#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ১৯
#তানিশা সুলতানা
“আচ্ছা সিমি তোমার কি একবারও মনে হয় না সিফাতের ওই মেয়ের মুখটা একদম তোমার মুখের মতো? গায়ের রংটাও তোমার মতো। হাসলে ঠোঁটের বা সাইডে টোল পড়ে।
কেনো এমনটা? কি কানেকশন এই মেয়েটার সাথে তোমার? তুমি কি কোনো টান অনুভব করো না?
কেনাকাটা শেষ করে কফি খাওয়ার জন্য একটা কফিশপে বসেছে ওরা। এই মুহুর্তে কফি খাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু হিমু জোর করলো। সিফাত আর পরি চলে গেছে সিমিকে কিছু না বলেই। অবশ্য যাওয়ারই কথা। সিমি ইচ্ছে করেই ইগনোর করেছে ওদের।
কফির মগের চুমুক দেয় সিমি। সত্যিই এমনটা ও ভেবে দেখে নি। বাচ্চাটার প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করে সিমি। মনে হয় এটাই ওর মেয়ে৷ একেই নয় মাস পেটে পুরেছে। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কথাটা কাউকে বলা যাবে না। কেউ বিশ্বাস করবে না।
” আমি দেখেছি তোমাকে নয়টা মাস লড়াই করতে। লেভার পেইন ওঠার পরে তোমার সেই চিৎকার আমি এখনো ভুলি নি।
আমার মন বলছে এটাই তোমার মেয়ে৷ নার্স সেদিন মিথ্যে বলেছিলো। আমি স্পষ্ট সেদিন বাচ্চার কান্না শুনেছিলাম অপারেশন থিয়েটারের ভেতর থেকে৷ কিন্তু জোর দিয়ে বলতে পারি নি। কারণ আশেপাশের অনেক কেবিনের বাচ্চা ছিলো।
হিমু সিমির হাতের ওপর নিজের হাতটা রাখে। কাঁচের টেবিলের দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে সিমি। হিমুর কথা গুলো মন দিয়ে শুনছে।
“আমি তোমার বাচ্চাকে তোমার কাছে ফেরাতে লড়াই করবো। আমরা দুজন মিলে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবো আমাদের মেয়েকে।
সিমি এক পলক তাকায় হিমুর মুখের দিকে। চোখ দুটো টলটল করছে।
” তোমার কথা সত্যি হলে আমি নিজে হাতে খুন করবো সিফাতকে। কোনো দিন মাফ করবো না ওকে।
কি দোষ করেছিলাম আমি? যার শাস্তি পেয়ে যাচ্ছি পাঁচটা বছর যাবত।
ভালোবেসে ছিলাম। ভালোবাসার পরিনাম এতোটা ভয়াবহ হয়?
গলা ধরে আসছে সিমি। বুকটা হু হু করছে পরির জন্য। এই তিনটা বছরে খুব কমই মনে পড়েছে সিফাতকে। সবটা সময় স্মৃতি জুড়ে শুধুই মেয়ে ছিলো।
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সিমি। হিমু সিমির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“আমি সবটা ঠিক করে দেবো সিমি। একটু ভরসা করো আমার ওপর। পৃথিবীর সব সুখ তোমার পায়ের কাছে এনে দেবো।
বিরবির করে বলে হিমু।
দুপুরের খাবার রান্না করা প্রায় শেষ সাদির। ডাল ডিম করলা ভাজি আর মুরগীর মাংস রান্না করছে। একা থাকলে শুধু করলা ভাজিই করতো। কিন্তু এয়কন তো এখানে আরও কয়েকজন আছে। তাদের নিশ্চয় করলা ভাজি খেতে অসুবিধা হবে। সবাই তো আর সাদি না। ওদের কথা চিন্তা করেই সাদি মাংস আর ডাল রান্না করেছে।
সাওয়ার নিয়ে রান্না করতে গেছিলো এখন আবার ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। সিফাত সেই কখন এসে রুমে ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। পরি সাদির পাশে টুল টেনে বসে গল্প করছে।
এক রাশ অভিযোগ ঠেলে দিচ্ছে সাদির দিকে। অভিযোগটা সিফাতকে নিয়ে। সে কেনো তাকে বাড়ি নিয়ে এলো? আইসক্রিম কিনে দিলো না
এসব।
সাদি পরির মুখের দিকে এক পলক তাকাচ্ছে তো আবার রান্না করছে।
“এই মিষ্টি মেয়েকে ছেড়ে ওর মা কেনো চলে গেছিলো? না কি ভাইয়াকে তাকে চলে যেতে বাধ্য করেছিলো। না কি অন্য কারণ?
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সাদি। ডালটা বাটিতে ঢেলে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে নেয় সাদি।
” মা কি খাবে বলো?
পরির সামনে হাঁটু মুরে বসে পরির মুখের সামনে নিজের মুখটা রেখে বলে।
পরি সাদির ঘামে জর্জরিত মুখটাতে আলতো হাতে ছুঁয়ে দেয়।
“ও আসুক তারপর খাবো।
মিষ্টি হেসে বলে পরি।
সাদি ভ্রু কুচকে তাকায়।
” ও কে?
“ওই মেয়েটা। মাম্মামের আপি। জানো এতোগুলো ভালো মেয়েটা। আমাকে খাইয়ে দেয়, ঘুম পারিয়ে দেয়। খুব ভালোবাসে।
কিন্তু
পরির হাসি মুখটা চুপসে যায়। চোখ দুটো টলমল করে ওঠে।সাদি বিচলিত হয়ে পড়ে। পরির দুই গালে হাত দিয়ে কপালে চুমু খায়।
” কিন্তু কি মা?
“ওই আংকেল টার কাছে গেলে আমার সাথে কথাই বলে না।
ফুঁপিয়ে ওঠে পরি।
” মা কাঁদে না।
সাদি পরির চোখের পানি মুছে দেয়।
“ও কে মেয়েটা না। মামনি বলবে৷ আর ওই অংকেলটা মামনির বর। সে তো তাকে সময় দেবেই বলে।
পরি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সাদির মুখের দিকে। বর শব্দটার সাথে পরিচিত না পরি। তাই বুঝতে পারলো না। কিন্তু কান্না থেমে গেছে।
” আচ্ছা।
আমি তো সাওয়ার নেবো এখন। তুমি কি করবে তাহলে?
“মাম্মামের কাছে যাবো।
ছোঁয়ার কথা মনে হতেই সাদি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
” ওকে চলো
পরির হাত ধরে রুমে চলে আসে। ছোঁয়া এখনো একই ভাবে শুয়ে আছে। মাঝেমধ্যে কেঁপে কেঁপে উঠছে। হয়ত জ্বরটা বেড়েছে। কিন্তু সাদিতো ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে। তাহলে কেনো বাড়লো জ্বর?
পরি গিয়ে ছোঁয়ার পাশে বসে পড়ে।
“মাম্মামের কি হয়েছে?
ঘুমন্ত ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বলে পরি।
– বাঁদর তো তাই বাঁদরামি করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে।
বিরবির করে বলে সাদি।
তারপর ছোঁয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছোঁয়ার মাথায় হাত রাখে। একটুও জ্বর নেই। তবে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। আর এই ঘামের জন্যই কেঁপে উঠছে।
এই মেয়েরা আস্ত ইডিয়েট।
কোম্বল সরিয়ে ফেলে সাদি। তারপর এসির পাওয়ার বাড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে।
পরি ছোঁয়ার পাশে শুয়ে জাপ্টে ধরে ছোঁয়াকে।
সাওয়ার শেষে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হয় সাদি। সর্বপ্রথম চোখ পড়ে বিছানায় শুয়ে থাকা ছোঁয়ার দিকে। পরিকে জাপ্টে ধরে কি আরামসে ঘুমিয়ে আছে।
সাদি ফোঁস করে শ্বাস টেনে তোয়ালে রেখে আবার কিচেনে চলে যায়।
প্লেট ভর্তি করে খাবার নিয়ে আসে। সাথে এক জগ পানি।
টেবিলে রেখে এসির পাওয়ার কমিয়ে দেয়। তারপর সোফায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ে।
ঘুম ভেঙে যায় ছোঁয়ার। ঘামে জর্জরিত শরীর নিয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না। উঠে বসতেই পেটের ভেতর থেকে ঢেকে উঠে। ভীষণ খিধে পেয়েছে। তাকে পরিকে দেখে ঠোঁটের কোনে হালকা হাসি ফুটে ওঠে।
পরির এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে দেয় ছোঁয়ার।
তারপর বিছানা থেকে নামতে যেতেই চোখের সামনে সাদিকে দেখতে পায়। ছোঁয়ার ড়িক নাক বরাবর বসে এক মনে ল্যাপটপে কিছু দেখছে।
মেজাজ বিগড়ে যায় ছোঁয়ার।
ভেংচি কেটে অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
“ফ্রেশ হয়ে খাবারটা খেয়ে নাও। আর সাথে মামনিকেও খাইয়ে দাও।
সাদি ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখেই বলে। গা জ্বলে ওঠে ছোঁয়ার। আদেশ করা হচ্ছে ওকে? ওই লোকটার আদেশ শুনতে বয়েই গেছে ছোঁয়ার।
” “খ” তে খাবো “ন” তে নাহহহহহহ
সাদি ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছোঁয়ার দিকে তাকায়।
“আবার থাপ্পড় খেতে মন চাইছে?
ইডিয়েট
আর একটা কথা বললে থাপ্পড়ে গাল লাল করে দেবো।
শান্ত গলায় বলে সাদি।
ছোঁয়া একটুও ভয় পায় না।
” খাবো না মানে খাবো না।
ছোঁয়া একবার যা বলে তাই করে। বলেছি খাবো না তো খাবোই না।
কোলের ওপর বালিশ চেপে মুখ বাঁকিয়ে বসে থাকে ছোঁয়া।
সাদি ল্যাপটপ সাইডে রেখে হনহনিয়ে এগিয়ে আসে ছোঁয়ার দিকে।সাদির এগোনো দেখে এবার ছোঁয়া ভয় পেয়ে যায়৷ আবার থাপ্পড় মারলে দাঁত একটাও পাওয়া যাবে না।
দুই গালে হাত দিয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায় ছোঁয়া।
চলবে…
#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ২০
#তানিশা সুলতানা
ছোঁয়া নাক টানছে আর খাচ্ছে। মাঝেমধ্যে শব্দ করেও কেঁদে উঠছে। পরিও খাচ্ছে আর ছোঁয়া দিকে তাকাচ্ছে। ছোঁয়া একটু শান্তনা দেবে তারও সাহস জোগাতে পারছে না।
সাদি চোখ মুখ শক্ত করে একবার ছোঁয়ার মুখে ভাত দিচ্ছে তো আরেক বার পরির মুখে।
তখন সাদির এক ধমকে ছোঁয়া সোজা হয়ে বসে পড়েছিলো। আর পরিও উঠে যায়। তারপর দুটোকে আরেকটা ধমক দিয়ে ওয়াশরুমে পাঠায়। দুজনই কেঁদে ফেলে। ভয়ে তারাহুরো করে হাত মুখ ধুয়ে আবার এসে জায়গা মতো বসে পড়ে।
সাদি পরির গালে একটা চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ব্যাচ পরির কান্না শেষ। কিন্তু ছোঁয়াকে আর বাপ্পি দেয় না তাই ছোঁয়ার কান্নাও থামে না।
অনেকখন যাবত পরি পেটের মধ্যে একটা কথা রেখে খাচ্ছে। কথাটা বের হতে চাচ্ছে কিন্তু ভয়ে বের করতে পারছে না। কিন্তু এখন আর রাখতে পারছে না।
পরি ছোঁয়ার পাশ থেকে উঠে এসে সাদির কোলে বসে।
“পাপা তুমি আমাকে কিসি দিলে তো মাম্মাকে দিলে না কেনো?
সাদির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে পরি।
সাদি এক টুকরো আলু ছোঁয়ার মুখে পুরে দিয়ে পরির দিকে তাকায়।
” কেনো দিলাম না?
সাদি ভ্রু কুচকে বলে।
“হুমম কোনো দিলে না? আমাকেও ধমক দিলে আবার আদর করে দিলে। মাম্মাকে তো থাপ্পড়ও মেরেছো আর ধমক। তো মাম্মাকে আদর করে দাও।
ছোঁয়া চোখের পানি মুছে মুখ বাঁকায়। সাদি ছোঁয়ার দিকে এক পলক তাকায়। অনু সূচনা হয়। গালটা এখনো অসম্ভব লাল। আবার জ্বর এসে গেছে সেটা ফ্যাকাশে মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটো লাল করে ফেলেছে। না কি জ্বরের জন্যই চোখ দুটো লাল?
” তুই ও যে কি বলিস না? উনি হলেই হনুমান, সাদা বিলাই। আমাকে কিসি দেবে? হুহহহহহ
পারে তো আরও দুই চারটা থাপ্পড় দিয়ে আমাকে কোমায় পাঠিয়ে দেয়।
রাগে ফুসফুস করতে করতে নাক টেনে বলে ছোঁয়া।
সাদি পরির মুখের সামনে খাবার নিতেই মুখ ফিরিয়ে নেয়।
“আর খাবো না।
সাদি ছোঁয়ার মুখের সামনে খাবার নেয়। ছোঁয়াও মুখ ফিরিয়ে নেয়।
” শুয়ে পড়ো। আমি ঔষধ নিয়ে আসছি।
সাদি পরিকে কোল থেকে নামিয়ে প্লেট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
ছোঁয়া রাগে গজগজ করতে করতে কম্বল টেনে শুয়ে পড়ে। পরি সাদির ফোন নিয়ে গেমস খেলা শুরু করে।
“আমিও থাকবো না। চলে যাবো। আপির বিয়ের সময় একটা সুন্দর ছেলে খুঁজে প্রেম করবো। তারপর তার সাথে পালিয়ে যাবো। সে আমাকে অনেক ভালোবাসবে। মারবে না।
ছোঁয়া একা একাই বলতে থাকে।
সাদি রুমে ঢুকে ছোঁয়ার কথা গুলো শুনতে পায়। কিছুই বলে না।
” তোমার ঔষধ।
ছোঁয়ার পাশে বসে বলে সাদি। ছোঁয়া কম্বল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে।
সাদি ফোঁস করে শ্বাস টানে।
“এই মেয়ে উঠবে না কি থাপ্পড় খাবে?
আবারও ধমক দিয়ে বলে সাদি। ছোঁয়া কেঁপে ওঠে। হুরমুর করে উঠে বসে। আবারও কান্না চলে আসে।
সাদি ঔষধ ঢুকিয়ে দেয় মুখে। তারপর পানিও খাইয়ে দেয়।
পানির গ্লাসটা সাইডে রেখে পা টানটান করে বসে।
” শুয়ে পড়ো
কোলের ওপর ল্যাপটপ নিয়ে সেটা অপেন করতে করতে বলে সাদি।
ছোঁয়া বাধ্য মেয়ের মতো শুয়ে পড়ে।
🥀🥀
সিমি রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ভালো করে চোখ মুখ মুছে নেয়। হিমুর সামনে ওভারে কান্না করাতে এখন এমন খারাপ লাগছে। নিজের দুর্বলতা কাউকে দেখাতে চায় না ও। কিন্তু হিমু ছেলেটাই এমন। কিছু বলার আগেই বুঝে যায়। বারো বছর যাবত এক সাথে আছে দুজন। জীবনের এমন কোনো খুটিনাটি ঘটনা নেই যা হিমুর সাথে শেয়ার করা হয় নি।
বাসায় ঢুকে সরাসরি সিফাতের রুমে চলে যায় সিমি। সিফাত উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলো। খট করে দরজা খোলার আওয়াজে এক লাফে উঠে বসে। চোখ দুটো ফোলা ফোলা চুল গুলো এলোমেলো। কেমন বিধস্ত দেখাচ্ছে সিফাতকে।
সিমিকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসে সিফাত।
“ভেতরে এসো।
এলোমেলো বিছানাটা একটু ঠিক করার চেষ্টা করে সিফাত।
” আপনি বিয়ে করেছেন?
সিমি সিফাতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে।
সিফাত চমকে ওঠে। বড়বড় চোখ করে তাকায় সিমির দিকে। হঠাৎ এই প্রশ্ন করার মানে বুঝতে পারছে না।
“নাহহহ
মাথা নিচু করে বলে সিফাত। সিমির মুখটা চকচক করে ওঠে।
” সিটি হাসপাতাল চিনেন?
প্রবল উত্তেজিত হয়ে সিফাতের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলে সিমি।
“হুমমম। সেখানকার প্রায় ডাক্তারই আমার চেনা।
কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সিফাতের গালে একটা চর পড়ে। গালে হাত দিয়ে হতবাক হয়ে তাকায় সিমির দিকে। সিমি রাগে থরথর করে কাঁপছে। চোখে পানি টলমল করছে।
” এতটা বাজে আপনি? এতোটা খারাপ? কেনো?
কেনো করলেন এমনটা? খুব হ্মতি করেছিলাম আপনার?
শান্ত গলায় কাঁদতে কাঁদতে বলে সিমি। সিফাত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
“অনেক কিছু বলার ছিলো আপনাকে। অনেক অনেক কথা। যেদিন আপনি আমাকে বলেছিলেন ” সিমি আমার মা আমাদের সম্পর্কটা মেনে নেবে না। আমাকে ভুলে যাও”
সেদিনই বুঝে গেছিলাম আপনি একটা কাপুরুষ।
লম্বা দম নেয় সিমি। চোখের পানি মুছে নেয়।
“আমি তো কাপুরুষ। তো তুমি তো খুব ভালো। এতো ভালো মানুষ কি করে নিজের সন্তানের কথা ভুলে অন্য ছেলের হাত ধরে ঘুরে বেড়ায়?
গর্জে উঠে বলে সিফাত। হাত দুটো মুষ্টি বদ্ধ করে ফেলেছে। চোখ থেকে আগুন ঝড়ছে।
সিটির মাথা ঘুরে উঠে। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস টানে। নিজেকে কন্ট্রোল করে।
এটা ছোঁয়ার স্বামীর বাড়ি। এখানে কেনো সিনক্রিয়েট করলে তার দায় পড়বে ছোঁয়ার ঘাড়ে। সেটা সিমি চায় না।
” কোনো রকমের সিনক্রিয়েট ছাড়া আমি আমার মেয়েকে নিয়ে কাল চলে যাবো। আমি চাইছি না আমার মতো আপনার ফ্যামেলিও আপনাকে কাপুরুষ ভাবুক। আর এটাও চাইছি না আমার মেয়ে জানুক তার বাবা ঠিক কতটা নোংরা।
সিমি চলে যেতে নেয়।
“কিন্তু আমি চাইছি আমার আর তোমার মাঝে যা হয়েছে সবটা সবাই জানুক। তারপর তারাই ডিসাইড করবে তুমি
সিমি সিফাতের কথা শেষ করতে দেয় না।
হাত উঁচু করে থামিয়ে দেয় সিফাতকে।
” লাইফ আমার। তাই আমিই ডিসাইড করবো।
সিমি বেরিয়ে যায়। সিফাত বাঁকা হাসে।
🥀🥀
ছোঁয়ার মাথা ব্যাথায় টিকতে পারছে না। এপাশ ওপাশ করছে আর কাঁদছে। এটাই ছোঁয়া স্বভাব। একটু ব্যাথা পেলে বা খারাপ লাগলেই কান্না শুরু করে দেয়।
ছোঁয়ার মোচরামুচরিতে সাদি বসে থাকতে পারছে না। একই বিছানায় এক জন ছটফট করলে অন্য জন কি শান্তিতে থাকতে পারে?
“কি হয়েছে?
ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে ছোঁয়াকে।
ছোঁয়ার উওর দেয় না। এক হাত দিয়ে কপাল টিপতে থাকে।
সাদি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ছোঁয়ার কপালে হাত রাখে। চমকে ওঠে ছোঁয়া। চোখ মেলে তাকায় সাদির দিকে। সাদি এক মনে ল্যাপটপ দেখছে আর আরেক হাত দিয়ে ছোঁয়ার কপালে টিপে দিচ্ছে। এক রাশ ভালো লাগা ছুঁয়ে যায় ছোঁয়ার মনে। মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে ফেলে। খুব ভালো লাগছে।
আরও একটু সাদির দিকে ঘেসে শয়। সাদি ভ্রু কুচকে তাকায় ছোঁয়ার দিকে। কিন্তু ছোঁয়ার বন্ধ চোখ দেখে কিছু বলে না।
“আমি না ক্রাশ খাইছি।
ছোঁয়া মিষ্টি হেসে চোখ বন্ধ রেখেই বলে।
” মাম্মা আমিও খাবো। কোথায় দাও।
পুরি ফোন ফেলে এক লাফে ছোঁয়ার কাছে এসে বলে। ছোঁয়া ধপ করে চোখ খুলে। সাদি এক পলক তাকায় ছোঁয়ার দিকে।
“মা চেপে ধরো তোমার মাম্মাকে। ক্রাশ না দেওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না।
সাদি গালে হাত দিয়ে ল্যাপটপের স্কিনে চোখ রেখে বলে।
ছোঁয়া দাঁত কটমট করে তাকায় সাদির দিকে। বজ্জাত লোক। দিলো তো ফাঁসিয়ে।
” ও মাম্মা দাও না। একটুখানি খাবো। দাও না
পরি ছোঁয়ার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলে।
ছোঁয়া কি বলবে বুঝতে পারছে না। পরির দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
“মাম্মা না দিলে আমি কেঁদে ফেলবো।
বলেই কান্না করে দেয় পরি।
” মা জোরে জোরে কাঁদো। তাই দেবে
সাদির উসকানিকে পরি আরও জোরে কেঁদে ওঠে।
চলবে
#অন্যরকম তুমি
#পর্বঃ২১
#তানিশা সুলতানা
“মা কাউকে ভালো লাগলে তার দিকে তাকিয়ে থাকলে সেটাকে ক্রাশ বলে। তোমার পাপাকে আমার ভালো লাগছে। তার দিকে তাকিয়ে ক্রাশ খাইছি। এবার তোমার খেতে ইচ্ছে হলে তুমি খাও।
ছোঁয়া পরির গালে হাত দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে। পরি কি বুঝলো কে জানে?
” নাহহ তোমার ক্রাশ তুমিই খাও।
পরি আবার গেমস খেলা শুরু করে।
সাদি ছোঁয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
“স্যার আসবো?
সিমি দরজায় নক করে রিনরিনিয়ে বলে।
সাদি ল্যাপটপে মগ্ন ছিলো। সিমির কথা শুনে ল্যাপটপ থেকে চোখ ফিরিয়ে এক পলক সিমির দিকে তাকায়।
” হুমম এসো।
সিমি গুটিগুটি পায়ে এসে খাটের সাইডে দাঁড়ায়। পরি সিমিকে দেখে এক লাফে সিমির কোলে ওঠে।
“ছোঁয়ার কি শরীর খারাপ?
ছোঁয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে সিমি।
” হুমম জ্বর হয়েছে। এখন মাথা ব্যাথা করছে।
“আপনি কাজ করেন। আমি ছোঁয়াকে নিয়ে যাই? আজকের রাতটা আমার কাছে থাকলে কোনো পবলেম হবে কি?
সাদি ছোঁয়ার মাথা থেকে হাত সরিয়ে নেয়। ল্যাপটপ নিয়ে নেমে যায় খাট থেকে।
” সবে ঘুমিয়েছে। ওকে ডাকতে হবে না। তোমরা এখানে থাকো। আমি অন্য রুমে যাচ্ছি।
সাদি ল্যাপটপের চার্জার নিয়ে বেরিয়ে যায়। সাদি যেতেই সিমি মুচকি হেসে পরির কপালে চুমু খায়।
“তোমাকে এতগুলো মিস করেছি।
দুই হাত প্রসারিত করে বলে পরি।
” আমিও তো আমার মা কে এতগুলা মিস করেছি।
সিমি পরির নাক টেনে দিয়ে বলে।
“আমার সোনা টার খিধে পেয়েছে নাহহ?
পরিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে সিমি।
” পাপা খাইয়ে দিয়েছে আমাকে আর মাম্মাকে।
“ওহহ
আজকে ছোঁয়ার মনটা খুব ফুরফুরে। কেনো জানি খুব ভালো লাগছে।
সকাল সকাল উঠেপড়ে লেগেছে রান্না শিখবে বলে।
এখনো কেউ ওঠে নি। রাতে সিমির কাছেই ঘুমিয়েছে ছোঁয়া।
ফজরের নামাজ পড়েই কিচেনে চলে গেছে।
আগে কখনো রান্না করা হয় নি। আজকেই প্রথম বার।
কিন্তু কি রান্না করবে?
কিচেনের মাঝখানে গালে হাত দিয়ে কিছুখন বসে ভাবতে থাকে ছোঁয়া।
অবশেষে শাশুড়ীর কথা মাথায় আসে। শাশুড়ীর থেকে হেল্প নিলে মন্দ হয় না।
চট করে ফোন করে শাশুড়ীকে।
সাবিনা বেগম যেনো ছোঁয়ার ফোনের অপেক্ষায়ই ছিলো। রিং হওয়ার সাথে সাথে রিসিভ করে।
“শাশুড়ী কেমন আছেন?
এক গাল হেসে বলে ছোঁয়া।
” হুমম ভালো তুমি?
“আপনার ছেলের জন্য রান্না করবো ভাবছিলাম। তো কি রান্না করবো? আর কিভাবে?
” নুডলস রান্না করো।
“কি করে করে?
” ভিডিও কল দাও। আমি বলে দিচ্ছি।
ছোঁয়া শাশুড়ীকে ভিডিও কল দেয়। তারপর রান্না করায় লেগে পড়ে। সাবিনা বেগম যেভাবে যেভাবে বলে দেয় ছোঁয়া ঠিক সেভাবেই রান্না করে।
রান্না শেষ করে লম্বা দম নেয় ছোঁয়া। যাহহ বাবা রান্না করার মতো একটা কঠিন কাজ সম্পূর্ণ করলো।
“এখানে কি করছো?
সাদির প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় ছোঁয়া। এই মুহুর্তে ওনাকে আশা করে নি৷ তাই একটু ভয় পায়। পেছনে ফিরে সাদির মুখটা দেখে মুচকি হাসে ছোঁয়া।
” আপনার কিছু লাগবে?
ছোঁয়া সাদির দিকে একটু এগিয়ে এসে বলে।
“নাহহহ। আমি নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করি।
সাদি ফ্রীজ থেকে পানির বোতল বের করতে করতে বলে।
” তবুও কিছু লাগলে আমাকে বলবেন।
মাথা নিচু করে বলে ছোঁয়া। সাদি ভ্রু কুচকে ছোঁয়ার দিকে তাকায়। হঠাৎ পাল্টি খেলো কি করে?
“লিসেন
তোমাকে মেবি মা বা তোমার বোন বলেছে এসব বলতে। আমার এসব ভালো লাগে না।
বোতলের ছিপি খুলে এক ঢোক পানি খেয়ে বলে সাদি।
“আচ্ছা
আমি নুডলস রান্না করেছি। একটু খেয়ে দেখবেন?
সাদি এবার বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে।
” সাট আপ ওকে।
তোমার না শরীর খারাপ?
যাও এখান থেকে।
ধমক দিয়ে বলে সাদি। ছোঁয়া নাক ফুলায়।
“ধমক দিয়েন সমস্যা নেই। কিন্তু থাপ্পড় দিবেন না বলে দিলাম।
” এখান থেকে না গেলে থাপ্পড়ও দেবো।
ছোঁয়া সাদিকে ভেংচি কেটে চলে যায়৷ ভেবেছিলো লোকটার সাথে ভাব জমাবে। তারপর ফুলের টব কিনে দিতে বলবে। কিন্তু এই এইরকম বজ্জাত লোকের সাথে ভাব জমানো যায়? কখনো সম্ভব?
সাদি ঢাকনা খুলে নুডলসটা দেখে। দেখতে বেশ ভালো হয়েছে। খাবার টেবিলে সেটা রেখে রান্না করায় লেগে পড়ে।
এক প্যাকেট নুডলস দিয়ে তো আর সবার ব্রেকফাস্ট হবে না।
রান্না শেষ করে সাদি রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সিমি আছে রুমে। কি করে ঢুকবে? জামাকাপড়ও তো এই রুমেই। কি করবে ভাবছে?
“আপনার জামাকাপড় আমি ওই রুমে দিয়ে এসেছি।
ছোঁয়া রুম থেকে বের হতেই দেখে সাদি পায়চারি করছে। তখনই বলে।
” তোমাকে পাকনামি করতে কে বলেছে?
কপাট রাগ দেখিয়ে বলে সাদি।
ছোঁয়ার হাসি মুখটা চুপসে যায়। মাথা নিচু করে ফেলে। সাদি ফোঁস করে শ্বাস টানে। বাম হাত দিয়ে মাথার পেছনের আংশ চুলকে নেয়।
“রেডি হয়ে নাও।
” আমি তো আপির সাথে যাবো না।
ছোঁয়া মিনমিনিয়ে বলে।
সাদি চোখ ছোটছোট করে তাকায় ছোঁয়ার দিকে।
“স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যাবো ইডিয়েট
দাঁতে দাঁত চেপে বলে চলে যায় সাদি। ছোঁয়া সাদির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটে।
” কথাটা কি ভালো ভাবে বলা যেতো না? করলার জুস একটা। ইচ্ছে করে এক ঘুসিতে নাকটা ফাটিয়ে দেই।
ছোঁয়া বিরবির করতে করতে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। আজকে প্রথম বার সাদির সাথে বের হবে। ভাবতেই হাত পা ঝিনঝিন করে ওঠে ছোঁয়ার।
খুব ভালো ঘুম হয়েছে সিমির। তিন বছর পরে আজকে শান্তিতে ঘুমলো। জানালার কাঁচ ভেদ করে এক টুকরো রোদ্দুর এসে ভর করে সিমির চোখে মুখে। পিটপিট করে চোখ খুলে। বুকের ওপর ভারি কিছু অনুভব করতেই মুচকি হাসি ফুটে ওঠে সিমির অধর কোনে। দুই হাতে আরও একটু নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নেয় পরিকে।
বড্ড আফসোস হচ্ছে। ইসস কেনো যে পরির ছোট বেলাটা অনুভব করতে পারলো না।
সিফাত সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। পরিকে ছাড়া কখনোই ঘুম হয় না ওর। লুকিয়ে লুকিয়ে দশ বার দেখে গেছে পরিকে।
এটা অবশ্য ছোঁয়া জানে।
ছোঁয়া কালো জর্জেট থ্রি পিছ পড়েছে। ফর্সা গায়ে কালো রংটা বেশ মানিয়েছে।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে ছোঁয়া।
“আপি উঠো না। পরির খিধে পেয়েছে তো।
এই নিয়ে পাঁচবার ডাকলো ছোঁয়া। কিন্তু সিমির কোনো সারা নেই। বিরক্ত হয় ছোঁয়া। আজকে হঠাৎ এতো ঘুম আসলো কোথা থেকে?
সিমি পরিকে বালিশে শুয়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। লম্বা হামি দেয়।
” কোথাও যাবি?
ছোঁয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে।
“হুমম স্কুলে ভর্তি হতে যাবো।
চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে ছোঁয়া।
” একা?
“নাহহহ হনুমানটার সাথে যাচ্ছি।
” আচ্ছা সাবধানে যাবি। স্যারের সব কথা শুনবি। কেমন?
আচ্ছা
ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চোখে মোটা করে কাজল টেনে ঘুমন্ত পরির কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে যায় ছোঁয়া।
সাদি অফিসের জন্য রেডি হয়ে খেতে বসে গেছে। ছোঁয়াও গিয়ে সাদির পাশে বসে পড়ে।
সাদি ছোঁয়ার রান্না করা নুডলস খাচ্ছে না বলে মন খারাপ হয়ে যায় ছোঁয়ার। সাথে রাগও হয়। নুডলসের বাটিটা নিয়ে বেসিনে ভিজিয়ে রাখে ছোঁয়া।
সাদি সেদিকে তাকায়ও না। এক মনে ফোন দেখছে আর খাচ্ছে।
ছোঁয়া খায় না। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে পণ করে ওই লোকের রান্না করা খাবার খাবে না।
সাদি খাওয়া শেষ করে অফিসের ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে ছোঁয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
“চলো
বলে আগে আগে বেরিয়ে যায়। ছোঁয়া রাগে গজগজ করতে করতে পেছনে হাঁটতে থাকে।
চলবে