অন্ধ তারার অশ্রুজল পর্ব-১৯+২০

0
708

#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
১৯.

তুবা রাতের খাবারের আয়োজনে নিজেও সাহায্য করল। বাড়িতে সে তেমন কিছু রান্নাবান্না না শিখলেও শাশুড়ীর কাছে অনেক কিছুই শিখেছে। মিফতার পছন্দের একটা আইটেম রান্না করল সে। মাছের ডিম ভুনা৷ তারপর একটু তৈরি হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল তার জন্য। কিন্তু অনেকটা রাত হয়ে গেলেও মিফতার দেখা পাওয়া গেল না। তুবা কয়েকবার ফোন করল, কিন্তু মিফতা ফোন ধরল না৷ রিং বেজেই গেল শুধু। তুবা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। মিফতা বলেছিল আসবে, তার অবশ্যই আসার কথা। সে তো দুইরকম কাজ করার মানুষ হয়। তবে কি বিপদ আপদ হলো?

তুবা এবার শাশুড়ীর নাম্বরে ফোন করল।

“হ্যালো মা।”

“বলো তুবা৷ কী অবস্থা এখন?”

“এইতো ভালো। আপনার ছেলে কি বাড়ি ফিরেছে?”

“হ্যাঁ, সে সন্ধ্যার পরপরই ফিরেছে। খেয়েদেয়ে শুয়েও পড়েছে এতক্ষণে। কেন তোমার সাথে কথা হয়নি?”

তুবার ভীষণ কান্না পেল। তার কাছে আসার কথা বলে বাড়ি চলে গেল? যদি যাওয়ারই হতো তাহলে বলল না কেন আগে? এদিকে কত আয়োজন হয়েছে। তুবাদের বাড়ির কেউ খায়নি এখনো জামাই আসবে বলে। কী আজব একটা কাজ করল ছেলেটা!

তুবা শুকনো গলায় বলল, “ফোন ধরছিল না তাই আপনাকে ফোন করলাম৷ রাখছি মা।”

তুবা ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিল বিছানায়। দরজার বাইরে মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করে ডেকে বলল, “আম্মু…তুমি খেয়ে নাও। আমি খাব না। মিফতাও আসবে না।”

দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল সে। চোখের পানি বাঁধ মানতে চাইছে না৷ কেন সে এলো না? কিছুক্ষণ কাঁদার পর হঠাৎ তুবার মনে হলো বিয়ের পর এই প্রথবার সে তার স্বামীর জন্য কাঁদছে। তার জন্য কষ্ট পাচ্ছে!
___________________________

ইফতি আর প্রিয়তী বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যার একটু আগে। ওবাড়ির সাথে সম্পর্ক মোটামুটি একটা ভালো পর্যায়ে চলে এসেছে৷ এজন্য প্রিয়তী ইফতির কাছে মন থেকে কৃতজ্ঞ। সে নিজে গেলে হয়তো কিছুতেই বাবা মানতেন না। মেনেছেন ইফতির সুন্দর ব্যবহারে। ভালো ব্যবহার দিয়ে কী না জয় করা যায়!

বাড়ি ফিরে খুশি মনে সে চা বানিয়েছে। রাতের জন্য টুকটাক রান্না করেছে। শাশুড়ী মায়ের কাছে বসে গল্পও করেছে পুরো দিনের।

সন্ধ্যার পরপর কলিংবেল বাজলে প্রিয়তী দরজা খুলে দেখে মিফতা দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ ম্লান।

প্রিয়তী জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

মিফতা জবাব দিল, “মাথাটা ব্যথা।”

মিফতা ঘরে গিয়ে যে গোসলে ঢুকেছে সেই শব্দ পেল প্রিয়তী৷ সে দেরি না করে তাড়াতাড়ি খাবারের ব্যবস্থা করে ফেলল। মিফতা বের হলেই তাকে ডেকে এনে খাবার পরিবেশন করে দিল।

প্রিয়তীর কেন যেন মনে হলো শুধু মাথাব্যথা নয়, কী যেন এক চিন্তায় মিফতা অস্থির হয়ে আছে। প্রিয়তী তাকে কোনো প্রশ্ন করল না৷ মিফতাও কোনো কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নিল। প্রিয়তীর মনে হলো কী খাচ্ছে ছেলেটা দেখছেও না।

কদিনেই হাসিখুশি ছেলেটার প্রতি মায়া জন্মে গেছে প্রিয়তীর। তার নিজের ছোটো ভাই নেই। এই ছেলেটাকে একদম আপন ছোটো ভাইয়ের মতোই কাছের করে নিতে মন চাইছে। ইচ্ছে করছে মাথায় হাত দিয়ে প্রশ্ন করতে, কী হয়েছে?

কিন্তু শেষ পর্যন্ত করা হলো না ওই একটা কারনেই। ছেলেটা তুবার বর। তুবা নিশ্চয়ই মিফতার সাথে তার বেশি কথা বলা পছন্দ করবে না!
________________________________

সারারাত তুবার ঠিকঠাক ঘুম হলো না। এপাশ ওপাশ করল আর মোবাইলের নোটিফিকেশন চেক করতে লাগল বারবার। আশা একটাই, মিফতা ফোন করবে। কিন্তু ফোনটা আর এলো না। কখন সে ঘুমিয়ে পড়ল নিজেও জানে না।

ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে গেল রিংটোনের শব্দে। চোখ খুলে মোবাইলের স্ক্রিনে মিফতার নাম্বারটা দেখে উঠে বসল সে। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল কেন যেন৷ ততক্ষণে ফোন কেটে গেল। তুবা তখনো ভাবছে, সে কি মিফতাকে খুব ঝাড়বে? নাকি অভিমান করে কথা না বলে থাকবে? তারপর মনে হলো অভিমান করেই তো আছে সে।

আবার ফোন এলো। ধরল এবার তুবা।

“জি বলুন। এত সকাল সকাল কী মনে করে?”

“আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি তুবা! একদম ভুলে গিয়েছিলাম তোমাদের বাসায় যাবার কথা।”

তুবা আকাশ থেকে পড়ল। “ভুলে গিয়েছিলাম মানে? এটা ভোলার মতো জিনিস?”

“স্যরি!”

“আগে বলো ভুলেছ কেন?”

“অফিসে এত কাজের চাপ ছিল যে মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। আর ওদিকে যাওয়া হয় না তো, অভ্যাসমতো বাড়ির দিকের বাসে চড়ে বসেছি। একদম খেয়াল ছিল না তুবা। সত্যি বলছি!”

মিফতার গলা শুকনো, যেন সে জোর করে স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে। তুবা এবার মান অভিমান ঝেড়ে ফেলে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “কী হয়েছে বলো তো?”

“কিছু না।”

“আরে বলো না।”

মিফতা বলতে যাচ্ছিল, সে সময়ে কলটা কেটে গেল। মিফতা মোবাইল কান থেকে সরিয়ে দেখল সুইচড অফ! সে গতকাল ফোন পকেট থেকে বেরই করেনি। তুবা অনেকবার ফোন করায় চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে যখন সকালে মোবাইলটা হ্যাঙারে ঝোলানো প্যান্টের পকেট থেকে বের করেছে তখন তার চার্জ ছিল পাঁচ পার্সেন্ট।

মিফতা মোবাইলটা চার্জ দিতে গিয়ে দেখল কারেন্ট চলে গেছে এর মধ্যেই। এই এক শুরু হয়েছে! সকাল সকাল এলাকায় বিদ্যুৎ থাকে না। মাঝেমধ্যে তো পানি শেষ হয় বিদঘুটে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কবে যে এই শহরটা মানুষ হবে!

মিফতা বাথরুমে ঢুকে গেল গজগজ করতে করতে।

এদিকে তুবা ফোন কেটে যাবার পরেও কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করে বুঝতে পারল কানেকশন নেই। মিফতার মোবাইলে কল করে দেখা গেল সেটা বন্ধ। তুবার কিছুই মাথায় ঢুকছে না৷ একদিন সে নেই আর এর মধ্যেই কী হলো? মিফতা তো এমন কখনো করে না!

সে কি তাহলে কোনো বড়সড় স্ট্রেসে আছে? কী হতে পারে সেটা?

