#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ২২
#তানিশা সুলতানা
সাদি ড্রাইভ করছে আর ছোঁয়া গাল ফুলিয়ে বসে আছে। খিধেয় পেট চো চো করছে। সেই গতকাল বিকেলে খেয়েছিলো আর এখন পর্যন্ত পেটে কিছুই পরে নি। কেনো যে সাদির ওপর রাগ দেখাতে গিয়ে না খেয়েই চলে আসলো?
নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে ছোঁয়ার। ইচ্ছে করছে দুই গালে দুটো নিজে নিজে চর খেতে।
“এনি পবলেম?
সাদি মন দিয়ে ড্রাইভ করতে করতেই আচমকা বলে ওঠে।
ছোঁয়া সাদির কথা শুনেও না শোনার ভান করে থাকে। কি বলবে লোকটাকে? বলবে আপনার ওপর রাগ করে আমি না খেয়েই চলে এসেছি। আর লোকটা হেংলা ভাববে। ঢং দেখাবে। ছোঁয়া মোটেও হনুমানটার ভাব দেখবে না।
দাঁতে দাঁত চেপে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে ছোঁয়া।
হঠাৎ সাদি গাড়ি থামিয়ে দেয়। ছোঁয়া নরে চরে আশেপাশে তাকায়। ভেবেছিলো হয়ত স্কুলে চলে এসেছে। কিন্তু নাহহ। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামিয়েছে সাদি।
ছোঁয়া মুখ ফিরিয়ে গাড়ির সিটে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। হয়ত ওনার কোনো কাজেই গাড়ি থামিয়েছে। ছোঁয়ার জন্য থামাইনি নিশ্চয়।
সাদি দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। ছোঁয়া সেদিকে এক পলক তাকিয়ে আবারও চোখ বন্ধ করে। মনে মনে হাজারটা গালি দিতে থাকে সাদিকে।
” এটা খেয়ে নাও
ছোঁয়ার কোলের মধ্যে খাবারের প্যাকেট রেখে বলে সাদি। চমকে ওঠে ছোঁয়া। চোখ বন্ধ করে পাঁচ মিনিটে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলো ছোঁয়া।
সাদি আবারও ড্রাইভ করা শুরু করে। ছোঁয়ার ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ফুটে ওঠে।
“পানি?
সাদির দিকে তাকিয়ে বলে।
সাদি চোখের ইশারায় পানির বোতল দেখিয়ে দেয়।
ছোঁয়া কুলি করে প্যাকেট ছিড়ে। বিরিয়ানি দেখে ছোঁয়ার মনটা পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়। চোখ দুটো টিকটিক করে ওঠে।
তোরাহুরো করে প্যাকেট খুলে গাপুসগুপুস করে খাওয়া শুরু করে দেয়। সাদি আড়চোখে একবার ছোঁয়ার দিকে তাকায়।
” কেউ নিয়ে যাচ্ছে না তোমার খাবার। আস্তে আস্তে খাও।
সাদি ফোঁস করে শ্বাস টেনে বলে। ছোঁয়া কানেই তুলে না সাদির কথা।
“ইডিয়েট একটা
সাদি বিরবির করে বলে।
স্কুলের গেইটের সামনে গাড়ি পার্ক করে ভেতরে যায় সাদি আর ছোঁয়া।
পাশাপাশি হাঁটতে থাকে দুজন।
ছোঁয়ার খুব ইচ্ছে করছে সাদির হাতটা ধরে হাঁটতে। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছে না।
সাদির পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতেও পারছে না। তাই সাদির পিছু পিছু হাঁটছে।
” হেই কিউটি নাম কি তোমার?
সাদা শার্ট কাঁধে স্কুল ব্যাগ ঝোলানো একটা ছেলে মিষ্টি হেসে ছোঁয়াকে জিঙ্গেস করে। বয়স খুব বেশি না। হবে হয়ত উনিশ বিশ।
ছোঁয়া এক পলক তাকিয়ে আবার নিজের মতো হাঁটতে থাকে।
“এই মেয়ে নামটা তো বলো?
এবার কালো শার্ট পড়া অন্য একটা ছেলে বলে।
ছোঁয়া কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। পেছনে ঘুরে। পাঁচটা ছেলে আর তিনটা মেয়ে ছোঁয়ার পেছনে। সবাই ছোঁয়ার নাম শোনার জন্য ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
” পরিচয় দেওয়ার সময় নাই। এখান থেকে পঞ্চাশ টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে দশ মিনিট হেঁটে ফুল নগর এলাকায় গিয়ে জিজ্ঞেস করিয়েন সাদমান চৌধুরীর বউ কে?
তাহলেই পরিচয় পেয়ে যাবেন।
মুখ বাঁকিয়ে বলে ছোঁয়া। সবাই হা হয়ে তাকিয়ে থাকে ছোঁয়ার দিকে। কি বললো কেউ ঠিক বুঝতে পারলো না।
ছোঁয়া জীভ বের করে দুই কানে হাত দিয়ে ভেংচি কাটে ওদের।
“এখানে কেনো তুমি? তাড়াতাড়ি এসো।
সাদি ছোঁয়ার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে। ছোঁয়া বিশ্ব জয়ের হাসি দেয়।
পেছনে তাকিয়ে ওদের হাতের ইশারায় সাদিকে দেখায়।
ওরা হা করে তাকিয়ে থাকে ছোঁয়ার দিকে।
আগে থেকে পিন্সিপালের সাথে কথা বলে রেখেছিলো সাদি। তাই আর ভর্তি নিয়ে কোনো ঝামেলা হয় না। স্যার ছোঁয়াকে আজকে থেকেই ক্লাস করতে বলে। ছোঁয়া গদগদ হয়ে যায়।
পিন্সিপালের রুম থেকে বের হয়ে সাদি ছোঁয়াকে জিজ্ঞেস করে আজকে থেকেই ক্লাস করবে কি না?
” অবশ্যই একটা ক্লাসও আমি মিস করতে চাই না।
সাদি ছোঁয়াকে ক্লাস রুমে নিয়ে যায়। ছেলে মেয়ে সব এক সাথে বসেছে। বিরক্ত হয় সাদি। ছেলে মেয়ে এক সাথে কেনো বলবে?
একটা মেয়ে একা বসেছে। সাদি ছোঁয়াকে নিয়ে ওই মেয়েটার কাছে যায়।
“এক্সকিউজ মি আপু
মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়।
” কিছু বলবেন ভাইয়া?
“তোমার পাশে ওকে বসতে দিবা? ও নতুন।
” হ্যাঁ। কেনো দিবে না।
“ধন্যবাদ আপু। তোমার বাসা কোথায়?
” ফুল নগর।
“ওয়াও গ্রেট
আমাদের বাসাও ফুল নগর। ছুটির সময় এক সাথে যেয়ো। কেমন?
” ঠিক আছে।
“ওকে একা ছেড়ো না। এক সাথে থেকো দুজন।
মেয়েটা মিষ্টি হেসে মাথা নারায়৷ ছোঁয়া ভ্রু কুচকে ওদের কথা শুনছে।
সাদি ছোঁয়ার দিকে এক পলক তাকায়।
” ওর মাথায় একটু পবলেম আছে বুঝলে। একটু আতটু বাঁদরামি করবে। মারাক্তক কোনো বাঁদরামি করলে আমাকে কল করবা কেমন?
মেয়েটার কানের মাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে সাদি। খিলখিল করে হেসে ওঠে মেয়েটা। ছোঁয়া নাক ফুলিয়ে ওদের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে।
সাদি মেয়েটার খাতায় নিজের নাম্বার লিখে দেয়।
“আসছি
ছোঁয়ার দিকে বলে ফোন দেখতে দেখতে চলে যায়।
ছোঁয়া মুখ বাঁ কায়।
” ভাবখানা দেখো যেনে শাহরুখ খান। করলা একটা।
গাল ফুলিয়ে মেয়েটার পাশে বসে ছোঁয়া।
“হেই আমি প্রভা। তুমি?
