ইদানীং সাদির ধমক গুলো সয্য হয় না। একটু কি ভালোবেসে বলা যেতো না? এভাবে ধমক দেওয়ার কি আছে?
সাদি ফোঁস করে শ্বাস নেয়। মাথাটা টনটন করছে ব্যাথায়। আর একটু ঘুম হলে ভালো লাগতো। এখন আবার প্যাঁচ প্যাঁচ করে কান্না। জীবনটা একদম যা ইচ্ছে তাই অবস্থা।
“খাইয়ে দাও
চোখ বন্ধ করে চুল টেনে বলে সাদি। ছোঁয়া যেনো এটারই অপেক্ষায় ছিলো। চট করে চোখের পানি মুছে বাটি হাতে সাদির দিকে এগিয়ে বলে। চামচে নুডলস পেঁচিয়ে সাদির মুখের সামনে ধরে।
সাদি সরু চোখে তাকায় ছোঁয়ার দিকে।
” একটু বসো। কুলি করে আসি।
আলস ভঙিতে বিছানা ছাড়ে সাদি। হাঁটতে ইচ্ছে একদমই হচ্ছে না। কি আর করার? মহারানী যখন বলেছে তখন তো খেতে হবেই।
বেশ সময় নিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে বের হয় সাদি। ছোঁয়া এখনো একই ভঙিতে বসে আছে বিছানায়।
সাদি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ছোঁয়ার সামনে বসে। ছোঁয়া পরম তৃপ্তিতে খাইয়ে দিতে থাকে সাদিকে।
দুই এক বার মুখে দিয়েই নাক মুখ কুঁচকে ফেলে সাদি। ছোঁয়ার হাসি মুখটা চুপসে যায়।
“রেখে দাও পরে খেয়ে নিবো।
আবারও কম্বল টেনে শুয়ে পড়ে সাদি। ছোঁয়া সাদির আধখাওয়া খাবার টার দিকে তাকিয়ে আছে।
” চুল টেনে দাও।
ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে সাদি। ছোঁয়া মুচকি হাসে। আধখাওয়া খাবারটা তারাহুরো করে খেয়ে নিয়ে সাদির মাথার কাছে বসে টুল টেনে দিতো থাকে।
বিকেলে সিমি আর ছোঁয়াকে নিয়ে সাবিনা বেগম বের হবেন বলে তাড়া দিচ্ছে। সাদির জ্বর অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু এখনো ঘুমচ্ছে। সাদিকে একা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না ছোঁয়ার। আবার শাশুড়ীর মুখের ওপর বলতেও পারছে না যাবে না।
তাই মন খারাপ করে কালো একটা থ্রি পিছ পড়ে নেয়। সাথে কালো হিজাব বেঁধেছে। সিমিও কালো জামা পড়েছে। পরিকে সিফাতের কাছে রেখে যাবে।
সিফাতের কাজ নেই। সামিম চৌধুরি সিফাত আর সাদি বাড়িতে থাকবে আর মেয়েরা বেরবে।
শেষবার সাদির চুলের ভাজে হাত বুলিয়ে বেরিয়ে যায় ছোঁয়া।
শাশুড়ী প্রথমে ওদের নিয়ে পার্লারে আসে। ছোঁয়া ভীষণ ভয় পাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। নাক তো ফুটো করতেই হবে। সাবিনা বেগম নাক ফুল সাথে এনেছে। একেবারে নাক ফুল পড়িয়েই নিয়ে যাবে।
চোখ বন্ধ করে সাদির মুখটা স্বরণ করে আর তখনই নাক ফুটো করে দেয়।
নাক ফুটো করা শেষে কিছু কেনাকাটা করে নেয়। সিমি নিজে পছন্দ করে পরির জন্য কিছু জামাকাপড় কিনে নেয়৷
সিমিকেও একটা নাক ফুল কিনে দেয় সাবিনা বেগম। সিমি নিতে ইতস্তত করছিলো কিন্তু মুখের ওপর না করতে পারো না।
সাদি ভাই আর বাবার সাথে গল্প করছে। পরি সাদির কোলে বসে আছে।
ছোঁয়া বাসায় ঢুকেই সাদির সামনে পড়ে। সাদি এক পলক ছোঁয়ার দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। ছোঁয়াও রুমে চলে যায়। এখন অপেক্ষা সাদি রুমে আসার।
সাদির থেকে খুব করে শুনতে ইচ্ছে করছে “তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে ”
কিন্তু এটা কি আদো সাদি বলবে? যদি না বলে?
মন খারাপ করে বসে আছে ছোঁয়া। জামাকাপড় পাল্টাতে ইচ্ছে করছে না।
আয়না দেখতেও ইচ্ছে করছে না।
একটু পরেই সাদি রুমে আসে। তবুও ছোঁয়া তাকায় না সাদির দিকে। সাদি এসে ছোঁয়ার পাশে বসে ছোঁয়ার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।
“ঔষধ তো খেয়েছি। তাহলে মন খারাপ কেনো?
ছোঁয়া উওর দেয় না। তাকায়ও না সাদির দিকে। সাদি জোরে শ্বাস টানে।
” তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। নাক ফুলে খুব মানিয়েছে।
চলবে
#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ৩৬
#তানিশা সুলতানা
“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। নাক ফুলে খুব মানিয়েছে।
এই কথাটাই ছোঁয়ার ছোট মনে ভালোবাসার পরিমানটা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। মনের ছুঁয়ে যায় এক রাশ ভালোবাসা। প্রিয় মানুষটির একটু প্রশংসাই পারে হাজারও মন খারাপ দুর করতে।
ঠোঁটের কোনে ফুটে ওঠে এক চিলতে হাসি। সাদির দিকে তাকায়। সাদি ছোঁয়ার দিকে তাকিয়েই ছিলো। তাই দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। চোখে চোখ পড়তেই মৃদু হাসে সাদি।
ছোঁয়াও একটু হাসে। চোখ সরিয়ে নেয় না। পড়তে চেষ্টা করে সাদির গভীর চোখ দুটো।
” ব্যাথা পেয়োছো খুব?
ছোঁয়ার ছোট্ট হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে সাদি।
ছোঁয়া সাদির কাঁধে মাথা রাখে।
“একটু পেয়েছি।
চোখ বন্ধ করে অনুভব করে সাদিকে।
“মা তো এসবে বিশ্বাস করে। আমি জানি তুমি এতে বিরক্ত হয়েছো। কিন্তু মাকে জোর দিয়ে বলতে পারি নি। সরি ফর দ্যাট।
ছোঁয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে সাদি। ছোঁয়া চোখ তুলে এক পলক তাকায় সাদির মুখের পানে।
কয়েকদিন আগেও এই লোকটাকে বিরক্ত লাগতো। নাক ফুটো করার কথা শুনলে বিরক্ততে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলতো। কিন্তু এখন এই লোকটাকেই খুব ভালো লাগে। এই লোকটার আশেপাশে থাকতে ইচ্ছে করে। নাক ফুটো করতে ইচ্ছে হয়েছে এই লোকটার নাম করে।
” খারাপ লাগছে? ব্যাথায় ঔষধ খাবে?
ছোঁয়ার থেকে কোনো সারা না পেয়ে বলে সাদি।
“খারাপ লাগছে না।
ছোঁয়া রিনরিনিয়ে সাদির হাত জড়িয়ে ধরে বলে।
” তাহলে কথা বলছো না কেনো? মন খারাপ?
“ছিলো এখন আর নেই।
মৃদু হেসে সাদির বুকের ওপর মাথা রেখে বলে। সাদিও এক হাতে আগলে নেয় ছোঁয়াকে। এভাবে কতখন ছিলো জানা নেই। দুজনই চুপচাপ। একজন আরেকজনের নিশ্বাসের শব্দ গুনছে।
” তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেই?
হাঁসফাস করতে করতে বলে সাদি। ছোঁয়া সাদির কথার অর্থ বুঝতে পারে না।হাত ছেড়ে মাথা তুলে তাকায় সাদির দিকে। সাদি চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস টানে। তারপর ছোঁয়ার দুই গালে হাত দেয়। ছোঁয়া তাকায় সাদির চোখের দিকে। কিছু একটা আছে এই চোখে। লাল হয়ে গেছে চোখ দুটো। সাদি রেগে গেলে চোখ লাল হয়ে যায়। কিন্তু এই লাল রাগের লাল না।
সাদি ছোঁয়ার কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। ছোঁয়া সাদির হাতের ওপর নিজের হাত রাখে।
খুব যত্ন করে ছোঁয়ার নাকে ঠোঁট ছুঁয়েয়ে দেয় খানিকখন সময় নিয়ে। আবেশে চোখ বুজে নেয় ছোঁয়া।
“এখন শাড়ি পড়লে একদম পারফেক্ট বউ লাগবে তোমায়।
নাক টেনে দিয়ে বলে সাদি। তারপর ছোঁয়াকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে। ছোঁয়া একটু সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে।
” শাড়ি?
বলেই এক দৌড় দেয়। সাদি ছোঁয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলে।
“পাগল বানিয়ে দেবে আমায়।
বা হাতে মাথা চুলকে বিরবির করে বলে সাদি।
ছোঁয়া দৌড়ে শাশুড়ীর রুমে যায়। সাবিনা বেগম তখন সিমির মাথায় তেল দিচ্ছেন। খুব ভাব হয়ে গেছে দুজনের মধ্যে। নিজের মেয়ের মতো আপন করে নিয়েছে উনি সিমিকে।
” শাশুড়ী আমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিন।
হাঁপাতে হাঁপাতে সাবিনা বেগমের পাশে হাঁটু মুরে বসে বলে।
“হঠাৎ শাড়ি কেনো?
তেল দিতে দিতে বলে সাবিনা বেগম। সিমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার মুখের দিকে।
” আপনার ছেলে বলেছে এখন শাড়ি পড়লে একদম পারফেক্ট বউ বউ লাগবে।
ছোঁয়া লাজুক হেসে বলে। সাবিনা বেগমের হাত থেমে যায়। বাঁকা চোখে তাকায় ছোঁয়ার দিকে। এই মেয়েটার বুদ্ধি শুদ্ধি কোনো কালেই হবে না।
সিমি ঠোঁট টিপে হাসে।
“শাড়ি নিয়ে এসো।
গম্ভীর গলায় বলে সাবিনা বেগম।
ছোঁয়া আবার দৌড়ে রুম চলে যায়। সাদি কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে আছে। ছোঁয়া ঝড়ের গতিতে এসে আলমারি খুলে নীল রংয়ের শাড়ি বের করে। সাদি ভ্রু বাঁকিয়ে ছোঁয়ার কার্যকলাপ বোঝার চেষ্টা করছে।
ছোঁয়া শাড়ি বের করে সাদির দিকে এক পলক তাকিয়ে আবারও দৌড়ে চলে যায়।
ততখনে সিমির মাথায় তেল দেওয়া শেষ।
সিমি চুল হাত খোঁপা করে চলে গেছে পরির কাছে।
সিফাত এক হাতে চাকু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই পাপের বোঝা আর বইতে পারছে না। এর একটা বিহিত দরকার। কতদিন আর সিমির চোখে দোষী হয়ে থাকবে?
বউ বাচ্চা থাকতেও কেনো অনাথের মতো বাঁচবে? ভেবেছিলো মা একটা সুস্থ বিচার করবে। কিন্তু মা তা করলো না। একবার তো ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারতো?
কেনো করলি এমনটা?
তা তো করলোই না। উল্টে সিফাত নিজেই আগে বাড়িয়ে বলতে গেছিলো তখন স্পষ্ট বলে দিলো -তোর সাথে এই বিষয়ে কোনো কথাই বলতে চাই না আমি”
শুনতে তো পারতো কথা গুলো। একটু বোঝায় চেষ্টা তো করতে পারতো?
