#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
২৩ (শেষ পর্ব)
তুবারা চলে যাবার পর প্রায় পনেরো দিন হয়ে গেছে। প্রিয়তী নিজেও চলে যেতে চেয়েছিল বাপের বাড়ি, কিন্তু মিফতা হঠাৎ চলে যাওয়ায় শাশুড়ী মা এত অসুস্থ হয়ে পড়েছেন যে প্রিয়তী যেতে পারল না। সংসারের হাল ধরতে হলো আরও শক্ত করে। তবুও সে দিন গুনতে লাগল চলে যাবার। যেদিন মা সুস্থ হবেন, সেদিনই সে রওনা দেবে বাড়িতে।
সেদিনের পর থেকে প্রিয়তী একবারের জন্যও ইফতির সাথে ভালো করে কথা বলেনি। ইফতি তার রাগ ভাঙানোর অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু কাজ হয়নি। প্রিয়তী সাফ বলে দিয়েছে, “আমি তোমার ওপর রাগ করিনি। রাগ ভাঙানোর কিছু নেই। আমি যেটা হয়েছি সেটা হচ্ছে হতাশ। এই হতাশা তুমি কাটাতে পারবে না।”
ইফতি প্রথম প্রথম তবুও চেষ্টা কর দেখেছে, কিন্তু একসময় নিজেই হতাশ হয়ে পড়েছে।
বাড়িটা সারাক্ষণ নির্জিব হয়ে থাকে। বাবা শুধু মাঝেমধ্যে উৎফুল্ল হয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন, তেমন জমে না। এক অর্থে এই বাড়ির প্রাণ ছিল মিফতা। সেই চলে গেছে। সেজন্য সবার মন খারাপ।
ইফতিদের ঘরে দুটো হতাশ মানুষ নিঃশব্দে পড়ে থাকে নিজের মতো, যারা সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়তে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছে। ইফতি দিন দিন আরও যেন নিজের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। তাকে দেখলে মনে হয় সে মাঝ সমূদ্রে ডুবন্ত মানুষের মতো খাবি খেয়ে যাচ্ছে। তল পাচ্ছে না৷ সে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, “তোমার সবচেয়ে বড় সমস্যা কী ইফতি? দ্বিধা?” নিজের প্রশ্নের জবাবে তার বলার কিছু থাকে না।
এক সন্ধ্যায় ইফতি এক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গেল। কিছু হবে কি না জানে না, তবে কাউকে তার ভেতরকার কথাগুলো বলতে পারলে শান্তি লাগবে এই ভাবনাই তাকে টেনে নিয়ে গেল। সে ভেবেছিল সাইকিয়াট্রিস্ট হবে কোনো টাকমাথা ভদ্রলোক৷ কিন্তু অবাক হয়ে দেখল সুন্দর দেখতে এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন। নামটা আরেকবার চট করে দেখে নিল সে “নিঝুম আরেফিন”।
সে একটু ইতস্তত করেই মহিলার সামনে বসল। ডাক্তার বললেন, ” আপনি আমাকে পুরুষ ভেবেছিলেন?”
ইফতি অবাক হয়ে বলল, “বুঝলেন কী করে?”
“এতটুকু বুঝতে না পারলে আর কিসের মানসিক ডাক্তার হলাম বলুন! যাকগে, আপনার সমস্যা খুলে বলুন। আমি মেয়ে বলে দ্বিধা করার বা অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। আমি খুব ভালো ডাক্তার।” বলে মহিলা হাসলেন৷ ইফতির ভালো লাগল তার আন্তরিক কথার ধরণ।
সে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই খুলে বলল। নিঝুম আরেফিন মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। ইফতির কথা শেষ হলে বললেন, “আপনি এখন কী চাচ্ছেন সেটা পরিষ্কার করে বলতে পারেন?”
“আমি আমার নতুন জীবনটা নিয়েই সুখী হতে চাই।”
“মানে আপনার বর্তমান ওয়াইফের সাথে তাই তো?”
“জি।”
“আপনি শিওর?”
“জি।”
নিঝুম আরেফিন হাত গুটিয়ে মুচকি হেসে বললেন, “তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন?”
“এইযে মানসিক টানাপোড়েন যাচ্ছে এটাই আর নিতে পারছি না৷ আমি মুভ অন করতে চাই খুব ভালোভাবে। এমনভাবে যেন অতীতের কোনো ছায়া নতুন জীবনে না পড়ে।”
“দেখুন, আপনার অতীতের ছায়া নতুন জীবনে ইতিমধ্যেই পড়ে গেছে৷ আর দাগটা পেন্সিলের নয় যে রাবার দিয়ে ঘষে তুলে ফেলবেগ। দাগটা অনেক গভীর। কিন্তু তাই বলে কি বাঁচা বন্ধ করে দেবেন? তাও না। আপনাকে এটার সাথেই মানিয়ে নিয়ে নতুন জীবনটা সাজাতে হবে।”
“সেটাই তো পারছি না।”
“পারবেন। একটু সময় লাগলেও পারবেন। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, আপনার স্ত্রীকে বিয়ে করার পর আপমার মা মেনে নিয়েছেন?”
“আমার সাথে এখনো কিছুটা রেগে আছেন, তবে ওকে মেনে নিয়েছেন।”
“তাহলে আপনি একটু সাহস করে তুবাকে বিয়ে করলেন না কেন? আপনার মাকে তো আপনার ভালোই চেনার কথা। আপনার স্ত্রীকে তিনি যেভাবে মেনে নিয়েছেন, কিংবা আপনার ছোটো ভাইয়ের বউকে মেনে নিয়েছেন, সেভাবে আপনি তুবাকে বিয়ে করলেও তো মেনে নিতেন। আর যদি এতই কঠোর হয়ে থাকেন তাহলে এক রাতের পরিচয়ে মায়ের সব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আপনি একটা অপরচিতা মেয়েকে বিয়ে করলেন তখন আপনার মনে হলো না মা কষ্ট পাবে? আপনার এই ব্যাপারটা আমার কাছে ক্লিয়ার হলো না।”
ইফতি চুপ করে বসে রইল। একসময় বলল, “এই কথাটা আমি কাউকে বলিনি৷ না প্রিয়তীকে, না তুবাকে। তাই ওটা আড়ালে রেখেই আমি আপনাকে বাকি ঘটনাটা বলেছিলাম।”
“এখন বলুন। আমাকে সব না বললে আমি কোনো সঠিক পরামর্শ দিতে পারব কী?”
“তুবার মা একসময় আমার সাথে তুবার বিয়ের কথা বলেছিলেন। মাও নিমরাজি ছিলেন। এর মাঝে কীসব ঝামেলা হয় তাদের মধ্যে, পারিবারিক ব্যাপার, তেমন গুরুতর কিছু না, কিন্তু কথা অনেক হয়েছিল। ওই ঝামেলার জন্য আমাদের বিয়ের কথাটাও আর এগুতে পারেনি। উল্টে আমার মা তুবার মাকে কথা শুনিয়ে আসে, আমার জন্য তার মেয়েকে মরে গেলেও নেবেন না। এসব আমরা ছেলেমেয়েরা জানতাম না৷ বড়রা তাদের ঝগড়া নিজেদের মধ্যেই রেখেছিলেন৷ কিন্তু আমি যখন মাকে আমার প্রেমের কথা জানাই, তুবার কথা জানাই তখন তিনি বেঁকে বসেন। আমাকে কসম দিয়ে বলেন, তুবাকে বিয়ে করলে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। কোনোভাবেই তুবাকে আমার বউ হিসেবে মেনে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব না। কথাটা কাউকে বলিনি, কারন মাকে কারো সামনে ছোটো করতে চাইনি।”
“তাহলে আপনার ছোটো ভাইয়ের ক্ষেত্রে মেনে নিলেন যে?”
“মায়ের আমার সাথে তুবাকে বিয়ে দেয়া নিয়ে ঝামেলা ছিল। বিয়ে তো করেছে মিফতা। মা সেটাও মানতে চাননি। কিন্তু আত্মীয়স্বজন অনেক বোঝানোতে বলা যায় বাধ্য হয়েছেন।”
“ব্যাপারটা জটিল হয়েছে শুধু।”
“একটু বেশিই জটিল হয়েছে।”
“ঠিক আছে, সেনসিটিভ পারিবারিক ইস্যু বাদ দেয়া যাক। বর্তমানে ফিরি। আপনার ভাষ্যমতে, আপনি যখন প্রথম প্রিয়তীকে বিয়ে করে এনেছিলেন তখন আপনি অতীত ঝেড়ে ফেলে ওকেই কাছে টেনে নিয়েছিলেন তাই না?”
“জি। চেষ্টা করছিলাম।”
“তারপর কোন ঘটনাটা আপনার অতীতকে নাড়া দিয়ে যায়?”
“তুবার অসুস্থতা।”
“তার আগ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল?”
“জি।”
“বেশ! এবার বলুন এইযে এক দেখায় এক রাতের পরিচয়ে একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিলেন এর কারণ কী? শুধুই কি সিম্প্যাথি? আমার কিন্তু মনে হয় না। আমরা প্রতিদিন এমন অজস্র মানুষের সাথে মিলিত হই যাদের সাহায্য প্রয়োজন। কয়জনকে সাহায্য করি? আর বিয়ে ব্যাপারটা তো আরও অনেক গভীর একটা অনুভবের ব্যাপার, সারা জীবনের ব্যাপার। আপনি একটু ভেবে বলুন তো প্রিয়তীর কোন ব্যাপারটা আপনার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল?”
ইফতিকে তেমন একটা ভাবতে হলো না৷ সে বলল, “মেয়েটাকেই ভালো লেগেছিল। স্পেসিফিক কোনো কারন হয়তো বলতে পারব না সেভাবে। হয় না এমন, কিছু মানুষকে এমনিতেই খুব ভালো লেগে যায়। তার কথা, হাসি, ব্যবহার সব মিলিয়েই হয়তো ভালো লেগেছে। তবে বিয়ের পর আবিষ্কার করেছি মেয়েটা ভীষণ ভালো।”
নিঝুম আরেফিন হাসলেন। একটু চুপ থেকে বললেন, “আপনি মেয়েটাকে খুব পছন্দ করেন। আগের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার প্রবল ইচ্ছেও আপনার আছে। কিন্তু পারছেন না তাই তো?”
“ঠিক তাই।”
“আপনি কি ভেবেছেন, তুবাও ঠিক আপনার পরিস্থিতিটাই ফেইস করে এসেছে এতদিন?”
“তা তো করারই কথা।”
“তার বিয়ে আপনার থেকেও আগে হয়েছে। আমাদের উপমহাদেশের বেশিরভাগ মেয়েই বিয়েটাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে। আপনার ভাইকে বিয়ে করার পরেই সে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। সেই সাথে সে আপনাকেও ভালোবাসত। দীর্ঘদিনের সম্পর্ক আর গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাঝে যে ঝামেলাটা চলছিল তাতে সে নিজেই খুব ভুগেছে। আর এসবের মধ্যে আপনার প্রতি ভুল ধারণা তাকে অসুস্থ করে তুলেছে। কিন্তু খেয়াল করেছেন কি, যে মুহূর্তে সে সরে যাবার সুযোগ পেল, সে কিন্তু তৎক্ষণাৎ সরে গিয়েছে। এমনকি আপনি যাতে তার জীবনে আবার কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন সেজন্য আপনাকে কিছু কথা বলে গেছে। আদতে সে আপনার আড়ালে নিজেকেই বুঝিয়েছে। আপনারা দুজনেই আগের সম্পর্কের ছায়া থেকে বের হয়ে যেতে চান। আপনার প্রাক্তন পেরেছে, আপনি কেন পারবেন না? অবশ্যই পারবেন৷ এসব ঝামেলার মাঝে আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এমনিতেই ছোটোখাটো ভুল বোঝাবুঝি সম্পর্ককে নষ্ট করে দিতে পারে। আর এই ঘটনাটা ছোটো কিছু না৷ আপনার উচিত তাকে বেশি করে সময় দেয়া।”
“সে আমার ওপর হতাশ।”
“আপনি আগের কথা তুলবেন না। অন্যসব বিষয়ে কথা বলবেন। তাকে হাসাবার, ভালো রাখার চেষ্টা করুন। ছোটোখাটো উপহার, সারপ্রাইজ দেয়ার চেষ্টা করুন। দূরে সরে যেতে চাইলেও আটকে রাখুন। আচ্ছা, আপনারা তো হানিমুনে যাননি তাই না?”
“না।”
“তাহলে এই সুযোগে চলে যান। দুজন সুন্দর কোথাও নিজেদের মতো বেড়িয়ে এলে দেখবেন সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”
“ঠিক আছে। তাই করব।”
“আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“ম্যাম, আরেকটা কথা…”
“বলুন।”
“আমি যখন আগের সম্পর্কটা নিয়ে ভাবি, তখন সেখানেই হারিয়ে যাই। আমার নিজের কাছেই নিজেকে খুব ছোটো মনে হয় তখন। কিন্তু এটা থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় আমার জানা নেই।”
“দেখুন, এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিছু স্মৃতি থেকেই যাবে। কিন্তু আপনি যেহেতু সেটা ভুলতে চাচ্ছেন তাই নিজেকে ভাববার সুযোগ দেবেন না তেমন। ওয়াইফের সাথে যত বেশি অ্যাটাচ হবেন, এই ব্যাপারটা তত দ্রুত কেটে যাবে।”
ইফতি বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “অনেক ধন্যবাদ ম্যাম। সম্ভবত আমি আমার সমস্যা এখন সমাধান করতে পারব।”
“উইশ ইউ গুড লাক!”
___________________________________
প্রিয়তী দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘরে ঢুকেই ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। জামাকাপড় সব নেবে নাকি কিছুই নেবে না এটাই বুঝতে পারছে না৷ সে তো এসেছিল শূন্য হাতে। সেভাবেই যাবে? আবার কি ফেরা হবে?
মাকে বলেছে সে চলে যাবে। একেবারে যাবে সেটা অবশ্য বলেনি। আর ইফতিকে কিছুই বলা হয়নি৷ তার জন্য কি একটা চিঠি রেখে যাওয়া উচিত? প্রিয়তী বুঝতে পারছে না কী করবে। বার বার পা আটকে যাচ্ছে তার। শরীরটা প্রচন্ড ভারি মনে হচ্ছে। সে এই সংসারের মায়ায় পড়ে গেছে। মায়া কাটিয়ে যাওয়াটা এত সহজ নয়। মা-বাবাকে সে ভালোবাসে। ভালোবাসে একান্ত আপন মানুষটিকেও। এখন তো তুবাও চলে গেছে। তাহলে তার থাকতে বাঁধা কোথায়?
কিন্তু একটা জিনিসই তাকে অসহ্য করে তুলছে! ইফতি তাকে ভালোবাসে না৷ সে এমন একটা মানুষের সাথে সারাজীবন কী করে থাকবে যে তার ভাইয়ের বউয়ের জন্য মনের মধ্যে ভালোবাসা জিইয়ে রেখেছে। এই কথাটা মাথায় আসতেই গা গুলিয়ে আসে প্রিয়তীর। সে বসা থেকে উঠে বসে জামাকাপড় বের করতে শুরু করে আলমারি থেকে। সব নিয়েই যাবে সে। রেখে গেলে দেখা যাবে ইফতি দু’বার অনুরোধ করলেই সুরসুর করে ফিরে আসবে সে। নিজেকে ভালো করেই চেনা আছে প্রিয়তীর। কেন যে আল্লাহ এত নরম একটা মন দিয়ে তাকে পাঠিয়েছেন!
ব্যাগ অর্ধেক গোছানো হতেই কলিংবেলের শব্দ শোনা গেল। কে এলো আবার এই অসময়ে?
প্রিয়তী দরজা খুলে দেখল ইফতি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কয়েকটা শপিং ব্যাগ। প্রিয়তী মনে মনে ভাবল, গেল তার যাওয়া! এই লোক তাকে যেতে দবে তো? ক’দিন ধরে খুব বাড়াবাড়ি রকমের আদিখ্যেতা করছে। যেন ভালোবাসা উপচে পড়ছে!
ইফতি প্রিয়তীর বিরক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঢুকতে দেবে না নাকি?”
“এখন এলে যে?”
“এলে তোমার কী সমস্যা?”
প্রিয়তী আর কিছু না বলে সরে গেল। ইফতি গুনগুন করতে করতে ভেতরে চলে গেল। খানিকটা শুনতে পেল প্রিয়তী। “এখানে দু’জনে নির্জনে..সাজাবো প্রেমের পৃথিবী…”
মনে এত রঙ কেন লেগেছে কে জানে!
ইফতির ডাকে ঘরে ঢুকল প্রিয়তী। ইফতির চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে ভীষণ অবাক হয়ে গেছে। চোখ বড় বড় করে বলছে, “প্রিয়তী! তুমি থট রিডিং জানো?”
“না। কার থট রিড করলাম আবার?”
“তাহলে তুমি জানলে কী করে আমরা বেড়াতে যাচ্ছি? আগেই যে ব্যাগ গুছিয়ে ফেলছ? আমি মাত্র টিকিট কেটে নিয়ে এলাম। আগে থেকে জানার কোনো সুযোগই ছিল না।”
প্রিয়তীও অবাক হলো। তবে প্রচন্ড বিরক্তির ভাব নিয়ে বলল, “মানে কী? আমি কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি না। বাড়িতে যাচ্ছি।”
“কোন বাড়িতে?”
“নিজের বাড়ি থাকলে সেখানেই যেতাম। বাবার বাড়ি যাচ্ছি।”
“ওহ আচ্ছা!” ইফতি এমন একটা ভাব ধরল যেন কথাটা তার গায়েই লাগল না। সে শপিং ব্যাগগুলো বিছানায় ফেলে রেখে গোসলে ঢুলে গেল।
প্রিয়তী একটা ব্যাগ খুলেই লজ্জা পেয়ে গেল। লাল রঙের একটা নাইটি। একেবারই স্বচ্ছ, তবে ভীষণ সুন্দর। দেখলেই লোভ হয় পরার। সে ঢোক গিলে সেটা ব্যাগেই ঢুকিয়ে ফেলল। দ্বিতীয় ব্যাগে পাওয়া গেল শাড়ি। আরেকটাতে শাড়ির রঙের সাথে মিলিয়ে পাঞ্জাবি আর শেষ ব্যাগে অনেকগুলো চুড়ি, কিছু চমৎকার গহনা, যেগুলো একসময় প্রিয়তী একটা ফেসবুক পেজে দাম জিজ্ঞেস করে আর কেনেনি। গহনাগুলো শাড়ির সাথে ম্যাচিং হবে দারুণ!
সেগুলো দেখতে দেখতে প্রিয়তী খেয়ালই করেনি ইফতি বেরিয়ে গেছে। ইফতি যখন জিজ্ঞেস করল, “পছন্দ হয়েছে?” তখন চমকে প্রায় লাফিয়ে উঠল প্রিয়তী। চোর ধরা পড়ার মতো চোখ লুকিয়ে মুখের ভাব পরিবর্তন করে ফেলার চেষ্টা করল।
আবারও নিজের ব্যাগ গোছাতে লেগে গেল সে।
ইফতি বারান্দায় তোয়ালে মেলে দিয়ে এসে বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকল, “প্রিয়! শোনো না..”
প্রিয়তী কেঁপে উঠল। প্রথমবার ইফতি তাকে প্রিয় বলে ডাকল। সে কাঁপা গলায় অন্যদিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
ইফতি প্রিয়তীর কাছে এসে ওর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “আমি জানি তোমার মনে অনেক কষ্ট। তোমাকে বিয়ে করে এনে আমি সুখে রাখতে পারিনি। কিন্তু আমি কি শেষ সুযোগটা পাব? শুধু পাঁচটা দিন আমাকে দেবে? দূরে ঘুরতে যাব আমরা৷ শুধু তুমি আর আমি। ঘুরে আসার পরও যদি তোমার হতাশা না কাটে তাহলে নাহয় ছেড়ে চলে যেও।”
প্রিয়তীর চোখে পানি চলে এলো। সে হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারল না। ইফতি ওভাবেই বসে রইল৷ প্রিয়তী হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। ইফতি বলল, “জবাব না পেলে ছাড়ছি না।”
প্রিয়তী চোখের পানি আটকে রাখতে পারল না৷ কেঁদে ফেলে বলল, “কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
ইফতি হেসে প্রিয়তীর হাতে চুমু খেয়ে বলল, “কক্সবাজার থাকব একদিন একরাত, তারপর সেন্টমার্টিন দু’দিন।”
“সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ।”
“আগে বলোনি কেন?”
“সারপ্রাইজ দেব বলে।”
“কবে রওনা হব?”
“আজ রাতেই।”
“বলো কী!”
“জি ম্যাডাম!”
“হাত ছাড়ো! এখন তো ডাবল গোছগাছ করতে হবে।”
“গোছানোর মানুষও তো এখন দুজন!”
প্রিয়তী এবার আলমারি খুলে ইফতির জামাকাপড় বের করতে শুরু করল। একটু আগের জড়তা হারিয়ে গেছে। ইফতির কাছে হেরে গেছে সে। কিন্তু জেতার আনন্দ হচ্ছে।”
________________________________
সেন্টামর্টিনের নীল জলরাশির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেও যেন চোখের আশ মেটে না। প্রিয়তী দু’ঘন্টা ধরে একই জায়গায় বসে আছে। ইফতি তাকে টেনেটুনে তুলে বলল, “আসো একটু হাঁটি।”
পরষ্পরের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়তী আনমনে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি এখনো তুবাকে ভালোবাসো?”
ইফতি জবাব দিল, “নাহ। জানো প্রিয়, তুবার কাছে আমি গিয়েছিলাম হাওয়ার মতো। ওকে একবার ছুঁয়ে চলে এসেছি। ওর ঘ্রাণ মিশে ছিল আমার মধ্যে অনেকটা সময়। এখন আর নেই। কিন্তু তোমার কাছে আমি এসেছি স্রোতের মতো। বারবার আসতেই থাকব, ফিরিয়ে দেবার সুযোগ পাবে না। হা হা হা।”
প্রিয়তীর বুকটা হালকা হয়ে গেল। আকাশের দিকে চাইল সে। সাদা একটা গাঙচিল গাঢ় নীল আকাশে মনের সুখে উড়ে বেড়াচ্ছে। ঠিক প্রিয়তীর মনের মতোই মুক্ত, আনন্দে পরিপূর্ণ সে।
(সমাপ্ত)
সুমাইয়া আমান নিতু