#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
২১.
সকালে কলটা কেটে যাবার পর থেকে তুবা ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে মিফতার সাথে কথা বলবার। কিন্তু প্রতিবারই যান্ত্রিক কন্ঠের অপারেটর জানিয়ে দিচ্ছে, নাম্বারটা আনরিচএবল! এই ‘Unreachable’ শব্দটাই কেমন একটা ভীতি ধরিয়ে দিচ্ছে তুবার মনে। কোথায় মিফতা? কী হয়েছে ওর? ফোন কেন বন্ধ করে রাখবে একটা মানুষ?
তুবা শাশুড়ী মায়ের নাম্বারেও বার কয়েক ফোন করল। ফোনটা বাজে, কেউ তোলে না। তুবার অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলল।
আচ্ছা ইফতিকে কি একটা ফোন করা চলে? কাজটা উচিত হবে? নাকি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে? সে তো আর গল্প করতে ফোন করছে না, করছে নিজের স্বামীর খবর নিতে।
কাঁপা হাতে সে ডায়াল করল ইফতির নাম্বারে।
ইফতি একটা ফাইলের ভেতর ডুবে ছিল। কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছিল না। এই একটা জিনিস নিয়ে সে প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে বসে আছে। বসের ঝাড়ি আর বেশি দূরে নেই…
ফোনের শব্দটা এত বিরক্তিকর লাগল এ সময়ে যে কে কল করেছে তা না দেখেই হাত বাড়িয়ে ফোনটা বন্ধ করে দিল ইফতি। আবারও ডুবে গেল কাজে।
কল কেটে যাওয়ার সাথে সাথে তুবার মনে হলো ইফতি ওর গালে সজোরে একটা চ*ড় মা*রল। বুঝিয়ে দিল, ওকে ফোন করার কোনো অধিকার তুবার নেই।
তুবা অপমানে, বিরক্তিতে ফোনটা ফেলে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। চুল খামচে ধরল নিজের। মাথাটা ঘুরছে তার। কপালের শিরা দপদপ করছে। ইফতির কথা বাদ থাক, মিফতার কী হলো?
______________________________
প্রিয়তী সবকিছু আস্তেধীরে গোছগাছ করে ফেলল। ঘরটা নিজের মতো করে সাজাবার যে ইচ্ছেটা ছিল সেটা মরে গেছে। সে শুধু ধুলোময়লা সাফ করে যা যেমন ছিল তেমনি রেখে দিল।
কাজ শেষে দেখল মা রান্নাবান্না অনেকটা গুছিয়ে এনেছেন। ওকে দেখে মা বললেন, “অ্যাই! তোমার কি ডাস্ট অ্যালার্জি আছে নাকি?”
“না তো মা।”
“তাহলে চোখমুখ এত ফুলেছে কেন? সর্দি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। যাও গোসল করে ফেল দ্রুত। সকালের খাবারটাও খাওনি৷ এগারোটা বাজে। যাও যাও তাড়াতাড়ি!”
প্রিয়তী বিনা বাক্যব্যয়ে চলল ঘরের দিকে। জামাকাপড় বের করতে করতে মনে হলো, এখানে সে আর থাকবে না। চলে যাবে নিজের বাড়িতে। মা বাবা মে*রে কে*টে ফেললে ফেলবে। সেও ভালো। অন্তত এই বাড়ির পরিবেশের থেকে ভালো।
__________________________________
বিকেলের দিকে কলিংবেল বাজল। শ্বশুর শাশুড়ী দুজনেই ভাতঘুম দিয়েছেন। প্রিয়তী একা জেগে। এ সময়ে এই বাড়িতে কেউ আসবার নেই। কে এলো তবে?
প্রিয়তী পিপহোলে চোখ রাখল। তুবা এসেছে! এত তাড়াতাড়ি চলেও এলো! তাও আবার একা এসেছে।তুবাকে দেখে প্রিয়তীর অসম্ভব গা জ্বালা করতে শুরু করল যেটা আগে কখনো করেনি।
সে দরজা খুলে শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছো তুবা?”
তুবা যেন প্রশ্নটা শোনেইনি এমন ভান করে পাল্টা প্রশ্ন করল, “মিফতা বাসায়?”
“না তো।”
“কোথায়?”
“সকালেই অফিসের জন্য বেরিয়ে গেছে।”
“ওর ফোন কি বন্ধ?”
“তা তো জানি না। ফোন করে দেখি৷ তুমি ভেতরে আসো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
তুবা ঢুকে ডাইনিংয়ে একটা চেয়ার টেনে বসল। প্রিয়তী তার ঘরে গিয়ে মোবাইল এনে মিফতার মোবাইলে কল করল। কলটা ঢুকল। মিফতা ফোন ধরে বলল, “হ্যাঁ ভাবি।”
“এইযে তুবা কথা বলবে।”
“তুবা? তুমি তুবাকে পেলে কোথায়?”
প্রশ্নটা প্রিয়তী শুনতে পেল না। সে তুবার দিকে ফোন বাড়িয়ে দিয়েছে। তুবা ফোন ধরেই রাগে ফেটে পড়ল। “তুমি কি আমার নাম্বার ব্লক করে দিয়েছ মিফতা?”
“না তো, ব্লক করব কেন?”
“তাহলে আমি তোমাকে ফোনে পাচ্ছি না কেন? শুধু আমার না, আমার মা, বোন সবার নাম্বার তুমি ব্লক করেছ। আর এদিকে ভাবির মোবাইল থেকে ঠিকই কল করা যাচ্ছে।”
“আশ্চর্য তো! না জেনে উল্টোপাল্টা বকছ কেন?”
“আমি ঠিকই বলছি। তোমার জন্য আমি পাগল হয়ে এই বাসায় চলে এসেছি। সারাটাদিন কত টেনশনে ছিলাম! আমি যদি জানতাম তুমি এরকম করে রেখেছ তাহলে জীবনেও আসতাম না৷ আর আসবোও না। এখন চলে যাব আমি।”
তুবা বেশিক্ষণ কথাই বলতে পারল না৷ ফোঁপাতে লাগল। প্রিয়তী তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে মিফতাকে বলল, “কী হয়েছে বলোতো।”
“আরে ভাবি বোঝাও তো পাগলটাকে। আমার মোবাইলে সারাদিন চার্জ ছিল না৷ চার্জারও ফেলে এসেছি। এইমাত্র এক কলিগের পাওয়ার ব্যাংক দিয়ে চার্জ দিয়ে ফোন অন করলাম।”
“বুঝেছি।”
প্রিয়তী তুবার কাঁধে হাত রেখে বলল, “শান্ত হও। সব না জেনেই এত অল্পতে মাথা গরম করো কেন তুমি?”
“সবাই আমার সাথে বেঈমানী করে। আমি কার কী করেছি?”
তুবা যেভাবে কথা বলছে তাতে যে কোনো সময় মা বাবা উঠে চলে আসতে পারে। প্রিয়তী ভয় পেয়ে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল।
তুবা এখন কাঁদছে। প্রিয়তীর একটু আগেও তুবার ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল, কিন্তু এখন মায়া লাগছে। বাচ্চা একটা মেয়ে ব্যকূল হয়ে কাঁদছে। জীবনের টানাপোড়েনে সে মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। তার প্রভাবে শরীরও অসুস্থ হয়েছে। চেহারা ভেঙে গেছে। চোখের নিচে গাঢ় কালি।
প্রিয়তী তার পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বলল, “তুবা, শান্ত হও।”
তুবা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “সবাই ধোঁকা দিয়েছে আমাকে।”
“কেউ ধোঁকা দেয়নি।”
তুবা বাঁকা হেসে বলল, “তুমি কি জানো তোমাকেও ধোঁকা দেয়া হয়েছে? এই পুরুষ জাতটাই খারাপ। জঘন্য। ধোঁকাবাজ।”
প্রিয়তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল।
তুবা বলল, “তুমি ভাবছ কত সুখে আছ তাই না? তুমি যাকে বিয়ে করেছ সে একটা আস্ত ফ্রড। এক নম্বরের জোচ্চর। তোমার সাথে প্রেম করেছে, সেই সাথে আমার সাথেও। তোমাকে বিয়ে করবে বলে আমাকে করেনি। আর অযুহাত দিয়েছে মা মানবে না।”
প্রিয়তীকে ভাবলেশহীন মুখে বসে থাকত দেখে তুবা আবারও গরম হয়ে বলল, “তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না তাই না? আমার কাছে অজস্র প্রমান আছে, দেখবে?”