সিমি দরজার নক না করেই ঢুকে যায়।
“পরি আছো এখানে?
সিফাতকে উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে সিমি।
সিমির কন্ঠ শুনে সিফাত ঘুড়ে দাঁড়ায়। সিফাতের হাতে ছুড়ি দেখে ভ্রু কুচকে তাকায়।
” সুইসাইড করবেন না কি?
করলে একটা সুইসাইড নোড লিখে যাবেন। আর তাতে স্পষ্ট লিখে দেবেন “নিজের ইচ্ছেতে সুইসাইড করেছি আমি। এখানে সিমি নামের মেয়েটির কোনো দোষ নেই”
কেমন?
হাসিমুখে বলে সিমি। সিফাত খুব আহত হয়। একটু তো সিরিয়াসলি নিতে পারতো?
এভাবে তাচ্ছিল্য করলো।
“আমি মরলে তোমাকে নিয়েই মরবো। অনেক জ্বালাচ্ছো তুমি আমায়।
আরে বাবা দোষ করেছি। তিনটা বছর শাস্তি ভোগ করছি। মরণ যন্তনা পেয়েছি। আর কি শাস্তি পাবো? আরও শাস্তি দেওয়ার থাকলে দাও। তবুও তো একটা বিহিত দরকার।
ফাঁশির আসামিও দোষ স্বীকার করলে শাস্তি কমে যায়। আর আমি তো খুন করি নি।
চাকুটা শব্দ করে ফেলে দিয়ে রাগে পায়চারি করতে করতে বলে সিফাত।
সিমি বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ায়।
” আমি কখনোই আপনাকে হ্মমা করবো না।
শক্ত গলায় বলে দেয় সিমি।
সিফাত তেড়ে আসে সিমির দিকে। সিমি একটু ঘাবড়ে যায়। দুই পা পিছিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। সিফাত শব্দ করে দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে দেয়। চাবিটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়।
সিমি কপালে ভাজ ফেলে সিফাতের কার্যকলাপ দেখছে।
করতে চাইছে টা কি?
“আমি পারছি না সিমি। মরে যাচ্ছি আমি। আমাকে বাঁচাবে না তুমি? আমার কথা না হয় নাই ভাবলে। নিজের মেয়ের কথা তো ভাববে?
আমি মরে গেলে আমার পরি বাঁচবে না। ভীষণ ভালো বাসে আমায়।
হাঁটু মুরে বসে করুন দৃষ্টিতে সিমির দিকে তাকিয়ে বলে সিফাত।
সিমি তাচ্ছিল্য হাসে।
” বেইমানদের জন্য মায়াটা একটু বেশিই জমে যায়। কি গেরান্টি আছে আমার মেয়েও আমার মতো ঠকবে না?
যাদের রক্তে বেইমানি মিশে গেছে তারা কখনোই বেইমানি ছাড়তে পারে না।
ভালো তো এটাই হবে প্রতিদিন নতুন করে মরার চেয়ে একবারে মরে গেলে।
সিমি কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ফেলে দেওয়া ছুড়িটা আবারও কুড়িয়ে নেয় সিফাত……….
সাবিনা বেগম খুব সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে ছোঁয়াকে। শাড়িতে সত্যিই পারফেক্ট বউ লাগছে ছোঁয়াকে। আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে নিয়ে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় ছোঁয়া।
আচ্ছা এখনো কি সাদি বলবে “একদম পারফেক্ট বউ লাগছে। সাদমান চৌধুরীর বউ”
ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় ছোঁয়া। ঠোঁটে ঠোঁট চিপে মুচকি হাসে।
সাবিনা বেগম চলে গেছে রান্না করতে। রাতের রান্নাটা নিজে হাতেই করতে চাই।
ছোঁয়া শেষ বার নিজেকে দেখে রুমের বাইরে পা বাড়ায়।
আর তখনই
চলবে