#অন্যরকম তুই💘
#পর্বঃ০৭
#লেখিকাঃDoraemon
অহনা না চাইতেও অনন্তের ঠোঁটের স্পর্শের কথা বার বার মনে পড়তে থাকে। সেই ভয়ংকর অনুভূতির কথা মনে ভাবতেই অহনার রাতে আর ঘুম হলো না৷ সারারাত অহনা নির্ঘুম অবস্থায় কাটিয়ে দেয়। কারণ প্রথম ঠোঁটের স্পর্শ কেউ ভুলতে পারে না তেমনি অহনাও কিছুতেই ভুলতে পারছে না। অজানা ভয় অহনার মনে বিরাজ করছে। শুধু ভোর বেলায় অহনার চোখটা একটু লেগে যায়। সকালে অহনা ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির কাটায় দেখতে পেল অহনার আজ ঘুম থেকে উঠতে ভিষণ দেড়ি হয়ে গেছে। কলেজের ঘন্টা দিতে আর ১০ মিনিট বাকি৷ অহনা নিজে নিজে বলতে লাগল
–এটা কি হলো! আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি! আমার আজ কলেজে যেতে অনেক দেড়ি হয়ে যাবে!
অহনা কোনোরকমে ৫ মিনিটে রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে দিল এক দৌড়। কোনোরকম একটা রিকশা নিয়ে অহনা শেষমেষ কলেজে পৌছাল৷ সিড়ি দিয়ে অহনা এতই দ্রুত উঠছিল যে ঠাস করে একটা ছেলের সাথে অহনা ধাক্কা খেলো৷ যখন অহনা নিচে পড়ে যেতে নিল তখন ছেলেটি অহনার কোমড় জড়িয়ে একটান দিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। ঘটনাটা এতই দ্রুত ঘটল যে অহনা নিচে পড়ে যাওয়ার সময় ছেলেটার মুখটাও দেখতে পারে নি কারণ ছেলেটা তাড়াতাড়ি অহনার কোমড় জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়৷ ছেলেটি আর কেউ নয় সে হলো অনন্ত। যখন অহনা অনন্তের বুক থেকে নিজেকে ছাড়াল তখন একটু উপরে তাকিয়েই অহনা দেখতে পেল যে সে ভুল মানুষের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। কারণ এটা যে অনন্ত স্যার। অনন্তকে দেখেই অহনা ভয়ে কেঁপে উঠে। একেই তো অহনা গতকাল অনন্তের গালে কষিয়ে থাপ্পড় দিয়েছিল। আজ যে অহনার কপালে শনি আছে সেটা অহনা ভালো করেই বুঝতে পারছে৷ অনন্ত অহনার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অহনার ভয়ে হাত পা কাঁপা-কাঁপি করছে। অনন্ত অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–ছেলেদের সাথে ধাক্কা খেতে তোর খুব ভালো লাগে তাই না অহনা? তো আর কাউকে পেলি না! শেষমেষ আমার মতো একটা সুদর্শন ছেলের সাথেই তোর ধাক্কা খেয়ে পড়তে হলো!
অনন্তের এমন কথা শুনে অহনা রাগী দৃষ্টিতে অনন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। অনন্তের দিকে তাকানোর সময় অহনার হঠাৎ করে কালকের ঠোঁটের স্পর্শের কথা মনে পড়ে যায় যা অনন্ত ভয়ানকভাবে অহনার ঠোঁটে দিয়েছিল। কিন্তুু সাথেসাথেই অহনার মনে পড়ল যে অনন্ত তার শিক্ষক। তাই অহনা একটু বিনয়ের সাথে মাথা নিচু করে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–স্যার আ..আ আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। আসলে আমার কলেজে পৌঁছাতে একটু দেড়ি হয়ে গেছে তাই….
অহনাকে বলতে না দিয়ে অনন্ত অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–তাই তুই আমার শরীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে আমার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লি।
–স্যার আপনি এসব কি বলছেন? আমি পড়ে যেতাম তো যেতামই আপনি আমাকে ধরলেন কেন? আমি তো আপনাকে ধরতে বলি নি। আপনিই তো….
–আমি তো কি? তুই নিজে আমাকে ইচ্ছে করে ধরেছিস। ভবিষ্যতে আমার আশপাশে যদি তোকে ঘেঁষাঘেঁষি করতে দেখি তাহলে তোর খবর আছে। এখন যা ক্লাসে যা। একটু পরেই তো তোর সাথে আমার আবার দেখা হবে। তো নিজেকে তৈরি করে রাখিস৷
এ কথা বলেই অনন্ত সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে চলে গেল৷ অহনা এখনও সিড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে৷ অহনা অবাক হয়ে মনে মনে বলতে লাগল
–আমি তো উনার সাথে ধাক্কা লাগতে চাই নি! উনিই তো কোথা থেকে উড়ে এসে আমার সাথে ধাক্কা লাগলেন ! শয়তান, লুচু, দানব। তোর সাহস হয় কি করে হয় আমায় এতগুলো কথা বলার! নিজেই তো আমার শরীরে হাত দিলি আবার নিজেই নিস্পাপ সাজার নাটক করিস! কিন্তুু দানব স্যারটা কি যেন বলল! আমি কিসের জন্য তৈরি হবো?
অহনা আর কিছু না ভেবে দৌড় দিয়ে ক্লাসের কাছে পৌঁছাল৷ অনেক আগেই ক্লাসে স্যার ঢুকে গেছে। কিন্তুু অহনার ভাগ্য ভালো ছিল আজ অহনার প্রথম টিচার অহনাকে কিছু বলে নি। ক্লাসে কোনো বেঞ্চ খালি নেই দেখে অহনা একদম পেছনের বেঞ্চটায় বসল। অহনা বেঞ্চে বসার সাথে সাথেই অহনার সাথে বসা পাশের মেয়েটি অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–অহনা তোমার ঠোঁট দুটো এমন লাল হয়ে এবং ফুলে আছে কেন? ঠোঁটের পাশে তো অল্প কেটেও গেছে! এমন কি করে হলো?
মেয়েটির কথা শুনে অহনার গতকালকের সেই অন্ধকার ক্লাসে অনন্তের দেওয়া ভয়ংকর লিপ কিসের কথা মনে পড়তে থাকে। অহনা এটা ভাবতেই ভয়ে কেঁপে উঠল। অহনার ভয় পাওয়া চেহারা দেখে মেয়েটি অহনাকে বলল
–কি হলো অহনা তুমি এভাবে ভয় পাচ্ছো কেন? কি হয়েছে তোমার?
অহনা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল
–আমার কি… কি… কিছু হয় নি।
মেয়েটিও অহনাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না৷ স্বাভাবিকভাবেই অহনা তিনটি ক্লাস করতে লাগল। কিন্তুু ক্লাসগুলোতে অহনা কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিল না। অহনার ঠোঁটে এখনও ভীষণ ব্যথা করছে। অহনা নিজের ঠোঁটে নিজে হাত দিলেই ভয়ংকরভাবে কেঁপে যায়। অহনা হাই বেঞ্চের উপর হাত ঠেকিয়ে নিজের কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে। অহনার মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা করছে। তিনটি ক্লাস শেষ। এখন অনন্তের উচ্চতর গণিত ক্লাস। একটুপর অনন্ত ক্লাসে ঢুকল। সবাই অনন্তকে দাঁড়িয়ে সালাম দিল এবং অহনাও কাঁপা কাঁপা পায়ে অনন্তকে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। তারপর সবাই বেঞ্চে বসে পড়ল। আজ অনন্তের মুখে রাগী ভাব স্পষ্ট। অনন্তের রাগী চেহারাটা দেখেই অহনা বুঝতে পারল যে এটা ঝড়ের পূর্বাবাশ। অহনা মনে মনে বলতে লাগল
–অনন্ত স্যারকে কাল রাগে যেভাবে কষিয়ে থাপ্পড়টা দিয়েছিলাম তাতে তো উনি আমায় জীবনেও ক্ষমা করবেন না৷ আগের শাস্তিগুলোর থেকেও ভয়ংকর শাস্তি মনে হয় এবার আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
অহনা ভয়ে কাঁপতে লাগল।
অনন্তের ক্লাস অনেক্ষণ চলতে থাকল৷ ক্লাসে অনন্ত অহনাকে কিছু বলছে না দেখে অহনা কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হলো। কিন্তুু হঠাৎই অহনাকে চমকে দিয়ে অনন্ত অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–অহনা তুই দাঁড়া।
অনন্তের এমন রাগী কন্ঠে ডাক শুনে অহনার বুকের আত্মাটা কেঁপে উঠল। অহনার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসল৷ অহনা কাঁপা কাঁপা হাত পা নিয়েই দাঁড়াল। অহনার মুখে কোনো কথা নেই। অহনা শুধু নিজের মাথাটা নিচু করে আছে৷
–সারাদিন কয়টা ছেলের সাথে তুই ফূর্তি করিস অহনা?
অনন্তের এমন বাজে কথা শুনে অহনা স্তব্ধ হয়ে অনন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরো ক্লাসটাই এখন স্তব্ধ। ক্লাসের অন্যান্য ছেলে মেয়েরাও অনন্তের এমন কথা শুনে অবাক। কিন্তুু অনন্তকে সবাই ভয় পায় বলে কেউ কিছু বলছে না।
অহনার মুখে কোনো কথা বের হচ্ছে না। অহনা অনন্তের কাছে এমন ব্যবহার মোটেও আশা করে নি। অহনার চোখের কোণে পানি টলমল করছে। আরেকটু হলেই অহনার চোখের জল টুপ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়বে। অহনা মনে বলতে লাগল
–অনন্ত স্যার ক্লাসের সবার সামনে আমাকে এসব কি বলছে! শেষে কিনা স্যার আমাকে চরিত্রহীন উপাধি দিয়ে দিল!
–কিরে অহনা বলছিস না কেন? কয়টা প্রেমিক আছে তোর যাদের সাথে তুই ফূর্তি করিস?
অহনা আর সহ্য হলো না। এবার অহনা সাহস করে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–স্যার আপনি আমাকে এসব কি বলছেন? স্যার আপনার কি কোনো ধারণা আছে আপনি কি বলছেন?
–হ্যা আমি জানি তো আমি তোকে কি বলছি অহনা। তা তুই যে এবারের উচ্চতর গণিত পরীক্ষায় ডাবল শূন্য পেয়েছিস তা কি তুই জানিস অহনা? আমার বিষয়ে তুই ছাড়া সবাই পাশ করেছে।
অনন্তের কথা শুনে অহনা অবাক থেকে অবাক হচ্ছে৷ অহনার অনন্তের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়৷ অহনা মনে মনে বলতে লাগল
–এটা কি করে সম্ভব! আমি কি করে উচ্চতর গণিতে ফেল করতে পারি! আমিতো পাশ করার মতো যথেষ্ট লেখা লিখেছিলাম।
অনন্তের কথা শুনে অহনার চোখের কোণের পানি টপ করে নিচে পড়ে যায়। অহনার এ অবস্থা দেখে আজ সবারই মায়া হচ্ছে। আজ কারও মুখেই কোনো হাসি নেই। অহনার মন খারাপ দেখে আজ সবারই মন খারাপ। কিন্তুু ভয়ে কেউ অনন্তকে কিছু বলতে পারছে না। অনন্ত আবারও অহনাকে বলল
–সারাদিন পড়াশোনা বাদ দিয়ে যদি ছেলেদের সাথে ঢলাঢলি করিস তাহলে তো পরীক্ষার অবস্থা এমনই হবে। সত্যি তোর জন্য আমার ভীষণ মায়া লাগছে অহনা। শেষে কিনা তুই আমার বিষয়ে ফেল করলি! অহনা এবার মনে সাহস রেখে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–স্যার আপনি এসব কি বলছেন?আমি আজ অবধি কোনোদিনও কোনো বিষয়ে ফেল করি নি৷ স্যার আমি তো পাশ করার মতো খাতায় অংক লিখেছিলাম! আর আপনি এসব কি বলছেন যে আমি নাকি ছেলেদের সাথে এমন…! ছিহ্ স্যার আপনার মুখে কি একবারও এসব আটকালো না? আপনি কি করে আপনার ছাত্রীকে এসব বলতে পারেন?
–নারে অহনা আমার মুখে একটুও আটকালো না। কারণ তোর মতো ফালতু মেয়েদেরকে তো এসব বলাই মানায়। তাই তো বলছি প্রেমিকদের সাথে ঘুরাফেরা করা বন্ধ করে পড়াশোনায় মনোযোগ দে। তাহলে তোর ভবিষ্যৎে কাজে লাগবে। আর তুই যেন কি বললি? তুই পাশ করার মতো খাতায় লিখেছিস! হা হা হা একটু পরেই তোর খাতা তোকে দিয়ে দিব তখন ভালো করে খাতাটা দেখে নিস৷
অনন্তের এসব কথা শুনে অহনার মাথা আগুন হয়ে যায়। অহনার মুখে আর কোনো কথা নেই। অহনার চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ছে। অহনার চোখে জল দেখে অনন্তের বুকের ভিতরটা কস্টে ফেটে যাচ্ছে। অনন্তের মনে হচ্ছে অনন্ত তার নিজের কলিজায় আঘাত দিচ্ছে।
অনন্ত মনে মনে বলতে লাগল
–তোকে কস্ট দিতে আমিও চাই নি অহনা। তুই আমার গালে থাপ্পড় দিয়েছিস তাতে আমি কিছু মনে করে নি অহনা৷ তুই চাইলে আমি আমার জীবনটাও তোকে দিতে পারব। কিন্তুু তুই কাল আমার ভালোবাসাকে যেভাবে অপমান করেছিস তার জন্য তো তোকে শাস্তি পেতেই হবে। তোর কাছে আমি আগের করা ভুলগুলোর জন্য ক্ষমা চেয়েছিলাম কিন্তুু তুই আমাকে ক্ষমা করলি না। বরং তুই আমাকে আরও অপমান করেছিস। আমাকে তুই আরো কঠোর হতে বাধ্য করেছিস। ভালোবাসার জন্য যদি আমাকে আরো খারাপ, কঠোর, ভয়ংকর, এমনকি পাগলও হতে হয় তাহলে আমি তাই হবো। আমি যেমন তোকে নিজের থেকে বেশী ভালোবাসি তেমন তোকে নিজের করার জন্য তোকে যথেষ্ট আমি শাস্তিও দিতে পারি। তোকে অনেক ভালোবাসতে চেয়েছিলাম কিন্তুু তুই আমার ভালোবাসাকে অবহেলা করলি। এবার আমিও দেখব তুই কতদিন আমাকে অবহেলা করে থাকতে পারিস। ভালোবাসা না দিয়ে হলেও কস্ট দিয়ে হলেও আমি তোকে আমার ভালোবাসার কথা তোর মনে স্মরণ করিয়ে দিব। হতে পারে সেই ভালোবাসার প্রকাশটা অন্যরকম। আমার কাছেই যে অন্যরকম তুই।
।
।
।
#চলবে……