অন্যরকম তুমিময় হৃদয়াঙ্গণ পর্ব-০৫

0
640

#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৫

“এই পঁচা মেয়ে দূরে সরো। ছিঃ ছিঃ তোমার তো চিকন পেট দেখা যাচ্ছে। আমি কিন্তু পাগল হয়ে গেলে তোমার পেটে দাঁত দিয়ে কামড়ে দেব। তখন আমাকে পঁচা বললে আমি রাগ করে বসে থাকব।”

আফরাজ এর কথা শুনে লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে গেল নাজীবা। স্বামীর পাশেই তার দাদী শ্বাশুড়ি বসা। তিনি নাতি ও নাতবউয়ের মধ্যকার কথা শুনতে হবে ভেবে চটজলদি লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। আকবর তো রুম থেকে বেরিয়েছে দু’তিনেক সময় পার হবে। কুসুমা ভাবী কাজের কথা বলে চলে গেলো। খাদিজা বেগম নাতবউয়ের কাছে গিয়ে বলেন,

“নাতবু স্বামীর খেয়াল রেখো। দাদুভাই ছোট থেকেই জ্বর আসলে হুঁশ জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে। তখন কি করে তার মনেই থাকে না। জ্বরের ঘোরে বেশি পাগলামী করলে আমাকে না হয় তোমার আকবর ভাইকে ডাক দিও।”

নাজীবা দাদীর কথায় মাথা নেড়ে সায় দেয়। দাদী চলে যেতেই নাজীবা দরজাটা লাগিয়ে আফরাজ এর পাশে ঘোমটা ফেলে বসল। আফরাজ এর মাথায় জলপট্টি দেওয়া। সে তার পাশে সুন্দরী এক মেয়েকে বসতে দেখে থমকে যায়। গলায় কাঁপন লাগে তার। স্বামীর শরীরের কাঁপন দেখে অবুঝ নাজীবা তার হাত স্বামীর বুকের উপর চেপে ধরে। এমতাবস্থায় আফরাজ সেই হাত খামচে ধরে। ব্যথায় চোখে জল চলে আসে নাজীবার। তবুও হাত সরাতে মন চাইল না তার। আফরাজ মোহাবিষ্ট গলায় বলে,

“তুমি কি পরী হুম? না তুমি পরী না তুমি তো টকটকে লাল পরী। আচ্ছা তোমাকে যদি চিমটি দেয় তুমি কি পালিয়ে যাবে?”

আফরাজ এর বাচ্চা বাচ্চা কথায় নাজীবার হাসি পাচ্ছে। সে জানতো জ্বরের ঘোরে মানুষ আবুল তাবুল বকে। তাই নিজের হাসিকে মোটেও আফরাজ এর সামনে প্রকাশ করছে না। আফরাজ কি ভেবে যেন নাজীবার হাত সরিয়ে দেয়। এ দেখে নাজীবা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আফরাজ মুখ ফুলিয়ে বলে,

“এই মেয়ে তাবাসসুম কই হুম? ও তো আমার জ্বরের কথা শুনলে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতো। জানো ও আমাকে এতো এতো ভালোবাসতো। ওর কান্না দেখে আমিও তাকে ভালো…।”

‘ঠাসস’ করে স্বামীর গালে চ’ড় লাগায় নাজীবা। পুরো কথা সম্পূর্ণ হতে দিল না তার। বউয়ের সামনে পরনারীকে ভালোবাসার কথা বলছে কত বড় সাহস তার। চ’ড়ের কড়াঘাতে হুঁশ ফিরল আফরাজ এর। জ্বরের ঘোরে মাতলামি করা তার ছোটবেলার স্বভাব। মুখটা কান্নার মত করে নাজীবার থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে যায় আফরাজ। নাজীবা হা করে দেখে রইল। স্বামীর অভিমানী চেহারা বুঝি এমনই দেখায়। একদম নয়-দশ বছরের বাচ্চার মত লাগছে তার স্বামীকে। আকস্মিক হাঁচির শব্দে নাজীবা চোখ ফিরিয়ে দেখে আফরাজ নাকে টিস্যু চেপে হাঁচি দিচ্ছে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে স্বামীর নাক-মুখ মুছিয়ে দিয়ে শার্ট খুলতে নিলে নাজীবার হাত টেনে বুকে জড়িয়ে নেয়। স্বামীর বুকে ঠাঁই পেয়ে প্রশান্তি অনুভব করছে সে। আফরাজ লাজুক গলায় বলে,

“ছিঃ ছিঃ বিবিজান বুঝি আমার ইজ্জত হরণ করতে চাও?”

আফরাজ এর স্বাভাবিক কথায় চমকে গেল সে । মাথা উঠাতেই খেয়াল করল আফরাজ ঘুমিয়ে আছে। তবে ঘুমের ঘোরেই বোধহয় বেখেয়ালি কথাটি বলেছেন ভেবে চুপটি করে কম্বল টেনে নেয় দুজনের শরীরে । চোখ বুজতেই দু’ মানব-মানবীর শরীরের উষ্ণতায় আফরাজ শক্ত করে নাজীবার ছোট দেহটিকে আগলে নেয়। সে তার মনের অজান্তেই জড়িয়ে যাচ্ছে বিয়ে নামক বন্ধনে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
ফজরের আযানে নাজীবার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ধরফড়িয়ে উঠে আফরাজ এর শরীরের তাপমাত্রা চেক করে। শরীর স্বাভাবিক আর ঘাম দিচ্ছে দেখে তার বুকের উপর থেকে ভারী বোঝা নেমে যায়। ঘুমন্ত স্বামীকে ঠিকভাবে শুয়ে দিয়ে নাজীবা উঠে পড়ে। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। ঘুমের ঘোরে আফরাজ এর পানির পিপাসা লেগে যায়। আড়মোড়া হয়ে উঠতে নিলেই তার মাথায় চাপ পড়ে। পরক্ষণে আশপাশ খেয়াল করে দেখে, সে তার রুমের বিছানায় শুয়ে আছে। বেডসাইড টেবিলে জলপট্টি দেখে বুঝতে পারল, সমুদ্রে পড়ার কারণে জ্বর এসেছে তার। কিন্তু জলপট্টি কে দিচ্ছে জানার জন্য সে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে পেল। সুন্দর সুশ্রী নামাজরত এক মানবীকে। যে কিনা মনযোগের সহিত নামাজে মোনাজাত করছে। তার সুশ্রী মুখের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল সে। এই কোন পরী তার ঘরের মধ্যে নামাজ পড়ছে। ভুল করেও কেউ তার রুমে ঢুকতে পারে না। তাহলে এই পরীটি বুঝি সাত আসমান থেকে এসে তার জন্যে দয়া করছে? মনের নানান প্রশ্নের মাঝে তার চোখ অন্যদিকে সরে যায়। সে খেয়ালই করেনি তার চক্ষু আড়ালে নাজীবা ঘোমটা টেনে পূর্বের মত রুপ নিয়ে স্বামীর বিছানার কিনারায় গিয়ে দাঁড়ায়। গলা ঝেড়ে স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। কাশির শব্দে আফরাজ ধ্যান ফেরে দেখে তার চার পাশে নাজীবা মেয়েটি ছাড়া অন্য কেউ নেই। তাহলে কি তার মনের ভ্রম ছিল? ব্যাপারটা ঘেঁটে দেখতে সে নাজীবা কে জিজ্ঞেস করে।

“এখান থেকে পরীটা কোথায় গেল? এখানেই নামাজ পড়ছিল সামনে! হঠাৎ কই গেল তুমি কাউকে দেখছিলে?”