হঠাৎ একটা চিন্তা তুবার বুকটা খামচে ধরল যেন! মিফতা কি তাহলে তার আর ইফতির ব্যাপারটা জেনে গেল?
________________________________

প্রিয়তী কয়েকদিন ধরেই ভাবছিল তাদের ঘরটায় কিছু পরিবর্তন করবে। ফার্নিচারগুলো নতুনভাবে সাজাবে যাতে জায়গা আরেকটু বাড়ে আর সুন্দরও দেখায়৷ তাছাড়া ঘরটার আনাচেকানাচে ময়লাও জমে গেছে।

সে ভোরে উঠে শাশুড়ী মায়ের সাথে সকালের রান্নাবান্না করে ফেলল। ইফতি আর মিফতা খেয়েদেয়ে চলে গেলে শাশুড়ী শ্বশুরকে খাবার পরিবেশন করে দিয়ে নিজেরটা খাবারটা ঢেকে রাখল। ভাবল কাজ শেষে গোসল করে খাওয়াদাওয়া করবে। শুধু এক কাপ চা খেয়ে নিল সে।

পরিষ্কার অভিযানে নেমে সে আবিষ্কার করল বিছানার পাশে যে সাইড টেবিল সেটার নিচে একটা ছোটো বাক্স আছে যেটা আসলে একটা কুঠুরি। এমনিতে দেখলে মনে হয় এটা বদ্ধ একটা কাঠের বাক্স, কিন্তু মুছতে গিয়ে প্রিয়তী প্রথমবার ছোট্ট, প্রায় দেখাই যায় না এমন একটা চাবির ফুটো খুঁজে পেল। কী আছে এতে?

প্রিয়তী চাবিটা খুঁজতে নেমে গেল এবার৷ এই ঘরেই কি কোথাও আছে? চারিদিকে তাকিয়ে একটা জায়গায় সে খুঁজে পেল যেখানে চাবি থাকতে পারে।

ইফতির কম্পিউটার টেবিলের ওপর রাখা ছোট্ট একটা ঝুড়িতে তার টুকিটাকি জিনিস থাকে। সেটা উপুড় করে মেঝেতে ঢালল প্রিয়তী। পেনড্রাইভ, স্টেপলার ইত্যাদি টুকিটাকি জিনিসের মাঝে একটা ছোট্ট চাবি খুঁজে পেয়ে গেল সে।

নিজের বুদ্ধিতে নিজেই মুগ্ধ হলো। মনে মনে ভাবল তার আসলে গোয়েন্দা বিভাগে জয়েন করা উচিত!

চাবিটা তালার ছোট্ট ফুটোতে ঢুকিয়ে দিতেই ক্লিক করে দরজাটা খুলে গেল। ভেতর থেকে শা করে উঠে এলো একটা তেলাপোকা। বদ্ধ জায়গায় এটা কেমন করে ঢুকল কে জানে! প্রিয়তী ছোটোখাটো চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে সরে পড়ল। প্রথমটার পিছু পিছু দুটো বাচ্চা তেলাপোকা বেরিয়ে যাবার পর প্রিয়তী খেয়াল করল ভেতরে শুধু লাল রঙের বড় একটা কাপড়ের ব্যাগ।

ব্যাগটা টেনে বের করল সে। ব্যাগের মুখ শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা। সেটা খুলতেই অনেক জিনিস বের হলো, যেগুলো দেখে চোখ কপালে উঠল প্রিয়তীর।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
২০.

ব্যাগের ভেতর থেকে প্রথমেই বের হলো একটা দলা পাকানো পাঞ্জাবি। কোনো একসময় এর নেভি ব্লু রঙ থাকলেও ব্যবহার করতে করতে জ্বলে গেছে। বের হলো একটা ঘড়ি, এটাও অনেকদিন ব্যবহার করা হয়েছে, আপাতত বন্ধ। প্রিয়তীর বিরক্ত লাগল জিনিসগুলো দেখে। ফেলে দেবার জিনিস এভাবে রেখে দেয় কে?

ব্যাগ থেকে এরপর বের হলো বেশ কয়েকটা কার্ড। একটা খুলতেই প্রিয়তী বুঝল কেন জিনিসগুলো রেখে দেয়া হয়েছে৷ এগুলো তুবার দেয়া।

নিজের হাতে বানানো, মোটা কাগজের কার্ড। প্রেমের স্তুতি লেখা তাতে। উপহার দেয়া হয়েছিল ইফতির জন্মদিনে। ওদের চার বছর সম্পর্ক ছিল, কিন্তু কার্ডের সংখ্যা দশ-বারোটা। খুলে দেখল প্রিয়তী। এনিভার্সারি কার্ডও আছে!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়তী ভাবল আর কিছুই সে বের করবে না। করা উচিত নয়। জিনিসটা রেখে দেবে যেখানে ছিল সেখানে। সে বাক্সের ভেতরটা পরিষ্কারে মনোযোগ দিল। কিন্তু বেশিক্ষণ পারল না৷ কৌতুহলী চোখদুটো বারবার চলে যাচ্ছে ব্যাগের দিকে। কী আছে ওতে?

প্রিয়তী এবার হাতের ন্যাকড়াটা ছুঁড়ে ফেলে ব্যাগটা নিয়ে বসল। যে সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে তার ‘প্রাইভেসি’ নিয়ে অত না ভাবলেও চলবে! বেফাঁস কিছু পেয়ে গেলে নাহয় সে পুরো ব্যাপারটা চেপে যাবে। ইফতিকে কিছুই বলবে না।

সে এবার ব্যাগের সব জিনিস উপুড় করে ঢেলে ফেলল মেঝেতে। অনেককিছুই বের হলো, শুধু একটা জিনিস আটকে রইল। অ্যালবাম জাতীয় কিছু। আটকে আছে তলার দিকে। সেটা টেনে বের করে মেঝেতে রেখে বাকি জিনিসগুলোর দিকে তাকাল।

পারফিউমের শিশি, চুলের জেল, ওয়ালেট, আংটি, কলম, শোপিস, এমনকি খেয়ে ফেলা চকোলেটের খোসা পর্যন্ত! প্রিয়তীর গা জ্বলতে শুরু করল। কত উপহার দেয়া নেয়া হয়েছে! ইফতিও নিশ্চয়ই অনেক উপহার দিয়েছে ওই মেয়েকে! ছেলেটার দেয়ার হাত আছে। বিয়ের পরদিন তার জন্য অনেকগুলো জিনিস নিয়ে এসেছিল। আর ও তো ছিল প্রিয়তমা প্রেমিকা!

প্রিয়তী যতই ভাবল সে এসব স্বাভাবিকভাবে নেবে, কিন্তু পারল না৷ তাদের প্রেমঘন মুহূর্তের দৃশ্য কল্পনা করে তার চোখ বারবার ভিজে আসতে লাগল। নিজেকে সামলাবার অনেকটা চেষ্টা করেও যখন পারল না তখন বাথরুমে ঢুকে পানির ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে শব্দ করে কেঁদে ফেলল সে। কী প্রয়োজন ছিল এখন এসব ওর হাতে পড়ার? আর ইফতি এসব যত্ন করে রেখে দিয়েছে কেন?

নিজের বিয়ে হয়েছে, সেটা নিয়ে কোনো অনুভূতি তার নাই বা থাকলো, সে যে তার ভাইয়ের বউয়ের স্মৃতি জড়িয়ে বসে আছে সেজন্য লজ্জা করে না? প্রিয়তীর কেমন গা গোলানো একটা ভাব হলো। এই বাড়িতে সে থাকবে কেমন করে? এই ভুলটা সে জেনেশুনে করেছে। মাশুল তো দিতেই হবে!

ইফতিকে গতরাতেও ভীষণ ভালোবেসে জড়িয়ে শুয়েছিল সেকথা ভেবে নিজের ওপরেই রাগ ধরে গেল প্রিয়তীর। ইফতি নিশ্চয়ই তখন তার প্রাক্তন প্রেমিকার স্মৃতিচারণ করছিল! বিছানার পাশেই তো জমা করে রাখা ছিল এসব! সে কি প্রিয়তীর সাথে ভালোবাসাবাসির মুহূর্তগুলোতেও তুবাকে মনে করে! ছি! আর ভাবতে পারল না সে। হেঁচকি উঠে যাচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে। নিজেকে সামলাতে হবে।

প্রিয়তী আরও কিছুক্ষণ চেষ্টা করে কান্না থামাল। এভাবে ভেঙে পড়ার কোনো অর্থ হয় না। তাকে শক্ত হতে হবে।

মুখে অনেকটা পানির ঝপটা দিয়ে বের হলো সে। পুরো ঘর নোংরা ঝুলময়লায় মাখামাখি হয়ে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে নেমে পড়ল প্রিয়তী।

কিন্তু চোখ আটকে গেল আবারও। সেই অ্যালবামটা দেখা হয়নি৷

দেখবে কি দেখবে না ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে গিয়ে হাতে জিনিসটা তুলে ফেলেছে। কৌতুহলের কাছে আবারও নিয়ন্ত্রণ হারাল সে। কভার উল্টে ফেলল।

একটা ডায়েরি। কিন্তু কেনা না, নিজের হাতে বানিয়ে বাঁধানো হয়েছে। প্রথম সাদা পাতায় লেখা, “তোমার জন্য”

পরের কয়েক পাতা খালি৷ এরপর এক জায়গায় লেখা, সম্পর্কের এই চার বছরে তুমি আমার জন্য অনেক কিছু করেছ। অনেক ভালোবেসেছ। আমিই কিছু করতে পারিনি৷ তোমাকে তোমার যোগ্য ভালোবাসা দিতে পারিনি। যেসব ভুল করেছি তার জরিমানা হিসেবে তোমার জন্য নিজের হাতে উপহার তৈরি করছি। আমাদের চতুর্থ অ্যানিভার্সারিতে তুমি এটা গিফট হিসেবে পাচ্ছো। তোমার ভালো লাগবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

আবার কয়েক পাতা পরে-

চোখ বন্ধ করো। পরের পাতায় কী আছে সেটা হাতে ধরে বুঝতে হবে।

প্রিয়তী পাতা ওল্টালো।

আঠা দিয়ে সাঁটা কিছু ছবি। দুজনার৷ পাশাপাশি তোলা। কয়েকটাতে দুজন খুব কাছাকাছি বসে আছে। হাত ধরাধরি করে, কিংবা মেয়েটার কাঁধে হাত রেখে ছেলেটা!

প্রতিটার নিচে ছবি তোলার সময়, ঘটনা, জায়গার নাম ইত্যাদি লেখা।

পরের কয়েক পাতায় শুধুই তুবার ছবি। অজস্র, অসংখ্য!

আবার কয়েকটা ফাঁকা পৃষ্ঠা। এরপর একটা চিঠি।

প্রেয়সী,

নীলচে তারার একটুখানি আলো আমি তোমার জন্য আনতে পারব না ঠিকই, কিন্তু আমার জীবনটা আজ তোমার নামে লিখে দিচ্ছি৷

আমার এই জীবনে সবচেয়ে কাছের মানুষ আমার মা। মায়ের পর তুমিই হলে দ্বিতীয় কাছের মানুষ। মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, বড় করেছেন নিজের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে। তুমিও আমাকে ভালোবেসেছ নিজের সবটুকু দিয়ে। নইলে নিজের জীবন বাজি রেখে আমাকে বাঁচাতে না।

আমাদের সাঁতার না জেনেও নদীতে নামাটা উচিত হয়নি, একথা আমি বলব না৷ এই দুর্ঘটনাটা এটারই প্রমাণ যে তুমি আমাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসো।

এজন্যই আবারও বলছি, আমার জীবন তোমার নামে লিখে দিলাম৷

এখানে আজকের তোলা ছবি জায়গা হবার কথা ছিল। কিন্তু ক্যামেরাটা এখন গভীর নদীর তলদেশে হাবুডুবু খাচ্ছে। নিশ্চয়ই ভাবছে, কেন যে ছেলেটা কচুরিপানার ছবি তুলতে গিয়েছিল! ছাগল কোথাকার! আমাকে তো মারলই, নিজেও মরতে বসেছিল। ওর তো তাও বাঁচাবার মতো কেউ ছিল, যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মাঝ নদীতে। আমার পোড়া কপালে তেমন কেউ নেই।

বহুবার বলেছি, তবুও আজ আবারও বলি, তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি সেই ভেসে যাওয়া কচুরিপানাটাকেও।

ইতি
তোমারই।

প্রিয়তী কাঁপা হাতে পাতা ওল্টাল। আর কিছু নেই। সাদা পাতা বের হলো সব। একদম শেষ পাতায় কিছু লেখা চোখে পড়ল।

“আজ তোমার আমার সম্পর্ক শেষ হলো। আমার জীবনে যে তোমার চেয়েও জরুরি তারই জয় হলো, আমি হেরে গেলাম মায়ের কাছে। আমার দ্বিতীয় ভালোবাসাও হেরে গেল। আমি মায়ের কাছে খুব দুর্বল তুবা। খুব খুব দুর্বল! আমি ভালোবাসা শব্দটার কাছেই দুর্বল। আমাকে তুমি মেরে ফেলতে পারো। খুশি হয়ে মরে যাব।”

পৃষ্ঠার একেবারে নিচে লেখা-

এই ভালোবাসার কাহিনী যেহেতু এখানেই শেষ, তাই তোমার উপহার দেয়া কলমটারও লেখার কিছু বাকি নেই।

এরপর ছড়িয়ে পড়া গাঢ় কালি দেখে বোঝা গেল কলমটার মাথা ভেঙে ফেলা হয়েছে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে