#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
১৭.
পরদিন ইফতি সত্যিই অফিসে গেল না। সকালে উঠতেও খানিকটা দেরি হয়ে গেল ইফতি আর প্রিয়তীর। ওরা উঠে দেখল মিফতা আর তুবা চলে গেছে৷ তুবা কয়েকদিন বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকবে শুনে নিজের অজান্তেই প্রিয়তী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সে তুবাকে অপছন্দ করে না, তবে সম্পর্ক এমন যে বিতৃষ্ণা চলে আসে। তাছাড়া তুবা তার সাথে ভালো ব্যবহারও করে না।
সকালে খেয়েদেয়ে ওরা রওনা হলো প্রিয়তীদের বাড়িতে। ইফতি ভেবেছিল ওর অফিস কামাই করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা মা পছন্দ করবেন না। কিন্তু হলো উল্টোটা। মা বললেন, “আরও আগেই যাওয়া উচিত ছিল। তাও ভালো এখন সুমতি হয়েছে।”
বাসে যেতে যেতে ইফতির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে প্রিয়তীকে বলল, “তোমাদের বাড়িটা দূর থেকে দেখিয়ে দেবে। আমি একাই যাব।”
“কেন?”
“বলেছি তাই৷ তুমিও যাবে, তবে পরে।”
“তুমি গিয়ে কী করবে? চেনো কিছু?”
“চিনে নেব। ভরসা রাখো আমার ওপর। ভেবেচিন্তেই করব যা করার।”
প্রিয়তী কিছুই বুঝল না। খানিকটা বিরক্ত হলো।
প্রিয়তীদের বাড়ির গলির সামনে গিয়ে সে বাড়ি দেখাল। “ওইযে নীল গেট।”
“এটা কি তোমাদের নিজেদের বাড়ি?”
“না, ভাড়া। তবে আমরা অনেক বছর ধরে আছি। আর কোনো ভাড়াটে নেই।”
“তাহলে তো বাড়িতে শুধু তোমার মা আর বাবা?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা। তুমি আসবে না, থাকো এখানেই। আমি সময় হলেই ডাকব।”
ইফতি আস্তেধীরে হেঁটে গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়াল। কলিংবেল নেই। দরজার কড়া নাড়ল।
বেশ কয়েকবার কড়া নাড়ার পর দরজা খুলে গেল। দরজা খুলে দিয়েছেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। চোখে চশমা, চেহারাটা লম্বাটে। একরকম না হলেও প্রিয়তীর মুখের সাথে অনেকটা মিল আছে। তারই যে মেয়ে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
ইফতি বলল, “আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। আমি ইফতেখার আমিন। একটা কাজে এসেছিলাম। ভেতরে গিয়ে বসা যাবে?”
ভদ্রলোক সরে দাঁড়িয়ে বললেন, “এসো।”
ইফতি ঢোকার পর পেছনে দরজাটা করে দিলেন প্রিয়তীর বাবা। ওকে বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। গেট থেকে একচিলতে উঠোন পেরিয়ে ঘর। ছাদ টিনের। দেয়ালে নোনা ধরা। কয়েকটা বেতের সোফা সাজানো বসার ঘরে। তারই একটাতে বসল ইফতি৷ ঠান্ডা সিমেন্টের মেঝেতে পা রাখায় বেশ শীতল লাগছে পুরো শরীরই। প্রিয়তীর বাবা ইফতির মুখোমুখি বসে বসললেন, “কী বলতে চাইছিলে বলো।”
ইফতি গলা খাঁকারি দিল কয়েকবার। যেন গলায় কোনো সমস্যা হয়েছে এমন ভাব করে বলল, “একটু পানি পাওয়া যাবে? মানে যদি আপনার অসুবিধা না হয়। আপনার কষ্ট করতে হবে না। বাড়িতে আর কেউ থাকলে তাহলেই খাব।”
ইফতির ব্যবহার অতিশয় ভদ্র বলেই হয়তো প্রিয়তীর বাবা তাকে পাত্তা দিচ্ছেন। নইলে লোকটা যে কঠোর প্রকৃতির তা চোখ দেখেই বলে দেয়া যায়।
তিনি হাঁক ছাড়লেন, “প্রিয়র মা…মেহমান আসছে, এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও।”
কিছুক্ষণ পর পানি নিয়ে যিনি ঢুকলেন তিনি প্রিয়তীর মা-ই! ওনার চেহারার মাধুর্য পুরোটাই প্রিয়তীর আছে। ইফতির তাকে খুব আপন মনে হলো। সালাম দিয়ে সে বলল, “আন্টি, কষ্ট করলেন৷ একটু বসুন। একটা গল্প শোনাব। আপনি থাকলে ভালো হয়।”
প্রিয়তীর মা একটু অবাক হয়ে স্বামীর দিকে চাইলেন। ভদ্রলোকের আগ্রহ এখন তুঙ্গে। তিনি স্ত্রীকে বসতে ইশারা করে ইফতির দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললেন, “আর দেরি না করে বলে ফেলো তো কী বলতে চাও?”
ইফতির এবার সত্যিই গলা শুকিয়ে এসেছে। সে ঢকঢক করে পানিটুকু গিলে নিয়ে বলল, “বলছি।”
______________________________
তুবা বিয়ের পর বাবার বাড়িতে সেভাবে থাকার জন্য আসেনি। এলেও ওই দুই একদিন মিফতাও তার সাথে ছিল। আজ একেবারে আগের মতো বাড়িতে এসে জাঁকিয়ে বসে গেছে। ওর অসুখও যেন এক ঝটকায় সেরে উঠেছে অনেকটা। চিন্তাভাবনা পরিষ্কার হয়েছে। ওই বাড়ির আবহাওয়াটাই দূষিত হয়ে গিয়েছিল ওদের জটিল সম্পর্কের টানাপোড়েনে। এখন কত মুক্ত লাগছে তা তুবা কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না।
সে আসা ইস্তক মায়ের সাথে ওর বিছানায় বসে গল্প করছে। এবার উঠে গিয়ে রান্নাঘরে বসল। মা চা বানাচ্ছেন। তুবা মায়ের নতুন বানানো আচারগুলো একটা একটা করে চেখে দেখছে। একফালি রোদ এসে পড়েছে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে।
মা চা বানাচ্ছেন তুবার জন্যই। তিনি নিজে চা খান না। তার মাথায় ঘুরছে রান্নার চিন্তা। কতদিন পর মেয়ে এলো! মেয়ের পছন্দের সব আইটেম করবেন আজ। এমনিতেই গল্প করতে গিয়ে দেরি হয়েছে অনেকটা।
তুবা আচার খেতে খেতে কিছু একটা বলছিল। ওর কথার চেয়ে মায়ের কাজে মনোযোগ বেশি বলে আর কথা বাড়াল না। নিজের চা নিয়ে চলে গেল নিজের ঘরের বারান্দায়। গ্রীল বেয়ে উঠে যাওয়া মানিপ্ল্যান্টের দিকে তাকিয়ে ওর প্রথমেই মনে পড়ে গেল মিফতার কথা। মিফতার সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল এই বারান্দাতেই।
মিফতা এই বাড়িতে প্রথম যেদিন এসেছিল সেদিন ছেলেটা জানতোও না অদৃষ্টের কোন জালে জড়িয়ে পড়ছে। সে তো এটাও জানত না সে আসলে এখানে কেন এসেছে।
সেবার ইফতি আর তুবার ভয়ানক ঝগড়া হয়েছিল। মুখ দেখাদেখিও বন্ধ৷ তুবা ভেবেছিল এবার বিচ্ছেদ হয়েই যাবে, আর কোনো আশা নেই। প্রায় এক মাস কথা বলেনি দু’জন। তুবার রাগ না কমলেও ইফতি তাকে মিস করতে শুরু করেছিল৷ তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল অনবরত। কিন্তু তুবা পাত্তা দেয়নি।
বেশ কয়েকদিন পর ইফতি আর থাকতে না পেরে একদিন তুবার জন্য চমৎকার একটা শাড়ি কিনে ফেলল। কিন্তু সেটা তাকে কিভাবে দেবে এটা একটা সমস্যা। তুবা বাসা থেকে বের হয় না। নিজে গিয়ে দিয়ে আসাও যায় না। তাই সে একদিন প্ল্যান করে মিফতাকে দিয়ে শাড়িটা পাঠাল।
মিফতা তুবাদের আত্মীয় হলেও কখনো তেমন দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। সে সময় ইফতিদের মা বাড়িতে ছিলেন না৷ ইফতি শাড়িটা মিফতাকে দিয়ে বলেছিল মা তুবাদের বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য বলেছেন৷ মিফতাও সরল বিশ্বাসে চলে গেছে। তুবার মায়ের সাথে তার মায়ের ফোনে যোগাযোগ খুব কম হতো বলে শাড়ির ব্যাপারটা পরে ফাঁস হয়ে যায়নি।
মিফতা বাড়ি চিনত না। ইফতি সাথে এসেছিল। কিন্তু কী এক অযুহাত দিয়ে ঢোকেনি। সে ভয় পেয়েছিল, তুবা তাকে দেখে সিন ক্রিয়েট না করে ফেলে! মিফতা শাড়ি নিয়ে একা এসেছিল। তুবা তখন গোসলে।
তার মায়ের সাথে সেদিন অনেক গল্প হয়েছিল মিফতার। মা নাস্তা আনতে রান্নাঘরে গেলে মিফতা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল বারান্দায়। তুবা কাপড় মেলতে গিয়েছিল৷ প্রথম দেখা হয়েছিল তাদের।
মিফতা হা করে তাকিয়েছিল তার দিকে। তুবা লজ্জা পেয়েছিল ভীষণ! সে প্রথমটায় মিফতাকে চিনতেই পারেনি৷ পরে যখন চিনেছিল তখন লজ্জা কাটিয়ে গল্প করেছিল। যদিও সে নিজের হবু দেবর হিসেবেই মিফতাকে ভাবছিল, তবে এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে ছেলেটার তাকে একটু বেশিই পছন্দ হয়ে গেছে!
পরে ইফতিকে সে অভিযোগ করে বলেছিলও, “তোমার ছোটো ভাইয়ের ভাবসাব কিন্তু সুবিধার ঠেকছে না।”
ইফতি তখন ব্যাপারটা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল।
মিফতার সাথে তারপর মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যেত তুবার। কখনো ওর ইউনিভার্সিটির বাইরে, কখনো বাড়ির সামনের রাস্তায়। প্রতিবার মিফতা ইতস্তত করে মাথা চুলকে বলত, “আরে! কেমন আছো? আবার দেখা হয়ে গেল! হোয়াট আ কো-ইন্সিডেন্স!”
ভাবতে গিয়ে আপনমনে হেসে ফেলল তুবা। মিফতাকে কথাগুলো মনে করিয়ে দিলে কেমন হয়? সে ফোন হাতে নিয়ে আবার বারান্দায় এলো। চায়ে আয়েশ করে চুমুক দিতে দিতে মেসেজ করল, “হ্যালো জনাব, আপনার আগে হুটহাট আমাদের বাসার সামনে যে কাজ থাকত সেটা কি এখনো থাকে?”
মিফতা কাজ করছিল একমনে। মেসেজের টুং শব্দ কানে গেলেও মেসেজ দেখতে একটু দেরি হয়ে গেল। তুমুল ব্যস্ততায়ও তুবার নাম্বারটা ভাসতে দেখে মেসেজটা ওপেন করে পড়ল সে। সাথে সাথে হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে গেল মুখ। মন ভালো হয়ে গেল তার।
লিখল, “আজ রাতে থাকতেও পারে। ওদিকে গেলে তোমাদের বাড়িতে এক রাত থাকার জায়গা হবে কি? প্রমিজ, কোনো অভদ্রতা করব না।”
তুবা মেসেজ পড়ে হাসতে লাগল একা একা।
সূর্যটা তখন মাথার ওপর উঠবে উঠবে করছে।
__________________________
ইফতি বলল, “আমি এক রাতে একটা কাজে শহর ছাড়িয়ে একটু বাইরে চলে গিয়েছিলাম। আপনারা হয়তো জানেন, আত্ম*হত্যার ব্রিজ নামে খ্যাত একটা ব্রিজ আছে সঙ্গিনী নদীর ওপর। সেটার ওপর এক মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দেখে মনে হলো মেয়েটা ঝাঁপ দিতেই যাচ্ছে।”
ইফতি ঢোক গিলল। সত্য মিথ্যা মিলিয়ে বলছে সে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এমনিতে টুকটাক মিথ্যে সে বলে, তবে প্রিয়তীর বাবার স্ক্যান মেশিনের মতো চোখের সামনে কাজটা কঠিনই বটে।
প্রিয়তীর মা দয়া করে আরেক গ্লাস পানি এনে দিলেন।
ইফতি পানি খেয়ে আবার বলতে শুরু করল, “ঝাঁপ দেবার আগের মুহূর্তে আমি তাকে ধরে ফেললাম। মেয়েটা নিজেকে ছাড়িয়ে ঝাঁপ দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। আমি সেটা ঘটতে দেইনি। ওকে জোর করে আটকে রেখেছিলাম৷ নইলে তখনই পড়ে মারা যেন মেয়েটা। পূর্ণিমা ছিল সেদিন। নদীতে জোয়ার এসেছিল। প্রবল স্রোতে ভেসে যেত সাথে সাথে।”
কথাটা বলে আরেকবার ঢোক গিলল ইফতি৷ পূর্ণিমার ব্যাপারটা বানানো। নিশ্চয়ই এরা ধরতে পারবে না।
“মেয়েটা আমাকে জানাল, তাকে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছিল। সে বিয়ে করতে চায়নি বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু যাবার জায়গা নেই। তাই মরতে যাচ্ছিল।”
এই পর্যন্ত বলে প্রিয়তীর মায়ের দিকে চোখ পড়তেই সে দেখল ওনার চোখে পানি। তবে ওর বাবার চোখ এখনো শুকনো খটখটে।
ইফতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তারপর আমার খুব মায়া হলো। জানি, এই অবস্থায় মেয়েটা বাড়িতে ফিরতে পারবে না। ফিরলে বাবা মা তাকে বাড়িতে রাখবেন কি না সেটাও নিশ্চিত না। সমাজ তাকে ধিক্কার জানাবে। মেয়েটা হয়তো আবার মরতে যাবে আর সফলও হবে কিংবা এমন কোথাও তার জায়গা হবে যেটা আমরা ভদ্রসমাজ কল্পনাই করতে পারি না। তাই আমি মেয়েটাকে বিয়ে করলাম।”
ইফতি একটু বিরতি দিয়ে আবার বলল, “কিন্তু মেয়েটার বাবা মা ভাবে, মেয়েটা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে তাদের মুখে চুনকালি দিয়েছে। অথচ সে শুধুই চেয়েছিল জোর করে দেয়া বিয়েটা না করতে। এই অপরাধে তার কি মৃত্যু পাওনা হয়েছিল?”
প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে এবার সোজা হয়ে বসল ইফতি৷ তার মনে হলো প্রিয়তীর বাবা কিছুটা ভেঙেছেন। তার দ্বিধান্বিত দৃষ্টি এখন ইফতির দিক থেকে সরে মেঝের দিকে নিবদ্ধ হয়েছে।
(চলবে)
#সুমাইয়া_আমান_নিতু
#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
১৮.
প্রিয়তীর বাবা ইফতির দিকে তাকিয়ে মৃদু বাঁকা হেসে বললেন, “তুমিই তাহলে প্রিয়র বর?”
ইফতি মাথা নেড়ে বলল, “জি।”
প্রিয়তীর মা কান্নাজড়ানো গলায় বললেন, “সত্যি? তুমি…তুমিই? আমার মেয়ে কেমন আছে?” বলতে বলতে তিনি ইফতির পাশে এসে বসলেন৷ তার হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে বললেন, “বাবা, কেমন আছে আমার মেয়ে?”
ইফতি বলল, “এমনিতে ভালোই আছে। তবে আপনাদের সাথে কথা ভাবলেই কাঁদে।”
“সে এখন কোথায়? তোমাদের বাড়ি কোথায়?”
“কাছেই। প্রিয়তী বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আপনারা চাইলে তার সাথে দেখা হতে পারে। কিন্তু আপনারা দেখা করবেন কি না এটাই প্রশ্ন।”
মহিলা এবার থমকে গিয়ে নিজের স্বামীর দিকে করুণ দৃষ্টিতে চাইলেন। ইফতি বুঝতে পারল লোকটা এতটাই ডমিনেটিং যে তার স্ত্রী নিজের মেয়ের সাথে কথা বলতেও ভয় পায়। তার সম্মতি প্রত্যাশা করে।
ইফতির মনটা কিছুটা তিক্ত হয়ে উঠল। এই মধ্যবিত্ত বাড়ির কর্তারা একেকজন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়ে থাকতে চায়, অন্যদের মতামতের বিন্দুমাত্রও মূল্য দেয় না। নিজেরা যা বোঝে তাই করবে। এদের কিছু হঠকারী সিদ্ধান্তের মূল্য দিতে নষ্ট হয় পরিবারের মানুষগুলোর জীবন। প্রিয়তীর মা না জানি মেয়েকে হারিয়ে কত কষ্টে আছেন!
প্রিয়তীর বাবা বললেন, “এইযে শোনো, ওর এই বাড়িতে আসা বন্ধ৷ এখানে ওই মেয়ের কোনো জায়গা হবে না।”
ইফতি এবার একটু রুক্ষ স্বরে বলল, “হ্যাঁ সেটা তো আপনি বলেই দিয়েছেন। আপনার বাড়ি, আপনার সিদ্ধান্তই সই।”
এবার সে প্রিয়তীর মায়ের দিকে ঘুরে বলল, “মা, আপনি বাইরে চলুন। আপনার মেয়ে বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। আপনার জন্য সে প্রতিদিন কাঁদে। একবার তাকে জড়িয়ে ধরে একটু সান্ত্বনা দেবেন।”
মা কেঁদে ফেললেন।
বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, “না, ও কোথাও যাবে না। তুমি যে এত বড় বড় কথা বলছ, তুমি কি জানো আমাকে কতটা অসম্মানের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে? কত লোকে কত কথা শুনিয়েছে? আমার মুখে যে চুনকালি মাখিয়ে দিয়ে গেছে তার সাথে গেটের বাইরে কোলাকুলি করে আর আদিখ্যেতা দেখিয়ে নতুন করে লোকের মুখ খোলানোর কোনো দরকার নেই। তুমি আসতে পারো।”
“আপনি দেখা না করতে চাইলেও মা দেখা করতে চান।”
“ও চাইলেই হলো? যে একটামাত্র মেয়ে মানুষ করতে পারেনি তার আবার এত শখ আহ্লাদ কিসের?”
“কেন মেয়েটা আপনার ছিল না?”
“না, আমার মেয়ে মরে গেছে।”
ইফতি হতাশ হয়ে বসে রইল। কী চেয়েছিল আর কী হচ্ছে!
ইফতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “প্রিয়তী কত কষ্ট পাবে সেটা ভেবেই খারাপ লাগছে। তাকে বলে এসেছিলাম মা বাবার সাথে দেখা করিয়ে দেব। কিন্তু…যাহোক, আসি।”
ইফতি উঠতে চাইলেও পারল না। প্রিয়তীর মা ওর হাত ধরে ব্যকূল হয়ে কাঁদছেন। ইফতির মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
প্রিয়তীর বাবা বোধহয় চুপচাপ বসে এতক্ষণের কথোপকথন মনে মনে বিশ্লেষণ করছিলেন৷ বললেন, “তুমি যে গল্পটা শুনিয়েছ সেটা সত্যি?”
“জি। একশো ভাগ।”
“তোমার সাথে তার আগে থেকে পরিচয় ছিল না?”
“না।”
“বিয়েটা ঠিক কেন করেছ?”
“আগেও বলেছি।”
বাবা কী যেন ভেবে শেষ পর্যন্ত বললেন, “ঠিক আছে, যাও নিয়ে এসো তাকে। দেখি তার কী বক্তব্য।”
__________________________________
মিফতা আর তুবার সম্পর্কটা স্বামী স্ত্রীর মতোই। কখনো প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে যেরকম আবেগের বাড়াবাড়ি থাকে সেরকম ছিল না। মিফতার পক্ষ থেকে কোনো কমতি ছিল না, তবে তুবা কখনো এসব আবেগী কথাবার্তা, দুষ্টুমি, প্রেম ইত্যাদিতে আগ্রহী ছিল না। তার সব রকম সকম সোজাসাপটা। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক যেন শুধুই কিছু দায়িত্ব, কর্তব্য আর ঘনিষ্ঠ মেলামেশার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
মিফতা বুঝত, তুবা আগের সম্পর্কের রেশ থেকে বের হতে পারেনি। সেজন্য সে কখনো জোরও খাটায়নি এসব বায়বীয় আবেগ প্রকাশের জন্য।
তবে আজ তুবার কথাবার্তায় যেন একটা ইঙ্গিত পাওয়া গেল। একটু যেন দুষ্টুমি, একটু যেন মিঠে প্রেমের আভাস! আহা! সত্যিই যদি তুবাটা বদলে যেত! সে দেখিয়ে দিত রোমান্টিক প্রেমিক বর কেমন হতে পারে! কতটা ভালোবাসতে পারে!
যে কোনোকিছু না পেয়ে অভ্যস্ত, তার একটুতেই মন ভরে যায়। মিফতারও তাই মন ভরে গেল। সে ঠিক করে নিয়েছে, আজ অফিস থেকে আর বাড়ি ফিরবে না, তুবাদের বাড়িতে যাবে। একটা সুন্দর রাত অপেক্ষা করছে তার জন্য।
সে অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল অফিসের সময় শেষ হবার। এর মধ্যে একটা অপ্রত্যাশিত কান্ড ঘটল।
দুপুরের দিকে তার কাছে একটা লেটার এলো। চিঠির শব্দগুলো পড়ে হতভম্ব হয়ে বসে রইল মিফতা৷ এরকম হতে পারে তা সে কোনোভাবেই আশা করেনি। নিজের কপালে হাত দিয়ে বসে পড়ল সে।
________________________________
প্রিয়তীকে যখন ইফতি বলল তার বাবা তাকে ভেতরে যেতে বলেছে, প্রিয়তীর চোখ খুশিতে ঝিলমিল করে উঠল। যদিও সেই চোখে উপচে পড়ছে জল।
সে ইফতির হাত ধরে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল। মাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। মা মেয়ের মিলন দৃশ্য হলো দেখবার মতো।
ইফতির মনে হলো ওরা দুজন জোড়া লেগে গেছে। আর ছাড়াছাড়ি হবে না।
কিন্তু আবেগে পানি ঢালার মানুষ উপস্থিতই ছিলেন। তার গম্ভীর গলা ভেসে এলো, “আহ্লাদী শেষ হলে আমরা একটু বসে কথা বলি?”
প্রিয়তী মাকে ছেড়ে দিয়ে ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকাল।
ইফতি খেয়াল করল প্রিয়তীকে খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে। বিয়ের আগে ওর চেহারায় একটা ছন্নছাড়া ভাব ছিল, সেটা নেই। সুন্দর লাগছে মুখটা। পরনের শাড়ি, ওর কান্নারত লাল মুখ, খানিকটা এলোমেলো চুল, সব মিলিয়ে খুব নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। ইফতির মনে হলো বাবার মন না গলে যায় না।
মন যে কিছুটা গলেছে সেটা পরের কথাতে বোঝা গেল। বাবা বললেন, “ভেতরে এসে বসো।”
তবে সেই স্বভাবজণিত কর্কশতা গলা থেকে গেল না।
প্রিয়তী মায়ের হাত জড়িয়ে রাখল। মায়ের পাশেই গিয়ে বসল। ফিসফিস করে দু’জন কীসব যেন বলছে।
বাবা এবার প্রিয়তীকে জিজ্ঞেস করলেন, “বলো। শুরু থেকে বলবে কী কী হয়েছিল আর কেন কী করেছ।”
প্রিয়তী নাক টানল, চোখ মুছল। সেই কাহিনী বলার কোনো আগ্রহ দেখাল না।
প্রিয়তীর মা তার মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললেন, “কিছু বলতে হবে না। আমার মেয়ে কোনো অন্যায় করে নাই।”
বাবা চুপ করে বসে থেকে শেষে ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ইফতির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, সে কোথায় চাকরি করে, বেতন কত, বাড়ির লোকসংখ্যা কত, গ্রামের বাড়ি কোথায় ইত্যাদি।
একটু পর নিজের স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, “মেয়েকে পেয়ে কি এটাও ভুলে গেছ যে বাড়িতে প্রথমবার জামাই এসেছে? তাকে কিছু খাওয়ানো দরকার?”
প্রিয়তীর মা লজ্জা পেয়ে গেলেন। প্রিয়তীকে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “যাচ্ছি। তুমি একটু ভেতরে আসো, কিছু জিনিস আনতে হবে।”
ইফতি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কী আনতে হবে আমি আনছি। আপনি চলুন আমার সাথে।”
বাবাকে বসিয়ে দিয়ে সে বলল, “আপনি মেয়ের সাথে কথা বলুন।”
ওর গলায় কর্তৃত্ব এমনভাবে ফুটে ছিল যে স্বয়ং প্রিয়তীর বাবাও পাল্টা কিছু বলতে পারলেন না। ইফতি বেরিয়ে গেল মাকে নিয়ে। যেন এটা তারই বাড়ি, সে এই বাড়ির ছেলে।
প্রিয়তী ব্যাপারটা নিয়ে খানিকটা ধন্দে পড়ে গেল। ইফতির ব্যক্তিত্ব এমনিতে দেখবার মতো। তবুও মাঝেমধ্যে তাকে খুব ফিকে মনে হয়। শুধু দুটো মানুষের সামনে সে একেবারেই বেড়াল হয়ে যায়। এক মা, আর দুই তুবা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তাকাল বাবার দিকে। বাবাও তার দিকে তাকিয়ে আছেন। দু’জন কোনো কথা খুঁজে পেল না।
অনেকক্ষণ পর বাবা তাকে শুধু একটা প্রশ্ন করলেন, “সত্যি করে বলো তো, কেমন আছো তুমি?”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু