অন্যরকম তুমিময় হৃদয়াঙ্গণ পর্ব-০৬

0
623

#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৬

“বিবিজান আস্তে মুচড়া-মুচড়ি করো। সবাই বুঝতে পারলে তুমিই লজ্জা পাবে। আমাকে যে সকালে বোকা বানালে তার শাস্তি এখন মুখ বুজে সহ্য করো। এখন দেখো আমি কি করি?”

নাজীবা মুচড়া-মুচড়ি করায় কথাটি তার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে আফরাজ। কিন্তু স্বামীর শেষের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আফরাজ ভাব নিয়ে তার দাদীকে প্রশ্ন করে।

“দাদী স্বামী-স্ত্রী একে অপরের হাতে খাওয়া সুন্নত তাই না?”

খাদিজা বেগম শুনে ‘হ্যা’ বলে। এতে নাজীবার মুখ পাংশুটে হয়ে যায়। কেমনে নিজেকে আফরাজ এর কাছ থেকে ছুটাবে সেই পরিকল্পনা করেই যাচ্ছে। আফরাজ বাঁকা হেসে নাজীবার কোমড়ে ছোট চিমটি কেটে দেয়। আকস্মিক চিমটি কাটায় চিৎকার করে উঠে সে। আফরাজ ব্যতীত চেয়ারে বসা তিনজন ব্যক্তিই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। কুসুমা ভাবী অকপটে বলে উঠে,

“ভাবী কি হয়েছে? পেটে কি বেশি ব্যথা করছে? হাসপাতালে নেওয়া লাগবে?”

খাদিজা বেগমও চিন্তিত গলায় বলে,

“হ্যা রে নাতবু। তোর কিছু লাগলে বল এখনই আনতে পাঠাচ্ছি।”

“না না দাদী আমার কিছু লাগবে না। আর ভাবী আপনিও খাবার খান। আমি একদম ঠিক আছি। আসলে পায়ের উপর মাছি বসে ছিল। চুলকাতে গিয়ে টেবিলের কোণায় বারি খেয়েছি।”

‘বারি খেয়েছি’ শেষ দু’শব্দ আফরাজ এর দিকে চেয়ে দাঁত চিবিয়ে বলে নাজীবা। তারা চিন্তামুক্ত হয়ে খেতে লাগল। সেও নিজের প্লেটে বিরিয়ানি নিতে গেলে সেই প্লেটটি দূরে সরিয়ে আফরাজ নিজের প্লেট এগিয়ে দেয়। মহা বিরক্ত হয়েছে এমন ভান ধরে আফরাজ কে খাওয়ে দিচ্ছে সে। এখানে আফরাজ তার শোধ তুলতে পারছে ভেবে খুশি হচ্ছে। আর নাজীবা ঘোমটার আড়ালে চোখভরা খুশি নিয়ে স্বামীকে খাওয়ে দিচ্ছে। সে জানে আফরাজ কে বোকা বানানোর জন্য প্রতিশোধ নিচ্ছে। যদি সামান্য একটু বোকামিও তাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে, তবে ক্ষতি কই? লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
হঠাৎ দরজায় খোলার শব্দে সকলে দরজার দিকে তাকায়।

____

নতুন একটি নার্স এসে লোকটি কে মেডিসিন ও ইনজেকশন দিয়ে চলে গেল। তার সামনে কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখায়নি লোকটি আর তার সঙ্গে থাকা মহিলাও। তিনি নার্স যেতেই লোকটির কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে,

“বাবা আপনি ঠিকমত ব্লা’ড নিচ্ছেন? মনে রাখবেন তার স্বাদ না পেলেও , অন্যদের থেকে অবশ্যই সাধ্যমত পান করতে হবে। নাহলে আপনার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।”

লোকটি হিংস্র দৃষ্টিতে দেওয়ালে টাঙানো হারানো মেয়েটির ছবির দিকে চেয়ে থেকে বলে,

“এই এক মেয়ের সুস্থতার জন্য কত কি করলাম। তবুও সে পালিয়ে গেল। কিই এমন করতাম? রাত-বিরাতে একটু শরীরটার মধ্যে থেকে র’ক্ত নিতে চাইতাম। তাও হতে দেয়নি।”

“তাও বাবা আপনি র’ক্তপান তো করতে পেরেছেন। সে যদি কোনো ভাবে তার তাবিজ খোঁজে পেতো। তবে আপনাকে মে’রে ফেলতে তার একসেকেন্ড ও লাগতো না।”

কথাগুলো যেন লোকটির কানে গরম সিসা ঢালার মতো লেগেছে। তৎক্ষণাৎ মহিলাটির গলা চেপে হুংকার দিয়ে বলে,

“এই মেয়ে কি বললি তুই? ঐটুকুন মেয়ে আমাকে মা’রতে পারবে? কখনো না ঐ মেয়েকেই আমি জিম্মি বানিয়ে আজীবন রেখে দেবো দেখে নিস।”

বলেই মহিলাটির গলা ছেড়ে দিল। তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। গলায় ছাপটা বেশ জোরেই লেগেছে তার। কাশতে লাগল ক্রমান্বয়ে। লোকটি বিনা শব্দে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। পানি খেয়ে কিছুটা শান্তি লাগল তার। লোকটি রকিং চেয়ারে বসে নিজের মাথায় হাত দিয়ে ব্যান্ডেজ করা জায়গাটি খুব তীক্ষ্ণ চোখে খেয়াল করছে। একটানে ব্যান্ডেজ ছিঁড়ে ফেলল। মহিলাও টু শব্দ করল না। কারণ জানে লোকটি সুস্থ হয়ে গিয়েছে।
ব্যান্ডেজ ছিঁড়তেই দু’জনে অবাক। কারণ কপাল যে ফেটে ছিল। তার কোনো দাগও অবশিষ্ট নেই। মহিলাটি কাঁপা কণ্ঠে বলেন,

“এটা কেমনে সম্ভব হলো বাবা? আপনার কপালে হালকা আঁচ হলেও থাকার কথা। পুরোপুরি মিটলো কেমনে?”

লোকটি রকিং চেয়ারে গা হেলিয়ে দিয়ে বলে,

“জানিনা যাও এখান থেকে। আমি ধ্যান করব।”

মহিলা সায় দিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।

তিনদিন আগের কাহিনী…

লোকটি তার ছ্যালাদের থেকে কোনো খবর না পেয়েই, নিজের রাগ সামলাতে না পেরে নিজের মাথা ফাটিয়ে ফেলে ছিল। মহিলাটি কোনোমতে লোকটি কে ধরে হাসপাতালে নিয়ে আসে। যার খোঁজ পাওয়ার জন্য তারা এত অপেক্ষায় ছিল। ভাগ্যের সহায়তায় তারা মেয়েটিকে সেখানে পেতে গিয়েও পেলো না। কেননা হারানো মেয়েটিও সেই হাসপাতালের রোগী হয়ে ছিল।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের ৪৫নং কেবিনে নাজীবার চিকিৎসা চলছে। ডক্টর এসে একবার জানিয়েছেন,
মেয়েটির জীবন বাঁচানো আশংকাজনক। তবুও তারা চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। খাদিজা বেগম আঁতকে সিটে গা হেলিয়ে বসে পড়েন। নাতবু কে যে তিনি খুব ভালোবাসেন। মেয়েটা শুধু রুপে নয়,গুণেও অতুলনীয়। তার কখন কি দরকার হয় তা হাজির করে দিতে পারে। রাতবিরাতে স্বামীর পরোয়া না করেও চলে আসে, সঙ্গীহীন বিধবা বুড়িকে সঙ্গ দিতে। এমন ব্যবহারী নাতবউ যদি আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে তো কথাই নেই। চিন্তায় যেন তিনি প্রেসার ডাউন করে ফেলবেন মত অবস্থা প্রায়।
হঠাৎ তার লাঠিটি নিচে পড়ে যায়। তিনি বৃদ্ধ মানুষ ঝুকে লাঠি নিতে গেলেই কোমড়ে ব্যথা পাবেন। তাই চোখজোড়া দিয়ে আশানুরূপ কাউকে খোঁজছেন। যেনো কেউ এসে লাঠিটা উঠিয়ে দেয়। আশাটা পূরণ ও হলো বটে। এক ছাব্বিশ-সাতাশ বয়সী এক যুবক এসে লাঠিটা খাদিজা বেগমের হাতে দেয়। তিনি কৃতজ্ঞতা জানায়। এতে লোকটি মৃদু হেসে বলে,

“একটু সাবধানে চলবেন।”

“হ্যা-রে বাবা। কিন্তু তোমার কপালে কি হয়েছে গো? এত বড়ো ব্যান্ডেজ কেনো?”

লোকটি নিজের শার্টের হাতা গুটিয়ে খাদিজা বেগমের পাশে বসে পড়ে। নিজের চুলগুলো কে এলোমেলো ভাবে নেড়ে বলে,

“এই ব্যান্ডেজ করার জন্য একটা মেয়ে দায়ী বুঝছেন আন্টি। মেয়েটা আমার জীবনীশক্তি ছিল। কিন্তু একদিন সুযোগ পেয়ে আমার জীবনীর থেকে মুক্ত পেয়ে উড়াল দিয়ে ফেলেছে। তাকে এখনো খোঁজে চলেছি। পায়নি কি করবো বলো? মেয়েটার প্রতি যে আমার তীব্র ভালোবাসা তাই।”

“আহারে ব্যাটা চিন্তা করো না পেয়ে যাবা। এমন ও হতে পারে সে তোমার আশেপাশেই আছে। শুধু একটু মন দিয়ে খোঁজ করো পেয়ে যাবে।”

বৃদ্ধার কথায় লোকটির মনের নেশা বেড়ে গেল। হারানো মেয়েটির প্রতি আসক্তি দ্বিগুণ হলো। সে মাথা নেড়ে কথা বাড়ানোর পূর্বেই কেউ ‘দাহাব’ বলে ডেকে উঠে। দু’জনে সেদিক মুখ ঘুরিয়ে দেখে এক শাড়ি পরিহিত মহিলা। দেখেই বয়স কল্পনা করা দুরূহ। মহিলাটি এগিয়ে এসে দাহাব এর গালে হাত রেখে বলেন,

“সোনা বাবা কোথায় চলে গিয়ে ছিলে হুম? তোর মাথা ফাটানো নিয়ে এমনি চিন্তিত ছিলাম। তার উপর তুই হুটহাট উধাও হয়ে যাস। তোর মায়ের চিন্তা হয়তো নাকি?”

“সরি মা। এই যে এখান থেকেই হেঁটে যাচ্ছিলাম। তখন তিনি কাউকে খোঁজ ছিলেন দেখে , এসে সাহায্য করেছি।”

“ভালো সোনা আমার।”

মা-ছেলে ভালোবাসা দেখে খাদিজা বেগমের চোখে আফরাজ ও তার মায়ের খুনসুটি ভেসে উঠল। চোখ ভিজে গেল তার। তিনি ভেবেই নিলেন নাতবউ সুস্থ হতেই আফরাজ এর বাবা-মাকে সুদূর ভীনদেশ থেকে চলে আসতে আদেশ করবেন। ছেলেটা বিশ বছরে বাবা-মা-কে ছেড়ে খাদিজা বেগম এর কাছে দেশে চলে এলো। শুধু মাত্র তার দাদী আর বাবার বিজনেস এর জন্য। সেখানে তার বাবা-মা দুজনেই ভীনদেশে থাকছে। ছেলের জন্য কি তাদের মন পুড়ছে না ? এবারের সিদ্ধান্ত তিনি মোটেও ব্যর্থ হতে দেবেন না। তার দাদুভাইকে বাবা-মায়ের ভালোবাসা আর নাতবউকে শ্বশুর-শ্বাশুড়ির ভালোবাসায় জড়িত করবেন। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
আকস্মিক ‘দাদীই’ ডাকে তিনি ধ্যান ফিরে পান। সামনে আফরাজ কে দেখে চমকে গেলেন। দাদুভাই তার আতংকে কাঁপছে। এই চেহারা দেখে বেশ শান্তি অনুভব করছেন তিনি। নাতিকে ধরে বসিয়ে বলে,

“দাদুভাই ভেতরে নাতবু’র চিকিৎসা চলছে। তুই চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“ইন শা আল্লাহ তাই যেনো হয় দাদী।”

অল্প কথার পর তার মুখে আর কোনো কথা রইল না। সে নিশ্চুপে বসে থাকে। দাহাব তাদের দেখে বুঝল। কেবিনের মধ্যে তাদের ঘরের বউয়ের চিকিৎসা চলছে। আর এই যুবক মেয়েটার স্বামী। সে উঠে দাঁড়ায় আফরাজ এর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,

“হেই ডুড আইম দাহাব এহসান এ ফার্মাসিস্ট অফ ন্যাশনাল হাসপাতাল এট ফেনী।”

অচেনা যুবক এর নিজ থেকে কথা বলা দেখে আফরাজও বিনা বাক্যে হাত মিলিয়ে ‘হ্যান্ডশ্যাক’ করে বলে,

“আইম আফরাজ ফাহিম দ্যা বিজনেসম্যান অফ পারফিউমেটিক ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু আপনি নিজের চিকিৎসা এখানে কেন করাচ্ছেন? আপনাদের ফেনীতে ও তো করাতে পারতেন।”

“আসলে ফেনী হলো দাদার বাড়ি। আর আমি নানার বাড়ি পছন্দ করি। তাই মায়ের সাথে চিটাগাং থাকছি আজ চার বছর যাবত। দাদার বাড়ি বেশ অপছন্দের জায়গা আমার। বাই দ্যা ওয়ে মিট মাই মম মিসেস হিয়া দেয়ান।”

আফরাজ মহিলাটির দিকে তাকিয়ে সালাম দেয়। কিন্তু তার চোখ-মুখে অবাকতা ফুটে উঠেছে। দাহাব এর মাকে দেখতে মোটেও বয়স্ক লাগছে না। যদি না দাহাব পরিচয় করিয়ে দেয়, তিনি যে দেখতে এই দামড়া ছেলের বোন লাগে তা যে কেউ এক দেখায় বলে ফেলবে। অথচ আফরাজ এর মা তো ভীনদেশে থাকেন। তার চেহারায় তো বয়স্কের ছাপ বোঝা যায়। হয়ত দাহাব এর মা ফেসিয়াল করেন বেশি। আফরাজ এর মা তো ফেসিয়াল পছন্দ করেন না বটে। মিসেস হিয়া আফরাজ কে তার বউয়ের জন্য শান্ত্বনা দিয়ে একবার বাসায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। আফরাজও বিনম্র আচরণে তাদের সঙ্গে কথা শেষ করে বিদায় জানায়।

তখনি ডক্টরের ডাকে আফরাজ ও তার দাদী কেবিনের ভেতর প্রবেশ করে। বেডের মধ্যে নিথর শরীরে শুয়ে আছে মেয়েটি। ডক্টর চিন্তিত গলায় আফরাজ কে তাড়া দিয়ে বলে,

“আপনার বাসায় পেশেন্টের মেন্টাল কন্ডিশনের কোনো রিপোর্ট আছে কিনা জলদি খোঁজ লাগান। না হলে আমরা চিকিৎসা আগাতে পারব না।”

“কিন্তু আমার ওয়াইফ এর হয়েছেটা কি? সে কেনো নিজের ক্ষতি করল?”

ডক্টর শুধু বললেন,

“আপনি আগে রিপোর্টটি আনুন। প্রশ্নের সব উত্তর তখনিই দেব।”

কথা শেষ করে তিনি কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আফরাজ ও বাসায় যাওয়ার জন্য গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ে। দ্রুত বাসার রাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়। তার আর তার বউয়ের রুমের মধ্যে এসে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো রিপোর্ট পায়নি আফরাজ। এই নিয়ে হতাশ হয়ে সে গাড়িতে এসে বসে যায়। ফ্রন্ট সিটে চোখ পড়তেই চমকে যায়। তার গাড়িতেই একটি ফাইল রাখা। তৎক্ষণাৎ ফাইলটি নিয়ে দেখল। ফাইলের কভার পেইজের উপর স্পষ্ট লিখা ‘মেন্টাল হাসপাতাল এট ফেনী’। তার মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগে যদি নাজীবা ফেনীতে থেকে থাকে। তবে সে চট্টগ্রামে কেমনে এলো?

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে