18.8 C
New York
Sunday, October 5, 2025

Buy now







অন্ধ তারার অশ্রুজল পর্ব-৭+৮

#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল

৭.

ইফতি ফিরল রাত দশটায়৷ তার অফিস দূরে। ফিরতে ফিরতে দেরি হয় যায় প্রায়ই, বিশেষ করে যেদিন ট্রাফিক জ্যাম বেশি থাকে।

প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে ঘেমে-নেয়ে ফিরেছে সে। প্রিয়তী চট করে গিয়ে লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে এলো তার জন্য। ইফতি ফ্যানের নিচে বসেছে। শার্ট খুলে ফেলেছিল, প্রিয়তীকে দেখে আবার পরতে গেলে প্রিয়তী হেসে ফেলে বলল, “আগে ঘাম শুকিয়ে নিন। আমি দেখে ফেললে মানসম্মান চলে যাবে না৷”

প্রিয়তীর হাতে বিয়ের মেহেদী দেয়া ছিল। লেবু কেটেছে বলে ওর গা থেকে সতেজ একটা ঘ্রাণ আসছে। চুল উড়ছে বাতাসে। দুপুরে দেয়া কাজল লেপ্টে গেছে খানিকটা। কী মায়াবী লাগছে তাকে! শরবতের গ্লাসটা সে যখন বাড়িয়ে ধরল, ইফতির ইচ্ছে করল গ্লাসটার সাথে সাথে প্রিয়তীকেও টেনে কাছে নিয়ে আসতে। হয়তো কাজটা করেই ফেলত, শেষ মুহূর্তে কিভাবে যেন সামলে নিল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

প্রিয়তী জিজ্ঞেস করল, “আপনি চুল কাটতে পারেন না? এত বড় চুল থাকলে গরম বেশি লাগারই কথা।”

ইফতি কথা না বলে প্রিয়তীর চুলের দিকে তাকিয়ে রইল। এত লম্বা চুল নিয়ে অন্যকে বড় চুলের জন্য জ্ঞান দেয়া পাবলিক সে জীবনে দেখেনি। প্রিয়তী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, “আমি তো আর অফিসে যাই না৷ গেলে বয়কাট দিয়ে ফেলতাম।”

“তাহলে আপনাকে অফিসে ভর্তি করে দেই চলুন। বয়কাটে কেমন লাগবে দেখতে ইচ্ছে করছে।”

প্রিয়তী হেসে বলল, “অফিসের লোকেরা তো আমাকে ভর্তি করার জন্য সিট খালি করে বসে আছে তাই না? যাব, আর নিয়ে নেবে। আগে আপনি আমাকে আপনি বলা বন্ধ করুন তো! আপনার বাড়ির লোক শুনলে কী ভাববে? তিন বছরের প্রেমিকাকে কে আপনি বলে?”

“তা ঠিক! আচ্ছা তুমি বলব, তবে তুমিও আমাকে তুমি বোলো। তিন বছরের প্রেমিককেও কেউ আপনি করে বলে না।”

প্রিয়তী তোয়ালেটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “গোসল করে আসুন, স্যরি এসো। তারপর খাবার দিচ্ছি। অন্যদের খাওয়া শেষ।”

ইফতি তোয়ালে নিতে নিতে বলল, “তোমার জন্য কিছু জিনিস এনেছি, এই ফাঁকে পরে দেখে ফেলো লাগে কি না।”

প্রিয়তী খেয়াল করল ইফতি অনেকগুলো প্যাকেট এনেছে। সেগুলো খুলে দেখা গেল সবগুলোতেই প্রিয়তীর জন্য কিছু না কিছু আছে। রাতে পরার জন্য নরম টিশার্ট, বাসায় পরার কয়েকটা রেডিমেড সালোয়ার কামিজ, কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় কসমেটিকস, এমনকি অন্তর্বাস, স্যানিটারি ন্যাপকিন পর্যন্ত নিয়ে এসেছে! একটা ছেলের এতকিছু মাথায় থাকে! সবশেষে প্যাকেট থেকে বিশাল একটা গামছাও বের হলো। প্রিয়তী হেসে ফেলল।

প্রিয়তীর মন খুব ভালো হয়ে গেল জিনিসগুলো দেখে। চোখে পানিও চলে এলো। তার জন্য আজ পর্যন্ত কেউ এতটা ভাবেনি৷ মুখে না বলতেও কেউ প্রয়োজনীয় জিনিস হাজির করতে পারে এটা সে কোনোদিন ধারণাই করতে পারেনি।

ইফতি বের হতে হতে জিনিসগুলো একবার পরে দেখে ফেলল প্রিয়তী। সব জিনিসই একটু ঢিলেঢালা হয়েছে, তবে চলবে। সে আলমারিতে নিজের জন্য খানিকটা জায়গা ফাঁকা করে তাতে জিনিসগুলো গুছিয়ে ফেলল।

ইফতি বের হলে প্রিয়তী বলল, “বাব্বাহ! আমি ভাবতাম মেয়েরা শুধু এত সময় নিয়ে গোসল করে।”

“এত গরমে আমার বের হতে ইচ্ছে না করলে কী করব বলো!”

“খাবার দিচ্ছি। টেবিলে এসে বসো।”

“প্রিয়তী!”

“হু?”

“জিনিসগুলো পছন্দ হয়েছে?”

প্রিয়তী ঘুরে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসল। উত্তর দিল না৷ মুখে বললে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সম্পূর্ণ হবে না৷

★★★★

ইফতি খেতে বসে দেখল প্রিয়তী নিজের জন্যও প্লেটে খাবার নিয়েছে।

“তুমি এখনো খাওনি?”

“না।”

“আমার জন্য বসেছিলে?”

“হুম।”

“ভালোবাসা দেখানোর জন্য এভাবে না খেয়ে থাকতে হবে না। খিদে পেলে খেয়ে নেবে। বাড়ির লোক কিছু মনে করবে না৷ এমনিতেও আমি একাই খাই।”

প্রিয়তীর ভালো মনটা চট করে খারাপ হয়ে গেল। ইফতি কী ভাবছে, সে না খেয়ে বাড়ির লোককে দেখাতে চাইছে? ওর অনেক খিদে পেয়েছিল সত্যিই, কিন্তু ইফতিকে ছাড়া খেতে ইচ্ছে করছিল না বলে খায়নি। এখন খাওয়ার ইচ্ছেটাও নষ্ট হয়ে গেছে।

ইফতির কথাটা বলে ফেলে মনে হলো বলা উচিত হয়নি। প্রিয়তী খাবার মুখে তুলছে না৷ নাড়াচাড়া করছে। মুখ কালো।

“স্যরি! আমি এভাবে বলতে চাইনি আসলে।”

“তো কিভাবে বলতে চেয়েছেন?”

“তোমার আমাকে তুমি করে বলার কথা না?”

“বলতে ইচ্ছে করছে না।”

প্রিয়তী উঠে যেতে নিলে ইফতি তার হাত টেনে ধরে বসিয়ে দিল। প্রিয়তী হাত ছাড়াতে চেয়েও পারল না৷ অনেক শক্তি এই ছেলের গায়ে।

ইফতি নিজের প্লেট থেকে এক লোকমা ভাত নিয়ে প্রিয়তীর মুখের সামনে ধরে বলল, “খাও। তোমার খাওয়ার মুড নষ্ট করেছি বলে আবারও স্যরি৷ একটু খাও আমার হাতে।”

প্রিয়তী আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। মা বাবা ঘুমিয়ে গেছে, তূণা চলে গেছে সন্ধ্যায়ই। মিফতা-তুবা নিজের ঘরে। সে ইফতির হাত থেকে খেল। ইফতি প্রিয়তীর প্লেটের খাবারও নিজের প্লেটে ঢেলে নিয়ে তাকে খাইয়ে দিতে থাকল। প্রিয়তীর মনে হতে লাগল সে বুঝি ছোট্ট বাচ্চা কিংবা ন্যাকা প্রেমিকা! কিন্তু আসলে তো কোনোটাই নয়৷ তাহলে কী?

ইফতি খেতে খেতে বলল, “মাংসটা এত ভালো হয়েছে! তোমার হাতের রান্না দেখছি দারুণ!”

প্রিয়তী জিজ্ঞেস করল, “জানলেন কিভাবে আমার রান্না?”

“এই বাড়িতে নতুন ডিশ নতুন মানুষের হাত ধরে আসাটাই স্বাভাবিক না?”

“হুম, বুঝলাম, আপনি বুদ্ধিমান।”

“কচু! বুদ্ধি থাকলে জীবনে অনেক উন্নতি হতো। মাথায় গোবর ছাড়া আর কিছু নেই।”

প্রিয়তী হাসতে হাসতে বলল, “তোমার মাথায় গোবর থাকলে আমার মাথায় আছে পোড়া ছাই!”

ইফতি প্রিয়তীর মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল, “তাই নাকি? মাথায় ছাই নিয়ে ভালো রাঁধা যায়? আমরা সবসময় গৃহিনীদের ট্যালেন্টটাকে আন্ডারেস্টিমেট করি৷ তারা যেভাবে পারফেক্টলি খাবারের উপাদানগুলো মিশিয়ে প্রত্যেকটা ডিশ একেক রকম করে রাঁধে তাতে তাদের মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। সমস্যা হচ্ছে আমরা এগুলোকে খুব হালকাভাবে নিয়ে নেই আর ভাবি সারাজীবন চুলার ধারে পার করে দিল এরা! অথচ এরাই চমৎকার সব শেফ হতে পারবে! যে শেফ যত ভালো, তার বেতন তত বেশি৷ আমরা ফ্রি-তে এদের সার্ভিস পাই আর অকৃতজ্ঞের মতো অবজ্ঞা করি।”

প্রিয়তী মুগ্ধ হয়ে কথাগুলো শুনল। মানুষটাকে তার ভীষণ ভালোলেগে যাচ্ছে।

এদিকে ইফতি ভাবছে, এত বড় লেকচার ঝাড়ায় প্রিয়তী তাকে আবার বোরিং টিচার টাইপ ভেবে বসল না তো! সে প্রিয়তীর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ওর মনে কী চলছে৷ কিন্তু ঠিক বুঝতে পারল না৷ মেয়েদের মন পড়া বড় কঠিন জিনিস!

সে কথা ঘুরিয়ে ফেলল, “আজ খালারা আসার কথা ছিল, এসেছিল?”

“না, হয়তো মা নিষেধ করে দিয়েছেন৷ আমাকে কিছু বলেননি।” প্রিয়তী একটু ইতস্তত করে বলল। সে বুঝতে পারছে এদের পরিবারের ভেতরে কিছু ঝামেলা হচ্ছে। শাশুড়ী মাকে সন্ধ্যা থেকে দেখা গেছে মুখ অত্যাধিক গম্ভীর করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ সকাল থেকে তাও টুকটাক কথাবার্তা বলেছেন। সন্ধ্যার পর কার সাথে যেন ফোনে কথা বলার পর থেকে একেবারে বোম হয়ে আছেন। তবে সে এসব কিছু ইফতিকে বলল না।

খাওয়া যখন প্রায় শেষ, তখন তুবা পানির জগ ভর্তি করতে এলো। ইফতি প্রিয়তীকে খাইয়ে দিচ্ছে দেখে ওর চোখ জ্বলে উঠল। কোনোমতে জগে পানি ভরে যখন চলে যাচ্ছে, ওরা দুজনেই খেয়াল করল তুবার চোখে পানি।

ওদের আর কোনো কথা হলো না। প্রিয়তী প্লেটগুলো ধুয়ে খাবার গুছিয়ে রেখে ঘরে ফিরে দেখল ইফতি মোবাইল হাতে নিয়ে খাটজুড়ে শুয়ে আছে। যেন এভাবেই রাত কাটাবার প্ল্যান করেছে।

প্রিয়তী দরজাটা বন্ধ করে খাটের কোনে এসে বসে বলল, “আচ্ছা, তুমি কি তুবাকে এখনো ভালোবাসো?”

আচমকা এই প্রশ্নে ইফতি যেন হোচট খেল। চুপ করে কী একটা ভাবতে লাগল। প্রিয়তীর মনে হলো উত্তরটা ইফতি নিজেও জানে না৷ বিবেক আর মনের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে গেছে!

প্রিয়তী আর কিছু না বলে ইফতিকে উঠিয়ে দিয়ে বিছানা ঝেড়ে মশারি টানিয়ে ফেলল। শোওয়ার আগে এতক্ষণ পরে থাকা গতদিনের শাশুড়ীর জামাটা বদলে ইফতির আনা একটা টিশার্ট পরে নিল।

দু’জনেই শুয়ে পড়ার অনেকক্ষণ পর ইফতি ডাকল, “প্রিয়তী, ঘুমিয়ে গেছ?”

প্রিয়তী জেগেই ছিল। কিন্তু উত্তর দিল না। চুপচাপ পড়ে রইল।

ইফতি এমনিতে অফিস শেষে বাসায় এসে মড়ার মতো ঘুমোয়৷ আজ ঘুম আসছে না৷ মনটা অস্থির লাগছে। সে এপাশ ওপাশ করল বেশ কিছুক্ষণ, কিন্তু ঘুম এলো না।

প্রিয়তী একসময় ধীর স্বরে বলল, “তুমি অনেক ভালো মানুষ। তুবা হয়তো বুঝতে পারছে সে কী হারিয়েছে। সেজন্যই রিয়েক্ট করে ফেলছে।”

ইফতি কিছু না বলে চুপচাপ পড়ে রইল। প্রিয়তী জানে ইফতি ঘুমায়নি। তার কথা শুনছে। সে আরও বলল, “তোমাকে প্রথমদিন দেখে যেমন মনে হয়েছিল তুমি তেমন নও। এমনকি তোমার যে কাহিনীটা আমাকে শুনিয়েছ সেটাও আংশিক কাহিনী। আরও অনেক কিছুই আছে যা আমাকে বলোনি তাই না?”

ইফতি এবারও কিছু বলল না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

প্রিয়তী বলল, “বলবে?”

“অন্যদিন প্রিয়তী।”

প্রিয়তী ইফতির দিকে তাকাল একবার। তারপর অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তার চোখ বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমে ভারী হয়ে এসেছে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল

৮.

পরদিন সকালে ইফতি অফিসে চলে গেলে প্রিয়তী রান্নাঘরে ঢুকল শাশুড়ীকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। তিনি কাটাকুটি করছেন দুপুরের রান্নার জন্য। এই বাড়িতে কাজের লোক আছে, ধোয়ামোছার কাজ করে চলে যায়। সে বসে হাঁড়িপাতিল ধুচ্ছে। রান্নাঘরটা ছোটো, বেশি মানুষ জায়গা হয় না। মা বললেন, “মনিরের মা বের হলে তুমি আসো। আজকে তোমার একটু সাহায্য করা লাগবে। তুবা অসুস্থ।”

গতরাতের কথা মনে পড়ে গেল প্রিয়তীর। তুবার আবার এক রাতে কী হলো? সে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

“জ্বর। গিয়ে দেখে আসতে পারো। মিফতা তো অফিসে গেল না, ঘরে ছিল এতক্ষণ, মাত্র বের হলো।”

তুবা যে ওর সাথে কথা বলে না এটা বোধহয় মা বুঝতে পারেননি। গেলেও কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না, তবে না গেলেও তো খারাপ দেখায়। প্রিয়তী তুবার ঘরে উঁকি দিল। তুবা কপালের ওপর একটা হাত রেখে চোখ বুজে শুয়ে আছে। এই গরমেও গলা পর্যন্ত টানা কাঁথা দেখে বোঝা যায় শরীরের তাপ স্বাভাবিকের চাইতে বেশি।

প্রিয়তী পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, “তুবা, কেমন আছো এখন?”

তুবা চোখ মেলল। ভাবলেশহীন চোখ। নিরাবেগ গলায় বলল, “ভালো।”

“জ্বর আছে?” বলে কপালে হাত রাখল প্রিয়তী। জ্বর বেশ ভালোমতোই আছে।

“কিছু খাবে তুবা?”

“না।”

তুবার চোখের কোলে সামান্য কালি দেখা যাচ্ছে। এত ছোটো একটা মেয়ে! প্রিয়তীর খুব মায়া হলো। মিষ্টি লাগছে তুবার মুখটা। অসহায় একটা কষ্ট খেলা করছে মুখে। তুবার মোবাইলে কল এলো। ‘মা’ লিখে সেভ করা। তুবা কলটা ধরে দুর্বল গলায় বলল, “বলো মা।”, “এইতো আছি..”, “দুই পিস পাউরুটি খেয়েছি..”, ” হ্যাঁ ঔষধ খাইয়ে দিয়ে গেছে..”, “ডাক্তারের কাছে যাব একটু পরে..”

প্রিয়তী উঠে চলে এলো সেখান থেকে। নিজের ঘরে গিয়ে বসল। বাবা মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। গতকাল ফোন বন্ধ করার একটু পর আবার চালু করে ফেলেছিল। যদি বাড়ি থেকে ফোন করে! কিন্তু করেনি৷ ওদের কি তার কথা মনে পড়ে না? ও তো মরেও যেতে পারত সেদিন ইফতির সাথে দেখা না হলে। মরে গেলেও কি তারা ওর খোঁজ নিত না? এত অন্যায় করে ফেলেছে সে? সে তো বিয়েতে রাজিও ছিল না। বিয়েটা হলে জোর করে বিয়ে দেয়া হলো। সে অনেকবার বুঝিয়েছিল বাবাকে। তবুও সব দোষ যেন তারই।

ভাবতে ভাবতে চোখে পানি চলে এলো প্রিয়তীর। আপনাআপনিই তার হাত ডায়াল করতে শুরু করল মায়ের নাম্বারে।

কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন তোলা হলো। বাবা ধরেছে।

“হ্যালো!”

“বাবা! কেমন আছ?”

“যেমন থাকার কথা।”

“মা কোথায়? মায়ের সাথে কথা বলব।”

“মা তোমার সাথে কথা বলবে না।”

“বলবে। তুমি মাকে দাও।”

“সে কথা বলবে না বলেই তো দিচ্ছি না তাই না? এখন মায়ের কথা মনে পড়ছে কেন? যেখানে গেছ সেখানে ভালো লাগছে না? আর কখনো ফোন করবে না এই বাড়িতে।”

“বাবা প্লিজ…” কেঁদে ফেলল প্রিয়তী৷

বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটু থেমে বললেন, “তুমি আমাদের কাছে মরে গেছ। তাই তোমার খবরাখবর নেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না৷ তুমিও ভাবো আমরা মরে গেছি, তাহলে আর ফোন করতে ইচ্ছে করবে না।”

কলটা কেটে দেয়া হলো। এতগুলো কড়া কথা শুনে প্রিয়তী একেবারেই ভেঙে পড়ল। হাঁটু মুড়ে বসে কাঁদতে থাকল সে৷

বোধহয় কান্নার শব্দ জোরে হয়ে গিয়েছিল। শাশুড়ী মা ছুটে এলেন। “কী হয়েছে? হলো কী?”

প্রিয়তী কান্নার তোড়ে কিছুই বলতে পারল না। মা বসে রইলেন অনেকক্ষণ তার পাশে। গতকাল এই মানুষাই কথা বলেননি, আজ পাশে বসে আছেন। প্রিয়তীর ভীষণ ইচ্ছে করল তাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সংকোচে পারল না৷ মনে হলো যদি ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়? তার আরও বেশি কান্না পেল। একটা সুন্দর জীবন হাহাকারে ভরে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। জীবন প্রচন্ড রকমের অপ্রত্যাশিত।

শাশুড়ী মা একসময় চলে গেলেন। তার অনেক কাজ পড়ে আছে। আজ তুবাও কাজ করতে পারবে না। প্রিয়তী একসময় নিজেকে সামলে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। মা জিজ্ঞেস করলেন, “আমি অনেকটা করে ফেলেছি। তোমার কিছু করতে হবে না৷ তুমি স্যুপ রাঁধতে জানো? তাহলে একটু রেঁধে ফেলো তুবার জন্য৷ তবে চাইলে সবার জন্যও করতে পারো। ইফতি মিফতা দুজনেই পছন্দ করে। যদি পারো আরকি…”

প্রিয়তী বলল, “পারব মা।”

সে আগে কোনোদিন স্যুপ রান্না করেনি। তবে এক সুযোগে ইউটিউবে ভালো করে দেখে নিল।

স্যুপটা হলোও দারুন। তুবার জন্য রান্না হয়েছিল, তুবার পছন্দ হলো। সে অনেকটা খেল। কিন্তু যখন শুনল এটা প্রিয়তী রান্না করেছে, তখন ওর মুখটা কেমন হয়ে গেল।

খানিক পরে প্রিয়তী শুনল তুবার শরীর আরও কাহিল হয়েছে। কারন সে বমি করে ফেলেছে সবটা।

প্রিয়তীর ভাবতে ইচ্ছে হলো, শরীর খারাপ বলে এমনটা হয়েছে। কিন্তু মন মানতে চাইল না৷

সে অলস বিকেলটা চুপচাপ শুয়ে রইল৷ একসময় উঠে জানালার পাশে বসল। পিচঢালা পথের কিছু জায়গায় ভাঙা। সেই ভাঙা জায়গায় পানি জমেছে। কয়েকটা বাচ্চা সেই পানিতে লাফিয়ে খেলছে। আকাশ মেঘলা হয়ে আসছে ক্রমেই। যেন বৃষ্টি নামবে এক্ষুনি, কিন্তু নামছে না। সন্ধ্যার এখনো দেরি, তবু যেন ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যা৷ বিজলি বাতি জ্বলে উঠছে ঘরে ঘরে। প্রিয়তীর ইচ্ছে হলো না বাতি জ্বালাতে। মনের ভেতর দুর্নিবার এক কষ্ট চেপে সে না কাঁদার প্রাণপণ চেষ্টা নিয়ে শিশুদের খেলা দেখতে থাকল।

সন্ধ্যার পর চায়ের আসর জমল না৷ মিফতা তুবার পাশে বসে আছে। মিফতাকে দেখে প্রিয়তীর মনে হলো, ছেলেটা তার স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসে। সে নিজেও অতটাই ভালোবাসা ডিজার্ভ করে। কিন্তু পাচ্ছে কি? তার সন্দেহ আছে!

————————————————-

আজ রাতেও বৃষ্টি নামল। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে দেখে ইফতি উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করতে গিয়েও না করে দাঁড়িয়ে রইল জানালার কাছে। বৃষ্টির তোড়ে সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঠান্ডা পানির কণাগুলো গায়ে বিঁধে যাচ্ছে। সাথে বাতাসের ঝাপটা! ভালো লাগছে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে।

সেখানে দাঁড়িয়েই সে প্রিয়তীকে প্রশ্ন করল, “তুমি পড়াশোনা কতদূর করেছ? এখন কী করতে চাও?”

প্রিয়তী দু’দিন ধরে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা নিয়ে চিন্তা করেছে তা হলো পড়াশোনা৷ তার অনার্স শেষ হয়েছে৷ মাস্টার্সের ক্লাস করছিল। সেটাও শেষ করার ইচ্ছে আছে৷ কিন্তু তার আগে কিছু করা উচিত৷ নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে৷ ইফতির কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলাটা কি ঠিক হবে? সে চাইবে কেমন করে? স্বাভাবিক সম্পর্কে একটা অধিকারবোধ থাকে, সেটা তো তার নেই।

প্রিয়তী একটু ভেবেচিন্তে বলল, “গ্র্যাজুয়েশন শেষ। একটা চাকরিতে ঢুকতে চাচ্ছি।”

“এখনকার চাকরি তো আর সহজ না। চেষ্টা করতে হবে। পড়াশোনা করেছ চাকরির?”

“না, এতদিন মাস্টার্স নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।”

“কমপ্লিট করার ইচ্ছে নেই?”

“আছে।”

“তাহলে চাকরি করতে চাচ্ছো কেন? ওটা আগে ভালোভাবে শেষ করো।”

“বিয়ের পর কি আর পড়াশোনা হয়?”

ইফতি হেসে ফেলল। “হবে না কেন?”

“পড়াশোনার জন্য টাকাপয়সাও চাই। আমি মাস্টার্স শেষ করব, কিন্তু নিজে আগে কিছু করতে চাই।”

ইফতি বলল, “শোনো, তোমার যদি আমার থেকে টাকা নিতে হ্যাজিটেশন হয়, তাহলে ধার হিসেবে টাকা নেবে। তারপর পারলে শোধ করে দেবে। কিন্তু এখন বসে না থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফেলা ভালো। পরে হয়তো আর সুযোগই পাবে না। আর এমনিতেও চাইবামাত্র কেউ তোমাকে চাকুরি দিতে বাধ্য থাকিবে না।”

“এরকম একটা কথা টাকার ওপর লেখা থাকে তাই না?”

“জি ম্যাম। এবার বলুন তো, আপনার দিন কেমন কাটল?”

“ভালো।”

“ভালো যে কাটেনি সেটা আপনার চেহারা দেখে বোঝা গেছে। অবশ্য ভালো যে সবসময় থাকবে এটা এক্সপেক্ট করাও উচিত না। এই প্রিয়তী, চলো একটা ডীল করি।”

“কিসের ডীল?”

“তুমি আমাকে সবসময় সত্যি কথা বলবে। আর আমিও।”

“তাতে লাভ?”

“আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং বেটার হবে।”

“আর?”

“ধোঁয়াশা না থাকলে সম্পর্কটা স্ট্রংও হবে।”

প্রিয়তী বলল, “আচ্ছা, বলুন তো, আপনি যেরকম স্ত্রী চেয়েছিলেন আমি সেরকমের কাছাকাছি? হলে কত পারসেন্ট?

ইফতি হেসে বলল, “তুমি তার থেকেও ভালো প্রিয়তী।”

“আপনি ডীল করার পরের মুহূর্তেই ভঙ্গ করেছেন মিথ্যে বলে!”

“আমরা এখনো ডীলটা করিনি প্রিয়তী।”

“আচ্ছা চলুন করি।”

“ওকে! ডীল ফাইনাল করার শর্ত হচ্ছে হচ্ছে আমরা একে অপরকে পাঁচ মিনিট জড়িয়ে ধরে রাখব।”

প্রিয়তী অবাক হলো, পরমুহূর্তেই খিলখিল করে হেসে ফেলল। “আপনি এটা সোজাসুজি বললেই পারতেন৷ ডীল মাঝখানে টানার কী প্রয়োজন ছিল?”

ইফতি খানিক লজ্জিত সুরে বলল, “ডীলটাই মেইন ছিল। এই ব্যাপারটা কয়েক সেকেন্ড আগেই মাথায় এসেছে।”

প্রিয়তী বলল, “ঠিক আছে। করব। কিন্তু আপনাকে তারপরেই একটু আগের প্রশ্নটার জবাব দিতে হবে। সত্যি জবাব।”

“ঠিক আছে দেব।”

ইফতি প্রিয়তীর কাছাকাছি চলে এলো। ঠিক তক্ষুনি দরজাটা সশব্দে নড়ে উঠল। কেউ দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। মিফতার গলা শোনা গেল। “ভাইয়া একটু আয় তো, তুবার শরীর কেমন করছে।”

ওরা ছুটে বের হলো ঘর থেকে। তুবার শরীর খিঁচুনি দিচ্ছে। অদ্ভূতভাবে শরীরটা মুচড়ে যাচ্ছে। ইফতি মিফতাকে বলল, “ভয় পাস না। কিছু হবে না।”

মিফতা কিছু করার অবস্থায় নেই। ইফতি এক পরিচিত ডাক্তারকে ফোন করল, ডাক্তার হাসপাতালে নিতে বললে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করল।

মাঝরাতে তুবাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেল সবাই। বাসায় রয়ে গেল প্রিয়তী আর বাবা।

প্রিয়তী নিজের ঘরে ঢুকে বিকেলের মতোই জানালার পাশে বসে রইল। এখন বৃষ্টি নেই। রাস্তায় মানুষজনও নেই। তার মন ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। সেটা দেখারও কেউ নেই।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......

Related Articles

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Stay Connected

20,625ভক্তমত
3,633অনুগামিবৃন্দঅনুসরণ করা
0গ্রাহকদেরসাবস্ক্রাইব
- Advertisement -spot_img

Latest Articles