” আমি ছোঁয়া।
আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। তার আগেই স্যার চলে আসে।
সিমি আর সিফাতের মাঝে ঝগড়া চলছে। কেউ কারো কথা শুনছে না। যে যার মতো বলেই যাচ্ছে। পরি দুজনের মাঝখানে বসে একবার সিমির দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার সিফাতের দিকে তাকাচ্ছে। দুজনের চিৎকার চেচামেচিতে বেচারা পরির মাথা ধরে যাচ্ছে।
পাক্কা এক ঘন্টা বকবক করার পর দুজনই ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সিমি আর সিফাত।
চলবে
#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ২৩
#তানিশা সুলতানা
সিমি পরিকে নিয়ে যাবে কিন্তু পরি যাবে না। খুব মন খারাপ হয়ে যায় সিমির। মায়ের থেকে বাবা বড় হয়ে গেলো। চোখের কোনে চিকচিক করছে পানি।
পরি সিফাতের কোলে ঘাপটি মেরে বসে আছে। খুব শক্ত করে সিফাতের গলা আকড়ে ধরেছে। যেনো ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে।
“মামনি মায়ের সাথে চলে যাও।
সিফাত পরির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে।
” আমার মাকে চাই না পাপ্পা। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না।
কান্না করে দেয় পরি। থরথর করে কাঁপছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব ভয় পেয়ে গেছে।
সিমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পরির দিকে। চোখ থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু ধারা। গলা ধরে আসছে।
“সিমি ও এভাবে যাবে না। তুমি চলো। আমি ওকে গাড়ি ওবদি দিয়ে আসছি।
মাথা নিচু করে বলে সিফাত। পরি মুখ লুকায় সিফাতের বুকে। আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সিফাতের গলা।
সিমি তাচ্ছিল্য হাসে।
” আমি তোমার মতো অমানুষ নই। তুমি পেরেছিলে দুধের শিশুকে মায়ের থেকে ছিনিয়ে আনতে। কিন্তু আমি পারবো না বাবার থেকে মেয়েকে আলাদা করতে।
লম্বা দম নেয় সিমি। হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নেয়।
“দুই দিন সময় দিলাম। আমার মেয়েকে বুঝিয়ে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবেন। আর আপনি অনেক দুরে কোথাও চলে যাবেন। যাতে আমার মেয়ে চাইলেও আপনার এই ঘৃনৃত মুখটা না দেখতে পারে।
চলে যায় সিমি। পরিকে আকড়ে ধরে সিফাত। ছেলেদের না কি কাঁদতে নেই। কিন্তু এখন যে খুব কান্না পাচ্ছে সিফাতের। দম বন্ধ হয়ে আসছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কেউ নেই যার কাছে নিজের কষ্টের কথা বলে নিজেকে হালকা করবে।
মাথায় হাত বুলিয়ে ” আমি আছি তো সব ঠিক করে দেবো”
বলার মতো কেউ নেই।
মহান আল্লাহ তায়ালার নিখুঁত সৃষ্টির এই দুনিয়াটা বিষাক্ত লাগছে। ছুটে যেতে ইচ্ছে কাটছে শান্তির দেশে।
যেখানে কেউ ভুল বুঝবে না।
“পাপ্পা আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবো না৷
সিফাত মেয়ের মাথায় চুমু খায়।
” আমাকে যে তোমায় ছাড়তেই হবে মা। আমি যে খুব খারাপ মানুষ।
মনে মনে বলে সিফাত।
পাশের রুমে দরজা বন্ধ করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে সিমি। এতো বছর পরে হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় সিফাতের সাথে কাটানো মধুর দিন গুলো। যে দিন গুলোতে কোনো দুঃখ ছিলো না।
কতো ভালোবাসা ছিলো দুজনের মধ্যে। আচ্ছা এতোটা ভালোবাসার পরে কি করে পারলো ছেড়ে দিতে?
একবারও কি অনু সূচনা হয় নি?
লাউডস্পিকারের এতো বছরের প্রিয় গানটা ছাড়ে সিমি।
বন্ধ দরজা অন্ধকার রুম নিস্তব্ধ পরিবেশ।
“যদি থাকতে তুমি বাঁচতে আমার লাগতো না কঠিন।
যদি থাকতে তুমি কাটতো আমার দিন গুলো রঙিন।
যদি থাকতে তুমি সামনে তোমার এনে দিতাম সব যা যা চাইতে তুমি।
তুমি বলার আগে বুঝতাম আমি যখন মন খারাপ করে থাকতে তুমি।
এমন হবে কোনো দিন আমি আগে ভাবিনি,
যে আমার ছাড়া বাঁচতো না আর সে কেনো বিলিন?
💔
সব গুলো ক্লাস শেষ করে স্কুলের সামনে থাকাটা ফুসকা স্টলে যায় ছোঁয়া আর প্রভা। ফুসকা ছোঁয়ার মারাক্তক পছন্দ। ফুসকা হলে আর কিছুই লাগে না।
” মামা কড়া করে ঝাল দিয়ে তিন প্লেট ফুসকা দিন।
বলেই ছোঁয়া চেয়ারে বসে পড়ে।
“এই ছোঁয়া আমি এতো ঝাল খেতে পারি না।
প্রভা কাচুমাচু হয়ে বলে।
” তোর জন্য কে অর্ডার করেছে?
“কেনো তুই না তিন প্লেট বললি?
” সবগুলোই আমার জন্য। তুই খেতে চাইলে অর্ডার দে।
ছোঁয়া ফোন দেখতে দেখতে বলে। প্রভা ভ্রু কুচকে কিছুখন তাকিয়ে থাকে ছোঁয়ার দিকে। তারপর নিজের জন্য অর্ডার দেয়।
খাওয়া শেষ করে দুজনে হাঁটতে থাকে ফুটপাতের রাস্তা ধরে। উদ্দেশ্য আজকে হেঁটেই বাসায় যাবে।
প্রভা নিজের বয়ফ্রেন্ডের গল্প শোনাচ্ছে ছোঁয়াকে। ছোঁয়াও মন দিয়ে শুনছে।
হঠাৎ ছোঁয়ার চোখ যায় মেইন রোডের পাশে থাকা কফি শপের সামনে সাদি দাঁড়িয়ে আছে। আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভীষণ সুন্দরী একটা রমনি। সাদিকে আঙুল তুলে কিছু বলছে। আর সাদি বারবার হাত ধরার চেষ্টা করছে।
কিন্তু মেয়েটা ধরতে দিচ্ছে না।
বুকের ভেতর ধক করে ওঠে ছোঁয়ার। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে থাকে ওদের। কি সুন্দর মানিয়েছে। সাদির সাথে তো ছোঁয়া বেমানান। ছোঁয়া কোনো দিক দিয়েই সাদির যোগ্য না।
মুচকি হাসে ছোঁয়া।
“এই ছোঁয়া ওই দেখ তোর ভাইয়া?
প্রচার কথায় চমকে ওঠে ছোঁয়া। ভ্রু কুচকে তাকায় প্রভার দিকে।
” এদিকে কি দেখছিস? সামনের দিকে তাকা।
প্রভা ছোঁয়ার মুখটা সামনের দিকে ঘুরিয়ে দেয়।
“আমার বর উনি। ভাই না।
বিরবির করে বলে ছোঁয়া। প্রভা সেটা শুনতে পায় না। বড়বড় পা ফেলে সাদির দিকে এগিয়ে যায় প্রভা। ছোঁয়া ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
” হেই ভাইয়া।
প্রভাকে দেখে চমকে ওঠে সাদি।
“ততুমি এখানে?
মেয়েটির দিকে এক পলক তাকিয়ে রিনরিনিয়ে বলে সাদি।
” আমি আর ছোঁয়া এদিক দিয়েই বাড়ি যাচ্ছিলাম।
এক গাল হেসে বলে প্রভা।
“সাদমান এটা কে?
মেয়েটা বুকে হাত গুঁজে সরু চোখে সাদির দিকে তাকিয়ে বলে।
” মেঘলা তুমি এখন যাও। আমি পরে কথা বলবো তোমার সাথে।
মেয়েটা কপালে তিনটে ভাজ ফেলে সাদির দিকে তাকিয়ে থাকে।
“ও কোথায়?
সাদি জিজ্ঞেস করে
” ওই তো
প্রভা দুরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোঁয়াকে দেখিয়ে বলে।
“চলো
প্রভা আর সাদি ছোঁয়ার কারো আসে। ছোঁয়া তাকায় না সাদির দিকে।। মাথা নিচু করে থাকে।
সাদি ছোঁয়ার বাম হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। ছোঁয়া চমকে ওঠে। তাকায় সাদির দিকে।
” এই রাস্তায় কখনোই আসবা না। হেঁটে কেনো বাড়ি ফিরতে হবে? আমি তো টাকা দিয়েই এসেছিলাম। তাহলে? একদম পন্ডিতি করবা না বলে দিলাম।
সাদি ছোঁয়ার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে। ছোঁয়া মুখ থেকে একটা শব্দও বের করে না। চুপ চাপ মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকে। প্রভা ছোঁয়ার পাশে হাঁটছে।
পরি অসুস্থ হয়ে গেছে। ভীষণ জ্বর এসেছে মেয়েটার। ছোঁয়া পরির পাশে বসে আছে। বাড়ি ফিরে সাদির সাথে একটা কথাও বলে নি। সাদিও বলে নি। সিমি কপালে এক হাত দিয়ে পরির হাতটা ধরে বসে আছে।
নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।
সিফাত ডাক্তার আনতে গেছে।
ছোঁয়া চোখে জ্বালা করছে। শরীরটা ভারি ভারি মনে হচ্ছে। ছোঁয়া খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে আবারও জ্বর আসবে।
চলবে
#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ২৪
#তানিশা সুলতানা
এক আকাশ সমান অভিমান জমা হয়েছে ছোঁয়ার মনে। অভিমানের কারণটা জানা নেই তার।
সাদি খাইয়ে দিচ্ছে পরিকে। সিফাত রান্না করেছে৷ সিমি এখনো একই ভাবে পরির পাশে বসে আছে। ছোঁয়া জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি শূন্য আকাশের পানে।
“তোমাদের পবলেম কি? কি সম্পর্ক তোমাদের?
সাদি পরির মুখে নুডলস পুরে দিয়ে প্রশ্নটা করে। সিফাত ফোঁস করে শ্বাস নিয়ে রুম ছেড়ে চলে যায়। এই প্রশ্নের উওর নেই ওর কাছে।
সিফাত চলে যেতেই সাদি সিমির দিকে তাকায়। সিমি মাথা নিচু করে লম্বা দম নেয়। ছোঁয়া আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে সিমির দিকে তাকায় অধিক আগ্রহে।
” পরি আমার সন্তান
চোখ বন্ধ করে বলে সিমি। কেঁপে ওঠে ছোঁয়া। এটা কি শুনছে? সাদি পূর্ণ দৃষ্টিতে সিমির দিকে তাকায়৷ সিমির চোখ দুটো বন্ধ।
দীর্ঘ তিন বছর রিলেশনশিপ এ থাকার পরে হঠাৎ একদিন সিফাত আমাকে বিয়ে করার কথা বলে৷ খুব ভালোবাসতাম তাই আর দ্বিমত করি নি৷ পালিয়ে বিয়ে করে নেই আমরা।
কলেজের পাশেই একটা বাসা নেয় সিফাত। ওখানেই আমাদের সংসার শুরু হয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একসাথে থাকতাম। বিকেলে আমি বাড়ি চলে যেতাম। আর ও ওর বাড়ি। এভাবেই পাঁচ মাস সংসার করি আমরা। হঠাৎ একদিন আমি ফিল করি আমি প্রেগন্যান্ট। শিওর হওয়ার জন্য চেকআপ করি। পজিটিভ আছে। আর সেদিনই সিফাত আমাকে ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দেয়। আমার হাতে পায়ে ধরে রিকোয়েস্ট করে যাতে আমি ওর সাথে সম্পর্ক না রাখি।
কয়েক লাখ টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়।
গলা ধরে আসছে সিমির। পুরনো ঘাস তাজা হয়ে উঠেছে। হাউমাউ করে কান্না করে ফেলে সিমি। বোনের কথা শুনে আর কান্না দেখে ছোঁয়া নিজেকে আটকে পারে না। দুই হাতে মুখ চেপে কান্না করতে থাকে।
সাদি ছোট্ট পরির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা হয়ত কিছু বুঝতে পারছে না। বুঝলে নিশ্চয় কান্না করে ফেলতো। সাদি পরিকে বুকে চেপে ধরে। সিমিকে শান্তনা দেওয়ার ভাসা নেই।
“আর খোঁজ নেয় নি তোমার?
সাদি প্রশ্ন করে। সিমি কিছুটা সময় নিয়ে কান্না থামায়। হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে ফেলে।
” নিয়েছিলো তো। তার পাঁচদিন পরে কল করে বলেছিলো দুই ঘন্টার মধ্যে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে না দিলে আমাকে খুন করতেও দুবার ভাববে না।
তাচ্ছিল্য হাসে সিমি। সাদি চোয়াল শক্ত করে ফেলে। ভাইয়ের ওপর ঘৃণা হচ্ছে।
“দুই মিনিটে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে কোর্টে জমা করে দিয়েছিলাম।
হোস্টেলে থাকার কথা বলে সিফাতের সেই বাসায় উঠেছিলাম। দিনরাত ওখানেই পরে থাকতাম। কারণ আমার যাওয়ার মতো জায়গা ছিলো না। হাতে টাকাও ছিলো না যে অন্য বাসা নেবো। বাচ্চাটা নষ্ট করার মতো দুঃশাসন হয় নি আমার। বাবা মা বোন কারো সাথে শেয়ার করতে পারি নি। একা একা সামলেছি নিজেকে। কাউকে জানতেও দেয় নি।
তখন আমার অসহায় জীবনে হিমু আসে। একজন দায়িত্বশীল বেস্টফ্রেন্ডের মতো সামলেছে আমায়।
দম নেয় সিমি। কাঁদতে কাঁদতে ছোঁয়ার হেঁচকি উঠে গেছে। সাদি কপালে হাত ঠেকিয়ে সিমির কথা গুলো শুনছে। পরি সাদির বুকে ঘুমিয়ে গেছে।
” স্যার আমি এতোদিন জানতাম না পরি বেঁচে আছে। হাসপাতালের ডাক্তাররা বলেছিলো আমার পেট থেকে মরা মেয়ে হয়েছে৷ কিন্তু নাহহহ। এটা মিথ্যে ছিলো। আপনার ভাই আমার মেয়েকে চুরি করেছিলো।
আমি আমার মেয়েকে ফিরে চাই।
প্লিজ স্যার দয়া করুন একটু। আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিন।
হাত জোর করে কাঁদতে কাঁদতে বলে সিমি।
সাদি কি করবে বুঝতে পারছে না। এতগুলো বছর ভাইকে দেখেছে। এই পিচ্চিটাকে বুকে জড়িয়েই বেঁচে আছে সিফাত। পরি না থাকলে তো সিফাত বাঁচবে না।
“আমায় একটু সময় দাও সিমি। সবটা ঠিক করে দেবো আমি। প্রমিজ।
সিমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে সাদি।
সিমি করুন চোখে তাকায় সাদির দিকে।
” অবিচার করবো না এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারো। তোমার মেয়ে তোমারই থাকবে।
সিমি মাথা নিচু করে। সাদি পরিকে সিমির কোলে দেয়।
“তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু জানার আছে আমার। একটু সময় দাও আমায়।
পরির মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায় সাদি। ছোঁয়া পেছন থেকে জাপ্টে ধরে সিমিকে। দুই বোন আজকে মনের মধ্যে যত কান্না জমে আছে সব টুকু বের করে দিচ্ছে।
মনের মধ্যে জমানো পাহার সমান রাগ অভিমান না পাওয়ার কষ্ট সব কান্নার মাঝেই প্রকাশ করছে।
বইয়ের দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় বিভোর ছোঁয়া। ছোট্ট মনে অনেক গুলো প্রশ্ন জমা হয়েছে। কিন্তু একটা প্রশ্নরও উওর জানা নেই।
” হেই!
সাদি বিছানায় বসে ল্যপটপে নিজের কাজ করছে। আর ছোঁয়া টেবিল চেয়ারে বসে পড়ছে৷ অনেকখন ছোঁয়াকে অনমোনা দেখে কয়েকটা ডাক দেয় সাদি। কিন্তু ছোঁয়ার কোনো হুম নেই৷ তাই হাতের কাছে থাকা কলমটা ছুঁড়ে দেয়।
হকচকিয়ে ওঠে ছোঁয়া। চোখ তুলে তাকায় সাদির দিকে।
“কিছু বলবেন?
ছোঁয়া রিনরিনিয়ে বলে।
” বইয়ের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছো?
সাদি ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে।
ছোঁয়া বই বন্ধ করে রেখে বিছানায় গিয়ে গোল হয়ে বসে। ততখনে সাদি আবার ল্যপটপে মন দিয়েছে।
“আজকেও আপনাকে বেলি ফুল কে দিয়েছে?
ছোঁয়া মাথা নিচু করে প্রশ্ন করে।
” কিনে এনেছি। সাদমান চৌধুরী কারো কাছ থেকে কিছু নেয় না।
সাদি ছোঁয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে।
ছোঁয়া সাদির হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
“আপনিও কি আমাকে ছেড়ে দেবেন?
সাদির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে ছোঁয়া। সাদি কপালে তিনটে ভাজ ফেলে সরু চোখে তাকায় ছোঁয়ার দিকে।
” কত বয়স তোমার? ছেড়ে দেওয়ার কি বুঝো তুমি? ইডিয়েট একটা।
ধমক দিয়ে বলে সাদি। ছোঁয়া চমকায় না। সাদির চোখ থেকে চোখও সরায় না।
“আমার না মনে হচ্ছে আমি আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি। ভালো লাগে আপনাকে।
খুব বেশি দুর্বল হওয়ার আগেই না হয় আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপির মতো কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পারি না। আর কষ্ট পেতেও চাই না।
শান্ত গলায় বলে ছোঁয়া। চোখের কোণে এক বিন্দু পানি জমেছে।
সাদি কিছুখন তাকিয়ে থাকে ছোঁয়ার দিকে। তারপর চোখ সরিয়ে নেয়। ছোঁয়ার কথার উওর দেয় না।
” ছেড়ে দেবেন?
আবারও বলে ওঠে ছোঁয়া।
“হয়ত
সাদি কোল থেকে ল্যাপটপ নামিয়ে ছোঁয়ার দুই বাহু ধরে শুয়িয়ে দেয় ছোঁয়াকে। তারপর গলা ওবদি কম্বল টেনে দেয়।
” তুমি ঘুমাও আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
ছোঁয়ার চোখ দুটো বন্ধ করে দিয়ে বলে সাদি। তারপর আবারও কোলের ওপর ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করতে থাকে। আর অন্য হাত দিয়ে ছোঁয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
“আপনি আমাকে ছেড়ে দিলে আমি আপির মতো অপেক্ষা করবে না। সাথে সাথে আপনার থেকেও দ্বীগুন কিউট ছেলেকে বিয়ে করে নেবে।
আপনার প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। হনুমান একটা।
মুখ বাঁকিয়ে বলে ছোঁয়া। সাদি বাঁকা চোখে তাকায় ছোঁয়ার দিকে। ছোঁয়া ভেংচি কেটে পেছন ফিরে শয়।
” আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে না। আপনাকে আমার সয্য হয় না।
সাদির হাতটা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে ছোঁয়া। সাদি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কাজে মন দেয়। অযথা তর্ক করার মুড নাই।
সিফাত একটার ওর একটা সিগারেট খেয়েই যাচ্ছে। এতদিন মেয়ের জন্য সিগারেট খেতো না। সিমির সব কথাই শুনেছে সিফাত। আর সাদির বলা কথাও শুনেছে। সাদি যখন সিমিকে কথা দিচ্ছিলো “তোমার মেয়ে তোমারই থাকবে” তখন সিফাতের বুকের ভেতর রক্ত খরণ হচ্ছিলে। কি করে থাকবে মেয়েকে ছাড়া? আর পরিও তো সিফাতকে ছাড়া থাকতে পারে না। কি হবে এবার?
হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেট নিজের হাতে ঠেসে ধরে সিফাত। পাগলের মতো কাঁদতে থাকে।
ছোঁয়া ঘুমিয়ে যেতেই সাদি আবার ছোঁয়ার মাথায় হাত রাখে। খুব যত্ন করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
চলবে