প্রিয়তী শান্ত মুখে বলল, “আমি জানি সব।”
“জানো? তবুও মেনে নিয়েছ? ক্ষমা করে দিয়েছ ওকে?”
“তুবা, আমার কথা শোনো। তুমি অনেক কিছুই জানো না। ভুল বুঝছ।”
“কী ভুল বুঝছি আমি?”
“বলছি।”
প্রিয়তী এক গ্লাস পানি এনে দিল তুবাকে। তুবা পানিটা গিলে নিল ঢকঢক করে। তারপর চোখ নাক মুছে বলল, “বলো।”
প্রিয়তী তাকে তার বিয়ে থেকে শুরু করে সব কাহিনীই খুলে বলল। কিছুই বাদ দিল না৷ এমনকি আজকের সেই ব্যাগটার কথাও বলল।
তুবা বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে সে এতদিন ইফতিকে ভুল বুঝে এসেছে! সত্যিটা জানতে পেরে সে খুশি হবে নাকি দুঃখিত হবে তাও বুঝতে পারছিল না।
প্রিয়তী শেষে বলল, “তুমি অনেক অল্পতেই রেগে যাও তুবা। মাথা গরম করে উল্টোপাল্টা কাজ করে বসো। এই যে মিফতাকে বিয়ে করলে, প্রতিশোধ তো নিলে ইফতির ওপর। কিন্তু নিজেও যে জাহান্নামে জ্বলছ তার কী হবে? সাথে মিফতাকেও কষ্ট দিচ্ছ। যেখানে ওর কোনো দোষই নেই।” নিজের কথাটা বলতে গিয়েও বলল না সে।
অনেকটা সময় চুপ করে থেকে তুবা বলল, “আমি একটু ব্যাগটা দেখতে পারি?”
প্রিয়তী ব্যাগটা বের করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। চা বসাল রান্নাঘরে গিয়ে। বাবা উঠেই চা না পেলে উসখুস করতে শুরু করবেন।
চায়ের পানি ফোটার সাথে সাথে যে বুদবুদ উঠছে, প্রিয়তীর মনেও সেরকম বুদবুদ খেলে যাচ্ছে। বাষ্পে ছেয়ে যাছে চোখ। বুকে অদ্ভূত রকমের যন্ত্রণা হচ্ছে। মাথাটাও অল্প অল্প ঘুরছে।
সে রান্নাঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল শক্ত হয়ে। তুবা কী করছে? কাঁদছে? অ্যালবামটা বুকে জড়িয়ে কাঁদছে কি?
প্রিয়তী হঠাৎ শব্দ পেল বাসার মেইন গেট খুলে গেছে সশব্দে। কেউ বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা ধাম করে লাগিয়ে দিয়েছে। ছুটে বের হলো সে। দেখল তুবা নেই। তার মানে বেরিয়ে গেছে। কী হলো হঠাৎ করে সে ঠিক করে বুঝতে পারল না। মেয়েটা এরকম ঝড়ের মতো চলে গেল কেন?
বিছানার ওপর তখন সবকিছু ছড়ানো। প্রিয়তী আবার ওগুলো ব্যাগে তুলল। তারপর কী মনে করে আর বাক্সে ঢোকাল না। খাটের নিচে ঠেলে দিল।
________________________________
তুবা দাঁড়িয়ে আছে ইফতির অফিসের সামনে। এখানে সে আগেও একবার এসেছে, ইফতির জন্মদিনের দিন সারপ্রাইজ দিতে। তবে সন্দেহ নেই, সেদিনের থেকে ইফতি আজ আরও অনেক বেশি সারপ্রাইজড হবে।
অফিস ছুটি হয়ে গেছে। অনেকেই বের হচ্ছে। তুবা চোখ মুছে নিজেকে তৈরি করল।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
২২.
ইফতি যখন তুবাকে দেখতে পেল তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তুবা হঠাৎ তার সামনে উপস্থিত হয়েছে৷ ভূত দেখার মতোই চমকেছে ইফতি। তুবার উপস্থিতি যতটা না অবাক করেছে তাকে, তারচেয়ে বেশি হতবাক করেছে তুবার অভিব্যক্তি। যে মেয়েটার চোখে তার সাথে বিচ্ছেদের পরদিন থেকে ঘৃণা ঝরে পড়ত, সেই চোখ বদলে গিয়েছে। তাতে জমা হয়েছে জিজ্ঞাসা, করুণা, আর অদ্ভূত এক আবেগের মিশ্রণ। ইফতি কিছু জিজ্ঞেস করবে সেই ক্ষমতাও যেন হারিয়েছে।
তুবা এতক্ষণ ইফতির চোখে চোখ রেখে তাকিয়েছিল। এবার মাথা নিচু করে বলল, “আপনার সাথে কথা আছে। কোথাও বসা যাবে?”
কাছাকাছি একটা পার্কে গিয়ে বসল দুজন। ইফতি এখনো একটা কথাও বলেনি৷ সে বুঝতেই পারছে না ঘটনা কী ঘটছে। সকালে তুবার ফোন কেটে দেবার অনেকক্ষণ পর সে দেখেছে তুবা কল করেছিল। ভীষণ অবাক হয়েছিল, তবে কলব্যাক করার ইচ্ছে হয়নি। বরং সে মিফতাকে কল করেছিল। তাকে পায়নি।
তুবা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর গলা খাকারি দিয়ে বলল, “আমি অতীতের কথা তুলতে চাই না। তুলতে ইচ্ছেও করে না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে আপনার সাথে কিছুটা বোঝাপড়া হয়ে যাওয়া ভালো। যেহেতু আপনার সাথে বর্তমান সম্পর্কটা কখনোই ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে পারব না, তাই মানিয়ে নেবার চেষ্টা করতে চাইছি বলতে পারেন।”
“কী বলবে পরিষ্কার করে বলো।”
তুবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি আপনাকে অনেকবারই ভুল বুঝেছি। যতবার ভুল বুঝেছি ততবারই নিজের ক্ষতি করেছি।
প্রথম ভুলটা আমি করি মিফতাকে বিয়ে করে। আমি তখন ভেবে নিয়েছিলাম আপনি ফ্রড। আমার সাথে টাইম পাস করে এখন মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে চান। আপনি চাইলেই মাকে রাজি করাতে পারতেন৷ কিন্তু আপনার সেই জোরটা ছিল না৷ এদিকে মিফতা তখন আমার জন্য পাগল হয়ে আছে। আমি তাকে বলে দিতে চেয়েছিলাম আপনার আমার সম্পর্কের কথা। কিন্তু তার মধ্যে এসব ঝামেলা বাঁধে, আর সেও আমাকে সেই সময়েই বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তার প্রস্তাবে রাজি হওয়াটা স্বেচ্ছামৃত্যুর সমান ছিল।
কিন্তু আপনি জানেন, আপনার জন্য আমি মরতেও পারতাম।” এই পর্যন্ত বলে থেমে গেল তুবা৷ তার গলায় কান্না আটকে রইল। পুরো শরীরে একবার আবেগের স্রোত বয়ে গেল মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে।
ইফতির চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। আবেগের এক আস্ত সমূদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে সে নিজেও। আবেগ সামলানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বড় বড় করে কয়েবার নিঃশ্বাস নিয়ে তুবা নিজেকে সামলে আবার বলে চলল, “মিফতাকে বিয়েটা ঝোঁকের বশে করলেও আমার মাথায় দুটো জিনিস কাজ করছিল, এক. আপনার আশেপাশে থেকে প্রতিশোধ নেয়া, দুই. আপনার না হয়েও আপনার কাছাকাছি থাকার ইচ্ছে। মিশন ছিল, নিজে জ্বলব, আপনাকেও জ্বালাব।
কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি বাস্তবতাটা কত কঠিন। দিন দিন টের পাচ্ছিলাম। জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিলাম নিজেই। জানি না কতটা আপনাকে জ্বালাতে পেরেছি।
এসবের মধ্যে আপনি একদিন বিয়ে করে নিয়ে এলেন। মায়ের কাছে মিথ্যে বলেছিলেন আপনি যে, ভাবি আপনার প্রেমিকা ছিল। আমি ভেবেছিলাম সেটা সত্যি। এই একটা ব্যাপার আমাকে ভেঙে দিয়েছিল পুরোপুরি। ভেবেছিলাম আপনি ডাবল টাইমিং করছিলেন।”
ইফতি এতক্ষণে একটা কথা বলতে পারল, “এসব কোথা থেকে পরিষ্কার হলো তোমার কাছে?”
“আমার দেয়া উপহারগুলো যে ব্যাগে রেখেছিলেন সেটা ভাবি পেয়েছে। আমাকে দেখিয়েছে।”
ইফতির চোয়াল ঝুলে পড়ল৷ ওটা সে তালাবদ্ধ করে রেখেছিল। খুলে বের করেছে! বিরক্তই লাগল প্রিয়তীর ওপর। কিন্তু সেটা স্থায়ী হলো না। তুবার কথা কানে গেল। সে বলছে,
“ভাবি খুবই ভালো মানুষ। ওনাকে আমি সঙ্গত কারণেই পছন্দ করতাম না। কিন্তু আজকে আমাকে তিনি নিজের ছোটো বোনের মতোই সামলেছেন। আমাকে বুঝিয়ে বলেছেন সবকিছু।”
তুবা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ভীষণ আর্দ্র স্বরে হঠাৎ বলে উঠল, “ও তোমাকে ভালো রাখবে ইফতি। খুব ভালো রাখবে।”
ইফতি চমকে তাকাল। এই ভীষণ চেনা গলার স্বরটা হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ তার মুখোমুখি হয়ে ইফতি সহ্য করতে পারল না। দুই হাতে মাথার চুল খামচে ধরল।
তুবা আবার স্বাভাবিক সুরে বলল, “আই অ্যাম স্যরি ভাইয়া। আর কখনো আপনার সাথে আমি আলাদা করে কথা বলতে আসব না। কোনোদিন আপনার ব্যাপারে নাক গলাব না। আমি কথা দিচ্ছি। মিফতা আমাকে ভালোবাসে। আমিও তাকে সুখী রাখার চেষ্টা করব।”
“আজ কেন তাহলে এলে?”
“কথাগুলো পরিষ্কারভাবে বলে রাখা দরকার ছিল৷ ঘৃণা নিয়ে পাশাপাশি বাস করা যায় না। আপনার সাথে আমার একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক হোক। বাস্তবতাটা মেনে নিয়ে যতদূর সম্ভব অতীত ভুলে গিয়ে আমরা ভালো থাকার চেষ্টা করলেই মঙ্গল হবে।”
ইফতি এতক্ষণ তেমন কথাবার্তা বলেনি। এখন মুখ খুলল, “তুবা, তোমার ওপর আমার কোনো রাগ নেই। কখনো ছিলও না। মিফতাকে বিয়ে করার পরও কখনো রাগ হয়নি। শুধু কষ্ট হতো তোমার কষ্টের কথা ভেবে। আমি প্রিয়তীর সাথে ভালো থাকার অনেক চেষ্টা করেছি। তার সাথে আমি ভালো থাকতেও পারি। কিন্তু তুমি সামনে এলে আবার সবকিছু গোলমেলে মনে হয়। অতীতটা জেঁকে ধরে আমাকে।
আমি বাইরে থেকে যেমনই হই না কেন ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত দুর্বল। আর কেউ না জানলেও তুমি এটা ভালো করেই জানো। তোমার আর মায়ের সামনে আমি মানুষটা পুরোপুরি বদলে যাই।
এই অবস্থা থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন আদৌ সম্ভব কি না আমার জানা নেই। যে ক্ষত ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে সেটাকে যতবার খুঁচিয়ে তুলব, ঘা আরও বাড়বে, কমার প্রশ্নই আসে না। আমি জানি না এই সমস্যার আদৌ কোনো সমাধান আছে কি না।”
“ক্ষত না খুঁচিয়ে ঔষধ লাগিয়ে সময় দিলেই শুকাবে। ঔষধ তো আছেই, ভাবি। আর আমিও আর আপনার চোখের সামনে ঘুরঘুর করব না। আমি আর মিফতা চলে যাচ্ছি অন্য কোথাও।”
“মানে?”
তুবা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “যা শুনেছেন তাই। যথাসময়ে সব জানবেন।”
ইফতি একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “মিফতা কি কিছু জেনে গেছে?”
“নাহ। জানবেও না। আমার মনে হয় না আমাদের আর কথা বলার কোনো প্রয়োজন আছে। একসাথে বেশিক্ষণ কাটালে সমস্যা কমার বদলে বাড়বে। আশা করব আপনি এরপর থেকে আমাকে ছোটো ভাইয়ের বউ হিসেবে দেখবেন আর সেরকম আচরণই করবেন। আমিও আপনাকে বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করব।”
ইফতি মাথা ঝাঁকিয়ে একটু হেসে বলল, “অনেকদিন পর তোমার মুখে সেন্সিবল কথা শুনলাম। ভালো লাগল তুবা।”
তুবা পাল্টা হেসে বলল, “আপনি তো জানেনই আমি বয়সের তুলনায় বেশি বুঝি। মাঝে শুধু মনের বিশৃঙ্খলা মস্তিষ্কের ভাবনাগুলো এলোমেলো করে দিয়েছিল। আচ্ছা যাই। মিফতা অপেক্ষা করছে।”
ইফতি সিমেন্টের বেঞ্চিতে হেলান দিল। নিজেকে বড় ভারমুক্ত লাগছে আজ।
———————————
তুবা নিজের বাপের বাড়ির পথ ধরল। মিফতাকে সেখানেই যেতে বলেছে। তুবা যখন ইফতি-প্রিয়তীর ঘরে বসে নিজের উপহার দেয়া জিনিসগুলো আর সেই অ্যালবামটা দেখছিল, সে সহ্য করতে পারছিল না। ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছিল। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। এক পর্যায়ে থাকতে না পেরে সে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকেই। দৌড়ে নিচে নেমে গেটের কাছে বসে কেঁদে ফেলেছিল।
সে সময়ে মিফতা তার মোবাইলে অবরত ফোন করে যাচ্ছে। ফোনটা বন্ধ করে দিতে গিয়েও কী মনে করে যেন সে ধরল। গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “হ্যালো।”
মিফতা খানিকটা অপরাধীর গলায় বলল, “তুবা, সোনা, আই অ্যাম স্যরি। তুমি আমাকে বলতে দাও কী হয়েছে?”
“বলো।”
“আসলে….” ইতস্তত করতে করতে মিফতা বলল, “আমার বদলি হয়ে গেছে রাঙামাটিতে।”
“কিহ?”
“হ্যাঁ। গতদিন লেটার পেয়েছি। তারপর থেকেই মাথায় আর কিছু ঢুকছে না৷ অতদূরে গিয়ে কী করব আমি? তোমাকে নিয়ে যেতে পারব কি না জানি না, রেখে গেলে আমি টিকতে পারব কি না তাও জানি না। তুমিই বা ওখানে যেতে রাজি হবে কি না…এসব চিন্তায় মাথা এলোমেলো হয়েছিল। আজ সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করেছি বদলিটা আটকাবার জন্য। কিন্তু কিছু হয়নি। আমাকে যেতে হবে। আর সেটাও এখুনি। আর চারদিন আছে এই মাসের। পরের মাসের শুরু থেকে ওখানে জয়েন করতে হবে। স্যরি তুবা। ভেরি স্যরি!”
মিফতার কথাগুলো শুনে তুবার মনে হলো সে আঁধার হাতড়ে এক আলোর দিশা দেখতে পাচ্ছে। রাঙামাটি চলে গেলে এই বাড়িতে আর থাকতে হবে না, এই শহরেও না। দূরে চলে যাবে সে আর মিফতা। জীবনটা নতুন করে শুরু করবে তারা। যত কষ্টই হোক সেখানে, পুরানো ক্ষতগুলো শুকানোর মতো যথেষ্ট সুযোগ পাওয়া যাবে।
তুবা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন। বলল, “আমরা যাব মিফতা।”
“তুমি…তুমি যাবে?” মিফতা যেন ভাবতেই পারেনি তুবা এক কথাতে রাজি হয়ে যাবে। সে ধরেই নিয়েছিল তুবা চেঁচামেচি করবে, আর শেষ পর্যন্ত রাজি হবে না।
তুবা বলল, “যাব। কবে বের হতে হবে?”
“পরশু রাতে।”
“কাল অফিসে যাবে?”
“নাহ। এখানে আর কাজ নেই৷ একেবারে নতুন শাখায় গিয়ে শুরু করতে হবে।”
“তাহলে আজ আমাদের বাড়িতে এসো। ওখানেও আমার অনেক কিছু আছে। গুছিয়ে নিয়ে আসব। আগামীকাল এই বাড়ির জিনিসপত্র গোছানো যাবে।”
“তুমি কোথায় আছো?”
“বাড়িতেই এসেছিলাম৷ এখন একটা ছোট্ট কাজ বাকি। করেই চলে যাব। তুমি গিয়ে অপেক্ষা করো।”
“আচ্ছা।”
তুবা তারপরেই রওনা দিয়েছে ইফতির অফিসের দিকে। তার সাথে বোঝাপড়াটা হয়ে গিয়ে বেশ শান্তি লাগছে।
বাড়িতে ঢুকতেই তুবার মা চেঁচামেচি শুরু করল, “এত বেপরোয়া মেয়ে জীবনে দেখি নাই..তুই কিছু বলে বাসা থেকে বের হোস নাই, ফোন ধরিস না..বেয়াদব মেয়ে কোথাকার…”
তুবা কোনো কথাই কানে তুলল না। সে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
মিফতা আগেই এসেছে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে সে মোবাইল স্ক্রল করছিল। তুবাকে এভাবে ঢুকতে দেখে সোজা হয়ে বসল।
তুবা হঠাৎ করেই যেন উল্কাপিন্ডের মতো ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। গভীরভাবে চুমু খেল ওর ঠোঁটে। মিফতার মনে হলো বিয়ের পর এই প্রথম তুবা এতটা ভালোবাসা নিয়ে তার কাছে এলো।
সুমাইয়া আমান নিতু