তার ব্যাপারেই জিজ্ঞেস করছে তা বুঝতে পারল নাজীবা। সে বিয়ের পর বাসর রাত থেকে শুরু করে এখন অব্দি তার মুখমন্ডল আফরাজ এর সামনে প্রকাশ্যে আনেনি। সে চাই তার স্বামীকে রুপের নয়,গুণের জালে ফাঁসাতে। রুপের জ্বালে অনেক মেয়েই ফাঁসাতে পারে। সে না হয় ইউনিক ভাবে চেষ্টা করল তার গুণ দিয়ে স্বামীকে প্রেমে ফেলার। কথাটি ভেবেই ঘোমটার আড়ালে মুচকি হাসল। তবুও মুখে কাঠিন্য বোধ এনে বলে,

“এই যে পন্ডিতমশাই ভোর সকালে কি গাঞ্জা খেয়েছেন? দেখে তো মনে হয় না ভদ্র ঘরের ছেলে। ছাইপাশ গিলে রাতবিরাতে বমি করে ভাসানোর স্বভাবও দেখি আছে। তো এইভাবে কত মেয়ের বুকের জ্বালা মিটিয়েছেন একটু জানতে পারি?”

ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল আফরাজ এর মাথায়। মনে পড়ে গেল বিকালের ঘটনা। তাকে ব্রিজ থেকে সমুদ্রের কিনারায় ফেলেছিল তার বউ। এর প্রতিশোধ সে নিবেই। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে সে ভ্রু কুঁচকে বলে,

“দেখো মাথা ব্যথা করছে আমার। তোমার সাথে আলগা পিরিতি মেরে ভোর সকালে মুড নষ্ট করার কোনোরুপ ইচ্ছেই নেই। তোমার কাজ শেষ হলে যাও বের হও রুম থেকে।”

“বাহ বাহ রাতে কাছে পেয়ে চুমাচুমি করে এখন বের করা হচ্ছে তাই না? দাঁড়ান এখনই আপনার বের হও বলা বের করছি আমি।”

বলেই নাজীবা অসুস্থ আফরাজ এর কোলের উপর চড়ে বসল। হতভম্ব হয়ে গেল সে। চোখ ছোট ছোট করে নাজীবা কে ঠেলে ফেলতে নেওয়ার পূর্বেই তার গলায় সচল হাতে চিমটি দেয় জোরে। ‘আহহহ’ করে চিৎকার করে উঠে আফরাজ। কোল থেকে ফেলে দেয় নাজীবা কে। ভাগ্য সহায় ছিল বলে সে পড়ল শক্ত বালিশের উপর। চমকে তাকিয়ে দেখে আফরাজ এর সঙ্গে হাতাহাতির কারণে বিছানার দু’টো বালিশ ফ্লোরের উপর পরে গিয়ে ছিল। নিজের ব্যাকসাইড ধরে খুশির ঠেলায় বলে,

“আলহামদুলিল্লাহ জ’ল্লা’দ করলার ধাক্কায় পাছা ভাঙ্গেনি। না হলে ইহকালে আর বিছানার থেকে উঠতে হতো না আমার।”

পরক্ষণে রাগান্বিত চোখে আফরাজ এর দিকে তাকিয়ে বলে,

“এই করলা ঐ করলা সাদা কাউয়ার শোকাহত বয়ফ্রেন্ড। গার্লফ্রেন্ড পান নাই বলে কি আমার কিডনি নেওয়ার জন্য পাছা ভে’ঙ্গে দেবেন? আপনাকে কিন্তু বলে রাখতেছি আমি যদি পাগল হয় আপনাকেও পাগল বানিয়ে দেব।”

আফরাজ শেষের কথাটি শুনে বিরবির করে বলে,

“তুমি পাগল তো আগেই ছিলে। এখন মনে হচ্ছে আমার নিজের জন্য পাগলাগরাদে সিট বুকিং দিতে হবে।”

“ঐ করলার বাচ্চা ফিসফিস না করে ঘুমান না‌। ঐ আধমরা শরীর নিয়ে তো কর্মের কিছু করতেই পারবেন না। তার চেয়ে ভালো ঘুমান না! জেগে থেকে কি আন্ডা পারবেন?”

“এই মেয়ে তোমাকে না বলেছি চপাট চপাট মুখ না চালাতে। একদম মুখ ভে’ঙ্গে দেব। বে’য়া’দপ মেয়ে। স্বামীর সাথে কেমনে কথা বলতে হয় সেই ম্যানারটুকু ও জানো না। বাবা-মা-র থেকে দেখছি কোনো শিক্ষাই পাও না। যতসব ম্যানারলেস গাইয়া আমার কপালের উড়ে এসে জুড়ে বসে । আল্লাহ ভালো জানেন কি শিখেছো ছোট থেকে?”

কথাটুকু বলে আফরাজ বিছানার থেকে নেমে ধুপধাপ পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। নাজীবা স্তদ্ধ চোখে ওয়াশরুমের দিকে তাকায়। তার পুরোনো ক্ষতকে জাগিয়ে তোলার জন্য এই কথাগুলো যথেষ্ট ছিল। বিনা বাক্যে সে তার স্বামীর রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। বিছানার নিচ থেকে তার সুটকেস বের করে। যেখানে তার পরিবারের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোর সাক্ষী স্বরুপ এক অ্যালবাম রাখা। ছোট ছোট শার্ট ও রাখা আছে। নিরবে অ্যালবামটি জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল সে। চার পাশের দেওয়াল ব্যতীত বাহিরের কারো সেই কান্নার শব্দ শুনার উপায় নেই। অ্যালবাম খুলতেই নাজীবা তার মায়ের হাস্যজ্জ্বল ছবি দেখতে পায়। বাবার সাথে তার মা দাঁড়িয়ে আছে। হাতের দু’পাশে ছোট দুটি বাচ্চা একজন বাবাকে আরেক জন তার মা-কে জড়িয়ে রেখেছে। সে তাদের দিকে চেয়ে বলে,

“তোমরা নেই তো কি হয়েছে? আমি আমার মত তাকে খুঁজে শাস্তি দেবোই। তোমরা কোনো চিন্তে করো না। আমি তোমাদের সঙ্গে হওয়া কর্মের শোধ তুলবোই।”

কথাটুকু বলে অ্যালবামটি বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। সারারাত স্বামী সেবার পর হালকা প্রশান্তির ঘুম ঘুমিয়ে ছিল তার বুকে। কিন্তু স্বামীর মুখে তীক্ষ্ণ কথা শুনে মেয়েটির মন খারাপ হয়ে যায়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)অভিমানী মন নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বেশ হালকা লাগছে আফরাজ এর শরীর। গিজার অন করা দেখে একেবারে কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল সেরেছে। মন মেজাজ ঠান্ডা হওয়ায় সে পরণের কাপড় ঠিকঠাক করে রুমের মধ্যে চোখ বুলিয়ে নেয়। মেয়েটিকে রুমের মধ্যে না পেয়ে পাত্তা দিল না। মাথার চুলগুলো ঝেড়ে ফাইল নিয়ে বসল। যেগুলো তার গতদিন চেক করে শেষ করার কথা ছিল।

____

“স্যার উঠুন। আপনার শরীর থেকে ভীষণ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। স্যার?”

বলেই র’ক্তে’র উপর শুয়ে থাকা লোকটির ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয় নার্সটি। লোকটি আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। ফ্লোরের উপর চোখ বুলিয়ে দেখল লা’শটির ছিটেফোঁটা ও নেই। বাঁকা হেসে নার্সটির দিকে তাকায়। নার্সটির স্বাভাবিক আচরণ দেখেই বুঝতে পারল মেয়েটি রুমের মধ্যে কোনো লা’শ দেখতে পায়নি। তথাপি রুম যেমন ছিল তেমন থাকায় ভয়হীন কণ্ঠে তার ঘুম ভাঙ্গিয়েছে। লোকটি সোজা গোসল করতে চলে গেল। কেননা তার র’ক্ত’মাখা হাত কেউ দেখতে পেলে কেলেংকারি হতে পারে। সে জানে তার পরণের শার্টটি মহিলাটি ছাড়া আর কেউ পরায়নি। তাই সে গোসল সেরেই মেডিসিন সমেত ইনজেকশন নেবে। নার্সটি অবাক চোখে লোকটির স্বাভাবিক আচরণ দেখে তৎক্ষণাৎ তার ম্যামের কাছে ছুটে যায়। মহিলাটি তখন তসবিহ হাতে নিয়ে ধ্যান করছিল। মহিলাটির হাবভাব ও কেন জানি খুব ভয়ংকর মনে হয় নার্সের কাছে। কেননা মহিলাটি লাল রং এর শাড়ি পরেই ধ্যান মগ্ন হয়। এখনো সেই রুপে তসবিহ গুনছে। নার্স কিছু বলবে তার আগেই সে তার পেছনে কারো গরম নিঃশ্বাস এর আভাস পায়। ভয়ে বুক ধরফড়িয়ে উঠে তার। সে কাঁপা নজরে পেছনে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। কিন্তু যেই সামনে তাকালো বিকৃত ভয়ানক র’ক্তা’ক্ত মুখশ্রী দেখে চোখ বুজে চিৎকার দিয়ে উঠে। আকস্মিক কারো স্পর্শে সামনে তাকিয়ে দেখল মহিলাটি ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নার্স তার দেখা দৃশ্যপট শুনিয়ে দেয়। মহিলাটি হেসে বলেন,

“মা-রে বুঝছি তোর উপর কাজের চাপ বেশি। চোখে ভুলভাল দেখে তোর মনে ভ্রম জাগছে। এক কাজ কর আজকের মেডিসিন ইনজেকশন দেওয়ার পর বাসায় চলে যাইস। তোকে সাতদিন ছুটি দিলাম। আর এই নেহ্ খাম। এখানে পাঁচ হাজার টাকা আছে। হাফ তোর বেতন বাকি হাফ তোর জন্য টিপ’স।”

নার্সটি নিজেকে সামলে মাথা নেড়ে লোকটির রুমের দিকে চলে যায়। মহিলার হাসিমুখ উধাও হয়ে যায়। সেই চেহারায় ভর করে একরাশ চিন্তা। মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করেন।

“মেয়েটি কি কিছু বুঝতে পেরেছে? যদি বুঝে থাকে তাহলে এর পরিণতিও সেই রাতের লা’শটার মত হবে।”

ভেবেই বাঁকা হাসলেন তিনি। লোকটি গোসল সেরে উদাম শরীরে ট্রাউজার পরে রকিং চেয়ারে বসে দুল খাচ্ছে। হাতে তার হারানো মেয়েটির ছবি। নার্স এসে কাঁপা হাতে আগের দিনের মত মেডিসিন ইনজেকশন দিয়ে বেরিয়ে যায়। লোকটি তার রুমের টিভি চালু করে। দেখতে পেল ডা.সিফাত হাসানের আকস্মিক মৃত্যুর খবর টেলিকাস্ট করা হয়েছে। এই দেখে সে রুম কাঁপিয়ে হাসতে লাগে। মহিলা নিজের রুম পর্যন্ত হাসির শব্দ শুনতে পেলেন। চিন্তাভাবনা দূরে ঠেলে তিনিও টিভি চালু করেন। হারানো মেয়েটির চিকিৎসাধীন ডা.সিফাত হাসান এর মৃত্যুর কারণ কি হতে পারে এ নিয়ে খবরের ছড়াছড়ি চলছে। তিনি দেখে মৃদু হেসে টিভি অফ করে পুনরায় ধ্যান করতে লাগল।

____

আফরাজ নাস্তার টেবিলে সবাইকে দেখতে পেলেও তার নামেমাত্র বউকে সামনে না দেখে ভ্রু কুঁচকায়। কুসুমা ভাবী আফরাজ এর প্লেটে জেল লাগানো ব্রেড রেখে প্লেটের পাশে স্যালাদ আর কর্ন স্যুপের বাটি এগিয়ে দেয়। ভাবীর কাছ থেকে নাস্তা পেয়ে সে কিছুটা ইতস্তত বোধ করে। কারণ আগের দিন তার নাস্তা নাজীবা দিয়ে ছিল। আজ খাওয়ার টেবিলে মেয়েটি নেই দেখে তার অস্বস্তি লাগছে সবার সঙ্গে খেতে। আকবর বন্ধুর হাবভঙ্গি দেখে শয়তানি হেসে বলে,

“বন্ধু বুঝি তার ফ্রাইড রাইসকে খুব মিস করছে। এত সুস্বাদু নাস্তা রেখে চোরের মত কিচেনের দিকে নজর দিচ্ছো দেখি। বাট মাই ওয়াইফ অলসো কুক বেটার ওকে। দিস অলসো ডেলিসিয়াস ইয়াম্মম।”

স্যুপের বাটি থেকে এক চুমুক খেয়েই শেষ কথাটি বলে আকবর। আফরাজ নড়েচড়ে বসল। খাদিজা বেগম স্যুপ শেষ করে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে থেকে নিজের নাতিকে লক্ষ করছে। তিনি মনেপ্রাণে সন্তুষ্ট বোধ করছেন। গতরাতের পর থেকে আফরাজ একটু হলেও তার নাতবউয়ের শূন্যতা অনুভব করছে। তিনি আকবর এর দিকে মিথ্যে রাগের নজরে চেয়ে বলেন,

“আকবর ব্যাটা এটা কিন্তু ঠিক না। দাদুভাই এর সাথে মজা করলে পেছন থেকে বাঁশ দেবে।”

কুসুমা ভাবী হেসে ফেলল। আফরাজ এর অবস্থা সত্যি নাজেহাল এখন। এরা যে মেয়েটির সাথে তার নাম টেনে টিজ করছে তা বেশ বুঝতে পেরেছে। তাই বুদ্ধিমানের মত নিশ্চুপে নাস্তা খেতে লাগল। এমনে তার মনে প্রশ্ন জাগে।

“বিয়ের পর থেকেই দেখছি মেয়েটা তো আমার আগপিছ ঘুরে চপাট চপাট মুখ চালাতে পছন্দ করতো। আজ কি এমন হলো যে সামনেও এলো না। যাক বাদ দেয় আমার কি? মেয়েটার পাগলামী থেকে রেহাই পেলেই শান্তি।”

নিজের মনগড়া ভাবনার ইতি টেনে সে নাস্তা শেষ করে ফেলল। আকবর এর কাছে গিয়ে তার কান মলা দেয়। বেচারা বউয়ের লোভনীয় কোমড়ে একটুখানি চিমটি দিতে চেয়ে ছিল। জ’ল্লা’দ বন্ধু তাও হতে দিল না। বেচারা ‘আহ আহ ছাড় ব্যাটা। কান ছিঁড়ে ফেলবি নাকি? ছাড়।’ বলে দুষ্টুমি করছে। কেননা আফরাজ কান ছেড়ে দিয়েছে তখনি যখন আকবর চোখ বন্ধ করে মৃদু চিৎকার দিয়ে ছিল। কোনোরূপ ব্যথা অনুভব না করায় চোখ খুলে দেখে সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় ‘হেহেহেহ্’ হেসে গাড়ির দিকে ছুট লাগায়। আফরাজ মৃদু হেসে চোখে সানগ্লাস পরে দরজার কাছে গিয়েই থেমে যায়। পিছনে মোড়ে তার রুমের মুখোমুখি রুমটির দিকে তিন-চার মিনিট স্থীর দৃষ্টিতে চেয়ে তাকে। কিন্তু দরজা খুলছে না,দেখে সে ভাবনা সরিয়ে ফেলতে মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যায়।

জানালার বাহিরে স্বামীর গাড়ি চলে যেতে দেখেই স্বস্তি পেল নাজীবা। পরক্ষণে তার শরীরে কাঁপন শুরু হয়। সে তৎক্ষণাৎ টিভি অফ করে দেয়। নিজেকে গুটিয়ে নিতে আলমারির বাঁদিকে গিয়ে বসে পড়ে। ড্রেসিং টেবিলে পানির গ্লাস রাখা ছিল। সে কাঁপা হাতে গ্লাসটি নিয়ে মুখে নেয়। এক ঢোকে পানি খেয়ে নিজেকে সামলাতে হাতের কবজিতে কামড়ে ধরে। দুরুদুরু বুকে শান্তি পেল। কিন্তু চোখে ঝাঁপসা দেখায় অজ্ঞান হয়ে যায়।
তখনি….

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে